২১ আগ, ২০১৬

শ্রাবণী পূর্ণিমা, রবিঠাকুর এবং

   http://www.magazine.kolkata24x7.com/blog/21-08-2016-sriboni-purnima-by-indira/

" আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল্‌–'
রবিঠাকুরের বহুশ্রুত গানটি দিয়েই না হয় শুরু করি শ্রাবণী পূর্ণিমার কথা। কবির কথা ধার করে, গঙ্গাজলেই নাহয় গঙ্গা পুজো সেরে বলি কি আনিনি আমরা এই শ্রাবণী পূর্ণিমাতে?  ফুল ফোটার হাসি, ফুল ঝরার কান্না, বিরহ-মিলন, বাদল হাওয়া... এসবের সাথে বর্ষাঋতুর অন্তিম লগ্নে, বর্ষণস্নাত সবুজ ও সজীব এনেছি । ফল এনেছি কত রকমের। আদিগন্ত ফুলের সৌরভ ছড়িয়েছি । দিকে দিকে বৃক্ষরোপণ করেছি। বনমহোত্সবের বার্তা ছড়িয়েছি প্রকৃতির আনাচেকানাচে।  
এ যেন আবারো চলে যাওয়ার আগের মূহুর্তে আরো একবার বর্ষামঙ্গল। আবারো  বিদায়ী বর্ষার আঁচল টেনে ধরে, তুমি যেওনা, তুমি যেওনা বলে তার পথ রুখে দেওয়া। আবার তো আসবে একটা বছর পরে। তার চেয়ে আরো কটাদিন কাটিয়েও যাওনা, আমাদের সাথে।
শেষ শ্রাবণের মেঘজাল ভেদ করে শুক্লা একাদশীর চাঁদ বেরিয়ে আসবে। ধীরে ধীরে তা পূর্ণতা পাবে। ষোলকলা পূর্ণ করবে। তারপর সেই পূর্ণ চাঁদের জ্যোৎস্না চুঁইয়ে পড়বে সমস্ত চরাচরে। শ্রাবণের ধারাজলে ধৌত সবুজ প্রকৃতি, বৃষ্টি স্নানে আপ্লুত পাখীকুল সেই শেষ বর্ষার পূর্ণিমার আলো দেখবে । ধানচারা রোপণের আনন্দে কৃষকের মনে পরম তৃপ্তি আর তৃষ্ণার্ত চাতক চাতকীর মন যেন কানায় কানায় পূর্ণ । মৈথুন সুখে তৃপ্ত ময়ূর ময়ূরী আর বৃন্দাবনের ব্রজবাসীর মন টৈটুম্বুর আসন্ন ঝুলন উত্সবের প্রস্তুতিতে। সাজোসাজো রব শুধু বৃন্দাবনেই নয়। রাধাকৃষ্ণের সব থানগুলিই আনন্দমুখর এই ঝুলন তথা রাখীর মিলনোত্সবে সামিল হবার তাগিদে। বৌদ্ধ বিহারগুলিতেও বেশ তাত্পর্যপূর্ণ এই শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথি। বুদ্ধের নির্বাণলাভের পর ভিক্ষুরা গত চারমাস ধরে  চাতুর্মাস্যে ব্রতী হয়ে শ্রাবণী পূর্ণিমায় তা উদযাপন করে। বিশ্ব শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। এ হল বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বর্ষাব্রত পালন।  
হিন্দুদের বৈষ্ণবধারার সাথে শৈবধর্মও এই শ্রাবণী পূর্ণিমায় শিবলিঙ্গে জলধারা বর্ষণ করে....এও তাদের বিশ্বাস। বিশ্বনাথের জন্মমাস নাকি শ্রাবণ। শ্রাবণীপূর্ণিমাতে সেই জন্মমাস উদযাপিত হয় ভারতবর্ষের সর্বত্র। কাশ্মীরের অমরনাথ থেকে বিহারের বৈদ্যনাথ ধাম, বেনারসের কাশীর বিশ্বনাথ থেকে পশ্চিমবাংলার তারকনাথ ধাম সর্বত্র‌ই পুরো শ্রাবণ মাস ধরে মহাদেবের পুজোয় সামিল হয় শৈবরা। যারা দূর দূর শৈবতীর্থ যেতে পারেনা তারাও নিজের জায়গাতে প্রাচীন কোনো শিবমন্দিরে গিয়ে পাশের কোনো নদী থেকে জল ঢেলে আসে এই মাসে। শ্রাবণী পূর্ণিমায় সারা ভারত জুড়ে শিবের মেলা হয় ধুম করে।

আসেপাশের নদী, নালা, সমুদ্র, কুন্ড যা আছে সবই তো বর্ষার জল পেয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠা জলাধার।  এবার শিবভক্তদের বাঁক কাঁধে নিয়ে খালি পায়ে সেই জলাধার থেকে মাটির ঘটি কিম্বা কলসী ভর্তি করে আবারো পায়ে হেঁটে শিবমন্দিরে গিয়ে শিবলিঙ্গকে সেই জলে সিক্ত করা....এ তো চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। সোমবার নাকি শিবের বার । তাই শ্রাবণের সপ্তাহান্ত গুলো জমজমাট থাকে শিবভক্তদের কোলাহলে। নতুন গৈরিকবাস, নতুন মাটির কলস, বাঁক আরো আনুষাঙ্গিক কতকিছু! আবালবৃদ্ধবণিতা সামিল হয় কাঁবর কাঁধে এই পথচলায়। কিসের এই পথচলা? কিসের এই আকুতি? মহাদেব নাকি ভক্তের বয়ে আনা এই জলেই তুষ্ট হন। কাঁধে বাঁক নিলেই কঠোর সংযম। বাঁক রাখলেই আবার শুদ্ধ হয়ে তবেই পুনর্যাত্রা। ভাল, মন্দ, সৎ অসৎ সকলেই পাপ স্খালনের আশায় এই ব্রত করে।
"ভোলেবাবা পার লাগাও, ত্রিশূলধারী শক্তি জাগাও, ব্যোম্‌, ব্যোম্‌ তারক ব্যোম্‌, ভোলে ব্যোম্‌, তারক ব্যোম্‌ …' এই সম্মিলিত বাণী ছড়িয়ে যায় তারা। তাদের পথচলায় অনুরণিত হয় এই শব্দগুলো বারেবারে আর সেই সাথে থাকে টুং টাং ঘন্টাধ্বনি।
পুরাণে বলে সমুদ্র মন্থন হয়েছিল এই শ্রাবণেই। মহাদেব সেই মন্থনের ফলে উঠে আসা গরল নিজকন্ঠে ধারণ করে নীলকন্ঠ হয়েছিলেন। তাঁর এই বিষের জ্বালা নিরাময়ের কারণেই শিবলিঙ্গে অনর্গল জল ঢালার রীতি।    

আবার মনে পড়ে রবিঠাকুরের সেই গানের লাইন...
"আজ-শ্রাবণের সজল ছায়ায় বিরহ মিলন–'  এ ও এক অদ্ভূত মিলন আমাদের। শ্রাবণ আসে, শ্রাবণ যায়। রেখে চলে যায় বাইশে শ্রাবণের স্মৃতি আর উৎসবের চিহ্ন, মহামিলনের বার্তা। কখনও ঝুলন পূর্ণিমা বা রাখীবন্ধন কখনও শ্রাবণী পূর্ণিমার মত বারব্রত।
আমাদের রাঢ়বঙ্গে কত শৈবতীর্থ আর কত পরিচিত এই সব প্রাচীন শৈবতীর্থে এই শ্রাবণেই  মানুষ জমায়েত হয় পুণ্যলাভের আশায়। শুধুই কি পুণ্যলাভ? এই দল বেঁধে প্রতিটি পাড়া থেকে জনায় জনায় কত মানুষ এই শিবলিঙ্গে জলঢালা আর শ্রাবণী পূর্ণিমার মেলায় সামিল হবার আশায় জমায়েত হন বছরের এই সময়টায়। তাই আক্ষরিকভাবে বৈষ্ণবদের ঝুলনপূর্ণিমার মহামিলনে অথবা শিবমন্দিরগুলির প্রাঙ্গণে শৈবদের এই শ্রাবণী পূর্ণিমাটিও মহামিলনের বার্তা দেয় । 
তারকেশ্বরের বাবা তারকনাথ, মেদিনীপুরের খড়্গেশ্বর, বলিপুরের সুরথরাজার আরাধ্য সুরথেশ্বর, সাইঁথিয়ার কলেশ্বর, বর্ধমানের একশো আট শিবমন্দির সর্বত্র এই জন সমাবেশ। শিবের তুষ্টিতে জনগণের শান্তি। গোটা শ্রাবণ মাস শুধু ট্রেনগুলিই নয়, হাওড়া এবং শিয়ালদহ শাখার বহু স্টেশনই কার্যত চলে যায় শিবভক্তদের দখলে।


জলযাত্রীদের জন্য পসরা নিয়ে আশপাশের গ্রাম থেকে দোকানিরাও বসে পড়ে। প্লাস্টিকের ঘট, মাটির কলসি, ফুল বেলপাতা, গেরুয়া পোশাক, বাঁক, গামছা, তোয়ালে, বাঁক সাজানোর উপকরণ হিসেবে ঘণ্টা, কী থাকে না সেখানে? এভাবেই বুঝি বছরের পর বছর টিকে থাকে হিন্দুদের শিবমহিমা, তাদের ধর্মবিশ্বাস। শ্রাবণ যে মহাদেবের বড়ো প্রিয় মাস। ভক্তের ঢল নামাতে তিনিও খুশি হন যে! 

আবারো রবিঠাকুরের কথায় বলি,
যুগল মিলনমহোৎসবে শুভ শঙ্খরবে 
পূর্ণিমা-আকাশে জাগুক হাসি

কবির "শেষ বর্ষণ' গীতিনাট্যে রাজা নটরাজকে বলছেন 
"শ্রাবণের পূর্ণিমায় পূর্ণতা কোথায়? ও তো বসন্তের পূর্ণিমা নয়'
তার উত্তরে নটরাজ বললেন, 
"মহারাজ, বসন্তপূর্ণিমাই তো অপূর্ণ। তাতে চোখের জল নেই কেবলমাত্র হাসি। শ্রাবণের শুক্ল রাতে হাসি বলছে আমার জিত, কান্না বলছে আমার। ফুল ফোটার সঙ্গে ফুল ঝরার মালাবদল। ওগো কলস্বরা, পূর্ণিমার ডালাটি খুলে দেখো, ও কী আনলে।
আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল্‌...'

সেখানেও আবার নটরাজের মুখ দিয়ে কবি বলিয়ে নেন,
"মধুরের সঙ্গে কঠোরের মিলন হলে তবেই হয় হরপার্বতীর মিলন' 
 সেই শ্রাবণের অনুষঙ্গে শিবদুর্গার মিলন প্রসঙ্গও আনলেন আমাদের রবিঠাকুর। 


  হিন্দুধর্মে মহামিলনের জন্য‌ই কি এমন ঢালাও আয়োজন চলে আসছে প্রত্যেক পূর্ণিমা তিথিতে ? নয়ত শ্রাবণে ঝুলনযাত্রা, কার্তিকে রাসযাত্রা, ফাল্গুনে দোলযাত্রার মত এত মিলনোৎসবে আজও কেন সামিল হাজার হাজার মানুষ ? বছরের এই বিশেষ দিনগুলোতে তিথিক্ষণ মেনে কেন আমরা এখনো জমায়েত হ‌ই মেলা প্রাঙ্গণে?
আর কেন‌ই বা ঝুলনযাত্রার শেষে রাখী বেঁধে দিয়ে মিষ্টিমুখ করায় আমার বন্ধু ? রাধাকৃষ্ণ, ঝুলন সাজানো, এসব তো মানুষের মনগড়া । আসল তো মাঝেমাঝে সম্পর্কটাকে ঝালিয়ে নেওয়া। কৃষ্ণ স্বয়ং সেকথাও বুঝেছিলেন। হঠাত হঠাত মথুরা থেকে বৃন্দাবন, সেখান থেকে দ্বারকা ...তাঁর সামাজিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক  সদাব্যস্ত কর্মসূচীর টানাপোড়েনে  শ্রীরাধার সাথে সম্পর্কটা যায় যায় হয়ে দাঁড়াতো। তাই তো এই উতসবের মধ্যে দিয়ে আবারো মধুর সম্পর্কটা টিঁকিয়ে রাখার চেষ্ট করে যাওয়া। একান্তে দিনকয়েক কাছের করে পাওয়া। দুজনের কত শৃঙ্গার, ভৃঙ্গারে  গল্পমুখর দিনরাত এক হয়ে যাওয়া।
বছরের তিনটে বিশেষ পূর্ণিমাতে হয় রাধাকৃষ্ণের তিন লীলা-উত্সব বা যাত্রা  । ফাল্গুণী পূর্ণিমায় দোলযাত্রা, শ্রাবণী পূর্ণিমায় ঝুলনযাত্রা আর কার্তিক পূর্ণিমায়  রাসযাত্রা। ঝুলন হল বর্ষার লীলা যার অপর নাম হিন্দোলনলীলা। ব্রজবাসীরা কদমগাছে ঝুলা বেঁধে রাধাকৃষ্ণকে দোল খাওয়ায়। কাজরী গান হয়। মেঘমল্লারে বৃন্দাবনের আকাশবাতাস সঙ্গীতমুখর হয়ে ওঠে। একাদশী থেকে শুরু হয় ঝুলন আর শেষ  হয় পঞ্চমদিনের পূর্ণিমাতে। রাখী বাঁধা হয় সেদিন।
তবে অন্য্যন্য যাত্রাগুলির থেকে ঝুলনযাত্রা একটু ভিন্ন। এটি রূপকধর্মী। দোলা বা হিন্দোলনের অর্থ হল সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলন ময় মানুষের  জীবনের প্রকৃত অর্থ‌ই হল ঘড়ির পেন্ডুলামের মত চলমানতায় ভরা। একবার আসবে দুঃখ। তারপরেই সুখ। কখনো বিরহ, কখনো মিলন। কখনো আনন্দ, কখনো বিষাদ। স্থির হয়ে থাকাটা জীবন নয়। এই দোলনার আসা ও যাওয়াটি হল রূপকমাত্র। তাই জন্যেই তো বলে "চক্রবত পরিবর্ততে সুখানি চ দুখানি চ'   
উপনিষদে বলে " আনন্দ ব্রহ্মেতি ব্যজনাত" অর্থাত ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ। কিন্তু তিনি একা সেই কাজ করবেন কি করে? তাইতো তিনি সৃষ্টি করেন বন্ধু-বান্ধব, পিতামাতা, দাসদাসী, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রীর মত সম্পর্কের জালে আবদ্ধ মানুষদের। তাই প্রেমের আবাহনে পুরুষ আর প্রকৃতির যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠে হিন্দোলন বা ঝুলনের মত উত্সব। সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রজাপিতা ব্রহ্মের এরূপ দায়বদ্ধতা। মানুষ যাতে মানুষকে নিয়ে অহোরাত্র বেঁঁচে থাকে...... আর সেখানেই ঝুলন নামক মিলনোত্সবের সার্থকতা !   
শ্রীমদ্ভাগবতে বলে, বর্ষণমুখর বৃন্দাবন তখন বানভাসি। বর্ষণসিক্ত ধরিত্রী সবুজ। নদীনালা বর্ষার আনন্দে থৈ থৈ। প্রাণীকুল খলখল কলধ্বনিতে মুখর। পক্ষীকুল মনের আনন্দে সরব তাদের কূজনে। আসন্ন পূর্ণিমার রূপোলী জ্যোত্স্নায় ব্যাপ্ত আদিগন্ত চরাচর। এমন প্রাকৃতিক আবাহনে মেতে উঠলেন শ্রীরাধিকা তাঁর দয়িতের সাথে।  এতো মানুষের জীবনের মত‌ই মিলনের আর্তি। বহুদিনের অদর্শণের অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি। এতো আমাদের জীবনে চেনা ঘটনা...তাই নয় কি ? 
 
রবিঠাকুর বলে ওঠেন

দে দোল্‌ দোল্‌ ।
দে দোল্‌ দোল্‌ ।
এ মহাসাগরে তুফান তোল্‌ ।
বধূরে আমার পেয়েছি আবার —
ভরেছে কোল ।
প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে
প্রলয়রোল ।
বক্ষ-শোণিতে উঠেছে আবার
কী হিল্লোল!
ভিতরে বাহিরে জেগেছে আমার
কী কল্লোল!

সত্যি এ যেন পরাণের সাথে পরাণ বাঁধার উত্সব! চির বন্ধুতার আবেগে মাখোমাখো উত্সব।ঝুলনযাত্রা বহুযুগ আগে থেকে ব্রজভূমি বৃন্দাবনে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হত। শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধিকা তাঁদের অষ্টসখী ইন্দুরেখা, চিত্রা, চম্পকলতা, ললিতা, বিশাখা, তুঙ্গবিদ্যা, সুদেবী এবং রঙ্গদেবীর সাথে লীলা করেছিলেন ঐ দিনে। শ্রীচৈতন্যদেবের লীলাক্ষেত্র নবদ্বীপধামেও এখন ঝুলন পালিত হয় মহাসমারোহে। রাধাগোবিন্দের প্রচলিত ঝুলনযাত্রার হাত ধরে এসে পড়ে রাখীবন্ধন যা এখন গ্লোবাল মার্কেটে আরো জনপ্রিয়।
পুরাণের কাহিনী অনুযায়ী দেবতারা যখন অসুরদের দৌরাত্ম্যে স্বর্গ থেকে ক্ষমতাচ্যুত তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির শরণাপন্ন হলেন। ইন্দ্রের স্ত্রী পৌলমী তখন বৃহস্পতির নির্দেশে ইন্দ্রের হাতে বেঁধে দিলেন একগুচ্ছ রাখী। এই রাখী হল রক্ষাকবচ যা দেবরাজকে রক্ষা করবে অসুরদের সকলপ্রকার অত্যাচারের হাত থেকে। শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনে রাখী পরার পরেই নাকি দেবরাজ ইন্দ্র সমর্থ হয়েছিলেন অসুরদের পরাস্ত করে স্বর্গরাজ্য উদ্ধ্বার করতে।
ইতিহাস বলে অনেক কাহিনী।
তার মধ্যে বাঙালীদের কাছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ ও রাখীবন্ধনে রবিঠাকুরের অগ্রণী ভূমিকা। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলাকে দুভাগ করে বসলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করে দেশপ্রেমের মন্ত্রে জাতীয়তাবাদকে আরো সোচ্চার করার চেষ্টায় জাতিধর্ম নির্বিশেষে, আপামর জনসাধারণের হাতে রাখী বাঁধলেন। বীজমন্ত্র একটাই। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে দেশবাসীকে একসূত্রে আবদ্ধ করা। লিখলেন সেই অনবদ্য গান
"বাংলার মাটী বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পুণ্য হোক, পুণ্য হোক হে ভগবান! তাই সেইথেকে রাখীপূর্ণিমার দিনটি বাঙালীর মননে, স্মরণে আরো গুরুত্ব পেয়ে আসছে। 
রাখী হল সেই রক্ষাবন্ধনের কবচ যা পরিয়ে দিলে কোনো অমঙ্গলের আশঙ্কা থাকেনা। তাই বুঝি মা যশোদা কৃষ্ণের হাতে এই মঙ্গলসূত্র বা ডোর বেঁধে দিতেন। বালগোপাল অরণ্যে, প্রান্তরে গোচারণায় যেতেন সখাসখীদের সাথে, তার যাতে কোনো অনিষ্ট না হয় সেই জন্য । আবার ব্রজবালারা কিশোর কৃষ্ণের হাতে ফুলের রাখী বেঁধে দিতেন প্রেম-প্রীতির বন্ধন হিসেবে। মাতা কুন্তী নাকি অর্জুনপুত্র অভিমন্যুর হাতে যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে রাখী বেঁধে দিয়েছিলেন। অতএব রাখী হল স্নেহ-ভালবাসার বন্ধন দিয়ে মোড়া এক রক্ষাকবচ যা কেবল মাত্র ভাই-বোনের সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
মধ্যযুগের একটি ঘটনায় পাওয়া যায় অন্য বৃত্তান্ত। মোগলসম্রাট হুমায়ুনের হাতে রাখী বেঁধেছিলেন রাজপুতানার রাজকন্যা কর্ণাবতী । প্রবল পরাক্রমশালী বাহাদুর শাহর কাছে পরাজিত হয়ে রাজকন্যা খুব ভেঙে পড়লেন।  কিন্তু রক্ষাবন্ধনের দিনেও  দাদার মতন শুভাকাঙ্খী হুমায়ুনকে রাখী পাঠাতে ভুলে গেলেননা তিনি। সৌহার্দ্যপূর্ণ বন্ধনের এই রাখী পাওয়া মাত্র‌ই মোগলসম্রাট হুমায়ুন বুঝতে পারলেন ভগিনীসমা কর্ণাবতীর আবেগ। ততক্ষণাত তিনি ভগিনীর সম্মান ও তার রাজ্যের গৌরব বাঁচাতে সসৈন্যে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করলেন । কর্ণাবতী  ততক্ষণে সতী হয়ে অগ্নিশিখায় আত্মাহুতি দিয়েছেন। হুমায়ুন সেখানে পৌঁছেই ভগিনীর জন্য অশ্রুপাত করেন। 

কিংবদন্তীর কড়চা বলে, গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারের  ব্যাকট্রিয়ান  ধর্মপত্নী রোকসানা পুরুর সাথে তাঁর স্বামীর সাথে ঝিলামনদীর  তীরে  যুদ্ধের প্রাক্কালে পুরুর হাতে নিজে রাখী বেঁধে দিয়েছিলেন। পুরুরাজা এই রাখীবন্ধনে তৃপ্ত হয়ে এক লহমায় যুদ্ধাস্ত্র নামিয়ে ফেলেছিলেন। সে যাত্রায় এভাবে রোকসানার স্বামী আলেকজান্ডারের প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল  কেবলমাত্র একগুচ্ছ রাখীর জন্য। 

তাই শ্রাবণী পূর্ণিমা ফিরে এলেই মনে হয় রাখীই হোক কিম্বা মহাদেবের জন্য বাঁক কাঁধে গৈরিক বসনে শিবলিঙ্গে জল ঢালা সবটুকুনিই কি মহামিলনের মন্ত্র ?
যা শ্রাবণী পূর্ণিমা তাই তো ঝুলন পূর্ণিমা যার অপর নাম রাখী পূর্ণিমা!

শ্রাবণী পূর্ণিমা নিয়ে লিখতে বসে রবিঠাকুর দিয়েই শুরু করেছিলাম তাই শেষ করলাম তাঁর সোনারতরী কাব্যগ্রন্থের "ঝুলন" কবিতার প্রথম ও শেষ লাইনদুটি দিয়ে। আজো এই কবিতা ঝুলনের দিনে কত প্রাসঙ্গিক। 

আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে, মরণখেলা, নিশীথবেলা ।

......

আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে, ঝুলনখেলা, নিশীথবেলা ।