৩০ ডিসে, ২০১০

এখুনি চলে যাবে?


আবার চলল পাততাড়ি গুটিয়ে ৩৬৫দিনের পুরোণো একটা বছর । কেমন যেন লাগছে একটা । এই সে দিন আলাপ হল, কত কথা হল, কত ভাব-আড়ির টানাপোড়েন হ'ল তারপরেই শুরু হয়ে গেল ওর গোছগাছ । শীত পড়তে না পড়তেই কেবল যাই যাই ভাব । কত যেন চেনা হয়ে গেছিল ! আমার এই একরত্তি জীবন খানায় ৩৬৫রকম দিন দেখাল ।
কেড়ে নিল কত জীবন, খালি করল কত মায়ের কোল, ভেঙে দিল কত নদীর পাড় আবার দুহাত ভরে দিল কত কিছু ।কখনো ছুঁয়ে গেল মন, সিক্ত হল দুচোখের পাতা আনন্দের কান্নায়, কখনো সত্যিকারের কান্নায় দুচোখ ভরে গেল ।
বছরের মাঝামাঝি ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপে অক্টোপাস পলের বলিষ্ঠ ভবিষ্যত্‌বাণী আর ভুভুজেলায় কান ঝালাপালা হল । গাল্ফ উপসাগরে অয়েল লিক হল । শুরু হল আই-ফোন আর এন্ড্রয়েড ফোনের যুদ্ধ ; বিহারে নীতিশরাজের পুনরুত্থান এবং লালুর সমূলে পতন দেখলাম । ভারতীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ এল আর শচীনের রাজকীয় রেকর্ড হ'ল । জঙ্গলমহলে মাওপ্রকোপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেল । যদিও রাজনীতির টানাহ্যাঁচড়াতে আমার মত নিরুত্তাপ নাগরিকের কোনো হেলদোল নেই । তবুও দেখলাম বুদ্ধবাবুদের দাদাগিরি আর মমতাদিদির দিদিয়ানা ; উইকিলিক্সের হাটে হাঁড়িভাঙা থেকে টু'জি স্ক্যামের লবিবাজি , কমনওয়েলথ-গেমসের পুকুর চুরি থেকে উইমেন এথেলিটসদের জয়জয়াকার আর নিত্য নৈমিত্তিক বাজার দরের "onionism" তো আছেই ।
কিন্তু আমার কি হ'? এই একশোকোটির মধ্যে আমি এক কীটস্য কীট । কোলকাতা-খড়গপুরে শাটল্‌ ককের মত যাত্রা শুরু করলাম । দেখলাম যত্ন করে স্বপ্ন নিয়ে ছবি "ইনসেপশান" আর সাথে "মাই নেম ইজ খান" মোটের ওপর ভালোই বলা চলে । "ইশকিঁয়া" আর "দাবাং" দেখে ঠিক করলাম আর হিন্দী ছবি দেখব না । সত্যি সত্যি মুগ্ধ হলাম অপর্ণা সেনের "জাপানিজ ওয়াইফ" দেখে ; আর মন্দ লাগল না "আবহমান"
। বছরের একদম শেষে "ট্রন" দেখে বেশ লাগল |ভালো দুখানা ব‌ই পড়ালে তুমি এবছরে । একটা হল রাজশেখর বসুর অনূদিত "মেঘদূত" আর একটা প্রতিভা বসুর মহাভারতের সম্পূর্ন অন্যরকম ব্যাখ্যা । মেঘদূত নিয়ে এখনকার আঙ্গিকে
লিখে ফেললাম রম্যরচনা "মেঘ-মেল" । সেটিও ছাপা হয়ে বেরুলো সূদুর আটল্যান্টার পূজো ম্যাগাজিন "অঞ্জলি" তে । আরো কত কথা বলি ! আসামের করিমগঞ্জের একটি দৈনিক পত্রিকায় আমার লেখা ছোট গল্প "প্ল্যান-চ্যাট" আর "অথ্-মৃচ্ছকটিকম্‌" খুব হিট হয়েছে জানো ? সকলে পড়ে বলেছে "বেশ অন্যস্বাদের ছোট গল্প হয়েছে", "খাসা লিখেছ হে" ইত্যাদি ইত্যাদি । এদ্দিনে কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী ছেড়ে আমাকে গল্প লেখায় পেয়ে বসেছে ।
কালবোশেখির একটা বিকেলে রবীন্দ্রনাথের গান শুনিয়ে "নয়নতারা" সোজা পৌঁছে গেল এক্কেবারে প্রিন্ট মিডিয়ার দরজায় ! তারপর? তারপরই নয়নতারার প্রথম এলবাম "চলো রে আলোকে" বেরুলো সেই বর্ষাকালে গো ! আর তাও আবার আমারই সবচেয়ে প্রিয় টিভি চ্যানেলে রিলিজ হয়ে গেল ! তোমার জন্য ভুটান দেখে এসেছি গো এই বার গরমকালে । কত নদী আর কত বিভিন্নতার মাঝে ভুটানের প্রকৃতিতে আপ্লুত হয়ে জীবনের প্রথম ভ্রমণকাহিনী লিখেছিলাম প্রাণ দিয়ে , মন ঢেলে দিয়ে । আবার প্রিন্টহয়েও বেরুলো তা । তারপর ঠিক করলাম নাঃ তোমার সাথে আর ঝগড়া নয় ! নিউঅর্লিন্সে মধুচন্দ্রিমা হয়েছিল বিগত দু দশক আগে । কিছু কাহিনী ছিল লিপিবদ্ধ করা । তা আবার পাঠালাম প্রিন্ট মিডিয়ার দরবারে । বিদ্ধংসী ক্যাটরিনা ঝড়ের ৫ বছর পূর্তি আর নিউঅর্লিন্সের সবকিছু নিয়ে আবার তা ছেপে বেরুলো । ইতিমধ্যে সুদূর নর্থ-ইস্টের দুই ডিজিটাল বন্ধু চেয়ে পাঠালো কবিতা আর কবিতা । তাও ছেপে বেরুলো ।
হঠাত আমার মত নগণ্য গৃহবধূ আমন্ত্রণ পেল তিন তিন বার একটা টেলিভিশন চ্যানেল থেকে, একবার বন্‌ধ্‌ একবার হোমমেকার আর একবার সোশ্যাল-নেট ওয়ার্কিং নিয়ে শুধু কথা বলার সুযোগ এল .... লাইভ একটা ঘন্টা আমি অনর্গল কথা বলে গেলাম । তাও তোমার জন্যে ... শুধু তোমার জন্যে । এর মধ্যে একটা প্রিন্ট ম্যাগাজিনে কবিতাও বেরুলো । বন্ধুরা বলল তোমার বেষ্পতি তুঙ্গে এখন ! দুর ....আমার কি কোয়ালিটি ছিল ?আমি তো এক সাধারণ গৃহবধূ ।
আবার গেল বর্ষা । কাশ ফুলের বনে হাঁটছিলাম । শিউলি কুড়িয়ে , শিশির ভেজা পায়ে চুপিচুপি গাইছিলাম মনে মনে, গুন গুন করে ... মহালয়ার দিনে টিভির পর্দায় গান গাইবার সুযোগ এল । শ্যামপুকুর বাটিতে মায়ের বাড়িতে মহিষাসুর মর্দিনির গান আর স্তোত্র দিয়ে ভরিয়ে দিল "নয়নতারা" একটি ঘন্টা; আর জানো তো ঠিক তারপরই শ্যামপুকুর বাটি অধিগ্রহণ করল বেলুড়মঠ । আর গান গাওয়া হবে না এখানে কখনো ।এও ছিল কপালে আমাদের? স্বামীজি যেখানে বসে স্বয়ং গান
শুনিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে সেখানে সুযোগ হয়ে গেল গান করার ! তাও তোমার জন্য । ভাবি এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না ! পূজোর পর "বীরভূমের পাঁচ সতীপিঠ" নিয়ে আবার ফিরে এলাম লেখায় । ভাইফোঁটার দিন একমাত্র ভাইয়ের জন্য রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত আছি তখুনি খবরের কাগজে ভাইফোঁটার জন্য ছ'খানা রেসিপি লেখার আমন্ত্রণ এল । আমি সেদিন ল্যাজেগোবরে । ভাইয়ের জন্য রাঁধব না কাগজের জন্য টাইপ করব, ছবি তুলে পাঠাব । মনে মনে বললাম এই তো চাই আমি " সারাদিন অকুপায়েড " নয়ত আবার শুরু হয়ে যাবে আমার মন খারাপের পার্টির তোড়জোড় ।
ইতিমধ্যে ডিজিটাল পরিচিতি হয়েছে আমার অনেকটাই । এতদিন স্বপ্ন দেখতাম শুধু | এখন স্বপ্ন সত্যি করেছ তুমি ।শীতের রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে আর বসন্তের মাতাল হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে আমার মত সাধারণ কলমচি'র কর্ণিকা চলতেই থাকল তোমার জন্য সেই ইচ্ছেমতীর ধারে, খোয়াব দেখতে দেখতে আর কচিকাঁচাদের দিয়ালায় যোগ দিতে দিতে| চললাম অলস দুপুরগুলোতে অর্কুটের আঙিনায় , কবিতার উঠোনে হোঁচট খেতে খেতে আর গুগ্‌লদ্বীপের আশপাশে । মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখি সোনার চুড়ি খোলা আমার । ভাতের জল চাপিয়ে চাল ছাড়তে ভুলে গেলাম । রোজ রোজ দুধ উথলে পড়ে গেল ! আমার কর্ণিকা থেমে র‌ইল না কো । গরমের বিকেলে গা ধুয়ে এসে গান আর রাতে ঘুমের আগে বডিলোশনের মত লেখা আমাকে পেয়ে বসেছে । আমার পৃথিবী স্বপ্নময় ... আমার বাস্তব গদ্যময়। আমি খুব লোকময়ী ; সেই আমার কুঁড়ি-কিশলয় থেকে । কিন্তু আমি অন্যের মনের তল পাইনা । কি জানি বুঝতে পারিনা বোধ হয় । এ ব্যাপারে আমার বিশেষ জ্ঞান গম্যি নেই । আজ পৃথিবীর মানুষগুলোকে কেমন যেন অচেনা লাগে, বড্ড অচেনা , আবহাওয়াটা বড্ড গুমোট লাগে । দম বন্ধ হয়ে আসে । কি জানি তুমি এত দিলে বলেই কি আস্তে আস্তে সকলে দূরে সরে
যাচ্ছে । হয়ত তাই , হয়ত বা নয় । এবারে আমি কিন্তু নিজেকে ঠিক বদলে নেব দেখ ...এই কথা দিলাম !
জানো আবার যেই শীত পড়ল আমার মন খারাপ শুরু হয়ে গেল তুমি চলে যাবে বলে । এই নিয়ে মন খারাপ করে বসে আছি ঠিক সেই সময় আবার ডাক এল টিভিতে রান্না করার জন্যে । বিনিপয়সায় নিজস্ব রেসিপি সকলের সাথে শেয়ার করব আর অনেকে তা দেখবে কে না চায় ! পাড়ার কেষ্ট-বিষ্টু থেকে শ্বশুরবাড়ি-বাপেরবাড়িতে এক্কেবারে হৈ হৈ ! আবার তাদের আমাকে ভাল লেগে গেল । ডাক পড়ল আধ ঘন্টা লাইভ কথা বলার জন্যে । তুমি হয়ত বিশ্বাস করবে না তবুও বলছি, আমার যে এ সব ভাল লাগে না তা নয় কিন্তু আমাকে কেন এদের ভালো লাগে তা বুঝে উঠতে পারলাম না । আমার সবথেকে যারা প্রিয় তাদের নিয়ে ঘুরতে গেছিলাম সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের শংকরপুর দেখব বলে । ও মা ! হঠাত যেন সি বিচথেকে উঠে আসার সময় ভূতে ঠেলা মেরে ফেলে দিল ভূত চতুর্দশীর দিনই । আর আমার দু' হাঁটু চিরকালের মত বোধ হয় অকেজো হয়ে গেছে মনে হল । ধীরে ধীরে কাটল ট্র্যমা কিন্তু দুটো হাঁটুতেই সারাজীবনের মত একটা অস্বস্তি থেকে গেল জানালেন ডাক্তার বাবু আর তার রিপোর্ট । তাই তো তোমাকে আর ভালো লাগছিল না ... তুমি বড্ড নজর দাও আমাকে । আমি যে এত কিছু করি তা তোমার ভাল্লাগেনা বুঝলাম | তা বাবা আগে বললেই পারতে । সাবধান হতাম । সেই খোঁড়া পা নিয়েই গেলাম শীতের গর্জিয়াস গোয়া দেখতে । আঠাশ বছর বাদে গোয়া গেলাম । অনেক বদলেছে সে । কেমন যেন অচেনা মানুষের ভীড়ে চেনা গোয়াকে আরো নতুন করে পেলাম ।
জানো তো নিশ্চয়ই, সকলে বলছে পরিবর্তনের হাওয়ার কথা; আচ্ছা বলত মানুষের পরিবর্তন হবে না ? আমি বাপু ডান-বাম কোনো রাজনীতিই ভাল বুঝি না । পরিবর্তনে আমার কি ভালো হবে তাও জানিনা | আদৌ পরিবর্তন হবে কি না তাও জানিনা কিন্তু আশপাশের মানুষকে চিনতে শেখার জন্য আমার কি কোনো পরিবর্তন হবে না ?
ভাগ্যিস তোমার খোলা হাওয়া ছিল তাই রক্ষে ! গতবছরের কত না বলা কথারা আজ বলে ফেললাম তোমায় আপন ভেবে । আবার তোমার নয়নজুলি বেয়ে বেয়ে আমার শব্দমালারা সাঁতরে চলে আসবে আমার ডান হাতের মুঠোয় । আর সুর এসে ভর করবে আমার ওপরে । আমি নেই-আঁকড়ের মত শব্দমালা আর সুর নিয়ে আবার ৩৬৫ দিন ধরে জাগলিং করে যাব তোমায় সাক্ষী করে ।
যতবার ভেবেছি তুলাযন্ত্রের একপাল্লায় আমার গান আর একটাতে আমার লেখা নিয়ে বেঁচে থাকব ততবার অনেক বাধা এসেছে । কিছুতেই আর ব্যালেন্স হল না । একে ভালোবাসলে অন্যটির হিংসে হয় ! কি জ্বালা ! তাই এবার তোমাকে বলব "আমাকে আমার মত থাকতে দাও..." আমি নিজের জীবনটাকে নিজের মত করে গুছিয়ে নি...শুধু যদি তুমি পাশে থাকো ! তোমার নতুন নৌকার পুরোণো যাত্রীটিকে ভুলোনা যেন । 
 

২২ ডিসে, ২০১০

অথ মৃচ্ছকটিকম্‌ -(ছোট গল্প)


রাত প্রায় দুটো। তিলোত্তমা মহানগরী ঢলে পড়েছে গভীর নিদ্রায়।  দ্বিতীয় হুগলী ব্রিজের ওপরে দুয়েকটা গাড়ি নিঃসাড়ে পার হচ্ছে গঙ্গা। গিয়ে ঢুকছে প্রশস্ত রাজপথে। রাস্তার দুপাশে  স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করছে স্ট্রীট ল্যাম্প।    আকাশে প্রতিপক্ষের একসূতো চাঁদ। ঘোর অন্ধকারে চুঁইয়ে পড়ছে পথবাতির আলো। ছুটে চলেছে ইন্দ্রসেনা । পরণে নীল শিফন শাড়ি,  জমিতে হলদে বড়বড় ফুলের ছাপ  । একহাতে বেদের মেয়ের মত চুড়ির গোছা আর একহাত খালি । ফাইভস্টার হোটেলে কাজ করে ইন্দ্রসেনা। রিসেপশানিস্ট হয়ে ঢুকেছে; আজ তার এত দেরীর কারণ দেবদত্ত | দুজনার চলার পথে দু একবার দেখা হয়নি যে তা নয় কিন্তু আজকের আলাপ একটু অন্যরকম । গভীর তাত্পর্যপূর্ণ। অন্তত ইন্দ্রসেনার কাছে। আজ হোটেলে একটা বিরাট ককটেল পার্টি ছিল সেখানে দেবদত্তের সাথে একাধিকবার তার ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় হয়েছে আর তারপর সব কিছু ওলটপালট । পার্টিতে উপস্থিত কেউ কেউ তাদের ঘনিষ্ঠতাও লক্ষ্যও করেছে।   পার্টিটা ছিল সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটদের উদ্যোগে এক বিরাট ফেস টু ফেস কমিউনিকেশন পার্টি,  বছর পাঁচেক ধরে সোশালনেটে বন্ধুত্বের দায়,সামাজিক দায়বদ্ধতা যারা এড়াতে পারেনি তাদের একটা বিশাল সমাবেশ হযেছিল এই হোটেলে আজ সন্ধ্যায়। দেবদত্ত সেই পার্টির প্রধান অর্গানাইজার | গুগল, ইয়াহু,  এই সব কম্পানির কর্ণধাররা প্রচুর  বিজ্ঞাপন দিয়েছে। একা দেবদত্তর ফ্রেন্ডলিস্ট থেকেই  হাজির হয়েছে প্রায় একশ জন, ইন্দ্রসেনাও আছে এদের মধ্যে।   আর দেবদত্তর বন্ধুর বন্ধুরাও আছে, আছে কিছু কমন বন্ধু যেমন ইন্দ্রসেনা।  ককটেল স্পনসর করেছে ট্যুইটার গ্রুপ আর ডিনার খাইয়েছে গুগলবাজ । লাকি ড্রও ছিল সেই সাথে,  ছিল সোনি ল্যাপটপ জেতার সুযোগ ।  
পাঁচবছর ধরে নেটালাপে ডিজিটাল ঘনিষ্ঠতা চলার পর আজ ছিল লক্ষ্যভেদের পার্টি, ইন্দ্রসেনা তাই ভাবে মনে মনে  ।  খাস কোলকাতার কেতার হোটেলের রিসেপশানিস্ট বলে কথা । ইন্দ্রসেনার রূপ যেন উথলে উঠেছিল সেই সন্ধ্যায় ।  যারা অর্কুট, ফেসবুক, টুইটারে নিজের পরিচয় গোপন করেনি তারা একে অপরকে দেখেই চিনেছে , উদ্বেলিত হয়ে কুশল বিনিময় করেছে, আনন্দের আতিশয্যে আটখানা হয়ে পড়েছে।
সারা সন্ধ্যা ধরে হোটেলের স্ফটিক কক্ষে চলেছে একে ওকে কোণ ঠাসাঠাসি, পা চাটাচাটি, ল্যাং মারামারি,  হিং লাগানো কথার মারপ্যাঁচ, পিঠচাপড়ানি ; কেউ  ফোকটে আকন্ঠ পানের ফোয়ারা ছুটিয়ে ঘুম দিয়েছে সোফায়, কেউ আদেখলার মত স্ন্যাক্স খেয়েই চলেছে  দফায় দফায় । ইন্দ্রসেনা বুদ্ধিমতী মেয়ে কিন্তু সরল ; ও লোককে বিশ্বাস করে ফেলেছে ।   দেবদত্ত আগে থেকেই বলে রেখেছিল তাকে যে, রাতে বাড়ি পৌঁছে দেবে । 
ইন্দ্রসেনা মনে মনে বলে "সদাশিব না? ওমা এত একটা বুড়ো"? প্রত্যয় না? এতো এক্কেবারে বাচ্চা ছেলে, ওমা অরূন্ধতী না? শুধু ছবি বদলায় আর কোনো কাজ নেই এর; আরে অনীশদা না? ইনি এত গম্ভীর? না দেখলে কে বলবে? ইনি সেই কবি না কি যেন নাম! শৌনক সেন মনে পড়েছে ; ইনি সেই শ্রুতিনাটক করেন, প্রায়ই এনার প্রোমো দেখি নতুন অনুষ্ঠানের,  এদের মধ্যে দেবদত্তর সাথে ইন্দ্রসেনার একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়েছে এই চার-পাঁচ বছরে। 
সকলে যেন গিলছে ইন্দ্রসেনাকে, যেন কোনোদিন মেয়ে দেখেনি এরা; কি নির্লজ্জ রে বাবা ! কি গায়ে পড়া । আরে সেই লোকটা না ? সেই লাস্ট ইয়ারে একে তো কমিউনিটি থেকে ব্যান করেছিল ফেসবুক । কি যেন অশ্লীল সব কমেন্ট করত বলে, একবার অর্কুটে তাড়া করেছিল ইন্দ্রসেনাকে,  তারপর আর ইন্দ্রসেনা অর্কুটে ছবি দিত না নিজের, নয় ফুল, নয় পাখি, নয় গাছ এভাবেই চলত।  "লোকটার কি নাম যেন দেব"? ইন্দ্রসেনা বলল | দেবদত্ত বলল  নাম তো আসল নয়, অমন নাম কি হয় কারো?  অর্কুটে অর্বাচীন, ফেসবুকে ফর্নাথিং, টুইটারে টেরিবল, আর গুগলবাজে  গ্যাঁড়াকল নাম এনার । নামকরণের বলিষ্ঠতা দেখে মনে হয় খুব ক্রিয়েটিভ পার্সন । আসলে হোপফুলি হোপলেস ইনি ।    ইন্দ্রসেনা রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল ভেতরে ভেতরে । রাত বেড়ে চলেছে, কথার শেষ নেই, এক‌ই  মানুষজন পরিবৃত হয়ে একনাগাড়ে পার্টি চলছে তো চলছে, যেন ডিজিটাল জি-টক আজ  চাক্ষুষতায় পূর্নতা পেয়েছে। কেউ লগ আউট করছেনা, ইন্দ্রসেনা খুব ট্যাক্টফুলি নিজেকে সংযত রাখছে।দেবদত্তকে ইন্দ্রসেনা দেখতে পায় আর এক মহিলার সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে  । ইন্দ্রসেনা কি করবে বুঝতে পারেনা একবার সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ায় |
এতদিন সে ভেবে ছিল দেবদত্ত বুঝি বা তার একার সম্পত্তি;  অন্তত অর্কুট, ফেসবুক ট্যুইটার তাই বলে । কিন্তু এই মহিলা কে ? এনাকে তো কখনো দেবদত্তের বন্ধু তালিকায় দেখিনি । মনে মনে ভাবল ইন্দ্রসেনা । তাহলে কি অন্য কোনো ছদ্ম প্রোফাইলে আছেন এই মহিলা ?   ছি: দেবদত্ত,  তুমি আমাকে শেষে ঠকালে ? এতদিন আমার সাথে অভিনয় করলে প্রেমের ? আর পাঁচটা বন্ধুর থেকে আমি তোমাকে আলাদা ভাবতাম । আমি তোমার কথা বাড়িতে বলেছি । বাবা মা কে বিয়ের সম্বন্ধ করতে বাধা দিয়েছি ।  হঠাত হোটেলের সেই স্ফটিক কক্ষ যেন দমটা বন্ধ করে দিচ্ছিল ইন্দ্রসেনার  । নিজেকে মনে মনে বলল সে " এই জন্য অজ্ঞাতকুলশীলকে কখনো প্রশ্রয় দিতে নেই অন্তত প্রেম-বিয়ে এই সবের ব্যাপারে"   তার দাদা তাকে অনেক বার বলেছিল এ কথা । সাবধানও করেছিল । কিন্তু ঐ যে রোজকারের এই ইন্টারএকশান,  নিয়মিত চ্যাটালাপ, স্ক্র্যাপ তাদের ঘনিষ্ঠতা এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল যে সে মনে প্রাণে ভালবেসে ফেলেছিল দেবদত্তকে ।

এদিকে দেবদত্তের ভরসায় সে এসেছে এখানে । সে ভাবতেই পারেনি কস্মিনকালে যে পুরো পার্টিটা তার বোনা স্বপ্নের জালকে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে দেবে দেবদত্ত । এক চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়ল সে ।  একে একে সব অচেনা পুরুষগুলো নেশা করে তার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে, কেউ ধরছে হাত, কেউ অশালীন ইঙ্গিত করছে ।ইন্দ্রসেনা একবার দেবদত্তকে ইশারা করে ডাকতে গিয়েও সরে এল । কিছু পরে দেবদত্তই নিজে এগিয়ে এসে তাকে নিয়ে গেল একজনের কাছে,"এই যে এই আমাদের মিস ইন্দ্রসেনা রয় আলাপ করুন এর সাথে " আর "ইনি মিস্টার ডিসুজা, ট্যান্ডেলিং গ্রুপ অফ হোটেলস এর মালিক"  বলে আলাপ করিয়ে দিল ইন্দ্রসেনার সাথে । ভদ্রলোকের ঘোলাটে চোখ আর চাকচিক্যময় পোশাক দেখে ইন্দ্রসেনার কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকল । এদিকে দেবদত্ত আলাপ করিয়ে দিয়েই পালাল সেখান থেকে । চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়ল ইন্দ্রসেনা । ভদ্রলোক তার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে জিগেস করল " আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে বলি আপনার মত একজনকে আমার গোয়ার রেসর্টে রিসেপশানে দেখলে খুব খুশি হব ।অশালীন ইঙ্গিত করল হোটেলের ঘরগুলি দেখিয়ে, বলল How much would you expect as your salary?" ইন্দ্রসেনা চকিতে বলল না, না আমার ফ্যামিলি এখানে, আমি কলকাতা ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না" ভদ্রলোক তখন চেঁচিয়ে উঠল  "কি যাবেন না মানে ? আমাকে তো দেবদত্ত কথা দিয়েছে" আর দেবদত্তকে আমি তাই আমার বন্ধুর কোম্পানিতে ডাবল স্যালারিতে  চাকরি দিলাম । এই মাসের শুরুতেই সে মিডল‌-ইষ্ট চলে যাচ্ছে, নতুন কোম্পানি জয়েন করছে । ইন্দ্রসেনা বলল " কি মুশকিল আমি তো এসবের কিছুই জানিনা "    লোকটা তার সেলফোনের কললিস্ট থেকে দেবদত্তকে ফোন ঘোরাতে লাগল । 
এদিকে দেবদত্ত ততক্ষণে হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ষ্টার্ট দিয়েছে  । তার মোবাইলটি অফও করেছে মনে করে । ফোন সুইচ অফ দেখে লোকটা হোটেলের ক্রিষ্টাল রুমের দিকে এগোল  দেবদত্তকে খুঁজতে ; ততক্ষণে  ইন্দ্রসেনা ছুটে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে টয়লেটে গিয়ে মুখে চোখে ঠান্ডা জল দিয়ে হোটেলের বাইরে পা রেখেছে ।       বেরিয়ে পড়েছে  সেই অন্ধকার রাজপথে । আর কেবল মনে হতে লাগল মৃচ্ছকটিকমের নায়িকা বসন্তসেনার কথা । মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল, "চুলোয় যাক সোশালাইট করা,   হায়রে সমাজ, এখনো মানুষ হলনা তোমাদের সেই চারুদত্ত, ভগদত্তেরা" !!!  

১৬ নভে, ২০১০

অণুগল্প -- "লিভ টুগেদার"


অণুগল্প -- "লিভ টুগেদার"  ই-ম্যাগাজিন "কর্ণিকা" য় প্রকাশিত 


নীল আর লেখার ছোট্ট ঘরবাঁধার স্বপ্ন।

নীলের নাকে বাবলাফুলের ঘ্রাণ, লেখার আত্মসমর্পণ;
নীলের ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি চাওয়া, লেখার এলোচুল;
নীলের চোখে ক্রেসেন্টমুন, লেখা সেই জ্যোত্‌স্নায় ভিজে সারা ;
নীলের ঠোঁটে সিক্ত উষ্ণতা আর লেখার অবগাহন।

এভাবেই চলছিল...

একদিন নীল বলল "আর কেন ? চল্‌ এবার সেরে নি বিয়েটা"
লেখা বলল "এই তো বেশ ভালো তুই-আমি"

নীলের বুকে মাথা গুঁজে লেখা বলল, "চল্‌ একটা নতুন জায়গায়, চিত্রকূট পাহাড়ের গায়ে শ্বেতসাগরের মধ্যে অভ্রকূট দ্বীপে...অনেক মানুষের ভীড়ে"
নীল বলল, "বিয়েই যদি না হয় কি হবে গিয়ে? এই বেশ থাক তোর-আমার প্রতিদিনের সহমরণ, প্রতিমূহুর্তের সমব্যথা"
লেখা বলল, "তবে তাই হোক! তুই বলবি, আমি শুনব ;
তুই দিবি আমি নোব।
তুই চাইবি, আমি দোব ;
তুই আছিস তাই বেঁচে থাকব তোর লেখা হোয়ে।
বেঁচে থাকবে তোর-আমার "লিভ-টুগেদার"

একদিন নীলের চোখে ভেসে উঠল একটা অন্যমুখ...
তার নাম স্বপ্না | অলস শীতের দুপুরে, ক্লান্ত চড়ুইয়ের পায়ে পায়ে, বসন্ত কোকিলের গানে গানে, নীল স্বপ্নাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করল ; সাথে র‌ইল কাঠবেড়ালির খুনসুটি, হঠাত্‌ ভর দুপুরে শিলাবৃষ্টি, আরো কত কি !

এদিকে লেখার দিন কাটেনা, রাত কাটেনা ...

সে একা একা বাঁশঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে স্টীম ইঞ্জিনের ধোঁয়া দেখে ; পাক খেয়ে খেয়ে ধোঁয়া কেমন আকাশে উঠে যায় দূর দিগন্তে গিয়ে মেশে আর সেখানে মেঘেরা ঢাকনা খুলে দেয় ...নীল আকাশে গিয়ে মেশে তার চোখ। ভেসে চলে একা একা নীলের দেশে... রাতের নীল নক্ষত্র গুনতে থাকে সে।

হঠাত্‌ একদিন বনে জ্বলে উঠল দাবানল স্বপ্নার ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হোল, স্বপ্নাও শেষ ।

নীল খুব ভেঙে পড়ল, আবার লেখার কথা মনে পড়তেই লেখাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করল । লেখা "লেখা" হল তখন...

বর্ষার থৈথৈ, অন্তহীন রাতের আকাশ, অগুন্তি তারা, লাফিয়ে ওঠা ভাদ্রের নদী, আকাশ কালো করা ট্রেনের ধোঁয়া আরো কত কি তাকে পেয়ে বসল । সবকিছুর মাঝে ভেসে চলল একটা মুখ নীল, নীল আর শুধু নীল। নীল দিল সব কিছু উজাড় করে লেখাকে ; আর লেখাও নিল সব কিছু প্রান ভরে, "আজ যা কিছু আমার দিতে পারি সব‌ই ..."
সাদা পাতায় সঞ্চারিত হোল নীল-লেখার ভ্রূণ ।
বেঁচে র‌ইল তাদের "লিভ টুগেদার"


নীল আর লেখার ছোট্ট ঘরবাঁধার স্বপ্ন।

নীলের নাকে বাবলাফুলের ঘ্রাণ, লেখার আত্মসমর্পণ;
নীলের ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি চাওয়া, লেখার এলোচুল;
নীলের চোখে ক্রেসেন্টমুন, লেখা সেই জ্যোত্‌স্নায় ভিজে সারা ;
নীলের ঠোঁটে সিক্ত উষ্ণতা আর লেখার অবগাহন।

এভাবেই চলছিল...

একদিন নীল বলল "আর কেন ? চল্‌ এবার সেরে নি বিয়েটা"
লেখা বলল "এই তো বেশ ভালো তুই-আমি"

নীলের বুকে মাথা গুঁজে লেখা বলল, "চল্‌ একটা নতুন জায়গায়, চিত্রকূট পাহাড়ের গায়ে শ্বেতসাগরের মধ্যে অভ্রকূট দ্বীপে...অনেক মানুষের ভীড়ে"
নীল বলল, "বিয়েই যদি না হয় কি হবে গিয়ে? এই বেশ থাক তোর-আমার প্রতিদিনের সহমরণ, প্রতিমূহুর্তের সমব্যথা"
লেখা বলল, "তবে তাই হোক! তুই বলবি, আমি শুনব ;
তুই দিবি আমি নোব।
তুই চাইবি, আমি দোব ;
তুই আছিস তাই বেঁচে থাকব তোর লেখা হোয়ে।
বেঁচে থাকবে তোর-আমার "লিভ-টুগেদার"

একদিন নীলের চোখে ভেসে উঠল একটা অন্যমুখ...
তার নাম স্বপ্না | অলস শীতের দুপুরে, ক্লান্ত চড়ুইয়ের পায়ে পায়ে, বসন্ত কোকিলের গানে গানে, নীল স্বপ্নাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করল ; সাথে র‌ইল কাঠবেড়ালির খুনসুটি, হঠাত্‌ ভর দুপুরে শিলাবৃষ্টি, আরো কত কি !

এদিকে লেখার দিন কাটেনা, রাত কাটেনা ...

সে একা একা বাঁশঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে স্টীম ইঞ্জিনের ধোঁয়া দেখে ; পাক খেয়ে খেয়ে ধোঁয়া কেমন আকাশে উঠে যায় দূর দিগন্তে গিয়ে মেশে আর সেখানে মেঘেরা ঢাকনা খুলে দেয় ...নীল আকাশে গিয়ে মেশে তার চোখ। ভেসে চলে একা একা নীলের দেশে... রাতের নীল নক্ষত্র গুনতে থাকে সে।

হঠাত্‌ একদিন বনে জ্বলে উঠল দাবানল স্বপ্নার ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হোল, স্বপ্নাও শেষ ।

নীল খুব ভেঙে পড়ল, আবার লেখার কথা মনে পড়তেই লেখাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করল । লেখা "লেখা" হল তখন...

বর্ষার থৈথৈ, অন্তহীন রাতের আকাশ, অগুন্তি তারা, লাফিয়ে ওঠা ভাদ্রের নদী, আকাশ কালো করা ট্রেনের ধোঁয়া আরো কত কি তাকে পেয়ে বসল । সবকিছুর মাঝে ভেসে চলল একটা মুখ নীল, নীল আর শুধু নীল। নীল দিল সব কিছু উজাড় করে লেখাকে ; আর লেখাও নিল সব কিছু প্রান ভরে, "আজ যা কিছু আমার দিতে পারি সব‌ই ..."
সাদা পাতায় সঞ্চারিত হোল নীল-লেখার ভ্রূণ ।
বেঁচে র‌ইল তাদের "লিভ টুগেদার"


১২ নভে, ২০১০

শান্ত-স্নিগ্ধ শঙ্করপুরের সমুদ্রতটে











The Sandy Bay Hotel : Excellent place to stay when you are here



একটা বিকেল নেবে তুমি?
যার নোনা জলের সাদাফেনায় ছুটে আসা জলের ফোঁটার রঙ সাদা
যার সাদা উড়নি নোনতা স্বাদের ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের
আনাগোনায় আছড়ে পড়া বালির চরে আসর বসায়
মুঠো মুঠো ঝিনুক তারা মাছ, শঙ্কর মাছেরা,
দলবেঁধে আসা বকের সারি উড়ে যায় ক্যাসুরিনার ফাঁক দিয়ে,
খেয়ে যায় বাঁশপাতা মাছ সমুদ্রের তট থেকে,
ঢেউ এসে নিয়ে যায় বিকেলের সূর্যাস্তের রং ।
সব মনখারাপের দুপুরগুলো আছড়ে পড়ে সেই ঢেউতে ।
ক্লান্ত সূর্য তখন আপন মনে রঙ ছড়িয়ে চলে পশ্চিম আকাশের গায়ে,
রং ছড়াতে ছড়াতে অবসর নেয় ঠিক আমার মত
যখন আমার ইচ্ছেডানায় ভর করে সাগর-স্বপ্নেরা...



৯ নভে, ২০১০

"মেঘ-মেল"

আটলান্টার পুজো ম্যাগাজিন "অঞ্জলি"২০১০ এ প্রকাশিত রম্য রচনা

মেঘ-মেল
গল্পের নায়ক যীশু একজন বিরহী যক্ষ । সে সফট্‌ওয়ার কনসালটেন্ট। বছরের মধ্যে তিনভাগ থাকে দেশের বাইরে আর একভাগ থাকে তার হোমটাউন আলিপুরের অলকাপুরীতে। সবেমাত্র বিয়ে করেছে অনন্যাকে। বিয়ের পর প্রথম বর্ষা অনন্যাকে ছাড়া যীশু ভাবতে পারছে না, তাই মেঘের উদ্দেশ্যে তার এই মেল লেখা।
পূর্বমেঘ
"মেঘ", এবারের বরষা আমার জীবনে অভিশাপ । আমি জানিনা তোমার এবারের গতিপথ, জানিনা তোমার ট্রাভেল-আইটিনারি। কোলকাতায় "মেঘমৌসুমী" তুমি হাজির হওয়া মাত্রই আমায় সঙ্কেত দিও। আলিপুরের অলকাপুরীতে আমার প্রিয়া অনন্যা অপেক্ষমানা। সে আমার শোকে কাতর কিনা জানিনা তবে আমি তার বিরহে বড় কষ্টে আছি। তাকে বোলো গিয়ে একটিবার, যে সকল প্রোষিতভর্তৃকারাই এরূপে আছে, তাদের সকলের স্বামীও শীঘ্র ফিরবে । সে যেন মন খারাপ না করে।"মেঘ", উদাসী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমিবায়ুর আনুকুল্যে ভেসে চলেছ তুমি ; পথে শুনবে দলে দলে চাতকের সুখ শ্রাব্য বর্ষা মঙ্গল, নববর্ষার আগমনী বার্তা তুমি ঘোষণা করবে তোমার গুরু গুরু গর্জন দিয়ে। উত্সুক রাজহংসেরা নবকিশলয়ের মত গ্র্রীবা উঁচিয়ে তোমাকে অভিবাদন করবে। শোন মেঘ, আমার প্রিয়াকে অভিবাদন কোরো তোমার শিলাবৃষ্টি দিয়ে, মুছিয়ে দিও তার উষ্ণ অশ্রুবিন্দু আর তাকে শুনিও আমাদের দুজনার সম্ভাব্য মিলনগান, রবিঠাকুরের গানই শুনিও পারলে, "এমন দিনে তারে বলা যায়" অথবা "আজি ঝরঝর মুখর বাদরদিনে" । শ্রান্ত হলে পাহাড়ের ঢালে পা ফেলে জিরিয়ে নিও, পিছলে পড়ে অন্যকোথাও চলে যেও না, তাহলেই কোলকাতায় পৌঁছান হবেনা তোমার । নদীর জল পান কোরোনা যেন জন্ডিস হতে পারে । মিনারাল ওয়াটার সাথে রেখ।গরমে বাইরের খাবারই তোমার খেতে হবে । হলদিয়া বন্দর হয়ে, ডায়মন্ডহারবারের দিক দিয়ে, রায়চকের রেসর্টে দুদন্ড জিরিয়ে নিও; তারপর দক্ষিণ কোলকাতার সাউথসিটিমলের মাথায় ধাক্কা না খেয়ে ভেতরে গিয়ে ফুডকোর্টে একটা ধোসা আর একটু হিমশীতল টকদৈ খেও | যদি পেটে জায়গা থাকে তবে আইসক্রিম খেতে পারো । যা খাবে সব কিছুই যাতে তোমায় ঠান্ডা রাখে দেখো। আমপান্না, লস্যি এজাতীয় পানীয়ই তোমার পক্ষে আদর্শ এখন । হাজরা পার্কে ফুচকা খেও খুব সুস্বাদু ! তবে দেখো যেন মিনারাল ওয়াটারে বানায় । দূষণ এখন কোলকাতার ভূষণ তাই চমকে উঠনা । নিজেকে বাঁচিয়ে রেখ একটু, শুকিয়ে যেও না যেন । উর্বর কোরো কৃষিভূমি আর কোলকাতায় মাত্রাতিরিক্ত জলবর্ষণ করোনা যেন, তাহলে অনন্যার মত সকল প্রোষিতভর্তৃকাদের জলমগ্ন হয়ে কালাতিবাহিত করতে হবে ।
উত্তরমেঘ
আলিপুরের প্রাসাদোপম অলকাপুরী এপার্টমেন্টের টপফ্লোরে আমার ফ্ল্যাট । দেখো গিয়ে অনন্যা বোধ হয় বাড়ি থাকেনা সব সময় । তবে কোনো একটা শপিংমলে তাকে তুমি পেয়ে যাবে নিশ্চয়‌ই । শোনো মেঘ, তুমি উড়ে গিয়ে দেখ একটিবার কোথায় আমার অনন্যা? কার কন্ঠলগ্না হয়ে কোন ক্লাবে বসে আছে নাকি বক্ষলগ্না হয়ে ডিস্কোথেকে, তন্ত্রে মন্ত্রে মেতে আছে ! আমার সাথে তার যোগাযোগ বিছিন্ন, মেলের উত্তর দিচ্ছেনা নেট খারাপ বোধ হয়, ট্যুইয়াটেরো বহুদিন ট্যুইট নেই, অর্কুটের আইডি ডিলিট করেছে, জি-টকেও আসে না আজকাল। সেল ফোনটা সব সময় ব্যস্ত তার |
কি জানি অনন্যা এখন বসে আছে যোগাসনে না জিমনেসিয়ামে ! নাকি কোনো বিউটিস্যালনে অথবা মায়া নাকি ছায়া সুশীতল কোনো ক্লিনিকে কুড়চি-কদম্ব-কেতকী প্রলম্বিত স্পা এর অবগাহনে অলকাপুরীর বেডরুমে তো সর্বদা শীর্ষাসনে থাকত সে, মেদশূন্যতার আশায় । যাবার সময় তার জন্য কিছু টাটকা কচি শশা অথবা অমৃততুম্বী এবং মেদনিবারক পাকা পেঁপে নিয়ে যেও অনন্যা আমার আর কিছুই খায়না সাথে সুশীতল বরফকুচি দিও তাকে, তার প্রসাধনে কাজে লাগবে তোমাকে এককপি ছবি এটাচ করে দিলাম এই মেলের সাথে যাতে আমার অনন্যাকে তুমি চিনতে পারো সহজেই । তার রূপের কথাতো তোমাকে বলিনি এখনো। একলহমায় দেখো মনে হবে অপরূপা, অসমান্যা, অতুলনীয়া ! সে চলনে বিপাশা বসু, বলনে বরখা দত্‌, ভূষণে সেনকো গোল্ড, বসনে মোনাপালি । চোখদুটোয় ল্যাকমে-কোহলের চিরায়ত ইশারা, তিলফুলের মত নাসারন্ধ্রে সানিয়ার ছোঁয়া, কর্ণপটহের উপর থেকে নীচ অবধি পাঁচটি ছিদ্রে পঞ্চরত্ন খচিত, ওষ্ঠাধারে ম্যাটফিনিশ!কেশরাজি ? কালো নয় বারগ্যান্ডি বর্ণের... এই ঠিক তোমার গায়ে পড়ন্ত সূর্যের আভা লাগলে যেমনটি হয় তেমনি।
ময়শ্চারাইসড নিটোল বাহুপেশী আর মণিবন্ধে ট্যাটু আঁকা তার, তুমি দেখলেই চিনতে পারবে। সুন্দর করে ম্যানিকিওর্ড হাতের অনামিকায় নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বলে হীরকের দ্যুতি আর সাথে এক্সপ্রেস মিউজিক, সুন্দর পেডিকিয়োর্ড পদযুগলের পাঁচজোড়া নখ, দুষ্প্রাপ্য নখরঞ্জনীর বিচিত্রতায় তোমার দিকে প্রকট ভাবে তাকিয়ে আছে । দেখা মাত্রই তুমি বলবে "দেহি পদপল্লবমুদারম্‌" । ভাইটাল স্টাটিস্টিকস্‌ ৩৬-২৪-৩৬ ! মিস কোলকাতা হতে পারতো !
মেঘ , তুমি দেখ, আমার বিদ্যুতলতার মত অনন্যা যেন আমাকে শুধু ভুলে না যায়। আমি কেবলই তার চকিত হরিণীর মত নয়নের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি। তোমার ধারাবর্ষণে তাকে সিক্ত করে তুমি ফিরে এস আমার কাছে ।
ভলো থেকো মেঘ। আবার দেখা হবে আমাদের !
ইতি
আমার বাউল মন 

৭ নভে, ২০১০

"লালমাটির পথে পাঁচ সতীপিঠ "

দৈনিক স্টেটসম্যান ৭ই নভেম্বর ২০১০, রবিবারের ক্রোড়পত্র বিচিত্রায়  ভ্রমণ কাহিনী
"লালমাটির পথে পাঁচ সতীপিঠ "  


১৯১৪ সালে পূজোর ছুটির পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গয়া থেকে বেলা যাবার পথে রেলওয়ে ওয়েটিংরুমে বসে লিখলেন পথের গান
"পান্থ তুমি পান্থজনের সখা হে,
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া
যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে
তারি কন্ঠে তোমারি গান গাওয়া"
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত বীরভূম-রাঙামাটির অমোঘ আকর্ষণে বেশ কয়েকবার পা বাড়িয়েছি । কখনো বিদায়ী ফাগুণের ভোরে, কখনো শ্রাবণী পূর্ণিমার মেঘমালাদের সঙ্গী করে, কিম্বা শীতের অলস দুপুরে |শেষ বসন্তের রেশ নিয়ে চোখঝলসানো চৈতী আগুণই হোক বা পৌষালির কনকনানি কাঁপুনিই হোক কিম্বা শরতের সোনালী রোদ ঝলমলে আকাশ ; বোলপুরের প্রকৃতির রঙ এক এক সময় এক এক রকম । ফুলের বৈচিত্রে পাতাবাহারের রঙিনতায় গ্রামবাংলার এই রাঙামাটি বোধহয় একসময় কবিগুরুকে আকৃষ্ট করেছিল ।আর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী না থাকলে সাধারণ মানুষ এই অঞ্চলের প্রতি টান অনুভব করত না । শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের আশপাশগুলিও বুঝি এত জনপ্রিয়তা পেত না । এই লালপাহাড়ির দেশ, রাঙামাটির বেশে আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে তার শক্তিপীঠের পাঁচ-পাঁচটি বরণ ডালা ।কিংবদন্তী সতীপীঠের সত্যতা যাচাই করার ধৃষ্টতা আমার নেই তবে যেমন বৌদ্ধধর্মের মহাপুরুষের রেলিকস ও তাকে কেন্দ্র করে স্তূপ তৈরী হয় হিন্দুধর্মের সতীর দেহত্যাগের পর সতীর দেহাবশেষকে কেন্দ্র করে ৫১টি শক্তিপীঠ রয়েছে | আর বীরভূমে রয়েছে এই ৫১ পীঠের পাঁচটি| বীরভূমের এই পাঁচটি সতীপীঠ হল কঙ্কালিতলা, নলহাটি, ফুল্লরা, সাঁইথিয়া আর বক্রেশ্বর ।তারাপীঠও বীরভূমের একটি পুণ্য শক্তিপীঠ কিন্তু এটি সতীপীঠ নয় ।শান্তিনিকেতন ছাড়াও এই পীঠের আকর্ষণে বারবার ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে কোলকাতা থেকে বোলপুরের পথে... "তোমায় নতুন করে পাবো বলে" | দেখা হয়েচে বহুবার চোখ মেলে, তবুও ঘর থেকে দু'পা ফেলেই আবার হাঁটি চেনা পথে, আবার নতুন করে আবিষ্কার করি গ্রামবাংলাকে। সবথেকে ভালো হয় যদি বোলপুর থেকে প্রথমে প্রান্তিক হয়ে কঙ্কালিতলা, তারপর ফুল্লরা ও সাঁইথিয়া দেখে তারাপীঠে গিয়ে রাতে কোনো হোটেলে থাকা যায় । পরদিন সকালে তারাপিঠ মন্দির ঘুরে, পুজো দিয়ে নলহাটি ও সেখান থেকে বক্রেশ্বর দেখে বোলপুরে ফিরে আসুন । যদি সময় থাকে তবে নলহাটি থেকে আকালিপুরও ঘুরে আসা যাবে ।

পথের আকর্ষণে বেরিয়ে পড়ি বারবার, কালের গাড়ি আরোহন করে। লিখে চলি পথের পাঁচালী । দু'চারদিন ছুটি চাই শুধু ।হাওড়া থেকে গণদেবতা, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস, শহীদ এক্সপ্রেস,, ইন্টার সিটি এক্সপ্রেস, বিশ্বভারতী এক্সপ্রেস, আর সরাইঘাট এক্সপ্রেস ; এই এতগুলি ভিন্ন সময়ের ট্রেন আছে বোলপুর বা প্রান্তিক পৌঁছবার জন্য । আর কোনো অপরিকল্পিত ছুটির পিকনিক হলে শীতকালে গাড়ি নিয়ে সদলবলে বেরিয়ে পড়লেই হল । শেরশাহ সুরীর মধ্যযুগীয় রাস্তার ওপর ইংরেজ তৈরী করেছিল গ্র্যাণ্ড ট্র্যাঙ্ক রোড এবং সেটিকে এনএইচ-২ আখ্যা দিয়ে ভারত সরকার গোল্ডেন কোয়াড্রিল্যাটারালের কোলকাতা দিল্লী শাখা তৈরী করে।
স্বর্ণালী-চতুর্ভুজ-সড়ক-যোজনার সার্থকতায় ভ্রমণের আনন্দ ছাপিয়ে যায়। মনে হয় কে বলে বাংলা আমার নি:স্ব? মানুষ রীতিমত টোল ট্যাক্স দিয়ে গাড়িতে ভ্রমণ করছে এখন । ধন্যবাদ বিশ্বায়ন ! ন্যাশানাল হাইওয়ে অথরিটি অফ ইন্ডিয়া(NHAI) মেন্টেন্যান্স করছে ! ধন্যবাদ NHAI ! চারলেনের রাস্তায় স্রোতের মত নিয়ম মেনে গাড়ি চলছে ঠিক বিদেশের মত ; মাঝখানের ডিভাইডারে দৃষ্টিনন্দন বোগন-ভোলিয়া, করবী আর কলকে ফুলের বাতাসীয়া দোলা দেখে কৃতজ্ঞতা জানাই NHAI ইঞ্জিনিয়ারের রুচিশীলতাকে । গাড়িতে যাবার কথা বললাম এই কারণে । আর বললাম এভাবে গেলে কোনো প্ল্যান ছাড়াই বেরোনো যায় । ট্রেনের টিকিট কাটা, স্টেশন যাওয়া, সময় মত ট্রেন ধরার হ্যাপা নেই । আর ব্যস্ততার জীবনে হঠাত মনে করলেই বেরিয়ে পড়া যায় এইসব কাছে পিঠের জায়গায় । কোলকাতা থেকে গাড়ি করে গেলে বোলপুর পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টা । ভোর ভোর বেরুলে অনেক বার ঘন্টা তিনেকের মধ্যেও পৌঁছে গেছি ।  মাঝে শক্তিগড়ে দাঁড়িয়ে প্রাতরাশ সেরে নেওয়া যায় গরম কচুরি আর চা দিয়ে । এন এইচ-২ ধরে সোজা যেতে হবে পানাগড় অবধি|পানাগড়ের ভাঙা ট্রাকের সারি পেরিয়ে তারপর ডান দিকে পানাগড়-মোরগ্রাম হাইওয়ের বাঁকে ঘুরে, অজয় নদী পেরিয়ে পেরোতে হয় শাল ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল | ইলামবাজারের ঘন জঙ্গলমহল | পথের সাথী সকালের মিষ্টিরোদ এসে পড়ে তখন শালবনের মাথায়, কচি সবুজপাতায় ।চেনাপথ যেন আরো নবীন সজীবতায় ভরে ওঠে । বৃক্ষরাজির এভ্যিনিউ সুসজ্জিত গভীর অরণ্যের করিডোর |শিল্পায়নে ব্রতী হয়ে আমরা "অরণ্যমেধ" যজ্ঞে সামিল হয়েছি তবুও বাংলার সবুজ এখনো যা আছে তা অনেক রাজ্যের ঈর্ষা আর আমাদের গর্ব | তারপরেই কবিগুরুর কর্মভূমিতে, ছাতিম, শিমূল, পলাশের শহর শান্তিনিকেতনে। শ্র্রীনিকেতন, বিশ্বভারতীর আশ্রম পেরিয়ে রতনপল্লী, বনপুলক, শ্যামবাটি, তালতোড়কে সরিয়ে রেখে দুপুর সূর্যকে মাথায় নিয়ে বোলপুর বা প্রান্তিক পৌঁছে সেরে নেওয়া যেতে পারে দুপুরের খাওয়া।বোলপুর বা প্রান্তিকে অনেক হোটেলে আছে থাকার ব্যাবস্থা। কলকাতা থেকে বুক করে এলেই হল ।
শ্যামবাটির মোড়ে সেচ দপ্তরের ক্যানালের জল বয়ে চলেছে । ভরাবর্ষায় এই জলের অমোঘ আকর্ষণ আমাকে আরো টানে। প্রতি শনিবারে ক্যানালের ধারে খোয়াইয়ের হাট বসে । এটি আর কোথাও দেখিনি। সূর্যাস্তের ঠিক ঘন্টা দুয়েক আগে থেকে বসে এই হাট। কত শিল্পীরা নিজ নিজ শিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেন সেখানে আর সাথে থাকে বাউলের গান । রাঙামাটির পথ ধরে আমরাও পৌঁছে যাই সেখানে । ডোকরার গয়না, কত রকম ফলের বীজ দিয়ে তৈরী গয়না, কাঁথার কাজের বাহার, পটশিল্প, বাউলগানের আনুষাঙ্গিক বাদ্যযন্ত্র, তালপাতা, পোড়ামাটির কাজ, বাটিকের কাজ আরো কত কিছু এনে তারা বিক্রি করে । কিন্তু অন্ধকার হবার পূর্বমূহুর্তেই পাততাড়ি গোটাতে হয় তাদের । সোনাঝুরির ছায়ায় প্রান্তিকের বনবীথি যেন ঘুরে ফিরে নতুন করে ধরা দেয় আমার কাছে। প্রান্তিকের অনতিদূরে বোলপুর থেকে ৯কিমি দূরে বোলপুর-লাভপুর রোডের ওপর কংকালিতলায় মাকালীর মন্দিরের আকর্ষণও দুর্নিবার । দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর খন্ড দেহাংশের কাঁখাল অর্থাত কোমরের অংশ বিশেষ পতিত হয় এখানে ...একটি কুন্ডে। আর পাশে উত্তরমুখে প্রবাহিনী কোপাই নদী সংলগ্ন এলাকায় শ্শ্মশান । আমি এই জায়গায় এলে কিছু মাহাত্ম্য অনুভব করি।কঙ্কালিতলার মায়ের মন্দিরের সামনেই রুরু-ভৈরব শিবের মন্দির । অগণিত বাউলের গানের মূর্ছনায় জমজমাট কঙ্কালিতলার প্রাঙ্গণ । ঐ পথেই অনেক দূর এগুলেই পড়বে ময়ূরাক্ষী নদীর সমতলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মস্থান লাভপুর যার অনতিদূরে অবস্থিত ফুল্লরা বা সতীপীঠ অট্টহাস । এখানে সতীমায়ের অধর ওষ্ঠ পড়েছিল । মন্দিরের পাশে বিরাট পুকুর । কথিত আছে রামচন্দ্র যখন দুর্গাপুজো করেছিলেন তখন হনুমান ১০৮টি নীলপদ্ম এই পুকুর থেকে সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন রামচন্দ্রের পূজার জন্য । অট্টহাসে দেবী ফুল্লরার ভৈরব হলেন বিশ্বেশ ।সেখান থেকে ঘুরে আসা যায় অপর একটি পীঠ সাঁইথিয়া যেখানে সতীর গলার গহনা পড়েছিল । সাঁইথিয়ার নন্দীকেশ্বরী মায়ের অপর নাম নন্দিনী ।ভৈরব হলেন নন্দীকেশর । সাঁইথিয়া স্টেশন থেকে দেড় কিমি দূরে এই মন্দির ।এরপর রামপুরহাট থেকে ৬কিমি দূরে দ্বারকা নদীর ধারে তারাপীঠও ঘুরে আসা যেতে পারে । একদিকে কিংবদন্তীর সাধক বশিষ্ঠ মুনির তপস্যায় আর অন্যদিকে ইতিহাস খ্যাত সাধক বামাখ্যাপার তন্ত্রসাধনায় "তারাপীঠ" আজ একটি জাগ্রত পীঠ । বামাখ্যাপা তারাপীঠের মহাশ্মশানে তন্ত্র সাধনা করে তারামায়ের দর্শন পেয়েছিলেন । ভোর চারটের সময় তারাপীঠের মন্দির খোলে ।রাতে এখানে একটি হোটেলে থেকে, ভোরে পুজো দিয়ে মন্দির দর্শন করে চা জলখাবার খেয়ে পরদিন বেরিয়ে পড়া যেতে পারে পানাগড়-মোরগ্রাম হাইওয়ের ধারে নলহাটির পথে যেখানে সতীপীঠ "নলহাটেশ্বরী"র মন্দির । এখানে সতীমায়ের গলার নলী বা ভোকাল কর্ড পতিত হয় ।ছোট্ট টিলার ওপরে রাণি ভবানীর তৈরী নলাটেশ্বরী মন্দির রামপুরহাট থেকে ১৬কিমি দূরে এবং শান্তিনিকেতন থেকে ৯১ কিমি দূরে । নলাটেশ্বরী দেবীর নাম কালিকা আর তাঁর ভৈরব হলেন যোগেশ । সেখানে সকালে পৌঁছে গেলে মায়ের ভোগের ব্যাবস্থাও পাওয়া যায় । পানাগড়- মোরগ্রাম হাইওয়ের থেকে বেরিয়ে ঘুরে আসা যায় বক্রেশ্বরে যেখানে সতীর "মন" পড়েছিল । বক্রেশ্বর নদীর ওপর "নীল-নির্জন" ড্যাম যা একটি ট্যুরিষ্ট স্পটও বটে | এই জলাধারটি বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের জল সরবরাহ করে । এবার আসি বক্রেশ্বরের মাহাত্ম্যে । সত্যযুগে লক্ষ্মী-নারায়ণের বিবাহের সময় ইন্দ্র সুব্রত নামে এক মুনিকে ভীষণ অপমান করেছিলেন । যার ফলে সেই সুব্রত মুনির শরীরে আটটি ভয়ংকর ভাঁজ পড়ে যার জন্য তার নাম হয় "অষ্টাবক্র" মুনি । এই অষ্টাবক্র মুনি বহুদিন শিবের তপস্যা করার পর শিবের আশীর্বাদে মুক্তি পান । তাই এই বক্রেশ্বর শিব খুব জাগ্রত । এখানে দশটি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে যাদের জল গড়ে ৬৫ থেকে ৬৬ডিগ্রি সেলসিয়াস । সতীর "মন" বা ভ্রুযুগলের মধ্যবর্তী অংশ পতিত হয় । আপাত অনাড়ম্বর মহিষমর্দিনি মায়ের মন্দিরে দাঁড়ালে বেশ ছমছমে অনুভূতি হয় । আর সাথে বক্রেশ্বরের শিবমন্দিরটিও দেখে ঘোরা যায় । কত প্রাচীন এইসব মন্দির তা মন্দিরের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় । বক্রেশ্বরের উষ্ণপ্রস্রবণে স্নানের ব্যাবস্থাও আছে । সেখান থেকে সময় থাকলে যাত্রা করা যায় আকালিপুর ভদ্রপুরের উদ্দেশ্যে । এটি রামপুরহাট থেকে ২৫কিমি দূরে । মহারাজা নন্দকুমারের প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দির আছে এখানে ।
অসাধারণ সুন্দর এই ছয়কোণা মন্দিরের স্থাপত্য । আর সুন্দর প্রতিমার বিগ্রহ । আকালীপুর যাওয়ার পথে পড়বে "একচক্রাগ্রাম" যেখানে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর জন্মস্থান । কথিত আছে মহাভারতের পান্ডবরা তাদের অজ্ঞাতবাসের সময় এখানে কিছুদিন বাস করেছিলেন ।
কেন্দুলি এবং নানুর এই দুটি জায়গার জন্যও বীরভূম প্রসিদ্ধ। গীতগোবিন্দের রচয়িতা জয়দেবের জন্মস্থান কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলি আর বৈষ্ণবপদাবলীর রচয়িতা চন্ডীদাসের জন্মস্থান নানুর । শান্তিনিকেতন থেকে মাত্র ১৮ কিমি দূরে অজয় নদী ও ময়ূরাক্ষী নদীর মধ্যবর্তী সমতলে অবস্থিত নানুর । পানাগড় থেকে গেলে ইলামবাজারের একটু পরেই বাঁদিকে ঘুরে কেঁদুলির পথে যাওয়া যায়।মকর-সংক্রান্তির সময় বিরাট মেলা বসে কেঁদুলিতে ।গ্রামবাংলার চালার অনুকরণে তৈরী অত্যন্ত সুন্দর সব মন্দিরের হাট এই কেঁদুলি | অপূর্ব সুন্দর টেরাকোটার ভাস্কর্যের রাধাবিনোদ মন্দির যা আবারো মনে করিয়ে দেয় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে, পোড়ামাটির নিখুঁত স্থাপত্যে রামায়ণের কাহিনী লিপিবদ্ধ করা আছে মন্দিরের গায়ে ।
কাজেই শুধু বিশ্বভারতী পৌষমেলা বা বসন্ত উতসব নয় পুজোর ঠিক পরথেকেই রাঙামাটির বাতাসে থাকে মৃদু ঠান্ডার স্পর্শ যার রেশ চলে বসন্তের শেষ অবধি । ঐসময়গুলি বাদ দিলেও ক্ষতি নেই । নিরিবিলিতে আর শান্তিতে ঘুরে আসা যায় দর্শনীয় স্থানগুলি । তিন থেকে চারটি দিন বার করে নিলে একটু আরামে দেখা যায় সব ক'টি জায়গা । আর কোলকাতার এত কাছে এতগুলি জায়গা থাকতে পুজোর পর মনখারাপ কাটাতে সস্তায় ঘুরে আসা যেতেই পারে বোলপুর ।আর যদি উইকএন্ডে যান তবে ভুলে যাবেন না যেন শনিবারের খোয়াই হাটের কথা |
ফুলেদের সাথে কথা বলে, পাখিদের সাথে গান গেয়ে যাই । আর খবর নিয়ে যাই সবুজ আর নীলের | ভালো থাকতে বলি , বেঁচে থাকতে বলি বাউলকে আর মনের একতারায় বেঁধে নিয়ে যাই বাউলের দোতারার সুর |আবার আসি ফিরে গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথের ধূলায় সতী মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে ।