১৪ নভে, ২০১৫

ভাইফোঁটা


কার্তিকের শুক্লা প্রতিপদ কিম্বা দ্বিতীয়া । নরকাসুর বধ করে কেষ্টাদা সবেমাত্র ফিরেছেন ঘরে। বোন সুভদ্রা দাদার মুড বুঝে নিল চটপট। আগের দিন দেওয়ালির রান্নাঘর থেকে ঘিয়ের গন্ধ তখনো পুরোপুরি যায়নি চলে। রান্নাঘরে গিয়ে দুখানা মুচমুচে নিমকি, গোটাকতক ম্যাওয়া কুচোনো লাড্ডু, সোহন পাপড়ি আর এক ভাঁড় রাবড়ি এনে দাদার মুখের সামনে ধরল। কেষ্টদা তো মহা খুশি। একে মিশন সাকসেসফুল...দুষ্কৃতের বিনাশ করে সাধুদের পরিত্রাণ করতে চলেছেন বলে মহা ফূর্তি মনে আর দুই দেওয়ালির সুহাগ রাতে অগণিত গার্লফ্রেন্ডকে সাথে নিয়ে ছাদে গিয়ে কখন ফষ্টিনষ্টি করবেন সেই অহ্লাদে ভরপুর তাঁর মেজাজ। বিদ্যুতলতারা সকলে শৃঙ্গারে ব্যস্ত তখন। কেউ কেতকী-কুর্চি-কদম্ব প্রলম্বিত জলে স্পা নিচ্ছেন। কেউ আবার কর্পূর-কেওড়া-অগরুর জলে গাত্রমার্জনা করে সুগন্ধা হচ্ছেন। কেউ ধূপের ধুনোয় কেশ শুষ্ক করে ফুলের মালা জড়াতে ব্যস্ত।

কেষ্টদার দুই গৃহিণী সত্যভামা আর রুক্মিনী বৌদির মেজাজ একটু ক্ষেপে আছে আজ। একে বহুদিনের অদর্শণে প্রাণের ভেতরটা আঁকুপাঁকু অন্যথায় আসামাত্র‌ই ননদিনী সুভদ্রা কেষ্টদাকে চিলের মত ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে গেল তাদের কাছ থেকে। তারপর যদিও ননদিনী ছাড়বে তাদের কর্তামশায় তো এবার যাবেন ছাদের ওপর কিম্বা নদীর তীরে। একে কার্তিকের আকাশে রাসপূর্ণিমার হাওয়া ব‌ইল বলে !
সুভদ্রা বলল, দাদা মনে আছে কালকের কথা? এবারে কিন্তু আরো বড় উপহার চাই। ঐ ময়ূরের পালক, কদমফুলের আর্মলেট আর জাঁতিফুলের মুকুটে কিন্তু চলবেনা বলে দিলাম। এবার ডাবল ধামাকা কিন্তু। একে ভাই ফোঁটা তায় নরকাসুর বধ হয়েছে। অতএব ট্রিট চাই বস!
কেষ্টাদা মুখটা বেঁকিয়ে বললেন, তা আমাকেই বা কেন বধ করা বারেবারে? আরো একজন দাদাও তো আছে নাকি। সুভদ্রা বলল, তুমি তো গেছ নরকাসুর নিধন করতে। বলরাম দাদা? তিনি তো দ্রাক্ষারসে অবগাহন করে পড়ে রয়েছেন সেই ধনতেরস থেকে।

কেষ্টাদা প্রমাদ গনলেন। চটপট স্মার্টফোনে দেখে নিলেন ব্যাংকে কিছু পড়ে আছে কিনা। সুভদ্রাকে বললেন, ঠিক হ্যায় তব। মানাও ভাই দুজ, ঘটা করে ভাইফোঁটা হোউক! !!!

রুক্মিনী, সত্যভামা বৌদিদ্বয় শশব্যস্ত হয়ে গাত্রোত্থান করে বাজারের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন।হাজার হৌক রান্নাবাটিতো তাদেরি করতে হবেক। আরতো সকলে সুখের পায়রা! যদি আবার নন্দাই বাবু অর্জুন এসে পড়েন তাহলে আর কথাই নেই! জামাই বলে কথা! বৌদিরা আবার নন্দাইকেও ভাইফোঁটা দেয়।

১২ নভে, ২০১৫

দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজো


কালীপুজোর অমাবস্যার দিনে পশ্চিমবঙ্গীয়দের রীতি  দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজো করার। ব্রতকথা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম অনেক কিছু। লক্ষ্মীপুজো করলেই যে অর্থাগম হবে, ঐশ্বর্য্যপ্রাপ্তি হবে এ বিশ্বাস আমি করিনা তবে সব ধর্মের মূল কথা "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর" এই আপ্তবাক্যটি আমি মানি। আর গল্পটি এযুগেও বেশ যুক্তিসম্মত বলে মনে হল। কারণ আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী। ঈশ্বর, মানুষ, পুজোআর্চা এসবকিছুই  তো মানুষের মনগড়া। এই অনুষঙ্গগুলি জীবনযাপনের উপলক্ষ্যমাত্র। 

দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজো ব্রত কথা
 
এক রাজার পাঁচ মেয়ে ছিল। একদিন সকলকে একত্র করে রাজা তাঁদের জিগেস করলেন, তোমরা কে কার ভাগ্যে খাও? ছোটমেয়েটি অত্যন্ত সপ্রতিভ উত্তর দিল।

সে বলল "মা লক্ষ্মী খাওয়ান আমাদের। মানুষের কি সাধ্য যে সে নিজে খাবে। মানুষতো উপলক্ষ্য মাত্র। আমরা সকলেই নিজের ভাগ্যে খাই বাবা"

কন্যার কথায় রাজা তো অগ্নিশর্মা। সাথেসাথে তিনি জ্বলে উঠে বললেন, "রাজার মেয়ে তাই কিছু বুঝতে পারলিনা। এ জীবনে অর্থ, যশ প্রতিপত্তির জোরেই আমরা সকলে বেঁচে আছি। ঠিক আছে, ভালো কথা। কাল সকালে আমি যার মুখ আগে দেখব তার সাথে তোর বিয়ে দেব। তখন দেখব তুই কি করে আর কার ভাগ্যে খাস"

রাণী সেই কথা শুনতে পেয়ে প্রমাদ গনলেন। রাজপুরীতে সকলকে সাবধান করে দিলেন, কেউ যেন পরদিন রাজবাড়ির মুখো না হয় আর রাজধানীর সব দোকানপাট সব বেশ বেলায় খোলার পরামর্শ দিলেন। যাতে রাজার চোখের সামনে কোনো ব্যক্তি এসে পড়ে। প্রজারা ঢেঁড়া পিটিয়ে সেই খবর চালু করে দিল। সেই কথা জানতে পেরে অন্য একপ্রদেশের গরীব বামুন তার ছেলেকে সঙ্গে করে চুপিচুপি রাজ অন্তঃপুরে এসে লুকিয়ে থাকল সেদিনের মত। পরদিন ঘুম ভাঙতে রাজার চোখে পড়ল সেই গরীব বামুনের ছেলেটি। রাজা তাঁর ছোটমেয়ের বিয়ের আয়োজন করলেন সেই ছেলের সাথে আর বিদায়বেলায় মেয়েকে বললেন, "দেখি এবার কেমন তুই নিজের ভাগ্যে খাস!”

গরীব বামুন রাজকন্যাকে ছেলের বৌ করে, পুত্র আর বৌমাকে সাথে নিজের কুঁড়েতে ফিরে এল। রাজকন্যা স্বামী-শ্বশুরকে বলে রাখল, যখনি তারা বাড়ির বাইরে থেকে ঘরে ফিরবে রাস্তায় যা পাবে তা যেন কুড়িয়ে নিয়ে আসেন, খালি হাতে যেন না ফেরেন। একদিন বামুন ফেরার পথে রাস্তায় একটি মরা কালকেউটে পড়ে থাকতে দেখল। সেটিকে ঘরে এনে রাজকন্যাকে দেখালো। রাজকন্যা বললে ওটিকে ঘরের চালে ফেলে রাখুন, কাজে আসবে। এবার সেদেশের আরেক রাজার ছেলে কঠিন অসুখে পড়েছে। রাজবৈদ্য এসে জানালো কালকেউটের মাথাটা পেলে তিনি রাজপুত্রকে সারিয়ে তুলতে পারেন। রাজা ঢেঁড়া পিটিয়ে খবর করলেন, যে ব্যক্তি তাঁকে মরা কালকেউটের মাথা দিতে পারবে সে যা চাইবে তাই পাবে।

রাজকন্যা সেই কথা শুনে শ্বশুরকে বললে, "ঢ্যাঁড়াদারদের ডেকে আমাদের ঘরের চালে যে মরা কেউটে রাখা আছে তার মাথাটা রাজাকে দিয়ে আসুন তবে তার বিনিময়ে কিছু চাইবেননা"

রাজবৈদ্য সেই মরা কেউটের মাথা থেকে ওষুধ তৈরী করে রাজ্পুত্রকে তা খাওয়াতে সে সুস্থ হয়ে উঠল। রাজা মহা খুশিতে বামুনকে ডেকে পাঠালেন। যাবার আগে রাজকন্যা শ্বশুরকে বলে দিল যে কার্তিকমাসের অমাবস্যা তিথিতে রাজধানীর কোথাও যেন বিন্দুমাত্র আলো না জ্বলে। এইকথাটুকু রাখলেই হবে, বিনিময়ে কিছু চাইনা তাদের। বামুন সেকথা রাজাকে জানালো। রাজা বললেন কার্তিকমাসের অমাবস্যায় রাজধানীতে যেন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার থাকে। যে আলো জ্বালাবে তাকে দন্ড পেতে হবে।

এদিকে রাজকন্যা সেদিন নিজে উপোস করে তার কুঁড়েটি গোবর দিয়ে নিকিয়ে পিটুলিগোলার আলপনা দিয়ে ফুলচন্দন-মালা, ধূপ-ধুনো দিয়ে যতসামান্য আয়োজনে মালক্ষ্মীর জন্য ঘট পেতে তাঁর আগমনের অপেক্ষায় বসে র‌ইল।

ঐদিনে সর্বত্র ঘোর আঁধার আর রাজকন্যার কুঁড়েতে প্রদীপের আলো জ্বলা দেখে মালক্ষ্মী সেখানে অবতরণ করলেন। তুষ্ট হয়ে নিজের পায়ের নূপুরটি রেখে গেলেন কমলাসনে। এরপর যা হয় বামুনের ঐশ্বর্য আর দেখে কে! ধীরে ধীরে তাদের মালক্ষ্মীর কৃপায় অবস্থা ফিরে গেল। একদিন বামুন ঠিক করল বাড়ির পাশে একটি পুকুর কাটাবে। পুকুর প্রতিষ্ঠার দিনে দলেদলে লোক এল। রাজকন্যা জানলা দিয়ে হঠাত দেখতে পেল তার একদা রাজ-চক্রবর্তী বাপকে। তিনি আজ হতদরিদ্র। পুকুর খননের কাজে এসেছেন তাদের গ্রামে। পুকুর খননের কাজ শেষ হলে রাজকন্যা সকলকে খাওয়ালে। দরিদ্র পিতাকে যখন ভাত বেড়ে দিতে যাবে তখন তিনি কেঁদে বললেন, আমার ঠিক তোমার মত একটি মেয়ে ছিল। এদ্দিনে সে কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানিনা আমি। রাজকন্যা বাবার কন্ঠস্বর চিনে ফেলেছে এর মধ্যে। বাবাকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললে, বাবা, তুমি যে আমায় নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছিলে , এই দ্যাখো আমি কেমন এখনো নিজের ভাগ্যেই খেয়ে পরে বেঁচে আছি। সেই পরীক্ষার শেষ হয়েছে বাবা। দরিদ্র বাপ তখন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর কথাই ঠিক মা, আজ আমি নিজের অহঙ্কারে সর্বস্বান্ত। সত্যি‌ই বলেছিলি তুই। মানুষ নিজের ভাগ্যেই খায়।অর্থ-যশ-প্রতিপত্তি থাকলেই হয়না রে। মানুষের ভাগ্য‌ই মানুষকে টেনে নিয়ে যায়। নয়ত আমি আজ ফকির হয়ে গেছি আর তুই আজ রাজরাণী! ঈশ্বরবিধাতাই সব মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেন।

রাজকন্যা বললে, "বাবা এবার থেকে তোমার ঘরে কার্তিকমাসের অমাবস্যার দিনে লক্ষ্মীপুজো করো। আবার তোমার হৃত ঐশ্বর্য্য সব ফেরত পাবে।"

......
শেষলাইনটি কতটা সত্যি জানিনা তবে ভাগ্যে আমিও কিছুটা বিশ্বাসী। আর তোমরা?

৯ নভে, ২০১৫

ধন-তেরস

আকাশে বাতাসে ধ্বনির ত্রাস, পালন করছি ধন-তেরস 
ধন কিনতে পকেট হ্রাস, সোনারূপোয় গিলছি গ্রাস  !   

  • সকল দ্বন্দ বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সেই তো তোমার ভালো....

সারা ভারতবর্ষ জুড়ে চতুর্দশীর আগের দিন অর্থাত ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরস নামে উত্সব পালন হয় । পুরাণের গল্পে আছে সমুদ্রমন্থনের সময়কালীন এক গল্প। ঐশ্বর্যের ভারে অহংকারী দেবরাজ ইন্দ্র সকলকে খুব হেয় করছিলেন। একদিন দুর্বাশা মুনি তাঁর গলার পারিজাতের মালাটি অত্যন্ত স্নেহের সাথে হাতির পিঠে চড়া ইন্দ্রকে গলায় পরিয়ে দিতে যান। মালাটি ইন্দ্রের গলায় না পড়ে হাতির দাঁতের ওপর গিয়ে পড়ে ও হাতি ততক্ষণাত সেই মালাটিকে শুঁড়ে করে মাটিতে ফেলে দেয়। তা দেখে দুর্বাসা অতীব ক্রুদ্ধ হন ও দেবরাজকে "লক্ষ্মী চ্যুত হও" এই বলে অভিশম্পাত করেন। মুনির এই অভিশাপে দেবরাজ ইন্দ্র অসুরদের পরাজয় লাভ করেন ও রাজ্য, সিংহাসন, লোকবল সব হারান। অসুররা তখন স্বর্গের মালিকানা পান ও লক্ষ্মীদেবী সহ সমগ্র দেবতাকুল পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রের অতলে আশ্রয় নিলেন। দেবকুলের এহেন সমূহ বিপদে দেবরাজ ইন্দ্র প্রজাপিতা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। তিনি সব শুনে বললেন একমাত্র বিষ্ণুই পারেন দেবতাদের বিপন্মুক্ত করতে। আর তখনি শুরু হল সেই মহাকার্য যার নাম সমুদ্রমন্থন। সমুদ্রের গভীরে নাকি "অমৃত" নামে এক অমোঘ সঞ্জিবনী সুধা আছে যা পান করলে দেবতারা অমরত্ব লাভ করবেন। বিষ্ণুর আদেশে মন্দার পর্বত হল সমুদ্রমন্থনের দন্ড। আর নাগরাজ বাসুকী হল মন্থনের রজ্জু। মন্দার পর্বতকে বাসুকী তার সমগ্র শরীর দিয়ে বেষ্টন করে র‌ইল আর দেবতারা দুইদিক থেকে তার মুখ ও লেজ ধরে টানতে লাগলেন। শুরু হল ভয়ানক সমুদ্রমন্থন প্রক্রিয়া। ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত নামে হস্তী, চন্দ্র, উচ্চৈঃশ্রবা নামক অশ্ব, বৈচিত্রময় মণিমাণিক্য, পারিজাত নামক স্বর্গের নান্দনিক পুষ্পবৃক্ষ সব উঠে আসতে লাগল একে একে । এরপর অমৃতের ভান্ড হাতে উঠলেন দেবতাদের চিকিত্সক ধ্বন্বন্তরী। আর সবশেষে বাসুকীরাজের সহস্র ফণারূপ ছত্র মাথায় উঠে এলেন মা লক্ষ্মী।

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী কার্তিকমাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীতেই সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিলেন ধ্বন্বন্তরী। তাই এই তিথির নাম হল ধনতেরস। তাই এই দিনটিতে ধনের উপাসনা করতে হয়। আর তার ঠিক পরেপরেই লক্ষ্মীর পুজো করতে হয়। সমুদ্রের ক্ষীরসাগর থেকে উঠে এসেছিলেন মহালক্ষ্মী। সেদিন নাকি ছিল কার্তিক অমাবস্যা। তাই লক্ষ্মীকে বরণ করে স্বর্গে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুষ্ঠানটিতে আলোকমালায় সুসজ্জিত করা হয়েছিল স্বর্গকে।

  • ডুব দে রে মন কালী বলে, হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে...

দীপাণ্বিতাই বল কিম্বা দীপাবলী অথবা ধনতেরসে লক্ষ্মী-গণেশের পুজো...উদ্দেশ্য একটাই ধনাগম ও শ্রীবৃদ্ধি। তবে কোথাও যেন কালীর সাথে সবকিছু একাত্ম হয়ে যায়। বাজি পোড়ানো, আলোর উত্সব, মিষ্টিমুখ, উপহারের আদানপ্রদান সবকিছুই যেন সেই সনাতন ধর্মের সৌহার্দের বার্তা বহন করে আনে।  কালী করেন অশুভ শক্তির বিনাশ আর লক্ষ্মী ঘটান শ্রীবৃদ্ধি। দেওয়ালী হল মিলনোত্সব, দীপাণ্বিতা সেই উত্সবে আলোর রোশনাই। 

২১ অক্টো, ২০১৫

সন্ধিপূজা? তার আবার বিশেষত্ব কি ?


রামায়ণে আছেঃ 

শুক্লাসপ্তমী থেকে মহানবমী অবধি বিশেষ পুজো চলতে লাগল । সপ্তমীর দিন দেবী স্বয়ং রামের ধনুঃশ্বরে প্রবেশ করলেন । অষ্টমীতে রামের বাণে আশ্রয় নিলেন । অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে দশানন রাবণের মস্তক পুনঃ পুনঃ ছেদন করলেন রামচন্দ্র ।
দেবী দুর্গা নাকি এই দুইতিথির মিলনক্ষণেই আবির্ভূতা হন দেবী চামুন্ডারূপে । চন্ড এবং মুন্ড এই দুই উগ্রমূর্ত্তি ভয়ানক অসুরকে বধ করেছিলেন এই সন্ধিক্ষণে । আশ্বিনমাসে রামচন্দ্রের অকালবোধন এবং অপ্রতিরোধ্য রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করার জন্য যে দুর্গাপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসের রামায়ণে সেখানেও দেখি রামচন্দ্র সন্ধিপূজা সমাপন কালে দেবীর চরণে একশো আট পদ্ম নিবেদন করার আশায় হনুমানকে দেবীদহ থেকে একশো আটটি পদ্মফুল তুলে আনতে বলেন । হনুমান একশোসাতটি পদ্ম পেলেন । দেবীদহে আর পদ্ম ছিলনা । এবার প্রশ্ন কেন দেবীদহে একটি পদ্ম কম ছিল । তার কারণ স্বরূপ কথিত আছে , দীর্ঘদিন অসুর নিধন যজ্ঞে মাদুর্গার ক্ষত বিক্ষত দেহের অসহ্য জ্বালা দেখে মহাদেব কাতর হলেন । মায়ের সারা শরীরে একশো আটটি স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল । মহাদেব তাঁকে দেবীদহে স্নান করতে বললেন সেই জ্বালা জুড়ানোর জন্য । দেবীদহে মায়ের অবতরণে একশো সাতটি ক্ষত থেকে সৃষ্টি হয়েছিল একশো সাতটি পদ্মের । মহাদেব দুর্গার এই জ্বালা সহ্য করতে না পারায় তাঁর চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু নিক্ষিপ্ত হল মায়ের একশো আটতম ক্ষতের ওপর । দেবীদহে স্নানকালে সেই অশ্রুসিক্ত ক্ষতটির থেকে যে পদ্মটি জন্ম নিয়েছিল সেটি মা নিজে হরণ করেছিলেন । কারণ স্বামীর অশ্রুসিক্ত পদ্মফুলটি কেমন করে তিনি চরণে নেবেন । আবার কৃত্তিবাসের রামায়নে পাই রাবণ নিধন যজ্ঞের প্রাক্কালে রামচন্দ্র বলছেন

” যুগল নয়ন মোর ফুল্ল নীলোত্পল
সংকল্প করিব পূর্ণ বুঝিয়ে সকল ।।

রাম ধনুর্বাণ নিয়ে যখন নিজের নীলোত্পল সদৃশ একটি চক্ষু উত্পাটন করতে উদ্যত তখন দেবী রামচন্দ্রের হাত ধরে তাঁকে নিবৃত্ত করে বলেন

“অকালবোধনে পূজা কৈলে তুমি, দশভুজা বিধিমতে করিলা বিন্যাস।
লোকে জানাবার জন্য আমারে করিতে ধন্য অবনীতে করিলে প্রকাশ ।।
রাবণে ছাড়িনু আমি, বিনাশ করহ তুমি এত বলি হৈলা অন্তর্ধান ”

দুর্গাপুজোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণ হল এই সন্ধিপুজো। অষ্টমীতিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমীতিথির শুরুর ২৪ মিনিট....এই মোট ৪৮ মিনিটের মধ্যেই  অনুষ্ঠিত হয়। মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধের সময় দেবী দুর্গার পিছন দিক থেকে আক্রমণ করেছিল দুই ভয়ানক অসুর চন্ড ও মুন্ড। দেবী তখন এক অদ্ভূত রূপ ধারণ করেন। কেশরাজিকে মাথার ওপরে সু-উচ্চ কবরীতে বেঁধে নিয়ে, কপালে প্রজ্জ্বলিত অর্ধচন্দ্রাকৃতি টিপ ও তিলক এঁকে, গলায় বিশাল মালা ধারণ করে, কানে সোনার কুন্ডল ও হলুদরঙা শাড়িতে নিজেকে সজ্জিত করেন। তাঁর রক্তচক্ষু, লাল জিহ্বা, নীলাভ মুখমন্ডল  এবং ত্রিনয়ন থেকে অগ্নি বর্ষণ করতে থাকেন। ঢাল ও খড়্গ নিয়ে চন্ড ও মুন্ডকে বধ করেছিলেন দেবী এই সন্ধিপুজোর মাহেন্দ্রক্ষণে।  

সন্ধিপূজার এই মাহেন্দ্রক্ষণে কেউ বলি দেন । কেউ সিঁদুর সিক্ত একমুঠো মাসকলাই বলি দেন । সবকিছুই প্রতিকী । সর্বকালের সর্বক্ষণের দুষ্টের দমন হয় দেবীর দ্বারা । রক্তবীজ অসুর কুল বিনষ্ট হয় । ঢাকের বাদ্যি বেজে ওঠে যুদ্ধজয়ের ভেরীর মত । একশো আট প্রদীপের আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয় ভারতবর্ষের আনাচকানাচ । উত্তিষ্ঠত ভারতবাসীর জাগ্রত মননে দুষ্কৃতের বিনাশিনী এবং সাধুদের পরিত্রাণ কারী মা দুর্গা কান্ডারী হয়ে প্রতিবছর অবতীর্ণ হন মর্ত্যলোকে ।

২০ অক্টো, ২০১৫

মহাসপ্তমীঃ নবপত্রিকা স্নান করায় কেন?


ছোটবেলায় জ্ঞান হবার পর থেকে আমরা সকলেই দুর্গাপুজোর সপ্তমীর ভোরে মহা সমারোহে ঢাকের বাদ্যির সাথে সাথে গঙ্গায় বা নদীতে “কলা-বৌ” স্নান করানোর আয়োজন দেখি । স্নান করিয়ে সেই কলাবৌটিকে নতুন লালপাড় শাড়ি পরিয়ে মাদুর্গার পাশে রাখা হয় এবং পুজোর পাঁচটাদিন পুজো করা হয় ঐ কলাবৌটিকে । বিসর্জনের দিন প্রতিমার সাথে তাকে ও বিসর্জন দেওয়া হয় । ছোটবেলায় প্রশ্ন করলে বলা হত ওটি গণেশের কলা-বৌ । আদতে গণেশ কিন্তু বিয়েই করেন নি ।  মা দুর্গাকেই ঐ রূপে পুজো করা হয় । আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে এই কলাবৌটির পুজোটি এই প্রসঙ্গে যথেষ্ট তাতপর্য পূর্ণ । বেদে আছে ভূমি হল মাতা, মৃত্শক্তি  যা ধারণ করে জীবনদায়িনী উদ্ভিদকে । আযুর্বেদের  ঐতিহ্যবাহী ভারতবর্ষে রোগভোগের প্রাদুর্ভাব ও কিছু কম নয় । এবং মা দুর্গার চিন্ময়ীরূপটি এই কলা-বৌয়ের অবগুন্ঠনেই যে প্রতিস্থাপন করা হয় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । এই কলাবৌকে বলা হয় নবপত্রিকা । নয়টি প্রাকৃতিক সবুজ শক্তির সঙ্গে আধ্যাত্মিক চেতনশক্তির মিলন হয় দেবীবন্দনায় । সম্বচ্ছর যাতে দেশবাসীর রোগ ভোগ কম থাকে এবং  দেশ যেন সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠে সেই বাসনায় এই নবপত্রিকাকে দুর্গারূপে পুজো করা হয় । ন’টি উদ্ভিদের প্রত্যেকটির গুরুত্ব আছে । প্রত্যেকটি উদ্ভিদ ই দুর্গার এক একটি রূপ এবং তার কারিকাশক্তির অর্থ বহন করে । এরা সমষ্টিগত ভাবে মাদুর্গা বা মহাশক্তির প্রতিনিধি ।  যদিও পত্রিকা শব্দটির অর্থ হল পাতা কিন্তু নবপত্রিকায় নয়টি চারাগাছ থাকে । আবক্ষ অবগুন্ঠনের আড়ালে নববধূর একটি প্রতিমূর্তি কল্পনা করা হয় । বাসন্তী এবং দুর্গা এই দুই পুজোতেই নবপত্রিকা অর্চনার নিয়ম আছে । যে ক’টি চারাগাছের সমষ্টিকে একত্রিত করে অপরাজিতার রজ্জু দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকা তৈরী করা হয় সেই নয়টি উদ্ভিদের নাম শ্লোকাকারে লেখা আছে  আর এই ন’টি গাছের প্রত্যেকের আবার অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেন

রম্ভা, কচ্বী, হরিদ্রা চ জয়ন্তী বিল্বদাড়িমৌ। অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা ।।

অর্থাত

(১) কলা–ব্রহ্মাণী(শক্তিদাত্রী)

(২) কালো কচু– কালিকা (দীর্ঘায়ুদাত্রী)

(৩) হলুদ– ঊমা( বিঘ্ননাশিনী)

(৪) জয়ন্তী–জয়দাত্রি,  কার্তিকী( কীর্তিস্থাপয়িতা )

(৫) বেল–শিবাণী(লোকপ্রিয়া)

(৬) ডালিম–রক্তবীজনাশিনী( শক্তিদাত্রী)

(৭) অশোক–দুর্গা(শোকরহিতা)

(৮) মানকচু– ইন্দ্রাণী( সম্পদদায়ী)

(৯) ধান–মহালক্ষ্মী( প্রাণদায়িনী)

মহাসপ্তমীর সূচনা হয় নবপত্রিকার স্নানপর্ব দিয়ে । নবপত্রিকা দেবীদুর্গার প্রতিনিধি । শ্বেত অপরাজিতা লতা এবং হরিদ্রাক্ত সূতা দিয়ে এই ন’টি উদ্ভিদ একসাথে বেঁধে নদীতে স্নান করানো হয় । দেবীর প্রিয় গাছ বেল বা বিল্ব । নদীতে নবপত্রিকা স্নানের পূর্বে কল্পারম্ভের শুরুতে দেবীর মুখ ধোয়ার জন্য যে দাঁতন কাঠি ব্যাবহৃত হয় তাও আট আঙুল পরিমিত বিল্বকাঠেরই তাছাড়া মন্ত্রে সম্বোধন করে নবপত্রিকাকে দেবীজ্ঞান করা হয় । শস্যোত্পাদনকারিণি দেবী দুর্গা স্বয়ং কুলবৃক্ষদের প্রধান অধিষ্ঠাত্রীদেবতা ও যোগিনীরা দেবীর সহচরী । স্নানান্তে নতুন শাড়ি পরিয়ে তিনটি মঙ্গলঘটে আমপাতা, সিঁদুর স্বস্তিকা এঁকে জল ভরে একসাথে ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ, ঘন্টা এবং উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করে, মন্ডপে মায়ের মৃন্ময়ীমূর্তির সাথে স্থাপন করা হয় । এই তিনটি ঘটের একটি মাদুর্গার ঘট, একটি গণেশের এবং তৃতীয়টি শান্তির ঘট । নবপত্রিকার পূজা একাধারে কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষের বৃক্ষপূজা অন্যদিকে রোগব্যাধি বিনাশকারী বনৌষধির পূজা । মহাসপ্তমীর ভোরে বিল্ববৃক্ষের পূজা, নবপত্রিকা এবং জলপূর্ণ ঘটস্থাপন এর দ্বারাই দেবীপূজার সূচনালগ্ন ঘোষিত হয় ।


ওঁং চন্ডিকে চল চল চালয় চালয় শীঘ্রং ত্বমন্বিকে পূজালয়ং প্রবিশ।

ওঁং উত্তিষ্ঠ  পত্রিকে দেবী অস্মাকং হিতকারিণি”

 
এঁরাই আবার নবদুর্গা রূপে পূজিতা হ’ন । তাই দুর্গাপূজার মন্ত্রে পাই 


“ওঁ পত্রিকে  নবদুর্গে ত্বং মহাদেব-মনোরমে”

ভবিষ্যপুরাণে পাওয়া যায়.. 

"অথ সপ্তম্যং পত্রিকাপ্রবেশন বিধিঃ" 


নবপত্রিকাকে জনপদে মঙ্গলের দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে পূজা করা হয় । একাধারে এটি কৃষিপ্রধান দেশের চিরাচরিত কৃষিলক্ষ্মী যা প্রাক্‌-আর্যসভ্যতার নিদর্শন অন্যাধারে জীবজগতের কল্যাণকর এই উভিদগুলির রোগনিরাময়ক গুণাবলীর জন্য  বনৌষধিও বটে । তাই এই ন’টি গাছকে অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে দেওয়ার অর্থ হল জনকল্যাণকর এই উদ্ভিদগুলি যেন রোগ-ব্যাধির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে বা মানুষ যেন এই পুজার মাধ্যমে রোগ ব্যাধিকে জয় করতে পারে ।

১৭ অক্টো, ২০১৫

কাউন্টডাউন ৫ঃ চালচিত্তির আবার কেন?


মাদুর্গার চালচিত্র যেন দুর্গাপূজার অন্যতম অঙ্গ । বহু দেবতার সমাবেশ লক্ষ্য করা যায় এই চালচিত্রে । শিল্পীর রং তুলির টানে এই চালচিত্রের  সুষমা যেন মায়ের মূর্তিকে আরো সম্পূর্ণ এবং উজ্জ্বল করে তোলে । আমরা কেবল দেবী দুর্গাকে সপরিবারে পূজা হতে দেখি কিন্তু আসলে হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল দেবদেবীরাই কিন্তু উপস্থিত থাকেন ঐ চালচিত্রতে ।



  • শিব

দুর্গাপূজা যেন কলিকালের অশ্বমেধ যজ্ঞ । শিব ছাড়া যেমন সকল যজ্ঞ অসম্পূর্ণ তাই মায়ের চালচিত্রের মধ্যমণি হলেন মহাদেব । তিনি যেন এলাহী বৈচিত্রের মাঝে নির্বিকার স্বামীরূপে বিরাজমান । মহামায়া মা দুর্গাকে যেন তিনি সৃষ্টি ও প্রলয়ের ভার দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে আছেন তাঁর মাথার ওপর । মা অসুর বিনাশ করলে শিবপ্রদত্ত আশীর্বাদে আর তাই আমরা শিবকে বন্দনা করি আর মা এর কারণে প্রসন্ন হন । শিব ও শক্তির সম্মিলিত সত্তায় প্রকৃতির সর্বক্ষণের ভাঙাগড়া অব্যাহত থাকে ।

  • রাইরাজা

চালচিত্রে শিবের ডানদিকে উপবিষ্টা শ্রীরাধা । শক্তিবাদী আরাধনার সাথে সেখানে বৈষ্ণববাদের মেলবন্ধন । বিষ্ণুর শক্তি লক্ষ্মী । শ্রীরামের অবতারে তিনি সীতা আর শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গীনী শ্রীরাধিকা । দেবী-ভাগবতে বলা আছে  যে জগতের উত্পত্তিকালে বিশুদ্ধ শক্তিরূপিণী রাধিকা এবং বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা আবির্ভূতা হন তাই একত্রে এই দুই শক্তিযুগলের আরাধনা একান্ত কর্তব্য ।

  • নারসিংহী

রাইরাজার ডানদিকে নারসিংহী থাকেন ।  অষ্টশক্তির অন্যতম হলেন নারসিংহী । ভগবান শ্রীহরি দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য  নৃসিংহ রূপে অবতীর্ণ হয়ে হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন । সেই কারণে অসুরগণের বিনাশ ও দেবতাদের কল্যাণার্থে দেবগণের মহাবল শক্তিসমূহ তাদের শরীর থেকে বহির্ভূতা হয়ে নারসিংহী নামক দেবীমূর্তিতে প্রবেশ করে ।  এই দেবীমূর্তি শ্রীচন্ডীর সমীপে উপস্থিত হন । এবং মাদুর্গার সঙ্গে অসুরের যুদ্ধের সময় এই নারসিংহী দুর্গার শরীরে লীন হয়ে যান ও মা’কে  অসুর নিধনের জন্য  আরো শক্তি দান করেন ।

  • রক্তবীজ

নারসিংহীর ডানদিকে আছেন রক্তবীজ । রম্ভাসুরের মৃত্য্র পর তার চিতার আগুণ থেকে এক বিশালাকায় দৈত্য নির্গত হয় যার নাম রক্তবীজ । চন্ডও মুন্ড বধের পর দাবরাজ শুম্ভ মহাসুর রক্তবীজকে বলে মাদুর্গাকে সংহার করতে । রথে আরোহণ করে রক্তবীজ শৈলশিখরে মাদুর্গার কাছাকাছি পৌঁছতেই দেবীদুর্গা শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন । সেই শঙ্খধ্বনিতে রক্তবীজ বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে দেবীর নিকট গিয়ে দেবীকে শুম্ভ অথবা নিশুম্ভকে বিবাহ করতে বলে । দেবী উগ্র থেকে উগ্রতর হয়ে ওঠেন । প্রচ্ন্ড যুদ্ধ হয় দুজনের মধ্যে । পাপমতি রক্তবীজ দেবীর বাণে বিদ্ধ হয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়ে । মূর্ছা ভঙ্গ হলে তার শরীরের প্রতিটি ফোঁটা রক্ত থেকে সেই দানবের অনুরূপ বলশালী দৈত্য উত্পত্তি হয় । শত সহস্র অসুরে ধরিত্রী ছেয়ে যায় । দেবগণ তখন বিপদ দেখে চন্ডিকা রূপিণিদেবীকে বলেন রক্তবীজের দেহনিঃসৃত প্রতিটিরক্তের ফোঁটাকে পান করতে তাহলে দৈত্যের উত্পত্তি রোধ হবে । চামুন্ডারূপিণিদেবী তাই করতে লাগলেন এবং অতঃপর সেই রক্তহীন রক্তবীজকে অস্ত্রাঘাতে নিহত করলেন ।

  • চামুন্ডা

রক্তবীজের ডানদিকে আছেন দেবী চামুন্ডা ধূম্রলোচন বধের পর শুম্ভের আদেশে চন্ড ও মুন্ড পদাতিক, অশ্ব, হস্ত ও রথ এই চতুরঙ্গ সৈন্য সহ দেবীর উদ্দেশ্যে ধাবিত হয় । দেবী ক্রোধে অতিশয় কৃষ্ণবর্ণ হলে তাঁর ললাট থেকে করালবদনা, লোলজিহ্বা কালী নির্গত হন । দেবী কালী চন্ডের মস্তক ছিন্ন করেন এবং পরে মুন্ডকেও অসির আঘাতে বধ করেন । সেই দেখে চন্ডিকাদেবী কালীকে চামুন্ডা রূপে অভিহিত করেন ।  তাই দুর্গার চালচিত্রে চামুন্ডার অবস্থান যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ।

  • মাহেশ্বরী

চামুন্ডার ডানদিকে আছেন দেবী মাহেশ্বরী ।  অষ্টশক্তির অন্যতমা এই দেবী চতুর্ভুজা, ত্রিনেত্রা, বৃষভারূঢ়া ।

  • ইন্দ্রাণী

মাহেশ্বরীর ডানদিকে আছেন ইন্দ্রাণী ।  তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের পত্নী, ইন্দ্রের শক্তি । গজবাহনা, চতুর্ভুজা, বজ্রধারিণী ।

