৩০ ডিসে, ২০১০

এখুনি চলে যাবে?


আবার চলল পাততাড়ি গুটিয়ে ৩৬৫দিনের পুরোণো একটা বছর । কেমন যেন লাগছে একটা । এই সে দিন আলাপ হল, কত কথা হল, কত ভাব-আড়ির টানাপোড়েন হ'ল তারপরেই শুরু হয়ে গেল ওর গোছগাছ । শীত পড়তে না পড়তেই কেবল যাই যাই ভাব । কত যেন চেনা হয়ে গেছিল ! আমার এই একরত্তি জীবন খানায় ৩৬৫রকম দিন দেখাল ।
কেড়ে নিল কত জীবন, খালি করল কত মায়ের কোল, ভেঙে দিল কত নদীর পাড় আবার দুহাত ভরে দিল কত কিছু ।কখনো ছুঁয়ে গেল মন, সিক্ত হল দুচোখের পাতা আনন্দের কান্নায়, কখনো সত্যিকারের কান্নায় দুচোখ ভরে গেল ।
বছরের মাঝামাঝি ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপে অক্টোপাস পলের বলিষ্ঠ ভবিষ্যত্‌বাণী আর ভুভুজেলায় কান ঝালাপালা হল । গাল্ফ উপসাগরে অয়েল লিক হল । শুরু হল আই-ফোন আর এন্ড্রয়েড ফোনের যুদ্ধ ; বিহারে নীতিশরাজের পুনরুত্থান এবং লালুর সমূলে পতন দেখলাম । ভারতীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ এল আর শচীনের রাজকীয় রেকর্ড হ'ল । জঙ্গলমহলে মাওপ্রকোপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেল । যদিও রাজনীতির টানাহ্যাঁচড়াতে আমার মত নিরুত্তাপ নাগরিকের কোনো হেলদোল নেই । তবুও দেখলাম বুদ্ধবাবুদের দাদাগিরি আর মমতাদিদির দিদিয়ানা ; উইকিলিক্সের হাটে হাঁড়িভাঙা থেকে টু'জি স্ক্যামের লবিবাজি , কমনওয়েলথ-গেমসের পুকুর চুরি থেকে উইমেন এথেলিটসদের জয়জয়াকার আর নিত্য নৈমিত্তিক বাজার দরের "onionism" তো আছেই ।
কিন্তু আমার কি হ'? এই একশোকোটির মধ্যে আমি এক কীটস্য কীট । কোলকাতা-খড়গপুরে শাটল্‌ ককের মত যাত্রা শুরু করলাম । দেখলাম যত্ন করে স্বপ্ন নিয়ে ছবি "ইনসেপশান" আর সাথে "মাই নেম ইজ খান" মোটের ওপর ভালোই বলা চলে । "ইশকিঁয়া" আর "দাবাং" দেখে ঠিক করলাম আর হিন্দী ছবি দেখব না । সত্যি সত্যি মুগ্ধ হলাম অপর্ণা সেনের "জাপানিজ ওয়াইফ" দেখে ; আর মন্দ লাগল না "আবহমান"
। বছরের একদম শেষে "ট্রন" দেখে বেশ লাগল |ভালো দুখানা ব‌ই পড়ালে তুমি এবছরে । একটা হল রাজশেখর বসুর অনূদিত "মেঘদূত" আর একটা প্রতিভা বসুর মহাভারতের সম্পূর্ন অন্যরকম ব্যাখ্যা । মেঘদূত নিয়ে এখনকার আঙ্গিকে
লিখে ফেললাম রম্যরচনা "মেঘ-মেল" । সেটিও ছাপা হয়ে বেরুলো সূদুর আটল্যান্টার পূজো ম্যাগাজিন "অঞ্জলি" তে । আরো কত কথা বলি ! আসামের করিমগঞ্জের একটি দৈনিক পত্রিকায় আমার লেখা ছোট গল্প "প্ল্যান-চ্যাট" আর "অথ্-মৃচ্ছকটিকম্‌" খুব হিট হয়েছে জানো ? সকলে পড়ে বলেছে "বেশ অন্যস্বাদের ছোট গল্প হয়েছে", "খাসা লিখেছ হে" ইত্যাদি ইত্যাদি । এদ্দিনে কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী ছেড়ে আমাকে গল্প লেখায় পেয়ে বসেছে ।
কালবোশেখির একটা বিকেলে রবীন্দ্রনাথের গান শুনিয়ে "নয়নতারা" সোজা পৌঁছে গেল এক্কেবারে প্রিন্ট মিডিয়ার দরজায় ! তারপর? তারপরই নয়নতারার প্রথম এলবাম "চলো রে আলোকে" বেরুলো সেই বর্ষাকালে গো ! আর তাও আবার আমারই সবচেয়ে প্রিয় টিভি চ্যানেলে রিলিজ হয়ে গেল ! তোমার জন্য ভুটান দেখে এসেছি গো এই বার গরমকালে । কত নদী আর কত বিভিন্নতার মাঝে ভুটানের প্রকৃতিতে আপ্লুত হয়ে জীবনের প্রথম ভ্রমণকাহিনী লিখেছিলাম প্রাণ দিয়ে , মন ঢেলে দিয়ে । আবার প্রিন্টহয়েও বেরুলো তা । তারপর ঠিক করলাম নাঃ তোমার সাথে আর ঝগড়া নয় ! নিউঅর্লিন্সে মধুচন্দ্রিমা হয়েছিল বিগত দু দশক আগে । কিছু কাহিনী ছিল লিপিবদ্ধ করা । তা আবার পাঠালাম প্রিন্ট মিডিয়ার দরবারে । বিদ্ধংসী ক্যাটরিনা ঝড়ের ৫ বছর পূর্তি আর নিউঅর্লিন্সের সবকিছু নিয়ে আবার তা ছেপে বেরুলো । ইতিমধ্যে সুদূর নর্থ-ইস্টের দুই ডিজিটাল বন্ধু চেয়ে পাঠালো কবিতা আর কবিতা । তাও ছেপে বেরুলো ।
হঠাত আমার মত নগণ্য গৃহবধূ আমন্ত্রণ পেল তিন তিন বার একটা টেলিভিশন চ্যানেল থেকে, একবার বন্‌ধ্‌ একবার হোমমেকার আর একবার সোশ্যাল-নেট ওয়ার্কিং নিয়ে শুধু কথা বলার সুযোগ এল .... লাইভ একটা ঘন্টা আমি অনর্গল কথা বলে গেলাম । তাও তোমার জন্যে ... শুধু তোমার জন্যে । এর মধ্যে একটা প্রিন্ট ম্যাগাজিনে কবিতাও বেরুলো । বন্ধুরা বলল তোমার বেষ্পতি তুঙ্গে এখন ! দুর ....আমার কি কোয়ালিটি ছিল ?আমি তো এক সাধারণ গৃহবধূ ।
আবার গেল বর্ষা । কাশ ফুলের বনে হাঁটছিলাম । শিউলি কুড়িয়ে , শিশির ভেজা পায়ে চুপিচুপি গাইছিলাম মনে মনে, গুন গুন করে ... মহালয়ার দিনে টিভির পর্দায় গান গাইবার সুযোগ এল । শ্যামপুকুর বাটিতে মায়ের বাড়িতে মহিষাসুর মর্দিনির গান আর স্তোত্র দিয়ে ভরিয়ে দিল "নয়নতারা" একটি ঘন্টা; আর জানো তো ঠিক তারপরই শ্যামপুকুর বাটি অধিগ্রহণ করল বেলুড়মঠ । আর গান গাওয়া হবে না এখানে কখনো ।এও ছিল কপালে আমাদের? স্বামীজি যেখানে বসে স্বয়ং গান
শুনিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে সেখানে সুযোগ হয়ে গেল গান করার ! তাও তোমার জন্য । ভাবি এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না ! পূজোর পর "বীরভূমের পাঁচ সতীপিঠ" নিয়ে আবার ফিরে এলাম লেখায় । ভাইফোঁটার দিন একমাত্র ভাইয়ের জন্য রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত আছি তখুনি খবরের কাগজে ভাইফোঁটার জন্য ছ'খানা রেসিপি লেখার আমন্ত্রণ এল । আমি সেদিন ল্যাজেগোবরে । ভাইয়ের জন্য রাঁধব না কাগজের জন্য টাইপ করব, ছবি তুলে পাঠাব । মনে মনে বললাম এই তো চাই আমি " সারাদিন অকুপায়েড " নয়ত আবার শুরু হয়ে যাবে আমার মন খারাপের পার্টির তোড়জোড় ।
ইতিমধ্যে ডিজিটাল পরিচিতি হয়েছে আমার অনেকটাই । এতদিন স্বপ্ন দেখতাম শুধু | এখন স্বপ্ন সত্যি করেছ তুমি ।শীতের রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে আর বসন্তের মাতাল হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে আমার মত সাধারণ কলমচি'র কর্ণিকা চলতেই থাকল তোমার জন্য সেই ইচ্ছেমতীর ধারে, খোয়াব দেখতে দেখতে আর কচিকাঁচাদের দিয়ালায় যোগ দিতে দিতে| চললাম অলস দুপুরগুলোতে অর্কুটের আঙিনায় , কবিতার উঠোনে হোঁচট খেতে খেতে আর গুগ্‌লদ্বীপের আশপাশে । মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখি সোনার চুড়ি খোলা আমার । ভাতের জল চাপিয়ে চাল ছাড়তে ভুলে গেলাম । রোজ রোজ দুধ উথলে পড়ে গেল ! আমার কর্ণিকা থেমে র‌ইল না কো । গরমের বিকেলে গা ধুয়ে এসে গান আর রাতে ঘুমের আগে বডিলোশনের মত লেখা আমাকে পেয়ে বসেছে । আমার পৃথিবী স্বপ্নময় ... আমার বাস্তব গদ্যময়। আমি খুব লোকময়ী ; সেই আমার কুঁড়ি-কিশলয় থেকে । কিন্তু আমি অন্যের মনের তল পাইনা । কি জানি বুঝতে পারিনা বোধ হয় । এ ব্যাপারে আমার বিশেষ জ্ঞান গম্যি নেই । আজ পৃথিবীর মানুষগুলোকে কেমন যেন অচেনা লাগে, বড্ড অচেনা , আবহাওয়াটা বড্ড গুমোট লাগে । দম বন্ধ হয়ে আসে । কি জানি তুমি এত দিলে বলেই কি আস্তে আস্তে সকলে দূরে সরে
যাচ্ছে । হয়ত তাই , হয়ত বা নয় । এবারে আমি কিন্তু নিজেকে ঠিক বদলে নেব দেখ ...এই কথা দিলাম !
জানো আবার যেই শীত পড়ল আমার মন খারাপ শুরু হয়ে গেল তুমি চলে যাবে বলে । এই নিয়ে মন খারাপ করে বসে আছি ঠিক সেই সময় আবার ডাক এল টিভিতে রান্না করার জন্যে । বিনিপয়সায় নিজস্ব রেসিপি সকলের সাথে শেয়ার করব আর অনেকে তা দেখবে কে না চায় ! পাড়ার কেষ্ট-বিষ্টু থেকে শ্বশুরবাড়ি-বাপেরবাড়িতে এক্কেবারে হৈ হৈ ! আবার তাদের আমাকে ভাল লেগে গেল । ডাক পড়ল আধ ঘন্টা লাইভ কথা বলার জন্যে । তুমি হয়ত বিশ্বাস করবে না তবুও বলছি, আমার যে এ সব ভাল লাগে না তা নয় কিন্তু আমাকে কেন এদের ভালো লাগে তা বুঝে উঠতে পারলাম না । আমার সবথেকে যারা প্রিয় তাদের নিয়ে ঘুরতে গেছিলাম সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের শংকরপুর দেখব বলে । ও মা ! হঠাত যেন সি বিচথেকে উঠে আসার সময় ভূতে ঠেলা মেরে ফেলে দিল ভূত চতুর্দশীর দিনই । আর আমার দু' হাঁটু চিরকালের মত বোধ হয় অকেজো হয়ে গেছে মনে হল । ধীরে ধীরে কাটল ট্র্যমা কিন্তু দুটো হাঁটুতেই সারাজীবনের মত একটা অস্বস্তি থেকে গেল জানালেন ডাক্তার বাবু আর তার রিপোর্ট । তাই তো তোমাকে আর ভালো লাগছিল না ... তুমি বড্ড নজর দাও আমাকে । আমি যে এত কিছু করি তা তোমার ভাল্লাগেনা বুঝলাম | তা বাবা আগে বললেই পারতে । সাবধান হতাম । সেই খোঁড়া পা নিয়েই গেলাম শীতের গর্জিয়াস গোয়া দেখতে । আঠাশ বছর বাদে গোয়া গেলাম । অনেক বদলেছে সে । কেমন যেন অচেনা মানুষের ভীড়ে চেনা গোয়াকে আরো নতুন করে পেলাম ।
জানো তো নিশ্চয়ই, সকলে বলছে পরিবর্তনের হাওয়ার কথা; আচ্ছা বলত মানুষের পরিবর্তন হবে না ? আমি বাপু ডান-বাম কোনো রাজনীতিই ভাল বুঝি না । পরিবর্তনে আমার কি ভালো হবে তাও জানিনা | আদৌ পরিবর্তন হবে কি না তাও জানিনা কিন্তু আশপাশের মানুষকে চিনতে শেখার জন্য আমার কি কোনো পরিবর্তন হবে না ?
ভাগ্যিস তোমার খোলা হাওয়া ছিল তাই রক্ষে ! গতবছরের কত না বলা কথারা আজ বলে ফেললাম তোমায় আপন ভেবে । আবার তোমার নয়নজুলি বেয়ে বেয়ে আমার শব্দমালারা সাঁতরে চলে আসবে আমার ডান হাতের মুঠোয় । আর সুর এসে ভর করবে আমার ওপরে । আমি নেই-আঁকড়ের মত শব্দমালা আর সুর নিয়ে আবার ৩৬৫ দিন ধরে জাগলিং করে যাব তোমায় সাক্ষী করে ।
যতবার ভেবেছি তুলাযন্ত্রের একপাল্লায় আমার গান আর একটাতে আমার লেখা নিয়ে বেঁচে থাকব ততবার অনেক বাধা এসেছে । কিছুতেই আর ব্যালেন্স হল না । একে ভালোবাসলে অন্যটির হিংসে হয় ! কি জ্বালা ! তাই এবার তোমাকে বলব "আমাকে আমার মত থাকতে দাও..." আমি নিজের জীবনটাকে নিজের মত করে গুছিয়ে নি...শুধু যদি তুমি পাশে থাকো ! তোমার নতুন নৌকার পুরোণো যাত্রীটিকে ভুলোনা যেন । 
 

কোন মন্তব্য নেই: