১৭ নভে, ২০১৭

ঘুম গেছিলাম গত দীপাবলিতে। প্রত্যন্ত চা বাগান তামসাং  টি-রিট্রিটের বাঙালি ম্যানেজার এই ধানী লঙ্কার দানা দিয়েছিলেন। এদ্দিনে সেই লঙ্কা আমার যত্নে। প্রথমে গাছের তেজ দেখে মালুম হয়নি।  এখন বুঝছি ভরা পোয়াতির কি তেজ! বিয়োতে না বিয়োতেই দাপট! দিদা বলত, " যেমন তেমন মেয়ে বিয়োব, বয়েস কালে তেজ দেখাব"

 প্রচন্ড ঝাল আর ঝাঁজ এই লঙ্কায়।তবে একে ধানী বলেনা পরে জেনেছি।  ঠিক বাঙালী মেয়ের মত। রূপে না গুণে ভোলায়, মিছরির ছুরিতে নয় শুধুই গন্ধে, ঝালের মাত্রা ছাড়িয়ে কাজ সারে।
বেশী ফলে না। জৈব সারের মাহাত্ম্য। গোবর,  খোল ভেজানো জল, মাছ ধোয়া জল আর বাকীটা অমিতাভ বচ্চনের অমৃত বচন যারর নাম বিজ্ঞাপন।  অল্প খাব, প্রতি রান্নাপিছু একটি লঙ্কাতেই মাত। অরগ্যানিক লঙ্কা বলে কথা। দুষ্প্রাপ্য।

১৪ নভে, ২০১৭

নবান্নে হেমন্ত লক্ষ্মী আর কুলুই চণ্ডী কি এক?


এইসময় ১৩ই নভেম্বর ২০১৭
বর্ধমান কে বলে Granary of Bengal অর্থাত বংলার শস্যভান্ডার। অঘ্রাণে ধানকাটা আর মাড়াই শেষ।চাষীর উঠোন ভরে গেছে সোনার ফসলে। নতুন ধানের গন্ধে ম ম করা গ্রাম। মৌসুমীর আনুকুল্যে বাম্পার ফলন। কৃষক পরিবারে আনন্দের বন্যা। আর তাই আমন ধান ওঠার সময় এখানে নবান্ন উত্সব বা হেমন্ত লক্ষ্মীর আরাধনায় মহাধূম। 
গ্রামবাসীরা খেতের সদ্য ওঠা নতুন আতপ চাল, এক টুকুরো সোনা, একটুকুরো রুপো, একটি ধাতব রেকাবির মধ্যে রেখে লক্ষ্মীকে নিবেদন করেন আর বলেন

“নতুন বাঁধি, পুরনো খাই, তাই খেতে খেতে যেন জন্ম যাই
নতুন বস্ত্র পুরনো অন্ন, তাই খাই যেন জন্ম জন্ম”

উৎসবমুখর বাঙালীর প্রিয় পার্বণ এই নবান্ন। নতুন অন্নের এই উৎসবে মেতে ওঠার আরেক অর্থ হল মা লক্ষ্মীর প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন।
বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দিরে সর্বকালের ঐতিহ্য পরম্পরা মেনে অনুষ্ঠিত হয় নবান্ন উৎসব। দেবী দুর্গার আর এক রূপ অন্নপূর্ণা।তাই এখানে মা  অন্নপূর্ণাকে নতুন অন্নের রাজকীয় ভোগ নিবেদন করে তবেই ভক্তরা নতুন অন্ন গ্রহন করেন। কেউ আবার তাদের আরাধ্য দেবদেবী, পিতৃ পুরুষ কে নিবেদন করে তবেই নতুন অন্ন গ্রহণ করেন।
আরেকটি লৌকিক প্রথা হল কাক কে নতুন চালের খদ্যদ্রব্য নিবেদন করা। যাতে কাকের মাধ্যমে সে অন্ন পূর্বপুরুষের নিকট পৌঁছে যায়।এর নাম "কাকবলী' । 
অঘ্রাণের নতুন চাল, মটরশুঁটি, মূলো, কমলালেবু আর খেজুরের গুড়ের পাটালী দিয়ে মা ঠাকুরঘরে "নতুন" দিতেন। দুধের মধ্যে সব নতুন জিনিস দিয়ে পাথরের বাটিতে ঠাকুরকে নিবেদন করা আর কি! আর পুজোর পর সেই প্রসাদের কি অপূর্ব স্বাদ! তখন মনে হত, 
আহা শীতকাল, থাক্‌না আমার ঘরে। বারেবারে ফিরে আসুক নবান্ন, ঠিক এমনি করে । 

অঘ্রাণের শুক্লপক্ষে "বড়িহাত' থাকে বাংলার ঘরে ঘরে ।  নতুন বিউলির ডাল ভিজিয়ে রেখে শীলে বেটে নিয়ে তার মধ্যে চালকুমড়ো কুরে দিয়ে, হিং, মৌরী সব মিশিয়ে  স্না সেরে অঘ্রাণের রোদে পিঠ দিয়ে মেয়েরা বড়ি দেয় । একটি বড় কুলোর ওপরে পাতলা পরিষ্কার কাপড় বিছিয়ে সুচারু হস্তে এই বড়ি হাত অর্থাত বড়ি দেওয়ার রীতি অনেকেরি আছে। ঝোলে খাবার বড় বড়ি, ছোট্ট ছোট্ট ভাজাবড়ি এসব আজকাল স্মৃতি। আমরা দোকান থেকে কিনে খাই। আর ডালের সাথে পরিবেশিত হওয়া এই ভাজাবড়ির অন্যতম অঙ্গ ছিল কালোজিরে আর পোস্ত। কেনা বড়িতে পাইনা তেমন আর। এই বড়িহাতের দিন দুটি বড় বড়ি গড়ে তাদের বুড়ো বুড়ি করা হত। বুড়ি-বড়িটির মাথায় সিঁদুর আর দুজনের মাথাতেই ধানদুব্বো দিয়ে, পাঁচ এয়োস্ত্রীর হাতে পান, কপালে সিঁদুর ছুঁইয়ে, শাঁখ বাজিয়ে তাদের রোদে দেওয়া হত। একে বলে বড়ির বুড়োবুড়ির  বিয়ে দেওয়া।
এছাড়াও অঘ্রাণ মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে মেয়েরা কুলুই চন্ডীর ব্রত করে । বহুযুগ আগে এক ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী এই ব্রত করত।তাদের মেয়ে পুজোর যোগাড়  দিত ।এই পুজোয় ঘটে জোড়া কলা রাখার নিয়ম। মেয়ে একবার জোড়াকলাটি লোভ করে খেয়ে নিল । কিছুদিনের মধ্যে তার গর্ভে এল যমজ সন্তান । কুমারী মেয়ের গর্ভধারণে কুলের সম্মান রক্ষার্থে ও লোকলজ্জার ভয়ে তার বাবা মা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল । মেয়েটি বনের মধ্যে কাঠকুটো দিয়ে পাতার ঘর বানিয়ে বাস করতে লাগল । নির্ধারিত সময়ে তার দুই যমজ পুত্র হল । নাম রাখল আকুলি ও সুকুলি । বড় হয়ে তারা নদীর ধারে খেলা করছে মস্ত এক সওদাগর ধনরত্ন বোঝাই নৌকা নিয়ে তাদের সামনে আসতেই আকুলি ও সুকুলি বলল "তোমার নৌকায় কি আছে? আমাদের একটু দেবে? '
সওদাগর বলল "কেবল গাছপালা আছে বাবা, আর কিচ্ছু নেই'
ছেলে দুটি বলল "বেশ, তবে তাই হোক'
সাথে সাথে সওদাগর গিয়ে দেখে নৌকায় সত্যি সত্যি গাছপালা রয়েছে ।
সওদাগর ছেলেদুটির মাথায় হাত রেখে বললে "তোমরা কে বাবা? আমার ঘাট হয়েছে, আমার নৌকার জিনিষ যেমনটি ছিল তেমনটি ঠিক করে দাও বাবা"

আকুলি-সুকুলি বলল "আমরা তো কিছু জানিনা" এই বলে সওদাগরকে তাদের মায়ের কাছে নিয়ে গেল । তার মা  সব শুনে মা মঙ্গলচন্ডীকে সবকথা জানাল ।
মা মঙ্গলচন্ডী  সওদাগরকে  দৈববাণী করে বললেন  "কেন সে তাঁর ব্রতদাসের অপমান করেছে, কেন সে কিছু ভিক্ষা দেয়নি ছেলে দুটিকে' 

সওদাগর তার ভুল বুঝতে পেরে বাড়ি ফিরে মঙ্গলচন্ডীর পুজোর আয়োজন করল ও হারাণো জিনিষ সব ফিরে পেল।

এবার মঙ্গলচন্ডী স্বপ্নাদেশ দিলেন সেই রাজ্যের রাজাকে । বললেন তার দুই মেয়েকে আকুলি আর সুকুলির সাথে বিয়ে দিয়ে তাদের ঘরজামাই করতে । আকুলি-সুকুলি আর তাদের মায়ের বরাত ফিরে গেল ।

ব্রতকথা যদি লোকশিক্ষার অস্ত্র হয় তবে আমি বলব কন্যার অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের জন্য পাশে থাকুক তার বাবা-মা। যে কারণেই গর্ভাধান হোক না কেন মেয়েসন্তানকে তাড়িয়ে না দিয়ে তার প্রতিকার করুক ।
সওদাগরের ধনসমুদ্র থেকে এক আঁচলা ভিক্ষান্ন পাক আকুলি-সুকুলির মত অবাঞ্ছিত শিশুরা ।
রাজকন্যার সাথে হোকনা ঐ যমজ ছেলেদুটির বিয়ে । বেঁচে যাবে সংসারটি ও সাথে তাদের মা টিও যাকে একদিন লোকলজ্জার ভয়ে ত্যজ্যা কন্যা হতে হয়েছিল । 
প্রতিবছর অঘ্রাণের ভোরে যখন শীত দরজায় কড়া নাড়ে তখন মনে পড়ে এইসব। পাল্টায়না ব্রতকথার গল্পগুলো। শুধু পাল্টে যায় সমাজের চিত্রকল্পটা। বদলে যায় চরিত্রগুলো। ব্রতের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলে এ যুগেও  । সমাজে মেয়েগুলো আজো ব্রাত্য ।