  • রামচন্দ্র

চালচিত্রে মহাদেবের বাঁদিকে আছেন রামচন্দ্র ।
সীতাহরণের পর রামচন্দ্র বানরসেনাদের সাহায্যে সেতুবন্ধ্ন করে লঙ্কায় হাজির হলেন । ব্রহ্মা তখন রামকে আদেশ করলেন অপরাজিতা দুর্গার পুজো করে জগতের উদ্ধারে নেমে পড়তে । সমগ্র রাক্ষসকুলকে ধ্বংস না করতে পারলে যে ধরিত্রীর নিস্তার নেই । তাই কৃষ্ণপক্ষেই নিদ্রিতা দেবীকে অকালে জাগ্রত করে অকালে অর্থাত শরতকালে (পূর্বে বসন্তকালে শুক্লপক্ষে দেবলোক জাগ্রত অবস্থায় পুজো হত) কাজে নেমে পড়েছিলেন রামচন্দ্র স্বয়ং । তাই তো অকাল বোধন । ব্রহ্মার পরামর্শে দেবী দুর্গার দশভুজা মূর্তি মাটি দিয়ে গড়ে সিংহবাহিনী সেই দেবীর বোধন করেছিলেন ব্রহ্মা স্বয়ং বিল্ব বৃক্ষমূলে । সেই দিনটিই ছিল মহাষষ্ঠী । শুক্লাসপ্তমী থেকে মহানবমী অবধি বিশেষ পুজো চলতে লাগল । সপ্তমীর দিন দেবী স্বয়ং রামের ধনুঃশ্বরে প্রবেশ করলেন । অষ্টমীতে রামের বাণে আশ্রয় নিলেন । অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে দশানন রাবণের মস্তক পুনঃ পুনঃ ছেদন করলেন রামচন্দ্র । নবমীর দিন সীতা উদ্ধার করলেন রাম । আর দশমীর দিন প্রাতে যুদ্ধে জয়লাভের পর দেবীমূর্তি নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে বিসর্জন মন্ত্র পাঠ হল । সেদিন পালিত হল বিজয়া দশমীর বিজয়োত্সব ।


  • জগদ্ধাত্রী

শ্রীরামচন্দ্রের বঁদিকে আছেন দেবী জগদ্ধাত্রী । তিনি মাদুর্গার অন্যতম রূপ । দেবী চতুর্ভুজা এবং কবীন্দ্রাসুর নিসূদিনী । দেবীর সাথে যুদ্ধের সময় মহিষাসুরের ছদ্মরূপ হল কবীন্দ্রাসুর । মা দুর্গা অঘটন পটীয়সী মায়ার বলে মহিষাসুরের আবরণ উন্মোচন করে কবীন্দ্রাসুরের শিরশ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।
  • নিশুম্ভ-শুম্ভ

চালচিত্রে জগদ্ধাত্রীর বাঁদিকে থাকে নিশুম্ভ আর নিশুম্ভের বাঁদিকে থাকে শুম্ভ ।  রক্তবীজ নিহত হবার পর নিশুম্ভ সসৈন্যে দেবীর দিকে তেড়ে যায় ।দেবীর সঙ্গে শুম্ভ ও নিশুম্ভের ভয়ানক যুদ্ধ হয় । দেবী নিশুম্ভকে বাণ দিয়ে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেন । সেই দেখে শুম্ভ কুপিত হয় । তখন দেবী শুম্ভকে শূলের দ্বারা আঘাত করেন । ইতিমধ্যে নিশুম্ভ জ্ঞান ফিরলে বাণ দিয়ে দেবীকে ও বাহন সিংহকে আঘাত করে । তারপর চলে গদাযুদ্ধ । শেষে দেবী চন্ডিকা শূলের দ্বারা নিশুম্ভের হৃদয় বিদীর্ণ করেন ।
শুম্ভকে বধ করতে দেবীর সময় লেগেছিল ।  একসময় শুম্ভ দেবতীর্থ পুষ্করে তপস্যা করে । ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দান করেন যে কোনো পুরুষের হাতে তোমার মরণ হবেনা । চন্ডিকার সঙ্গে যুদ্ধের সময় শুম্ভ দেবীকে বলেহে উদ্ধত দেবী দুর্গা, তুমি গর্ব কোরোনা । তুমি অন্যান্য দেবীর সাহায্যেই তো যুদ্ধ করছ । সেই শুনে দেবী বলেন,    সমস্ত দেবীর প্রকাশ তাঁর শরীরেই । এরপরেই তিনি যেইমাত্র শুম্ভকে শূল দিয়ে বক্ষে আঘাত করেন সাথে সাথেই শুম্ভর মৃত্যু হয় ।


  • বারাহী

দৈত্যরাজ শুম্ভের বাঁদিকে থাকেন বারাহী । ইনি বরাহ অবতারের শক্তি । বরাহবদনা, কৃষ্ণা, পীতাম্বরী, সালঙ্কারা, বরাভয়, হল ও মুষলধারিণী । ইনিও অষ্টশক্তির এক শক্তি যিনি দাঁত দিয়ে ধরণীকে ধরে রেখে উদ্ধার করেছিলেন ।

  • ব্রহ্মাণী

ইনি ব্রহ্মার সৃষ্টিশক্তি । কমন্ডলুর  মন্ত্রপূত জল কুশ দিয়ে ছিটিয়ে দৈত্যদের হীনবীর্য করেছিলেন । ইনি রক্তবর্ণা, বিশালনয়না, বর ও অভয় মুদ্রাধারিণী, হংসারূঢা ।

  • কাত্যায়নী

দেবী ব্রহ্মাণীর বাঁদিকে আছেন দেবী কাত্যায়নী । তিনি অপরূপা, শান্ত । কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে আশ্বিনমাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে আবির্ভূতা ও পালিতা এই কন্যা দেবতাদের তেজে প্রকাশিত হন ।  তাঁর ত্রিনয়ন থেকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর সৃষ্টি হয়েছিল । তাই সকল প্রকার জাগতিক ও পারমার্থিক বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য দেবতারা কাত্যায়নীর সাহায্য নেন ।

এছাড়াও চালচিত্রে রয়েছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, গণেশ, কার্তিক, সূর্য, চন্দ্র, পবন, ইন্দ্রাদি দেবতারা । নারীশক্তির মধ্যে অন্যতমা কালী, অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী সরস্বতীও আছেন সেই সাথে । সুতরাং চালচিত্রে আঁকা মূর্তিগুলি  যথেষ্ট ইঙ্গিত বহন করে এবং এই মূর্তিগুলির মধ্যে দিয়েই মায়ের সার্বিক শক্তির প্রকাশ ঘটে ।







তথ্যসূত্রঃ
(১) মহিষাসুরমর্দিণী- দুর্গা – স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ
(২)  শারদীয়া সংখ্যা উদ্বোধন ১৪১৮

২২ সেপ, ২০১৫

প্যাপিরাস পুজোসংখ্যা ২০১৫ আসছে...

সোনারতরী থেকে প্রকাশিত "প্যাপিরাস" ই-পত্রিকার পুজোসংখ্যা আসছে কয়েকদিনের মধ্যেই । "চক্রবৈঠক" এবার জমজমাট আলোচনা নিয়ে। বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত মানুষদের মুক্ত কলমে উঠে আসছে বিতর্ক। "সংস্কার না সংস্কৃতি? কোনটির প্রয়োজন এ যুগে "...তা নিয়ে। আর আছে মেয়েদের লেখা একগুচ্ছ থিম অণুগল্প। বিষয়ঃ দুর্গাপুজো। এছাড়াও থাকছে নিয়মিত বিভাগ স্মৃতিকণা, রম্যরচনা এবং ভিন্নস্বাদের নিবন্ধ।

১৮ সেপ, ২০১৫

জয় বাবা গণেশ !

তিনি হলেন গিয়ে "গণানাং পতি", গণশক্তির প্রতীক, গণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ (গণ+ঈশ)  । বিনায়ক (বি+নী+অক) তাঁর অপর নাম।  প্রমথগণ হলেন শিবের অনুচর এবং সঙ্গী। তাঁরা নাচগানে পারদর্শী । সন্ধ্যার অন্ধকার প্রমথগণের আশ্রয়। বিনায়ক হলেন সেই প্রমথগণের পতি। সন্ধ্যার অধিপতি দেবতা বলে সন্ধ্যারূপিণী লক্ষ্মীদেবীর পাশে গনেশের অবস্থান। ভূতপ্রেতদের দৌরাত্ম্যি ও সকলপ্রকার বাধাবিঘ্ন নাশ করার জন্য প্রমথগণ গণপতিকে সন্তুষ্ট রাখতেন তাই গণপতির অপর নাম বিঘ্নেশ।  তাঁকে পুজো করলে সিদ্ধিলাভ হয় তাই তিনি সিদ্ধিদাতা গণেশ। গ্রীসে ও রোমে গণেশ "জুনো(Juno)" নামে পুজো পান। হিন্দুধর্ম ছাড়া বৌদ্ধধর্মেও গণপতিকে " ওঁ রাগ সিদ্ধি সিদ্ধি সর্বার্থং মে প্রসাদয় প্রসাদয় হুঁ জ জ স্বাহা" মন্ত্রে পুজো করা হয়।  কিন্তু তফাত হল হিন্দুদের গণপতি সিদ্ধিদাতা আর বৌদ্ধদের সিদ্ধিনাশক যা সম্পূর্ণ বিপরীত। হিন্দুদের দেবী অপরাজিতা মা দুর্গার ডানদিকে থাকেন গণপতি। কিন্তু মহাযানী বৌদ্ধদের অপরাজিতা দেবীর সাধনায় লক্ষ্য করা যায় গণপতি চিরবিঘ্ন প্রদায়ক। সেখানে দেবীর বাঁ পা  গণেশের উরুতে আর ডান পা ইন্দ্রের ওপরে ন্যস্ত। বিনায়ক দেবীর পদভারে আক্রান্ত। আবার পুরাণের মতে গণেশ কেবলমাত্র শিব-দুর্গার পুত্ররূপে পরিচিত। বহুযুগ আগে সমাজে দুধরণের সম্প্রদায় ছিল যাঁরা দুটি ভিন্ন মতবাদে গণেশের পূজা করত। একদল নাগ-উপাসক ছিল তাই গণেশের গলায় যে যজ্ঞ-উপবীত বা পৈতেটি রয়েছে সেটি নাগোপবীত তথা নাগের অলঙ্কারের পরিচায়ক। আর অন্য সম্প্রদায় আবার স্কন্দ বা কার্তিকের পূজারী। তারা নাগ-উপাসনার বিরোধী হয়ে কার্তিকের বাহন ময়ূরকেই বেশী প্রাধান্য দিত । ময়ূর হল নাগেদের শত্রু।
বর্তমান দুর্গাপুজোতে আমরা মা দুর্গার দুই পাশে কার্তিক ও গণেশ উভয়েরি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান লক্ষ্য করি। অর্থাত নাগ-উপবীতধারী গণেশও র‌ইলেন আবার ময়ূরবাহন কার্তিকও র‌ইলেন।  আর সেই রূপটি‌ই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে আজো সমাদৃত।  
ছবিঃ রুচিরা চ্যাটার্জি 
মা দুর্গা  একদিন কৈলাসে বসে স্নানের পূর্বে তেলহলুদ মেখে গাত্রমার্জণা করছিলেন। মায়ের দুই সহচরী  জয়া-বিজয়া কাঁচা হলুদ বেটে তার মধ্যে সরষের তেল দিয়ে মায়ের সর্বাঙ্গে  মাখিয়ে দিতে ব্যস্ত। মা সেই আরাম পাবেন কি, মনে তাঁর খুব দুঃখ। মহাদেব কত নারীকে পুত্র দিয়ে তাদের আকাঙ্খা পূর্ণ করেন আর দুর্গাই স্বপুত্র থেকে বঞ্চিত। কার্তিককে পেয়েছেন যদিও কিন্তু সে তো তাঁর গর্ভের নয়। সে শিবের ঔরসজাত, গঙ্গার কানীনপুত্র আর ছয় কৃত্তিকার দ্বারা পালিত।  গাত্রমার্জণা শেষের দিকে। মা জয়া-বিজয়াকে বললেন, তোরা যা দেখি একটু ওদিকে, বাবার সাথে আমাকে একটু একা থাকতে দে। মা নিজের তেলহলুদ মাখা গায়ের ময়লাগুলি তুলতে তুলতে মহাদেবকে বলেই ফেললেন" আজ আমার একটা ছেলে থাকলে..." মহাদেব বললেন, তুমি ত্রিলোকের যত পুত্রসন্তান আছে তাদের সকলেরি মা"  মা বললেন,"তবুও, একটুতো দুঃখ হয়, বুঝলেনা" মহাদেব বললেন" কত ঝামেলা করে চন্দ্রলোক থেকে কৃত্তিকাদের অমতেও কার্তিককে এনে দিলাম তাও তোমার দুঃখ ঘুচলোনা?"  মা বললেন " ঠিক আছে আর বলবনা" বলতে বলতে নিজের গায়ের ময়লাগুলি তুলে তুলে মাটিতে ফেলছিলেন মনের দুঃখে। হঠাত তাঁর কি মনে হল, সেই ময়লাগুলি দিয়ে একটি পুতুল গড়ে ফেললেন মাদুর্গা। নারায়ণ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ঐ পুতুলের মধ্যে সূক্ষ্ম শরীরে প্রবেশ করা মাত্র‌ই পুতুলটি প্রাণ পেল আর মাদুর্গাকে "মা, মা" বলে ডেকে উঠল। মায়ের বুকের ওপরে উঠে তাঁর দুধ খেতে শুরু করে দিল। দুর্গা আনন্দে আত্মহারা হয়ে সেই ছেলেকে কোলে নিলেন। মহাদেব আবার কার্তিককে এনে তাঁর আরেক কোলে দিলেন। । এবার কৈলাসে মহাভোজ। দুর্গার সুখ আর দ্যাখে কে! দুই পুত্র নিয়ে, দুই কন্যা নিয়ে সুখের সংসার শিব-দুর্গার। কৈলাসের সেই মহাভোজে সব দেবতারা নিমন্ত্রিত হলেন। সকলেই নির্ধারিত দিনে এলেন কেবল শনি মহারাজ ছাড়া। শিব ক্ষুণ্ণ হলেন শনি না আসায়। শনি সম্পর্কে দুর্গার ভাই।  একবার দুর্গা শনিকে বর দিয়েছিলেন, সে যার দিকে চাইবে সাথে সাথে তার মাথাটা খসে পড়বে। মহাদেবের অসন্তোষের কারণে সেদিন শনি অবশেষে দুচোখ হাত দিয়ে ঢেকে প্রবেশ করলেন। এদিকে মহাদেব তো আর সেকথা জানেননা। তাঁদের ছেলেকে দেখছেন না শনি, সেও তো এক অপমানের বিষয়। শনি বাধ্য হয়ে  চোখ খুলে সেই ছেলের দিকে চাইতেই ছেলের মুন্ডুটি খসে পড়ে গেল মাটিতে। মাদুর্গা কাঁদতে লাগলেন। 
দুর্গা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল দেবতারা বিচলিত হয়ে পড়লেন। তাঁদের আদেশে মহাদেব নন্দীকে বললেন ত্রিভুবন ঘুরে উত্তরদিকে শয়নরত যে কোনো ব্যক্তির মুন্ডটা কেটে আনতে। নন্দী বেরিয়ে পড়ল। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ঘুরে দেখতে পেল উত্তরদিকে মাথা করে একটা সাদা হাতি শুয়ে আছে।  সেই হাতীর মাথাটা কেটে এনে সে মহাদেবের কাছে নিয়ে এল। মহাদেব তখুনি মাথাটা ছেলের কাঁধে জোড়া দিলেন ছেলে আবার মা, মা করে ডাকতে শুরু করে দিল। মা দুর্গার একাধারে মা ডাক শুনে আনন্দ হল আবার অন্যথায় ছেলের হাতীর মাথা দেখে দুঃখে প্রাণ কেঁদে উঠল। তাঁর দুঃখ দেখে দেবতারা বললেন, মা তুমি দুঃখ কোরোনা, তোমার এই ছেলের নাম দিলাম গণপতি। সকল দেবতার পুজোর আগে এঁর পুজো হবে সর্বাগ্রে।  মা দুর্গা ছেলের এই সম্মানে গর্বিত হলেন।আর মর্ত্যলোকে  ভাদ্রমাসের শুক্লা চতুর্থীতে গণেশের জন্মদিন পালন করা হয়।   

১৭ সেপ, ২০১৫

হ্যাপি কন্যা সংক্রান্তি!


তিনি সব্বোঘটে ক্যাঁটালি কলা। তিনি সব কাজ করতে পারেন। তিনি জ্যাক অফ অল ট্রেডস আবার মাষ্টার অফ অল ও। সবেতেই পারদর্শী।  তিনি একাধারে আর্কিটেক্ট অন্যধারে প্রোমোটার। একাধারে ইঞ্জিনিয়ার অন্যদিকে কার্পেন্টার। আবার তিনি নাকি ছিলেন ফ্যাশান কাম জুয়েলারি ডিজাইনার । তাঁর আবার অস্ত্রশস্ত্র বানানোর ফ্যাক্টরিও আছে। তাই বুঝি তিনি দেবলোকের স্থপতি, কারিগর, শিল্পী। মর্ত্যে যাকে বলে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার  কিম্বা ওয়েল্ডার, বা আর্কিটেক্ট বা পাতি মিস্ত্রী।  সমুদ্রমন্থনের একটি অনবদ্য ফলস্বরূপ তাঁর জন্ম।  সত্যযুগে যিনি স্বর্গ, ত্রেতায় লঙ্কাপুরী, দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা ও পান্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থের রাজধানী নির্মাণ করেছিল। তিনি যেন ত্রিযুগের পারদর্শী এক স্থপতি।   প্রতিবছর ১৭ই সেপ্টেম্বর তাঁর পুজো হয়। কেন হয়? সেদিন নাকি তাঁর জন্মদিন। বিশ্বকর্মাজয়ন্তী বলে অন্য প্রদেশে।  একাধারে তিনি ডিজাইনার আবার একাধারে তিনি  স্থপতি। দেবতাদের রথ থেকে অস্ত্রশস্ত্র, অলঙ্কার থেকে নানাবিধ ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পের প্রস্তুতকারক।  বিশ্বকর্মার চারহাতের একটিতে জলভর্তি কমন্ডলু, অন্যহাতে কুঠার। অপরদুটি হাতে ফাঁসযুক্ত দড়ি এবং ব‌ই থাকে।  ঠিক যেমন বাস্তব জগতের মিস্ত্রির মত।  পুরাণের মতে বাস্তু হল বিশ্বকর্মার পিতা।   প্রতিবছর কন্যাসংক্রান্তির দিনে, ১৭ই সেপ্টেম্বর বা ভাদ্রমাসের শেষদিনে তাঁর পুজো হয়। সূর্য সেইদিন থেকে কন্যারাশিতে গমন করে তাই এই সংক্রান্তির অপর নাম কন্যাসংক্রান্তি। 
বেদে বলা হয়, বিষ্ণুর সুদর্শণ চক্র, মহাদেবের ত্রিশূল, দেবরাজ ইন্দ্রের বজ্র এবং পুষ্পক রথ তিনি বানিয়েছিলেন। সীতার স্বয়ংবর সভায় যে বিশাল ধনুকটিতে জ্যা পরিয়ে ধনুকটি ভঙ্গ করে  রামচন্দ্র সীতাকে পেয়েছিলেন সেই  হরধনুটিও বিশ্বকর্মার হাতে তৈরী।  


 দক্ষিণবঙ্গে বর্ষার পরে  সরীসৃপের বাড়বাড়ন্ত হয়। জলে জঙ্গলে মানুষদের কাল কাটানো, বিশেষতঃ সাপখোপেদের সাথে তাদের অহোরাত্র ওঠাবসা। একটু অসতর্ক হলেই বনে জঙ্গলে সাপেকাটার খবর। তাই বর্ষা গিয়ে ভাদ্রের জল থৈ থৈ গ্রামবাংলায় শরতের নীল আকাশের আবাহনে আগমনীর সুর যেন সবে শুনতে পায় গ্রামবাসীরা। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে তারা করে রান্না পুজো। রাঁধে ভাদ্রের শেষ দিনে। আর সেই বাসি খাবার খায় আশ্বিনের প্রথমদিনে। তাদের বিশ্বাস তাদের প্রত্যেকের ঘরের নীচে যে বাস্তুসাপ আছে , যে সারাবছর তাদের বালবাচ্ছাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, যার নজরদারিতে তারা সম্বচ্ছর বেঁচেবর্তে রয়েছে তাকে এবছরের একটা দিন মনে করে পুজো করা। সাপেদের দেবী মা মনসার পুজো এটাই। মা মনসা তুষ্ট করলে তবেই সাপেরা উত্পাত করবেনা। এই তাদের বিশ্বাস। গোবরছড়া দিয়ে রান্নাঘর, উঠোন নিকিয়ে, শুকনো করে,  ধোয়ামোছা করে, ঘর রং করে ষোড়শ উপচারে সংক্রান্তির দিন রাতে তারা নতুন উনুনে রান্না করে। 
ভাত, তরকারি, ডাল চচ্চড়ি, কচুশাক, ইলিশমাছ, চিংড়িমাছ, চালতার টক, পাঁচ রকম ভাজা, আবার পিঠেপুলি, পায়েস...সব রেঁধে বেড়ে মনসাদেবীকে উত্সর্গ করে তারপর দিন সব ঠান্ডা খাবে তারা। যদি রান্নাবান্নায় কোনো অসংগতি থাকে কিম্বা পরিচ্ছন্নতায় দোষত্রুটি থাকে তবে ঐ দিন মনসাদেবী সাপকে পাঠিয়ে সব খাবার বিষাক্ত করে দেন তাই দক্ষিণবাংলার মানুষদের এই পুজোতে নিষ্ঠা চোখে দেখবার মত।
তারা কাঁটা মনসার ঝোঁপেঝাড়ে এখনো রেখে আসে দুধের বাটি আর কলা। সাথে কিছু রান্নাপুজোর ভোগদ্রব্য।   দক্ষিণবঙ্গের মেয়েরা অনেকে আজো বলে আন্নাপুজো। তারা "র" উচ্চারণে অক্ষম। তারা বলে আন্নাপুজোয় পান্না খাওয়া। পান্না হল পান্তাভাত।  ভাদ্রের পচা গরমে কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি। তাই বাসিভাতে ঠান্ডা জল ঢেলে রাখার রেওয়াজ। পরদিন ভাত টাটকা থাকবে। আর এই পান্তাও নাকি খুব স্বাস্থ্যকর।  সাথে কেউ রাঁধে ডালবড়া, মাছভাজা। কেউ উচ্ছেচিংড়ি, গাঁটিকচুর দম। কেউ আবার মহা উদ্যমে রাঁধে  ঘেঁটুফুল ও কচুপাতা বাটা, নারকোল কোরা, সর্ষে-বাটা আর সর্ষের তেল দিয়ে মাখা,  সর্ষে দিয়ে কচুর লতি আর শাপলা ডাঁটার ডাল ।  তবে ডালচচ্চড়ি, কচুরশাক, ইলিশ-চিংড়ি রাঁধতেই হয়। আর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে তারা সেই পঞ্চ ব্যঞ্জন নিবেদন করে মনসা ঠাকুরাণী আর তাঁর চ্যালা নাগনাগিনীদের।     
বিশ্বকর্মাপুজোর দিনে এই উত্সবকে বলা হয় অরন্ধন বা রান্না পুজো।  


এই বিশ্বকর্মা তথা মনসাপুজোর পর আমাদের আর কোনো উত্সব নেই। আবার সেই শরত্কালের দুর্গোত্সব হবে মহালয়ার পর, সুপর্বে।  তখন হবে সুসময়, পুণ্যকাল। আমাদের পরবের দিন শুরু হবে। তাই তো মাদুর্গার অরেক নাম "সুপর্বা"। তাই বুঝি আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, বিশ্বকর্মা পুজো শেষ হল মানেই দুর্গাপুজোর ধুম লেগে গেল হৃদিকমলে। আর হিন্দুদের এই পরব চলবে চৈত্রের সংক্রান্তিতে চড়কপুজো অবধি । পুরণো বছর চলে যাবে আবার নতুন বাংলা সন পড়বে তারপর। 
 
 এই দিনে বাংলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উত্সব হল ঘুড়ি উত্সব। সব কলকারখানা বন্ধ বিশ্বকর্মা পুজোর কারণে। সব যন্ত্রপাতি ধোয়া মোছা করে তাদের সম্বচ্ছরি বিশ্রাম ঐদিন। আর তাই বুঝি সেই আনন্দযজ্ঞে মেতে ওঠে ছোটবড় সকলেই। অনাবিল আনন্দ। অফুরন্ত সময় ঘুড়ি ওড়ানোর। শরতের নীল, মেঘমুক্ত আকাশে রং বেরংয়ের ঘুড়ি আর ঘুড়ি। কত রকমের নাম তাদের। কত রং তাদের।  দুদিন আগে থেকে ঘুড়ি তৈরী আর সেই সাথে ঘুড়ি ওড়ানোর সূতোয় মাঞ্জা দেওয়া। কাঁচের গুঁড়োর সাথে গদের আঠা মিশিয়ে কড়কড়ে করে সেই মিশ্রণ সূতোয় লাগানো। এ প্রান্তে একটা গাছের গুঁড়িতে সুতো বেঁধে ও প্রান্তে আরেকটা গাছের গায়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাক দিয়ে সুতোয় মাঞ্জা দেবার পালা। তারপর সেই সুতো গুটিয়ে নেওয়া কাঠের লাটাইয়ে। রান্নাবান্না বন্ধ। মেয়েদের আজ জিরেন। আর ছেলেদের মনের সুখে ঘুড়ি ওড়ানো। নীল আকাশে ঘুড়ির মেলা। আর এ পাড়ার টুবলুর দল ও পাড়ার বাপ্পার দল। কে কাকে কাটবে আজ? অসীম আকাশে উভয়েরি ঘুড়ির রাজ্যপাট । কে কার এক্তিয়ার অতিক্রম করে কাকে কাটতে পারে সেই হল গোল। একবার কাটতে পারলেই চীতকার..."ভোকাট্টা....দুয়ো, দুয়ো" আর সাথে সাথেই যারা অন্যপক্ষের ঘুড়ি কাটলো তাদের বাঁশী, কাঁসি, ঢাক, ঢোল পিটিয়ে প্রতিপক্ষকে হিউমিলিয়েট করা। সেই ফাঁকে মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় হাত কেটে রক্তারক্তি। রোদ্দুরে ঘুড়ি উড়িয়ে ছাদ থেকে তরতর করে নেমে গিয়ে ঠান্ডা জলে ঢকঢক। ব্যাস্! সর্দ্দিগর্মি। মায়ের বকুনি। পেটকাটি,  চাঁদিয়াল, একতে, দোতে, বাতিয়াল,  ঘয়লা, ময়ূরপঙ্খী,  শতরঞ্চি,  বামুনপেড়ে,
রসোগোল্লা,  মুখপোড়া, চৌখোপ্পি, জয়হিন্দ...   আরো কত নাম সব ঘুড়ির।  আর আছে হরেক কিসিমের ঘুড়ির সুতো.. ডেক্রণ, স্পেকট্রা, ডিকট। কাজ সকলের এক‌ই কিন্তু  কোন্‌ ঘুড়ি যে কাকে কাটবে ঐদিনে আর কার সুতোয় যে কত জোর অথবা পাড়ার কোন ছেলে সেদিন সবচেয়ে বেশী ঘুড়ি কাটবে আর গলা ফাটিয়ে তার বন্ধুরা তার জন্য চীতকার করবে তা ছিল দেখার মত।  
মফঃস্বলে আজো দেখি ঘুড়ির দোকান।  কিন্তু নিজের বাড়ির ছাদ তো অপ্রতুল শহরে। তাই শহুরে ছেলেপুলেদের ঘুড়ি ওড়ানোয় সেই মাদকতা চোখে পড়েনা। ঘুড়ির পাতলা, ফিনফিনে রঙীন কাগজের বদলে এখন পলিথিন হয়েছে ঘুড়ির অঙ্গশোভা। আজ সে আমাকে তেমন করে টানেওনা। আর শহরের হাইরাইজের ছেলেপুলের এখন সময়‌ই বা কোথায় ঘুড়ি ওড়ানোর? সব ফ্ল্যাটবাড়ির ছেলেরা তো একত্র হয়ে মেতে উঠতেই পারে এই ঘুড়ি উত্সবে??

১৩ সেপ, ২০১৫

মনসুন মোমেন্টস-২


ভেজা টাওয়েলটা আবার বিছানার ওপর রেখেছিস? ….সরি মা! তুমি তো আছো তাই।
দাদাই বলল, পরের বারে এসে হয়ত আমার সাথে আর দেখাই হবেনা তোর।.... ধুস্! দাদাই! কি যে বলো! 
দিদা বলল, আর কি পরের বার তোকে নিজের হাতে মাংস রেঁধে খাওয়াতে পারব? ….ঠিক পারবে দিদা। 
ঠাম্মা বলল, কি রে আরেকবার আজ দেশপ্রিয় পার্ক খেলনার দোকানে যাবি নাকি? হট-হুইলসের গাড়ি কিনতে? ….এখন আর অত ছোট্ট গাড়িতে হবেনা ঠাম্মা। রিয়েল মডেল চাই ফর্মুলা ওয়ান কারের।  

.....আইনক্সের সেই মুভিটা? মানিস্কোয়ারের সেই আইসক্রিমটা? গড়িয়াহাটের মোড়ের সেই রোলকর্ণার? মনে পড়ছে কি তোমার বলো? বলো? চুপ করে আছো কেনো মা? নিউমার্কেট যাবে যে বলেছিলে? সেই কত কত ফেক ঘড়ি ছিল ! পার্কস্ট্রীটের চেলো কাবাবটা খাওয়ানো হলনা তোমাকে আজো! প্রিয়ার কাছে সেই দুপুরগুলো? তুমি ফুটপাথী মোমো খেতে দিতেনা, বলতে বানিয়ে দেবো। মায়ের কেবিনের চপ আজো খাওয়া হলনা আমাদের্! এখনো ফুটপাথে বিরিয়ানির হাঁড়িগুলো বসানো থাকে মা? কি উগ্র গন্ধ বেরোয় আশপাশ থেকে। 
….
তোমাদের ধর্মের সংজ্ঞাটা আজো ক্লিয়ার না আমার কাছে। জানো মা ? আজ আমাদের দেশে এত রেপ হয় কেন?
এই তোমাদের মত অর্থডক্স যারা সংস্কারের বশে হাত ধুয়ে পুজো করো, পুজোর ফুল মাথায় ঠেকাও তাদের জন্য। মেয়েদের জন্যে যারা একটুও ভাবোনা তাদের জন্যে।  ঠাম্মা-দিদাই তো বলে ফুলো লুচিগুলো আমার পাতে দিতে। আর তোমরা সব মিয়োনো, ন্যাতন্যাতে, পোড়াগুলো নাও নিজেদের পাতে। ছেলেদের উচ্চাসনে বসিয়ে কি লাভ মা? সমান করতে শিখলেনা আজো? আমের আঁটিটা তুমি‌ই কেন খাবে? বাবার পাতে কেন দেবেনা মা? মেয়েদের এত নীচু করে রেখে আসার মাশুল দাও এবার। 
….
মা, আবার তুমি আজ সেই চিকেনটা বানিয়েছো? জিও! বেশী রুটি করেছ তো ?   
মা, জিনসের এই বাটনটা  একটু সেলাই করে দিও প্লিজ! কতবার বললাম এই নিয়ে!
ঘুম থেকে উঠবনা, ব্যাস্! আজ রোববার! আজ দেরী করব‌ই।
মা, রান্নার মাসী আসেনিতো কি? আজ তাহলে রান্না কোরোনা। কাবাব খেতে যাব চলো। প্লিজ মা, কাবাব এন্ড বিয়ার !!!
ফাটাফাটি হয়েছিল কালরাতের  পুডিংটা। আবার বানিও। ওজন বাড়ছে বাড়ুক, নো চাপ! চিল, চিল! কুল, কুল!
….
এই উইকএন্ডে তবে শান্তিনিকেতন ফাইনাল তো ?... ইয়েস!
মা শুনেছো? ইউটিউবে শানের রবীন্দ্রসংগীত! হোয়াট এন ইম্প্রোভাইজেশান! কর্ডগুলো ফলো করলে? এই নেক্সট উইকেন্ডে কিন্তু উইকেন্ডার কলকাতায়। ফসিলস থাকছে। যাবে তুমি?
নজরুল মঞ্চে ইন্দ্রায়ুধের বাবা তেজেন্দ্র নারায়ণ আছেন, সাথে জাকির হোসেনের তবলা। যাবে তো ? 
ঐ দ্যাখো মা, আমার সেন্ট জেভিয়ার্সের বন্ধু কবীর তোমার তারা মিউজিকে পারফর্ম করছে!
….
মা, রান্নার মাসীরো তো ছুটির দরকার আছে? সপ্তায় সাতদিন তোমার ছেলে যদি কাজ করত?
চিনি-দুধ না দিয়ে ঐ অখাদ্য চা যে তোমরা কি করে খাও?  
আমার ডিমের পোচে "মোলগরিচ" মাস্ট কিন্তু!    
….
 বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে বাড়ির মেয়েরা বলাবলি করছিলাম "বৌ কিন্তু বেশ ময়লা। রং টা আমাদের বাড়ির মতো নয়" ব্যস! ঝাড় খেলাম সক্কলে ছেলের কাছে।
আচ্ছা মা গায়ের "কমপ্লেকশান"টা কি  মেয়েটার দোষ? গায়ের ওপরে কি কোনো ট্যাগ লাগানো থাকে? "ফর্সা", "কালো" এইসব? তোমরা কতবড়ো হিপোক্রিট বলো! মাকালীর পুজো করো আবার কালো বৌ বাড়িতে এলে ক্রিটিসাইজ করো! 
….
অবশেষে ভরে গেল তার স্ট্রলি ব্যাগ। মামা-মামীর আদরে উপচে পড়া সেই হাসিটা ডোরবেল শুনে দৌড়ে গিয়ে রিসিভ করতেই থাকল সুদূর ব্যাঙ্গালোর থেকে পাঠানো  একের পর এক গিফ্ট...পারকার পেন, টাই, লেদার ওয়ালেট, ফার্ষ্টট্র্যাক ঘড়ি ....মায়ের চুপিচুপি ওয়েষ্টসাইডে গিয়ে  কিনে আনা পুজোর জামা, টিশার্ট- ব্লু জিন্স, মোজা, রুমাল, ভেস্ট, ড্রয়ার, ট্র্যাকস্যুটস, মেডিসিন, আর বাবার  ওয়ালেটে পড়ে থাকা কিছু খুচরো ডলার নোটস। ঠাকুমা, দাদু-দিদারা আলমারী ঘেঁটে আরো কয়েকটা ছোট নোট।
…..
মামাদাদুর ওভারকোর্টটাই নেব আমি। ড্রাই ক্লিন করিয়ে দাও। ওটা উইসকনসিন থেকে এবার ফিলি যাবে আমার সাথে।  তনুমা লাস্ট-ইয়ার  পুজোতে যে ব্লু শার্টটা দিয়েছিল? আর সেই ফুলস্লিভ রেড গেঞ্জীটা? দিয়েছো তো মা? 
….
ঠাম্মা, আজ বাজারে তপসে মাছ পেলে নাকি?  মৌরলাটা পেলেও এনো প্লিজ!
দিদা, তোমার সব লুচিগুলো গোল হয় কি করে? 
দাদাই,  তুমি তো কানে শুনতে পাবেনা, বরং আবার বলো সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের গল্পগুলো। 
কাজের মেয়ে বলে, ও বৌদি, খুব ভালো করে উজালা দিয়ে দিলাম গেঞ্জীগুলোতে....ওখানে বেচারার কি হবে কে জানে?
রান্নার মাসী বললে, ও দিদি? ওকে সহজে চিকেন স্ট্যু-টা শিখিয়ে দি চলো।
বাবু, কিচেনে ঢোকার আগে হাতটা ওয়াশ করে নিস। কুকিং রেঞ্জে হাত দেবার আগে গ্লাভস পরে নিস।  কি যে করবি তুই একা একা!  বাবু, ওখানে একটা মিক্সার-গ্রাইন্ডার কিনে নিস কিন্তু। মাসী নেই যে শিলে তোর মাংসের মশলা বেটে দেবে। 
দ্যাখ, এমনি করে স্ক্রেপার নিয়ে আলু ছাড়িয়ে, চপিং বোর্ডে রেখে তারপর ছুরি দিয়ে.....ব্যাস, ব্যাস! আর বলতে হবেনা মা, তোমার রান্নার ব‌ইটাতে এসব আছে তো ?
আমি বললাম, ধুস্! সেখানে তো শুধুই রেসিপি! এগুলো আস্তে আস্তে শিখে যাবি দেখিস!দেখিস বাবা হাতটা কেটে ফেলিসনি যেন! তুই যা ধড়পড়ে!  
আর তোমার সেই প্রেসারকুকারে ফেমাস চিকেন বিরিয়ানির রেসিপি? ওটাতো লাইফসেভার, মামু বলেছিল ফার্গোতে পৌঁছেই। 

সত্যি খুব ইজিরে ওটা। সকালবেলা কলেজ যাবার আগে চিকেনটা মশলাপাতি দিয়ে ম্যারিনেট করে, ইয়োগার্টে ভিজিয়ে ফ্রিজে রেখে দিবি।  সন্ধ্যেবেলা ঘরে এসেই প্রেসারকুকারে রিফাইন্ড তেলে গরমমশলা, আলু, পেঁয়াজটা বাসমতী চালের সাথে ভেজে নিয়ে চিকেনটা দিয়েই একটা সিটি ব্যাস! আর্সেনালের ম্যাচ আর আর্সেলানের বিরিয়ানি জমে দৈ এক্কেরে! ও হ্যাঁ, জলটা দিবি ডাবল অফ রাইসের একটু কম।
মা আমার দ্বারা এত্তসব হবেনা। ঠিক হবে দেখিস! একদিন বানিয়ে দু দিন খাবি। আর খিচুড়ি, ফ্যানেভাতে, ডাল সেদ্ধ, ওমলেট, আলুভাজা তো এতবার শেখালাম। 

১৬ আগ, ২০১৫

মনসুন মোমেন্টস-১


ফিরে এসে ঘরময় সেই ডিওডেরেন্টের হালকা চেনা গন্ধটা আমার স্নায়ুগুলোকে অবশ করে দিল। বাথরুমের দরজার হুকে রেখে  যাওয়া কমলারংয়ের বাটিকের পাঞ্জাবীটাতেও সেই পরিচিত ঘামের গন্ধ।  ভিজে তোয়ালেটাও তুলে মেলে দিলাম খাটের ওপর থেকে।  আর ব‌ইয়ের র‍্যাক থেকে সেই বিশালাকার ব‌ইখানা? যার শিরদাঁড়াতে জ্বলজ্বল করে, বোল্ড করে লেখা সেই পরিচিত অক্ষরত্রয়  "GRE" আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল।  একটা বছর আগে এই  গুরুত্বপূর্ণ  ব‌ইটি  জায়গা করে নিয়েছে আমাদের বাড়িতে। একটামাস সেই ব‌ইখানির সাথে লেপটে র‌ইল।  আর মাত্র একমাসের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল তার কাজ। আর কেউ সেই ব‌ইখানি খুলেও দেখেনা। তারপরেই শুরু হয়েছিল চিঠি লেখালেখি...তারপর খোঁজ খোঁজ ভালো কোন ইউনিভার্সিটিতে কোথায় কি পড়ানো হয়....তারপর অনিশ্চয়তা...মা আমি স্কল পাবো তো ?  ইমেল, এস-ও-পি লেখা, রেকো যোগাড়, ট্রান্সক্রিপ্ট পাঠানো....কত্ত কাজ তার! তারপর চুপচাপ বেশ কিছুদিন। হঠাত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি উড়ে এসেছিল দরকারি ইমেলখানি। খুশির ইমেল, আনন্দের ইমেল....সফলতার ইমেল, পিএইচডি স্কল  ।
লাস্ট একটা বছর  কলকাতার চাকরীটাও বেশ ছিল। ডেটা-সায়েন্টিস্ট, রিসার্চ এসোসিয়েট যাই বলো।   ফ্যাটি পে প্যাকেট। তবুও মন যে মানেনা।  রাতবিরেতে ক্লায়েন্ট কল...আবার লেখো প্রোগ্র্যাম...কোডিং করো..দুনিয়ার ডেটা নিয়ে কাজ এহেন সায়েন্টিষ্টের । সেক্টরফাইভ থেকে ফিরেই ডিনার খেতেখেতেই কানে হেডফোন লাগিয়ে কন-কল ...কি ব্যস্ততার জীবন !
কিছুদিন পরেই কর্মজীবন স্ট্যাগনেন্ট কিন্তু! বাবা বলল, ডক্টরেটটা করা থাকলে অনেক সুবিধে। 
তাই তো ফুরিয়ে গেল একটা বছর হুড়মুড় করে। এবার? 

ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস এস্যোসিয়েশান...পাসপোর্ট-আই টোয়েন্টি ভিসা--এয়ার টিকিট.. ক্যাব বুকিং..... গুচ্ছের ইমিউনাইজেশান, ফরেক্স,  সেলফোনের জন্য ডেটাকার্ড...যত দিন বদলাচ্ছে তত‌ই যেন প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে। কাজটাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।  এয়ারপোর্ট। তারপরেই  চেক-ইন-ইমিগ্রেশন-সিকিওরিটি চেকিং ...আমাদের ছাদের ওপর দিয়ে হয়তবা উড়ে গেল উড়োজাহাজ খানি। মেঘের মধ্যে দিয়ে ঠিক ঐ সময়ে যেন পেলাম একটা রামব্লিং সাউন্ড। 

ঠিক যেন কালবৈশাখীর আগে থম মেরে যাওয়া আকাশটার মত। গাছের পাতা কাঁপছেনা মোটেও। নিস্পন্দ, নিথর একটা পরিস্থিতি।  সব যেন ফুরিয়ে গেল মনে হচ্ছে। আশপাশটা ফিকে গোলাপী কুয়াশার মত‌ই অস্পষ্ট । চাপা একটা উত্তেজনা তবুও অসাড়।  আমি কি হারিয়ে গেলাম?

২৮ জুল, ২০১৫

অন্য অহল্যা

Photo Courtesy : Google
 ভিধানে অহল্যা শব্দটির অর্থ হলঃ লাঙল চালনার অযোগ্য এমন ভূমি  আর সংস্কৃতে ন-হলা বা যা হলকর্ষণযোগ্য নয় ।  এই অহল্যা নাম্নী নারীটি অযোনিসম্ভবা অর্থাত কোনো নারীর থেকে তার সৃষ্টি হয়নি।  সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নিজ হাতে গড়া  অমন তিলোত্তমা অন্য কোনো পুরুষের হয়ে উঠুক সেটিও বোধ হয় ব্রহ্মা মনেপ্রাণে মানতে পারেননি তাই বুঝি অহল্যা ছিলেন চিরকুমারী।  এবং সেখানেই তার  নামটি সার্থক। আবার অভিশপ্ত পাথরে রূপান্তরিত অহল্যা সত্য সত্য‌ই হলকর্ষণযোগ্য নয়  এবং নিষ্ফলা । সেদিক থেকেও নামের আক্ষরিক অর্থটির সাথে সাজুয্য রয়েছে।  

সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সৃষ্ট অহল্যা নামে নারী চরিত্রটি পৌরাণিক উপাখ্যানে স্বনামধন্য হয়ে আছে অনেকগুলি কারণে।
১) তাঁর রূপ ( সৃষ্টিকর্তার খেয়াল  )
২) বুদ্ধি (বৃদ্ধস্বামীকে মানিয়ে নেওয়া ও এক‌ইসাথে দেবরাজ ইন্দ্রকেও খুশি করা) 
৩) বৃদ্ধ স্বামীকে মেনে নেওয়া  (পিতা ব্রহ্মার কথা লক্ষ্মী মেয়ের মত মেনে নেওয়া )
৪) অসাধারণ সিডিউসিং পাওয়ার  (বৃদ্ধ, যুবক সকলকেই পটিয়ে ফেলা )
৪)ইন্দ্রের সাথে পরকীয়ার কারণে অভিশপ্ত পাথরে রূপান্তরিত হয়ে প্রকৃতিকে আঁকড়ে বেঁচে থেকে যাওয়া (চিরন্তন ভারত-নারীর ত্যাগ ) 
৫) রামায়ণের রামকে অতিথি সত্কারের দ্বারা অভিভূত করে অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া  (কঠোর তপস্যার জন্য, আর কিছুটা  গৌতমমুণির ক্ষমতা প্রদর্শণ) 
এবং এইসবগুলি কারণে পঞ্চকন্যার আখ্যা পাওয়া ।

"অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তদা, পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহা পাতক নাশনম্‌।।" 

এবার দেখি মূল অহল্যা-গৌতম-ইন্দ্র উপাখ্যান কি বলে ? 

 ব্রহ্মা যতগুলি মানসকন্যা সৃষ্টি করেছিলেন তার মধ্যে সর্বোত্কৃষ্টা এবং তিলোত্তমা ছিলেন এই অহল্যা।     সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নাকি স্বর্গের নর্তকী ঊর্বশীর রূপের দেমাক খর্ব করার জন্য‌ই এই অবর্ণনীয় সুন্দরী অহল্যাকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন। অহল্যা পেলেন ব্রহ্মার কাছ থেকে চিরযৌবনবতী থাকার আশীর্বাদ।
গৌতমমুণির কামনার স্বীকার হলেন যৌবনবতী অহল্যা। ধ্যানের বলে ব্রহ্মা জানতে পারলেন সে কথা।    কিন্তু ব্রহ্মা ঘোষণা করলেন, যে সারা পৃথিবী পরিক্রমা করে সর্বাগ্রে তাঁর সামনে আসবে তার সাথেই তিনি অহল্যার বিবাহ দেবেন। 
সেই কথা শুনে সমগ্র দেবকুল এবং মুণিঋষিরা সকলেই যাত্রা শুরু করলেন। যাত্রাশেষে আশ্রমে ফেরার মুখে মহর্ষি গৌতম একটি গোরুর বাছুর জন্ম নেওয়া লক্ষ্য করলেন। সেটি ছিল কামধেনু বা দৈব গোরু। সৃষ্টির এরূপ প্রকাশ লক্ষ্য করে গৌতম সেই গোবত্স্যের চারিপাশে প্রদক্ষিণ করে সেই পরিধির মধ্যিখানে একটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করলেন। 
ব্রহ্মা দৈববলে সে কথা জানতে পেরে গৌতমমুণিকে বললেন যে একটি গাভীর সন্তানের জন্ম দেওয়া হল পৃথিবী সহ সপ্তদ্বীপের উত্পত্তির সমতুল্য।  এবং সেই গোবত্স্যটি প্রদক্ষিণ করে তার মধ্যে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা হল সারা পৃথিবী ভ্রমণের সমান। গৌতমের এরূপ কঠোর ধৈর্য দেখে ব্রহ্মার মন ভিজল।  তিনি গৌতমমুণির সাথে অহল্যার বিবাহে সায় দিলেন।  অসামান্যা সুন্দরী অহল্যা হলেন বৃদ্ধ গৌতম মুণির যুবতী ভার্যা। ব্রহ্মা নবদম্পতিকে উপহারস্বরূপ "ব্রহ্মগিরি" দান করলেন। ব্রহ্মগিরি  হল নবদম্পতির আশা আকাঙ্খা পূরণের সর্বোচ্চ স্থান।
বিবাহের পর ঈর্ষায় কাতর হলেন সমগ্র দেবকুল এবং মুণিঋষিরা। দেবরাজ ইন্দ্রেরো খুব রাগ হল । তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন অহল্যাকে। তখনি তিনি ফন্দী আঁটলেন মনে মনে। 
প্রতিদিন সূর্যোদয়ের পূর্বে গৌতমমুণি স্নান ও তপস্যার কারণে আশ্রমের বাইরে যেতেন।  দেবরাজ ইন্দ্র সেই সময় চন্দ্রের তপস্যা করে চন্দ্রকে বুঝিয়ে বললেন একটি মোরগের রূপ নিতে এবং গৌতমমুণিকে আরো ভোরে জাগিয়ে দিতে। সেদিন মোরগের ডাকে গৌতমমুণির ঘুম গেল ভেঙে। মোরগের ডাক শুনে গৌতম ভাবলেন ভোর হয়ে গেছে। তিনি আশ্রম থেকে নির্গত হলেন মাঝরাতে।

 দেবরাজ ইন্দ্র সুযোগের সদ্ব্যাবহার করে অহল্যার কাছে এলেন   তাকে আহ্বান করলেন।  অহল্যা সম্মত হল।  যুবতী অহল্যা মহাখুশি। দেবরাজ ইন্দ্র সুদর্শন । বৃদ্ধ স্বামীর তরুণী পত্নীও যারপরনেই  দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে নিজেকে উজাড় করে দিতে পেরে মহাখুশি হলেন। শৃঙ্গার, সম্ভোগ পর্ব মিটতেই অহল্যা ইন্দ্রকে তখুনি চলে যেতে বললেন কারণ গৌতমমুণির আশ্রমে ফেরার সময় আসন্ন। 
নিজের ভোগলালসায় তৃপ্ত হয়ে ইন্দ্র সেই স্থান থেকে বেরিয়ে আসবার সময় গৌতমমুনির সাথে তার সাক্ষাত হয়ে গেল। গৌতম সব অবগত হলেন। তাই চন্দ্রে কলঙ্ক চিরস্থায়ী হয়ে গেল।   গৌতমমুণি অহল্যাকে অভিশাপ দিয়ে  বললেন,    "ছিঃ অহল্যা! আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। তোমার রূপের দেমাক ধুলি ধূসরিত হল আজ থেকে। তোমাকে আমি চিরকালের মত অদৃশ্য করে দিলাম পৃথিবী থেকে। আজ থেকে সামান্য একটি পাথরে পরিণত হলে তুমি ।  যদি কখনো বিষ্ণু মনে করেন তিনি‌ই একমাত্র তোমাকে শাপমুক্ত করতে পারবেন।"

তাই বুঝি  ব্রহ্মা স্রষ্টা আর বিষ্ণু পালনকর্তা ।  ( Brahama, the Creator, Bishnu, the Preserver, Shiva, the Destroyer ).....  ভগবানদের মাহাত্ম্য কীর্তণে শুনতে পাই ।

অহল্যা হল প্রস্তর আর ইন্দ্র হলেন সহস্রযোনীপ্রাপ্ত এক তৃতীয় লিঙ্গের জীব। 

শোকে, অনুতাপে প্রকৃতির কোলে অহল্যা বেঁচে থাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। 
পরে রামায়ণে পাই রামকে তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ করে আর কঠোর তপস্যার দ্বারা অহল্যা শাপমুক্ত হন এবং পুনরায় মানবদেহ লাভ করেন। তাই অহল্যা পঞ্চকন্যার প্রথম স্থানে। 

ভীল উপজাতিদের রামায়ণে বলে  সপ্তর্ষিদের যজ্ঞাগ্নির ছাই থেকে উঠে এসেছিল অহল্যা।   ভাগবদ্‌পুরাণে বলে অহল্যা নাকি চন্দ্রবংশীয় রাজা মুদ্‌গলের কন্যা । 

 এ হল অহল্যা নিয়ে আমাদের তথাকথিত ধর্মীয় উপাখ্যান। 

এবার আসল আলোকপাত "কহানী" খ্যাত পরিচালক সুজয় ঘোষের মাত্র ১৪ মিনিটের এপিক থ্রিলার "অহল্যা"র ওপর।
এও এক নতুন কহানী। কিছুটা  পুরাণকথা থেকে বেরিয়ে আবার কিছুটা তাকে রেখে দিয়ে। আর নামধাম অনুষঙ্গ সবকিছুই অটুট। ব্রহ্মা অনুপস্থিত এই অহল্যা কাহিনীতে কিন্তু গৌতম সাধু, ইন্দ্র সেন ও অহল্যা এই তিন মূল চরিত্র বেশ মিলেমিশে একাকার। এমনকি আর্টিষ্ট গৌতম সাধুর দেওয়া পরশপাথরটিও বেশ প্রতীকি। শিল্পী গৌতমের "বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা" অহল্যার সিডাকশান, পুলিশ ইন্সপেক্টর ইন্দ্র সেনের অহল্যার সাথে সেই শরীরিখেলায় মেতে ওঠা । অহল্যা গৌতমের সাথেও সাবলীল আবার তরুণ ইন্দ্রের (টোটা রায়চৌধুরী) সাথেও। রামায়ণ প্রসঙ্গ, পাথর অনুষঙ্গ, ঠিক আমাদের মূল উপাখ্যানের মত। কিন্তু যে ব্যক্তি হঠাত করে শিল্পীর কাছে আসেন আর ফিরে যান না তিনি। আর পাথর স্পর্শ করলেই তিনি পুতুলে পরিণত হন। সেটি বুঝি গৌতমমুণির অহল্যাকে অভিশাপ দেবার মত এক কঠিন শাস্তিপ্রদান। কিন্তু একটা খটকা থেকেই গেল। গৌতমরা  যুগে যুগে  তাঁর স্ত্রী অহল্যাকেই বারেবারে শাস্তি দিচ্ছেন এভাবে
কিন্তু কেন যে সুজয় ঘোষের অহল্যাকে "এপিক থ্রিলার" আখ্যা দেওয়া হল তা বুঝলামনা। অনবদ্য সৃষ্টি, নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় প্রেক্ষাপট, দুর্দ্দান্ত সিনেম্যাটোগ্রাফি, আর সবচেয়ে ভালো মাত্র ১৪ মিনিটের মধ্যে একটা কিছুকে কংক্রীট দাঁড় করানো।   
ভাবতে কষ্ট হল এই ছবিতে গৌতম সাধু(সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)  বারেবারে তাঁর যুবতী স্ত্রীয়ের কাছে ঋণি থেকে গেলেন কারণ তাঁর প্রত্যেক সৃষ্টির পেছনে নাকি তাঁর এই স্ত্রীরত্নটির অপরিসীম অবদান। আর তাই বুঝি বারেবারে অহল্যা (রাধিকা আপ্টে)  মোবাইলটি নীচে ফেলে চলে যায়। গৃহে কোনো আগন্তুক এলেই তাকে পাথর ছোঁবার অছিলায় বৃদ্ধ শিল্পী গৌতম সাধু সেই আগন্তুককে পুতুল বানিয়ে ফেলেন। সব কিছুই ঠিক ছিল যদিনা অহল্যার মূল কাহিনীর সাথে গুলিয়ে না ফেলি।
সব কিছুই ঠিক আছে তিনি সুজয় ঘোষ মহাশয় বলে। সবকিছুই ঠিক আছে যদিনা একজন ফেসবুক বন্ধু এই ছবিকে সত্যজিত রায়ের "প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুলের্" সাথে তুলনা না করতেন। তাহলে কি সুজয় ঘোষ "কপি পেস্ট" করলেন  কোন্‌টির থেকে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)? পুরাণের গৌতমমুণি-অহল্যা-ইন্দ্রের গল্প থেকে না কি সত্যজিত রায়ের ঐ ছবিটি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে।
স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ভাবায় আমাদের সফল ছোটগল্পের মত। শেষ হয়েও যা শেষ হয়না।   ওহ্‌! আরেকটা কোশ্চেন! গৌতমমুণি সে যুগে স্ত্রীকে শাস্তি দিয়ে, অভিশাপ দিয়ে প্রস্তরীভূত করেছিলেন কারণ পরকীয়া।  এযুগের গৌতম সাধু বেশ মেনে নিয়েছেন তাঁর যুবতী স্ত্রীয়ের অন্য পুরুষকে সিডিউস করা, কিছুটা যেন উসকেই দিয়েছেন তাকে পরকীয়ায় মেতে উঠতে কারণ নিজের অক্ষমতা ( যা তিনি স্বীকার ও করেছেন ) ।  এইযুগে মোবাইল ফোন, ম্যাগাজিনে স্বাছন্দ্য আধুনিকা অহল্যাকে বর্তমানের গৌতম সাধু কিন্তু বেশ প্যামপার করেন। সেটাই যুগোপযোগী পরিবর্তন কিন্তু অহল্যা-গৌতম-ইন্দ্রের প্রত্যাবর্তন নয়। 



ও কলকাতা ব্লগজিনে প্রকাশিত 

১৭ জুল, ২০১৫

নেত্রদান


কারো আষাঢমাস, কারো যগ্যিমাস! এক‌ইসাথে ঈদের শপিং, হাঁড়ি চেঁচেপুঁছে কিঞ্চিত হালিম, জগাদার প্রোফাইল বদল আর ছাপ্পান্নভোগের যগ্যি, রথের ঝাড়াপোঁছ । 
আজ জগাদার নেত্রদান-উত্সব। মানে উনি কারোকে আই ডোনেট করছেন না । ওনার নবকলেবরে চোখ উঠবে আজ। না, না, কংজাইটিভাইটিস নয়। নতুন শরীরে নতুন চোখ প্রতিস্থাপনা। না, না আই ট্রান্সপ্লান্টও নয়। শিল্পী চোখ আঁকবেন তাঁর নতুন কলেবরে। 
গতকাল ব্রহ্মবস্তু  সানন্দে ট্রান্সফার হয়ে গেছে ওনার আত্মার সাথে। আজ চোখ আঁকা হলেই রথের পূর্ব মুহূর্তের প্রস্তুতি শেষ।  তাঁদের চোখে, ঠোঁটে নাকি রাসায়নিক বর্জিত রং দেওয়ার প্রথা। মানে যাকে বলে ইকোফ্রেন্ডলি, ভেষজ রং । আর কেন‌ইবা তা হবেনা? এই শরীরের রং নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে দিনের পর দিন, যতক্ষণ না আবার নবকলেবর হয়।  
আয়ুর্বেদগুণ সম্পন্ন হরিতাল(হত্যেল, হলুদ রং), হিঙ্গুলা( টুকটুকে লাল পারদের প্রাকৃতিক যৌগ, যাকে বলে সিনাবার)  সোনার প্রদীপ জ্বালিয়ে তার ভুসোকালি (কালো রং),  শাঁখের গুঁড়ো থেকে সাদা রং, আবার সোনার গুঁড়ো‌ও  মিশিয়ে জগাদা এন্ড কোম্পানিদের সং সাজানোর পালা। 
পুরো বিউটি স্যালোনে তিনমূর্তি এখন। দারুব্রহ্মের নতুন অঙ্গ মার্জনা, ফেসিয়াল, পর্বের ইতি। কুড়চি-কদম্ব-কেতকীর স্নিগ্ধ জলে স্পা পর্ব শেষ। বাকী শুধু আই মেকাপ। ব্যস! রেডি টু বোর্ড অন রথ। টাইমেই আছে গজেন্দ্রগমন। শুধু ছাড়ার অপেক্ষা আর আমাদের দেখার!!! 

১৩ জুল, ২০১৫

সুবর্ণলতার সেকাল ও একাল

(আশাপূর্ণা  দেবীর ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

১৩ই জুলাই আশাপূর্ণাদেবীর মৃত্যু দিবস। আসুন তাঁকে বারেবারে স্মরণ করি। বরণ করি তাঁর চিন্তাধারাকে। পালটে ফেলি আজকের সুবর্ণলতাদেরো। 

আশাপূর্ণাদেবীর কলমে প্রথম-প্রতিশ্রুতির সত্যবতী এবং তারই ভাবমূর্তির মূর্ত প্রতীক তার কন্যা সুবর্ণলতা চরিত্রটি আজো আমার মনে চির সমাদৃতা । দুটি উপন্যাস পড়েছিলাম বারোক্লাসের পরীক্ষা দিয়ে । তখন নারীমুক্তি, নারী সংরক্ষণ নিয়ে এতটা মাতামাতি শুরু হয়নি কিন্তু ঘোমটা পরিবৃতা বঙ্গনারীর উত্তরণ ততদিনে হয়ে গেছে সালোয়ার-কুর্তায় এবং জিনস-টিশার্টে । ঘরের বন্দিনী নারী বাইরের জগতে পা রাখার প্রোমোশানও পেয়ে গেছে । কিন্তু পাল্টায়নি পারিবারিক বোঝাপড়া বা সম্পর্কের টানাপোড়েনের চিত্র, উড়ে যায়নি রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ । যে যুগে সত্যবতী সুবর্ণলতার মধ্যে সঞ্চার করেছিল স্ত্রী স্বাধীনতার ভ্রূণ, সেদিনের থেকে সমাজের চিত্র পাল্টে গেছে অনেকটাই কিন্তু বিবাহিতা নারীর লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও অপমানের বোঝা বোধ হয় এখনও হালকা হয়নি । সে সময় সুবর্নলতা পড়ে মনে হয়েছিল আমি সত্যবতী তথা সুবর্ণলতার সকলরসের ধারক ও বাহক হলাম । আমি আমার প্রাকবৈবাহিক জীবনে এইরূপ প্রতিবাদী মানসিকতা নিয়েই ঘর সংসার করব এবং "আমারে দাবায়ে রাখতে পারবা না" এই ভাবেই আন্দোলন চালিয়ে যাব । কিন্তু কার্যকালে অতটা অন্দোলন প্রবণ না হয়েও বরিষ্ঠনাগরিকজনের মুখনিঃসৃত বাক্যমালাকেও আপ্তবাক্য রূপে মেনে নিতে পারিনি ।

মেয়েদের মনকে বুঝতে পেরেছিলেন আশাপূর্ণা । বিভিন্ন বয়সে মেয়েদের বয়সের মনের গঠনকে খুব অন্তর দিয়ে লক্ষ্য করলে যা বোঝা যায় । নারীমনের বয়স এবং তার সঙ্গে নানাবিধ জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। যখন সে কন্যা তখন তাকে দিতে হবে অনেক কিছু, গড়তে হবে, শাসন করতে হবে, সোহাগও করতে হবে সেই সাথে । তাকে যোগ্য সম্মান দিতে হবে । তবেই তার কাছ থেকে সম্মান পাওয়া যাবে । সুবর্ণলতাকেও আশাপূর্ণার সত্যবতী এই ভাবেই গড়ে তুলছিল কিন্তু তার শাশুড়ি এলোকেশীর জেদের কাছে হার মানতে হয়েছিল আত্মসম্মানবোধ সম্পন্না সত্যবতীর । বেথুন স্কুলে পাঠরতা দশ অনুত্তীর্ণা সুবর্ণকে কেমন করে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার ঠাকুমা নিয়ে চলে এলেন আর তার মায়ের অনিচ্ছায় বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলেন তা আমরা দেখেছি । এলোকেশী বামনির কাছে পুত্রবধূর মতামত অপ্রয়োজনীয় । তিনি সত্যবতীকে মানুষ বলেই মনে করেন নি তাই এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছিলেন । নিজের ছেলেকে তিনি যারপরনাই বৌয়ের বশীভূত বলতেও কুন্ঠিত হন নি । সে যুগে একজন মেয়ে মানুষ কিরূপে আর একজন মেয়েমানুষকে পায়ের তলায় অর্থাত নিজের অধীনে রাখার চেষ্টা করত তা এহেন লজ্জাকর বিবাহ দেখে আমরা শিক্ষা লাভ করি । বৈধব্যের একাকীত্বে উপনীত এলোকেশীর এহেন নিন্দনীয় সিদ্ধান্তে তার পুত্রও মনে মনে অখুশী হলেও প্রতিবাদী হননি কারণ সেই মেরুদন্ডের কাঠিন্য তার ছিলনা । "মা রাখি না বৌ রাখি" তো সব বিবাহিত পুরুষেরই জীবন যুদ্ধের অন্যতম পর্যায় । কিন্তু যে পুরুষটি সেই কাজ বুদ্ধির বলে করতে পারে সে তো রাজা ।

সুবর্ণলতা শিক্ষালাভ করে যে অপমানের স্বীকার হয়েছিল তা বোধ হয় এখনকার সুবর্ণদের কল্পনাতীত । বরং সংসারের স্বাচ্ছল্যতার কারণে এই শিক্ষালাভ শাপে বর হয়ে দাঁড়িয়েছে । এখনকার স্বাধীন নারী সানন্দে চাকরীর দায় ভার গ্রহণ করে যারপরনাই খুশি; বৌমাটি রোজগেরে বলে শাশুড়িমা কিন্তু মনে মনে গর্বিতা কিন্তু অন্দরমহলে তার নিত্য অনুপস্থিতি সংসারে সূত্রপাত ঘটায় নিত্যি কলহের । ঠিক যেমনটি আমরা দেখেছি সুবর্ন পড়তে ও লিখতে পারত বলে তা মহা অপরাধ বলে গণ্য হত আবার বাড়িতে কোনো চিঠিপত্র এলে তাকে দিয়ে সেটি পড়িয়ে নেওয়াটি কোনো অপরাধ বলে মনে করা হত না ।

তখনকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমরা লক্ষ্য করেছি স্বৈরাচারীর ভূমিকায় এলোকেশী নামক বিধবা রমণীকে । আবার সেই একনায়কতন্ত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে সুবর্ণলতার সংসারে । সেখানে সুবর্ণলতার বিধবা শাশুড়ি মুক্তকেশী তার চারপুত্রের কারোকেই মানেন না । তাঁর সংসারে তিনিই সর্বময় কর্ত্রী এবং স্ত্রী নায়িকার ভূমিকা পালন করে চলেছেন। সত্যবতী এবং সুবর্ণলতা উভয়ের সংসারেই এই শ্ব্শ্রূমাতা স্বরূপিণী কর্তা ব্যাক্তিটির অত্যাচারের চরম মূহুর্তে ঘটেছে নিত্যি অশান্তি এবং গল্পদুটি পড়তে পড়তে কেবলই মনে হয়েছে ইতিহাসের মাত্‌সন্যায় যুগের কথা অর্থাত দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার । কি আনন্দই না পেয়েছেন এই দুই মহিলা দুটি কন্যাসমা অবলা পুত্রবধূর ওপরে মানসিক অত্যাচার করে ! এ যেন নবপরিণীতা বধূটির উপর ইচ্ছকৃত কর আরোপ করা । তাহলে প্রশ্ন জাগে পুত্রের বিবাহের প্রয়োজনীয়তা কি শুধুই দাসী আনার জন্যই? আর শাশুড়ি মা টি কি সব কাজকর্ম ফেলে ছোট সেই বালিকাবধূটিকে গালমন্দ করার জন্যই গৃহে এনেছিলেন বরণ করে?তিনি একথা ভুলে যান বারবার যে পুত্রবধূটিকে আপন করতে না পারলে তিনি ও তাঁর পুত্রের থেকে অনেক দূরে সরে গেলেন ।কিন্তু তাতে কি আসে যায় ! ভবি ভোলবার নয় ।

নারীশিক্ষার প্রসার হয়েছে আমাদের দেশে । বালিকা আর বধূ হয় না শিক্ষিত সমাজে । শাশুড়িমাও কিন্তু শিক্ষিতা আজকের যুগে, কিন্তু পারস্পরিক বোঝাপড়ায় উভয়ই হিমশিম খান আজকের যুগেও । অবশ্যি এর ব্যতিক্রমও থাকে । এক হাতে তালি না বাজিয়েই বলছি আজ দুইপক্ষের কেউই বিনা যুদ্ধে সূচাগ্র জায়গা ছাড়েন না এই সংসারে । "যে সহে সে রহে" এই অমোঘবাণীকে মাথায় করে যে বধূটি চলতে পারে সে আদর্শ গৃহবধূ আর "কারো দোষ দেখো না" এই নীতির অনুগামিনী হয়ে যে শাশুড়িমা কাল কাটাচ্ছেন বহাল তবিয়তে, তিনিই ভাল শাশুড়ির সংবর্ধনা পান প্রতিবেশী, আত্মীয় পরিজনের কাছ থেকে । কিন্তু তবুও এই শাশুড়ি-বৌ মানিয়ে চলার কারণে ভেঙে যাচ্ছে কত যৌথ পরিবার । সে যুগেও আমরা দেখেছি স্বাধীনচেতা সত্যবতীর স্বামীকে নিয়ে শ্বশুরভিটে পরিত্যাগ করে ভাড়াবাড়িতে এসে সংসার করতে । আর এযুগে শিক্ষিত, চাকুরীরতা নারীর তো কথাই নেই । সে তো আরো স্বাধীন, আরো বেশী সচেতন ;
শাশুড়িমায়েরও ভুলে গেলে চলবে না যে তিনিও একদা ছিলেন বধূ বেশে । তাঁরও অনেক শখ, অনেক স্বপ্ন পূরণ হয়নি বিয়ের পরে কিম্বা তাঁরও ইচ্ছা করত একান্তে স্বামীটিকে পাবার, স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করার কিন্তু তাই বলে তাঁর পুত্রবধূটির ওপর তো তিনি সেই সব নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন না বা তিনি পাননি বলে পুত্রবধূটিও তা থেকে বঞ্চিত হোক এতো মেনে নেওয়াও যায় না । যেমন ধরা যাক তখন কার কালে ঘোমটা মাথায় দেওয়া ছিল ম্যান্ডেটরি । কিন্তু এখন তা সভ্য সমাজে লুপ্তপ্রায় । তখন বাড়িতে ম্যাক্সি বা হাউসকোটের চল ছিলনা কিন্তু এখন তা আমাদের ঘরে ঘরে চালু হয়ে গেছে । এবার যিনি নতুন বৌমাটিকে এখনও ঘোমটা দিতে বাধ্য করছেন তিনি কিন্তু তাঁর অন্দরমহলে নিজের সুবিধার্থে ম্যাক্সি বা হাউসকোট পরে আধুনিকা হয়ে ঘুরে বেড়চ্ছেন ।"আমাদের সময়ে এমন হত না, আমরা অনেক সংযত ও বাধ্য ছিলাম" "আমাদের কালে এমন দেখলে লোকে ছি ছি করত" কিন্তু একবারও কি তিনি ভাবেন না যে তেনাদের কালে তাকে এমন হাউসকোট বা ম্যাক্সি পরিহিতা দেখলে তাঁর শ্বশুরভিটার গুরুজনেরা ভিরমি খেতেন ! আবার ধরা যাক বাপের বাড়ি থাকা নিয়ে বৌমাটিকে শুনতে হয় প্রচুর কথা । কিন্তু শাশুড়িমা যখন বৌ ছিলেন তখন তিনিও থাকতেন বাপের বাড়ি গিয়ে আর তাঁর মেয়েটির বেলায় তো তিনি এ ব্যাপারে রা'টি কাড়েন না ।

তিনি বয়সে বড় বলে "do what I say, don't do what I do"অথবা "a king can do no wrong" এই আপ্তবাক্যটিকে মেনে নিতে বাধ্য করেন। বধূরাও আজকের দিনে শিক্ষিত সুশীল সমাজের কর্ণধার । সত্যবতী বা সুবর্নলতার ধারাপাতে কিছুটা পুষ্ট । তারা আজকালকার নিউক্লিয়ার পরিবারের সদস্যা এবং সর্বোপরি শিক্ষার আলোয় জ্বাজ্জল্যমান এক একটি তারকা ; তার মা-বাবার স্নেহের সুধারসে লালিত ওয়ান এন্ড ওনলি কন্যারত্ন । তাই চট করে কিছুকে মেনে নেওয়াও তার পক্ষে কঠিন হয় । আর শাশুড়িমাটি কিন্তু ভিতর-বাহিরে, অন্তরে অন্তরে সুপ্ত এলোকেশী, প্রচ্ছন্ন মুক্তকেশী স্বরূপিণী । তাই ছলে বলে কৌশলে বধূটিকে আঘাত করতে বা অন্তরটিপুনি দিতেও কুন্ঠিত হন না ।

তবে এও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হই যে আশাপূর্ণার সত্যবতীর আমলে শ্বশুর ঘরে যাওয়ার পূর্বে কন্যাকে কিন্তু অনেক সতর্ক করে দেওয়া হত যাতে মেয়েটি সভ্যতা, শালীনতার সীমা লঙ্ঘন না করে, গুরুজনদের মান্যি করে, সকলকে যত্নআত্যি করে; এখনকার যুগে সেই কন্যাটি কে সেই মত কোনো সতর্কীকরণ করাও হয়না তার প্রধান কারণ সে এখন সত্যবতীর মত অবলা বালিকা নয় । সে রীতিমত উচ্চ শিক্ষিতা ও সাবালিকা । তার নিজস্ব মতামতকেই আজীবন কাল তার বাড়ির লোকেরা প্রাধান্য দিয়ে এসেছে অতএব সে তো সেই সতর্কীকরণ বার্তা শুনতেও চাইবে না । তবে এর ব্যাতিক্রমও আছে ।

সে যুগের সুবর্ণলতার তার ঠকুমার গুরুদেবের আদেশে হঠাত বিবাহ স্থির করা , সুবর্ণলতার সংসারে তার দুই দেবরের অমানবিক আচরণ এবং সুবর্ণলতার স্বামীর পুরুষ সিংহের কোনোরকম বিকাশ লক্ষ্য না করে ভেবেছিলাম পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের ক্ষমতার এহেন অপব্যবহার যেন আমাদের যুগে না হয় কিন্তু হায় রে বিধাতা এখনো পুরুষ বোধ হয় পুরোপুরি পুরুষ হননি । এ যুগেও অনেক পুরুষদ্বারা আজকের সুবর্ণলতারা লাঞ্ছিত হন সামান্য কারণে যেমন ধরুণ পণপ্রথা মেনে নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে যান বরবেশে আর পণের অঙ্কটি মন:পুত না হলে কনের "দেবর" রূপী বন্ধুটি কিন্তু অমানবিক আচরণ করতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হন না । ঈশ্বরের স্বপ্নাদেশের মত মিথ্যের অজুহাতে সে যুগের শাশুড়িমাটি বন্ধুর প্ররোচনায় ছেলেকে নিজের কাছে শুতে বলে কারণ বৌয়ের সাথে এক সঙ্গে শুলে নাকি ছেলের অকল্যাণ হবে । এ যুগেও ধর্মের নামে ভুচুংভাচুং দিয়ে আধুনিকা শাশুড়িরা এরূপ মিথ্যার আশ্রয় নেন কিনা সে ঘটনা আমার জানা নেই তবে প্রাকবৈবাহিক ঘনিষ্ঠতাও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আপত্তিজনক হয় তার কারণ একটাই তারা একত্রে থাকলে তাদের বন্ধন যদি আরো সুদৃঢ় হয়ে যায় !

মনে হয় সমাজের পরিকাঠামো বদলানো প্রয়োজন । আমেরিকার অগ্রসর-সমাজ কত যুগ আগে যা অনুধাবন করেছিল তাদের সমাজচেতনার মাধ্যমে;আমাদের দেশে সেই গঠনের বোধ হয় একান্ত প্রয়োজন তাতে রক্ষা পাবে উভয় পক্ষ । ভাঙবে না সংসার । মা-বৌ এই টানাপোড়েনের হাত থেকে বাঁচবে অবলা সেই পুরুষপ্রাণীটি । যাকে সহ্য করতে হবে না বৌয়ের কাছ থেকে অহেতুক গালমন্দ, "কাপুরুষ", "মেরুদন্ডহীন" এই সব বিশেষণ আর মায়ের কাছ থেকেও শুনতে হবে না "বৌয়ের আঁচল ধরা", "ভেড়ো", "স্ত্রৈণ" এহেন কটুক্তি।

আমার কাছে মেয়েদের মনকে "গ্লাস ইনসাইড, হ্যান্ডল উইথ কেয়ার" এই রূপ ভাবে প্রতিপালন করা উচিত । মেয়েটি যখন স্কুল যাচ্ছে তখন থেকে শুরু করে সে যখন শাশুড়ি মা তে পদার্পণ করেছে, তখন পর্যন্ত এবং তারপর সেই মা'টি যখন একাকী কালাতিবাহিত করছেন অর্থাত বৈধব্যের স্বীকার হয়েছেন । আর প্রয়োজন ঘরোয়া কাউন্সেলিং অর্থাত সংসারের প্রতিটি সদস্যের সামনে বসে একটা মিমাংসা বা সমাধানের সূত্র খোঁজা । নয়ত "বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনীর" ন্যায় চলতে থাকবে উভয় পক্ষের কোঁদল আর কখনো কখনো যার পরিণতি ঘটবে ডিভোর্সের ডিসিশনে । মেয়েটি যখন সাবালিকা তখন তার নিজস্ব মতামত , তার চিন্তাধারাকে সম্মান জানাতে হবে আবার বেচাল কিছু দেখলে তার বাবা-মাকেই শাসনের শাণিত অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে এবং তাও তাদের কন্যাটির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আর বিবাহের পরে পুত্রটিকে মায়ের পাশে থেকে বুদ্ধি করে মাকে ও শাসন করতে হবে যাতে যে তিনি যাতে তার প্রিয়তমা স্ত্রীরত্নটিকেও আঘাত না দেন তাহলে সব থেকে বেশী দুঃখ ছেলেটিই পাবে । তাকে নিতে হবে বিচারকের ভূমিকা । সে পিঠ বাঁচিয়ে চলবে মায়ের সামনে আর রাতের আঁধারে প্রেয়সী স্ত্রীটির বিরহে কাতর হবার ভান করবে তা যেন না হয় ।

এখনকার মেয়েরা যখন বধূরূপে বরণ হয়ে পা দেন শ্বশুর গৃহে তখন তাদের মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয় কারণ তারা তখন তো সেকালের সত্যবতী-সুবর্ণলতার মত কচি নন । আর তাই বলে নাবালিকা ঘরে আনাও তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর সবশেষে এখনকার সুবর্ণলতাদের বলি অন্যায় মেনে নিতে হবে না কিন্তু নিজের মাটি শক্ত করে শাশুড়িমাটিকেও একটু বোঝার চেষ্টা করে দেখুন না যাতে সাপ ও মরে লাঠিও না ভাঙে। আপনিও তো একদিন শাশুড়ি হবেন ।

আর সর্বকালের সকল এলোকেশী বা মুক্তোকেশী রূপিণি শাশুড়ি মায়েদের উদ্দেশ্যে বলি আপনারাও একটু ভেবে দেখুন না । ছেলেটি তো আপনার; তার অর্ধাঙ্গিনীকে একটু ভালবাসতে চেষ্টা করুন না । সেই মেয়েটি তো আপনার পরিবারেরই একজন, সে আপনার "মেয়ের মত" কেন ? মেয়ে হয়েই থাক না সে আপনার কাছে, পাক না একটু পক্ষপাতিত্ব । আপনারও ভুলে গেলে চলবেনা যে "আপ ভি কভি বহু থি" !
আজকের দিনেও মিডিয়া সোচ্চার প্রতি পলে পলে, দন্ডে দন্ডে । তাই বুঝি সেলিব্রিটিদের দিয়েও অবগুন্ঠনা বিয়ের কনেকে শৌচালয়ের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে দেখি আমরা। কিন্তু হায় আমার গ্রাম্যবধূ! তোমার শ্বশুরকুল তোমাকে ঘোমটা দিতেও বাধ্য করবে আবার খোলা স্থানে শৌচকর্ম‌ও করতে বলবে। আজকের সুবর্ণলতাদের কি সুদিন আসবেনা?  মদ্যা কথা তোমাকে অবদমিত করেই রাখবে তারা সেই মাত্সন্যায় যুগের মত অথবা কলেজের ragging period এর মত।  দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলছে ও চলবে। কিন্তু সুবর্ণলতারা যথেষ্ট সবলা আজ। তাই প্রতিবাদী মন নিয়ে এগিয়ে আসি আমরা। ঘরে ঘরে সব সুবর্ণরা স্বেচ্ছাচারিতা, স্বাধীনতার সীমারেখা আর IPC র 498Aর যথেচ্চাচার না করেই  সুবর্ণলতা হয়ে উঠুক.. আশাপূর্ণা দেবীর মৃত্যুদিনে আমাদের সমাজের কাছে এই হোক প্রথম প্রতিশ্রুতি। 




উত্তরবঙ্গ সংবাদ, শনিবার ১১ই জুলাই ২০১৫ 

১৭ এপ্রি, ২০১৫

বুড়ির ভোট, ভোট বুড়ির।


ব শেষ গো বাবু! সব শেষ! এতক্ষণে দুদন্ড শান্তি। ওদের চেঁচামেচি আর নিতে পারছিনা গো বাবু। আই-টি-ইউ থেকে আই-সি-ইউ এসেছি এবারে..বুড়ীটা হাউমাউ করে ডুকরে উঠল।
  • বললাম, কেন গো কি হল তোমার আবার? 
বুড়ী বলতে শুরু করল.. 
কত ডাক্তারবাবুর কত মত! কি ঝগড়া তাদের নিজেদের মধ্যি ! চীতকার, চেঁচামেচি সব শেষ। এবার কালকের রাত পুইলেই পরীক্ষ্যে! তারপর সব রিপোর্টগুলো আসতে শুরু করবে। একে একে জানতি পারবা আসল রোগ কোথায়। তখন বুঝেসুঝে আবার আমাকে আবার না আই-সি-ইউ থেকে  আই-সি-সি-ইউ তে ট্রান্সফার করে দেয়  । ততক্ষণ চলুক আমাগো গীতাপাঠ, চন্ডীপাঠ!

  • বললাম, খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে তুমি! 
বুড়ি বলল..
আমি যত না অসুস্থ ওরা আরো আমাকে রোগে কাবু করে দিতেছে।  জয় বজরংবলী! বাঁচিয়ে দাও এবারের মত। আর অনিয়ম করব না।  জয় মা দক্ষিণা কালী! বাঁচিয়ে দাও এবারের মত।  জয় নাস্তিকস্য মুনিঃ মাতা ! এবারটার মত আর আমাকে আই-সি-সি-ইউতে ট্রান্সফার কোরোনা। একে আমার দেনা গলা অবধি। তারপর আর আই-সি-সি-ইউর যা খরচ!  পারবোনি বাপু পারবোনি অত  ! একেই গুচ্চের টেষ্ট করাতে করাতে ফতুর । শরীলের কোনো অংশ বাদ নেই গো বাবু।
  • বললাম, দাঁড়াও , দাঁড়াও সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে আমার! কেন ভর্তি হলে হাসপাতালে? 
বুড়ি বলল.. 
ভর্তি? আমি তো হ‌ই নি বাবু। ওরাই তো জোর করে আমারে ভর্তি করিয়েই দিলে!  পাঁচবছর অন্তর অন্তর আমাকে নিয়ে বেকার টানাহ্যাঁচড়া। চামড়াটা ফুটিয়ে ফুটিয়ে শেষ। বলি তোমরা কি আমার নতুন চামড়া করে দিতি পারবা? তোমাদের না হয় হৃদয় বলে কিস্যু নেই। আমার হৃদয়টাতো গেল বাপু, তোমাদের ভালোবাসার চোটে! তোমরা এদ্দিনে বুঝতি পারলে? আমার মাথার অসুখটা কোনোকালে ছিলনা? অযথা মাথায় ফুটো করে, নল ঢুকিয়ে ব্যথা দিলে! এবার বলদিকিনি সত্যি করে, আমার রোগ সারাতে পারবে কিনা? আমার কিডনি দুটো পার্ফেক্ট ছিল। তোমরা বললে, পাথর হয়েচে। অপারেশন করে একটা কিডনি বাদ দিয়েই দিলে! জীবনে একটা বিড়ি-সিগারেট খাইনি। তোমরা টেষ্ট করে বললে ফুসফুসে কালো প্যাচ আমার। আমার নাকি  ফুসফুসে ক্যান্সার শুরু হয়েছে সবেমাত্র। দুটো কেমো দিয়ে দিলে!কেমো নিয়ে সে কি কষ্ট আমার! আমি যে আর ধকল নিতে পারছিনা বাবু!
  • বাপ্‌রে! এ কি অবস্থা তোমার! বলে উঠলাম 
বুড়ি বললে..
এবার বল তো আমাকে নিয়ে আর কত খেলবে? আমি জেনে গেছি গো বাবু, আমার এ রোগ সারার নয়। তোমরা কেউ পারবেনা আমাকে আগের মত সুস্থ করে দিতে। তাহলে? তাহলে কেন আমার ওপর এত অত্যাচার? মুক্তি দাও না আমায়! আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে এসি কেবিনে রেখে দিয়ে লোককে দেখাচ্ছো আমাকে তোমরা কত্ত ভালোবেসে চিকিতসে করাচ্ছো। এর শেষ কবে হবে বাবু? কবে হবে এই ছিনিমিনি খেলার শেষ?  আমি যে বড্ড অসুস্থ বাবু! আর নিতে পারছিনে তোমাদের এই লোক দেখানো আদিখ্যেতা!

বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের কোণা মুছতে লাগল। আমি হতভম্ভের মত চেয়েই র‌ইলাম ওর দিকে। আমি আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বুড়িকে বাঁচানোর ক্ষমতা নেই আমার মত একরত্তির।  বুড়ির আছে লোকবল। আমার আছে বুড়ি। কিন্তু আমারো তো দায় বুড়িকে বাঁচানোর। তবুও.... বুকের মধ্যে চাপ অনুভূত হল প্রচন্ড।
মনে হল বলি

"চলো তো বুড়িমা। হাসপাতালের বন্ডে স‌ই করে তোমাকে আজ ছাড়িয়ে নিয়ে যাই!" 

৭ এপ্রি, ২০১৫

সুচিত্রা সেন তোমাকে...



ই চিঠিখানা লিখে রেখেছিলাম অনেকদিন ধরে। ভেবেছিলাম রেখে আসব তোমার লেটার বক্সে। আমার বাড়ির খুব কাছেই ছিলে এদ্দিন কিন্তু সময় হয়নি। তাই আরো একটু মনের কথা লিখে পাঠিয়ে দিলাম শূন্যের মাঝে, শান্তির বুকে, যেখানে তুমি আছো এখন... c/oসেই ঠিকানায় ।

সত্যি বলতে কি জানো ? সিনেমার বড় একটা ভক্ত আমি ন‌ই। তবে বাংলা সিনেমাকে ভালোবাসতে শেখা উত্তম-সুচিত্রার হাত ধরে। মা জোর করে পড়ার ব‌ই, গল্পের ব‌ই আর অঙ্কের খাতা থেকে মুখটা ঘেঁটি ধরে খানিকটা ঘুরিয়ে দিতেন রোববারের দূরদর্শনের ইভনিং শোয়ে। আর মাঝেমধ্যেই টিকিট কেটে সেই বেকার হোমমেকারকে ম্যাটিনী শোয়ের কম্পানি দিতে দিতে চিনে গেলাম সেই সিনে আইডল, বাংলাছবির গ্রেটা গার্বোকে। মনে মনে তারিফও করলাম সেই অতি প্রচলিত "নাক মাটামাটা চোখ ভাসা, সেই মেয়ে খাসা " প্রবাদটির। আলগা চটক, লালিত্য, ব্যাক্তিত্ত্ব এই সব শব্দগুলো সদ্য যৌবনা আমার জীবনের ধারাপাতে তখনো অধরা জানো? শিখতে লাগলাম।

মা-মাসীরা নাকি রফ্ত করত তোমার চলন-বলন, কথা বলার সময় কম্বুকন্ঠীর সূক্ষকৌণিক গ্রীবা হেলন আর সর্বোপরি তোমার গুরুগম্ভীর চাহনি। আমার এক মাসী ছিল জানো? তিনি তো আজীবন তোমার মত রামগড়ুরের ছানা হয়েই থেকে গেল। আমৃত্যু হাসলোনা একটুও! এই ছদ্ম গাম্ভীর্য্য নাকি রূপের একটা আলাদা মাত্রা এনে দেয়। তুমি কি সেই কারণে অত্ত গম্ভীর থেকেছ আজীবন? এখন মনে হয় আরেকটু চটুল তুমি হলেও হতে পারতে ! দা ভিন্সির মোনালিসার মত এক টুসকি হাসিও দেখতে পেলামনা আমরা । জাস্ট ভাবা যায়না! তুমি হাসছ তাও বিনিপয়সায়? মানে এমনি এমনি! এটাই বোধহয় জাদুকাঠি বা ট্রাম্পকার্ড যা ছিল তোমার হাতে। কি ঠিক বললাম তো? রহস্যময়ীর রসিকতা আবার পছন্দ হবেনা হয়ত! প্লিজ, রাগ কোরোনা। আমি কিন্তু মস্ত ফ্যান তোমার! শুধু একটু যদি বাইরে আসতে। ধরা দিতে! পথে হল দেরীর সেই সূক্ষ্ম, সি-থ্রু ডেক্রণ শাড়ি আর সাথে এয়ারহোষ্টেস ব্লাউজ! আমরাতো পলিমারের যুগের মানুষ! সে সময়ের ডেক্রণ আর এসময়ের পলিয়েষ্টারে আকাশ পাতাল ফারাক। মায়েরা সকলে কিনে ফেলল নিউমার্কেটে গিয়ে। বানিয়ে ফেলল তোমার স্টাইলে ব্লাউজ! আমি সেই ব্লাউজ টেঁকে নিয়ে কলেজ কেটে রূপবাণীতে "পথে হল দেরী" দেখতে বন্ধুদের সাথে! সাগরিকার বোট-নেক ব্লাউজ? আর দীপ জ্বেলে যাই ছবির শাড়ির পাড়-আঁচলে ছিটকাপড়ের প্যাচ ওয়ার্ক আর ম্যাচিং ব্লাউজ ? এখনকার নায়িকারা তোমাকে নকল করছে ভাবলেও সুখ হয় । ভাবো তোমার ব্র্যান্ড!

পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ায় আগুণ জ্বালিয়ে দিলে তুমি সেই ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত ! কিন্তু ঐ পর্দার আড়ালেই। ফোটোগ্রাফের সেই মুখ মানুষ সামনাসামনি দেখবে বলে কত কসরত করল! তবুও তুমি সামনে এলেনা একটিবার। তোমার জীবন রসায়ন আজো অধরাই থেকে গেল তোমার হার্টথ্রবদের কাছে । কিন্তু তা তো হবার ছিলনা । সিলভার স্ক্রিনের সাক্ষ্য ও অলক্ষ্যের তুমিকে তো পাওয়া হলনা আমাদের!

আমি তখন ক্লাস এইট । দত্তা দেখেছিলাম। মোর বীণা ওঠে কোন্‌ সুরে বাজি গানের সাথে পর্দা উড়ছিল আর মধ্যে দিয়ে ঢেউ তুলে হেঁটে চলেছিলে তুমি লিপ দিতে দিতে। অত রাবিন্দ্রিক আর কারোকে মনে হয়নি । আমাদের স্কুলের অফ পিরিয়ড তখন ভরপুর সেই চাল-চলন নকলের মধ্যে দিয়ে। আমরা গাইছি, হাসছি ঠোঁটদুটো একটুকু ফাঁক করে আর কল্পনার রাজ্যে ভেসে ভেসে প্রত্যেকে সেই মহানায়িকার আসনে নিজেকে বসিয়ে চলেছি। তারপর দেবীচৌধুরাণী। দৃপ্ততা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার সেই রূপ, আর আমাদের মুগ্ধতা।

আমার শাশুড়িমায়ের মুখে শুনেছিলাম, "হারাণো সুর দেখতে দেখতে ওনার লেবার পেন উঠেছিল। উনি সেই আসি আর যাই যন্ত্রণা চেপে রেখেও গুণগুণিয়ে উঠেছিলেন "তুমি যে আমার" এর সাথে। বসুশ্রী সিনেমা হল থেকে সোজা শিশুমঙ্গলে ভর্তি হয়েছিলেন সেরাতে। পুরোটা সিনেমার কিছু বাকী ছিল। তারপর সেযাত্রায় খালাস হওয়ার পর সদ্যপ্রসূতির সন্তান বাত্সল্য উথলে উঠবে কি তার তখন কি মনখারাপ হারাণো সুর শেষ হয়নি বলে। সেদিন তুমি চলে যাবার পর আবারো দেখলেন হারাণো সুর আর গল্প বলছিলেন তারিয়ে তারিয়ে।

আমার মায়ের মুখে শুনেছি আরেক গল্প। দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দিরের পাশেই মামার বাড়ি ছিল আমার। মায়েদের বন্ধুরা খুব সিনেমা দেখত হলে গিয়ে কিন্তু বাড়ির রক্ষণশীলতাকে ফাঁকি দিয়ে মায়েদের মাট্যিনি বায়োস্কোপ সেই অর্থে ব্রাত্য। এদিকে বন্ধুবান্ধবরা গল্প বলে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখে এসে, ফ্যাক্টস এন্ড ফিগার্স তাদের নখদর্পণে কিন্তু মায়েরা চার বোন যেন লজ্জায় সেই কথোপকথনে অংশ নিতে পারেনা। দিদিমার মাধ্যমে দাদুর কানে তুলতে লাগল কানাঘুষো। দক্ষিণেশ্বর থেকে বরানগরে সিনেমা দেখতে যাওয়া মনে বিগ প্রজেক্ট। এদিকে উত্তম-সুচিত্রা জুটি কাঁপিয়ে তুলছে বাংলার আকাশ বাতাস! সিনেমা আসে, সিনেমা চলে যায়। কখনো কোনো হলে চলতেই থাকে গৌরবময় দশ-বারো-কুড়ি সপ্তাহ। দাদুও বুঝতে পারেন যে আর মেয়েদের আটকে লাভ নেই । সকলেই এখন মুক্ত ! হঠাত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে আসে। সিনেমাহলের পাসপোর্ট পেয়ে মায়েদের কপালে সুপারডুপার হিট অগ্নিপরীক্ষার টিকিট আসে দাদুর মারফত, ড্রাইভারের হাতে করে। মায়েরা তো আহ্লাদে ন'খানা ! থুড়ি! নয়জনা...তুতো বোনেদের ফোন করে আনিয়ে সকলের কানে কানে তখন গানে মোর ইন্দ্রধনু !

তারপর একে একে সাড়ে চুয়াত্তর, সবার উপরে, গৃহপ্রবেশ, দীপ জ্বেলে যাই, সাগরিকা । রেডিওতে অনুরোধের আসরে ফিল্মিগানের নোটেশন অব্যাহত থাকে।

মা সেবার ফার্স্ট ইয়ার। গরমের ছুটির ভোরবেলায় দাদু দক্ষিণেশ্বর গঙ্গায় স্নান করে এসে মায়েদের সংবাদ দিলেন

" কালীমন্দির চত্বরে তিল ধারণের জায়গা নেই, তোদের সুচিত্রা সেন এসেছে বিকাশ রায়ের সাথে কি যেন এক বাংলাছবির শুটিং চলছে সেখানে"

মায়েরা একপ্রকার নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে একছুটে মন্দিরে। গিয়ে শোনে উত্তর ফাল্গুনীর শুটিং চলছে। বিদেশ থেকে তখন সদ্য ফিরেছেন সুচিত্রা, সাত পাকে বাঁধার জন্য পুরষ্কৃত হয়ে। তাই খুব ভীড়। কালীমন্দিরের সিঁড়ির সামনে বিকাশ রায় ও তিনি তখন পুজো দিয়ে নেমে আসছেন মায়ের চোখের সামনে । দুহাত দূরে তিনি। কিন্তু ঐ মুখে একটুও হাসি নেই। সেই ছদ্ম গাম্ভীর্য ভরা সুখ চোখে মুখে আর উপছে পড়া ব্যাক্তিত্ত্ব গড়িয়ে পড়ছে সারা শরীর দিয়ে । তবে তাঁর মুখে হাসি থাক আর না থাক মায়েরা তো ফিদা সেই অর্থে!

এমন ফিল্মি নবজাগরণ তুমিই আনতে সক্ষম হয়েছিলে। কনসার্ভেটিজমের লক্ষণরেখা ডিঙিয়ে মধ্যবিত্ত যুবতীদের মনে সেই আঁধি আনলে ! কিন্তু সব ছিল ভালো যদি শেষটুকুনি আরো ভালো হত। সেযুগের আরো এক মহানায়িকা ঊমাশশী বা থিয়েটারমঞ্চ কাঁপানো নটী বিনোদিনীর মত সেই যে আড়ালে চলে গেলে অর এলেনাকো! কেউ বলল, তোমার নাকি আধ্যাত্মিক চেতনা এসেছে। কেউ বলল, তুমি সংসার জগতের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছ। কেউ আবার বলল তোমার শেষ ছবি প্রণয়পাশার বিফলতা তোমাকে হতাশ করেছে বলে তুমি আর ফিরতে পারলেনা। তদ্দিনে উত্তম-সুচিত্রা জুটি ভেঙে খান খান। তাই চলচিত্র জগতের ওপর বীতরাগ । তাই বলে যে দর্শক তোমাকে এত দিল তাদের জন্য একটি বার সাড়া দিলেনা তুমি! এ তোমার কেমন মহান আদর্শ! তুমি কি এমনি মহতী? জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে চলে বিলীন হয়েছ চিতার আগুণে । আত্মা অবিনশ্বর তাই তুমিও সর্বভূতে বিলীন হলে ঠিক‌ই কিন্তু আমার চোখে বহুদিন আগেই তুমি নিরালম্ব, নিরাশ্রয় আত্মার মত সেই কিংবদন্তী রূপসী হয়ে র‌ইলে । তোমার চলার পথ যদি এভাবে না শেষ হত!

আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার জীবনের সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়. সূর্য ডোবার পালা যদি আরো অন্যরকমভাবে আসত !

তুমি না হয় রহিতে কাছে, কিছুক্ষণ আরো না হয় রহিতে কাছে !

ইতি

...

২৮ মার্চ, ২০১৫

রামায়ণ না কি সীতায়ণ ???


চৈত্রমাস নাকি মধুমাস। কারণ রামায়ণের হিরো রামের জন্মমাস।আজ শুক্লা চৈত্রনবমীতে রামচন্দ্রের জন্মদিন? যে মানুষটা গণতান্ত্রিক স্বার্থে বৌকে ত্যাগ দিয়েছিল ? রাবণের ঘরে সীতার দিনযাপনকে কলঙ্কিত করে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছিল তার জন্য ঘটা করে জন্মদিন? মানতে বড় কষ্ট হয়। আদর্শবান পুরুষচরিত্র হয়েও সীতার দুঃখ বুঝতে পারেনি সে হেন পুরুষনায়কের জন্য ছেলের মায়েরা রামনবমীর উপবাস করেন। ভাবতে কষ্ট হয়। মনে মনে বলি, রামের চৈত্রমাস, সীতার সর্বনাশ।
কৈ সীতার আত্মত্যাগের জন্য কেউ তো সীতার জন্মদিন পালন করেনা? রামকে নিয়ে কত ভজন গান হয়। কিন্তু সীতার জন্য ক'জন ভজন গান? এমনকি "পঞ্চকন্যা"... অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরীর সাথে এক আসনেও সীতা স্মরেণ্যা ও বরেণ্যা নন। রাম নাকি দ্বাপরে কৃষ্ণের অবতার। তাই তার সাতখুন মাপ? এই রাম রাবণকে যুদ্ধে হারিয়ে বধ করবে বলে ধনুকভাঙা পণ করেছিল। মা দুর্গার স্তব করেছিল। আর শরতকালে দুর্গাপুজো করবে বলে দেবতাদের ঘুম পর্যন্ত ভাঙিয়েছিল অকালবোধন করে। রাম ঘরের সম্মান রাখতে পারলনা অথচ নিজের স্বার্থে দুর্গা নামে আরেক শক্তিশালী নারীর পুজো করতেও পিছপা হলনা!
হায়রে! হিপোক্রেসি ভারতের ধর্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজের প্রয়োজনে এক নারীর পায়ে একশো আট পদ্ম দিয়ে পুজো হল অথচ রাবণ বধ করে সীতাকে লাভ করে অন্যের কথায় বৌকে ত্যাগ দিল! সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে বাল্মীকির আশ্রমে পাঠাতে যার একটুও বুক কাঁপলনা !

এ হেন রামের অয়ন অর্থাত গমন পথকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছিল আমাদের মহাকাব্য রামায়ণ। কিন্তু সীতার পাতাল প্রবেশ কিম্বা অগ্নিপরীক্ষা কি তাকে মনে রাখেনা? সীতা মাটির কন্যা আবার মাটিতেই মিশে গেছিলেন। তাই সীতায়ণ (কবি মল্লিকা সেনগুপ্তর দেওয়া এই নাম, আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করে মনে মনে বলি) বা সীতার গমন পথও তো হতে পারত এই মহাকাব্যের নাম।
 মাটির কন্যা সীতা লাঙ্গলের ফলা বা "সীত" থেকে উঠে এসেছিলেন। আবার অত্যাচারে, লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হয়ে বসুন্ধরার কোলেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই  নিজের জীবনচক্র তো নিজেই সমাপ্ত করলেন। তাই সীতার গমন পথ নিয়ে নতুন রামায়ণ লিখলে হয়না??? রাম কে এত প্যাম্পার করে, আদর্শের মুন্ডপাত করে হোক না সীতায়ণ!!!  

৪ মার্চ, ২০১৫

বাসন্তী ধৌতিকরণ ও দোল

গোর দ্বন্দ। কিসের ইগো?  বাপ্-বেটার ইগো। কেন ইগো? এ হল ধর্মান্ধতার ইগো।   বাপ হলেন স্বৈরাচারী দৈত্য রাজা হিরণ্যকশিপু আর ব্যাটা হল বিষ্ণুর আশীর্বাদ ধন্য প্রহ্লাদ। আর বাপ হলেন গিয়ে anti-বিষ্ণু।  বাপ রাজা তাই can do no wrong। ব্যাটা ঠিক উল্টো। বিষ্ণুর সমর্থক, বিষ্ণু অন্ত প্রাণ।
 কশ্যপমুনির স্ত্রী দিতির দুই পুত্র। দৈত্য হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সমগ্র দেবকুল তখন সন্ত্রস্ত  । বিষ্ণু বধ করলেন হিরণ্যাক্ষকে।  এবার হিরণ্যকশিপু ভ্রাতৃহন্তা বিষ্ণুর ওপর প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠল। মন্দার পর্বতে কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার বর পেল সে। দেব, দৈত্য, দানব কেউ তাকে বধ করতে পারবেনা। এইবার খেলার শুরু। 

  শুরু হল একুশে আইন। হিরণ্যকশিপুর আপন দেশে বলবত্‌ হল নয়া আইন। কেউ বিষ্ণুপুজো করতে পারবেনা। এদিকে তার ছেলেই তো পরম বৈষ্ণব। তাহলে? তাহলে আর কি মার ডালো। আবার যে কেউ মারতে পারবেনা তার ছেলে প্রহ্লাদকে। রাজ্যের সব বিষ্ণুভক্তকে তিনি শূলে চড়িয়ে মৃতুদন্ড দিয়েছেন। কিন্তু ছেলের বেলায় কি করবেন? বুদ্ধি খাটালেন বাপ। সুইসাইড বম্বার চাই তাঁর। কে হবে সেই আত্মঘাতী ঘাতক যে কিনা নিমেষে শেষ করবে তার পুত্রকে? বাপের দুষ্টু পাজী এক বোন ছিল। তার নাম হোলিকা। যুগে যুগে যেমন থাকে আর কি! সংসারে ভাঙন ধরায় তারা, দুষ্টু বুদ্ধিতে ছারখার করে ভাইয়ের  সংসার। হোলিকার কাছে ছিল এক মায়া-চাদর।  

 
তৈরি হল বিশেষ ঘর। সেই ঘরে হোলিকা প্রবেশ করল প্রহ্লাদকে নিয়ে।  হোলিকা ভাইপো প্রহ্লাদকে তার কোলে নিয়ে  বসবে। আগুণ জ্বালানো হবে এমন করে যাতে ঐ মায়া চাদর হোলিকাকে রক্ষা করবে আর প্রহ্লাদের গায়ে আগুণ লেগে সে পুড়ে মরে যাবে। কৌশল, ছলনা সবকিছুর মুখে ছাই দিয়ে মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে এল।  অগ্নি সংযোগ হল । মায়া চাদর হোলিকার গা থেকে উড়ে গিয়ে নিমেষের মধ্যে প্রহ্লাদকে জাপটে ধরল। হোলিকা পুড়ে ছাই হল আর প্রহ্লাদ তখনো অক্ষত। 

হোলিকা দহনের সময় আখের গায়ে সপ্তধান্য বা ধান, গম, যব, ছোলা এমন সাতরকম শস্যের গাছ বেঁধে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়। প্রহ্লাদকে রক্ষা করেছিলেন বলে অগ্নিদেবকে এই শস্যদান।  
পুরাণের এই হোলিকা দহন বা আমাদের আজকের ন্যাড়াপোড়া বা বুড়ির ঘর জ্বালানোর কারণ হল অশুভ শক্তির বিনাশ আর পরেরদিনে দোল উত্সবে আনন্দ সকলের সাথে ভাগ করে নিয়ে শুভ শক্তিকে বরণ করা। অথবা যদি ভাবি বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে? বছরের শেষে  পুরণো স্মৃতি, জীর্ণ, দীর্ণ সবকিছুকে জ্বালিয়ে দিয়ে নতুন বছরকে সানন্দে বরণ করার আগাম তোড়জোড়? কিম্বা বসন্তে ঋতু পরিবর্তনে রোগের বাড়াবাড়িকে নির্মূল করতে এই দহনক্রিয়া??? আর সামাজিক কারণ হিসেবে শীতের শুষ্ক, পাতাঝরা প্রাকৃতিক বাতাবরণকে পুড়িয়ে সাফ করে কিছুটা  বাসন্তী ধৌতিকরণ। যাকে আমরা বলে থাকি  spring cleaning। সে যাইহোক দোল পূর্ণিমার আগের রাতে খেজুরপাতা, সুপুরীপাতা আর শুকনোগাছের ডালপালা জ্বালিয়ে আগুণের চারপাশে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের মহা উত্সাহে নৃত্য  করে করে গান গাওয়াটাই যেন আরো সামাজিক।
"আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরিবোল"
এবার সেই হরিবোলের সূত্র ধরে মনে পড়ে যায় মথুরা-বৃন্দাবন সহ ভারতের সর্বত্র দোলের পরদিন হোলি উত্সবের কথা। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা আর রং খেলার আনন্দে সব কালিমা , বৈরিতা মুছিয়ে দেওয়া আর বার্ষিক এই উত্সবের আনন্দ সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়া। বাংলার দোলযাত্রা আরো একটি কারণে বিখ্যাত । নবদ্বীপে দোলপূর্ণিমার দিনে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বা শ্রীচৈতন্যদেব। তাই এই পূর্ণিমার অপর নাম চৈতন্যপূর্ণিমা। বাংলার ৮৯১ সনে, ১৪০৭ শকাব্দে ও ১৪৮৫ খ্রীষ্টাব্দে এই ফাল্গুনী পূর্ণিমায় নবদ্বীপের জগন্নাথ মিশ্রের স্ত্রী শচীদেবীর কোল আলো করে এসেছিলেন তিনি  । একটি প্রাচীন নিমগাছের নীচে জন্ম হল তাই নাম রাখা হল নিমাই। আবার গৌরকান্তির জন্য কেউ নাম দিল গৌরাঙ্গ। জগন্নাথ ডাকলেন বিশ্বম্ভর ও আত্মীয়েরা ডাকলেন গৌরহরি। এ যেন দুর্জনদের হাত থেকে সমাজকে বাঁচানোর তাগিদে কলিযুগের মাটিতে অবতার হয়ে জন্ম নেওয়া শ্রীকৃষ্ণের।  তাই নবদ্বীপে এই দোলযাত্রা আজো মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়।   

১৩ ফেব, ২০১৫

ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে




সুলতান লিখতেন কবিতা । রাণী গাইতেন গান । কবিতা আর গানের মধ্যে দিয়ে ভালোবাসার এক গল্প শুনতে মধ্যপ্রদেশের মান্ডু যাওয়া আমাদের । এখনো মধ্যপ্রদেশের মালওয়ার চারণকবিরা গেয়ে থাকেন কবি এবং রাজপুত্র বাজ বাহাদুর আর তার হিন্দুরাণী রূপমতীর প্রণয় গাথা ।




হোসং শাহের আমলে মান্ডু তার অর্থ, প্রতিপত্তি এবং ঐশ্বর্যে খ্যাতি লাভ করে । অনেক হাত বদলের পর ১৫৫৪ সালে বাজ বাহাদুর ক্ষমতায় আসেন । বাজ বাহাদুর ছিলেন মান্ডুর শেষ স্বাধীন সুলতান । সঙ্গীতের প্রতি তার ছিল অকুন্ঠ ভালবাসা । কুমারী রূপমতী ছিল এক অতি সাধারণ হিন্দু রাজপুত ঘরের অসাধারণ রূপসী তনয়া । তার গলার স্বরে ছিল এক অনবদ্য মিষ্টতা যা আকৃষ্ট করেছিল বাজ বাহাদুরকে । একদিন শিকারে বেরিয়েছিলেন বাজবাহাদুর । বাগাল, রাখাল বন্ধুদের সাথে রূপমতী গান গেয়ে খেলে বেড়াচ্ছিলেন সেই বনে । সুলতান তাকে দেখে তার সাথে রাজপুরীতে যেতে বললেন এবং তাকে বিয়ে করবেন জানালেন । রূপমতী একটি ছোট্ট শর্তে সুলতানের রাজধানী মান্ডু যেতে রাজী হলেন । রূপমতী রাজার প্রাসাদ থেকে কেবলমাত্র নর্মদা নদীকে দর্শন জানাবার বাসনা জানালেন । বাজ বাহাদুর সম্মত হলেন । সুলতান তার হবু বেগম রূপমতীর জন্য পাহাড়ের ওপরে বানালেন এক ঐশ্বরীয় রাজপ্রাসাদ যার নাম রূপমতী প্যাভিলিয়ন এবং যার ওপর থেকে রূপোলী সূতোর এক চিলতে নর্মদাকে রোজ দর্শন করে রাণী তবে জলস্পর্শ করতেন । নর্মদা ঐ পথে এঁকে বেঁকে পশ্চিম অভিমুখে আরবসাগরে গিয়ে পড়েছে । রাণীর জন্য তৈরী হল পুণ্যতোয়া নর্মদার জলে রেওয়া কুন্ড । হিন্দু এবং মুসলিম উভয় রীতি মেনে বিবাহ সম্পন্ন হল তাদের কিন্তু পরিণতি সুখকর হলনা । মোঘল সম্রাট আকবর দিল্লী থেকে অধম খানকে মান্ডুতে পাঠালেন শুধুমাত্র মান্ডু দখল করতেই নয় রূপমতীকে ছিনিয়ে আনতে । বাজ বাহাদুরের ছোট্ট সেনাবাহিনী পারবে কেন সম্রাট আকবরের সেনাদের সাথে ? বাজ বাহাদুর ভয়ে চিতোরগড়ে পালিয়ে গেলেন রাণীকে একা ফেলে রেখে । রূপমতী সেই খবর পেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন । কবিতা আর গানের মধ্যে দিয়ে ভালোবাসার এক রূপকথার ভয়ানক পরিসমাপ্তি ঘটল । এখনো রূপমতী প্যাভিলিয়নে হয়ত বা ঘুরে বেড়ায় রূপমতীর অতৃপ্ত আত্মা । চুপকথার চিলেকোঠায় চামচিকেরা আজো শুনতে পায় তার পায়ের নূপুরের শব্দ । দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয় একটাই শব্দ যার নাম মেহবুবা । এখনো রাজপ্রাসাদের মধ্যে সেই ক্যানাল দিয়ে কলকল করে জল বয়ে চলেছে অবিরত । নর্মদাও রয়ে গেছে আগের মত শুধু রূপমতীই পারলেন না এই মহল ভোগ করতে । বাজ বাহাদুর রেওয়া কুন্ড নামে একটি জলাধার বানিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়তমা পত্নী রূপমতীর জন্য । বাজবাহাদুরের প্রাসাদ এবং রূপমতী প্যাভিলিয়ন এর আফগান স্থাপত্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। 
 

মান্ডু দেখা শেষ হল কিন্তু গাইডের বলা রূপমতী আর বাজ বাহাদুরের প্রেমের গল্প লেগে রয়ে গেল কানে । কিছুটা প্রতিধ্বনি, কিছুটা উদ্বায়ী আবেগ, কিছুটা এলোমেলো চিন্তার জটে সেই কাহিনী হোটেলে ফিরে এসে লিপিবদ্ধ করলাম ।