সত্যি সত্যি
এ জায়গাটার নাম "নিশ্চিহ্নপুর"| খুব কাছ থেকে এই নিশ্চিহ্নপুরকে আমি দেখেছি । একটা শহুরে পাড়া গাঁ বলা যেতে পারে । বা গেঁয়ো শহরও বলা যায়। কেউ বলে মফ:স্বল, কেউ বলে শহরতলী; পল্লীপ্রকৃতির সারল্য নেই এখানে আবার নেই শহরের ধূলো-ধোঁয়া, তেলকালি ভারি করা বাতাস। আমার ঘরের পাশে যাদের ঘর তাদের দুটি ছেলে সারাক্ষণ খালি গায়ে, খালি পায়ে বুকের পাঁজরা বের করা শরীর শুদ্ধ বারমুডা পরে ঘুড়ি ওড়ায় । একজন ধরে লাটাই আর অন্যজন প্রাণপনে আকাশের কোনো না কোনো ঘুড়িকে কাটার চেষ্টা করে । তার হাতে আকাশের লক্ষ্যে ছোঁড়া ঘুড়ির সূতো । একটা মেয়ে বোধহয় ছেলেদুটোর বড়বোন, সাদামাটা স্কার্ট-ব্লাউজ পরে থাকে । রোজ নিয়ম করে সকাল দশটা নাগাদ দুপাশে দুটো বেণী দুলিয়ে, নীল ছোপ ধরা সাদা স্কুলড্রেস পরে ইস্কুলে যায় । ফেরে সেই বিকেলে । তাদের একফালি বারান্দায় রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের চুঁইয়ে পড়া হলদে আলোয় মেয়েটির লড়াই শুরু হয় । মাধ্যমিকের ভৌতবিজ্ঞান, ত্রিকোণমিতি কিম্বা উপপাদ্যেরা উঁকি মারে তখন ।ছেলেদুটি তখন বোনের পাশে বসে ঢুলতে থাকে সারাদিনের ক্লান্তিতে আর অপেক্ষা করে কখন রান্নাঘর থেকে ডাক পড়বে নৈশাহারের.. মানে গরম ভাতের ।
উল্টোদিকের বাড়ির একফালি রান্নাঘর থেকে সারাদিন ধরে বেজে চলে প্রেসারকুকারের হুইস্ল | প্রেসারকুকারের মালকিনের একজন সহকারী আছে যে দিনের ভেতর প্রায় বিশ পঁচিশবার শাট্ল ককের মত একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে হোমডেলিভারির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে তার গন্তব্যস্থলে । বাড়ির নীচে একটা বিউটিপার্লার আছে। নাম "রূপশ্রী"| এ পাড়ার মেয়েরা সব নাকি কাজ করে সেখানে । আইব্রো, মেহেন্দি, ম্যানিকিওর এত সব দরজায় লেখাও আছে। বাড়ির মালিক একদম ওপরে মানে তিনতলায় থাকে । ছাপোষা গেরস্ত । নীচের দুঘর মানে ঐ একতলার বিউটিপার্লার আর দোতলার ছেলেমেয়ে তিনটিরা যেখানে থাকে বোধ হয় এনার ভাড়াটে। এই ভাড়ার টাকাতেই তার দিন চলে বলে মনে হয় আমার । সকালে রোজ লুঙ্গি পরে বাজারে যান আর ব্যাগ হাতে করে কিছু পরেই ফেরেন | কোন দিন ডাঁটা কোনদিন পুঁইশাক, কোনদিন লাউডগা উঁকি মারে ব্যাগ থেকে তার । সারাদিন বাড়ি থাকেন এই ভদ্রলোক । ছাদের ওপর টবে কটা শখের ফুলগাছ আছে তার বিকেলে রোদ পড়লেই ছাদে গিয়ে পরিচর্যা করেন । একটা ছেলে আছে তাঁর । স্মার্ট চেহারা কিন্তু ছোকরা যে কি করে জানতাম না । সেদিন ভোরে উঠে দেখি ও খবরের কাগজ দেয় এ পাড়ার বাড়ি বাড়িতে । একটা পত্রিকা কিনব বলে কথায় কথায় জিগেস করতে বলল বিএসসি পাশ করেছে গত বছর। এই জায়গাটিতে ঘরের কাজ করার লোকের অভাব নেই । কিন্তু সকলে একবেলার ঠিকের কাজ করে । বিকেলে এরা পালা করে করে ঐ বিউটিপার্লারে কাজ করে । এদের মধ্যে কেউ আবার সন্ধ্যের ঢল নামতে না নামতেই সেজেগুজে মুখে রঙ মেখে সব সফেদাসুন্দরী হয়ে বিদ্দ্যুল্লতার মত বড় রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ট্রাক ড্রাইভারদের মনোরঞ্জনের জন্য, যেখানে সব পেট্রোলপাম্প আছে| আছে চায়ের ঠেক,
ব্রেড-ওমলেট, তড়কা-রুটি, আর আলুপরোটার ধাবা । একটা মন্দির আছে এখানে । শুনেছি খুব জাগ্রত । সকালসন্ধ্যে পুজোর ঘন্টা শুনতে পাই আমি । শনিবারে সন্ধ্যায় উপচে পড়ে ভীড় সেখানে । খুব ধর্মভীরু এখানকার মানুষজনেরা । শ্রাবণে মহাধূম করে তারকনাথে যায় দলবেঁধে । চৈত্রে চড়কের সময় দন্ডী কাটে আর সম্বচ্ছর বারোমাসের তেরোপাব্বনে মাইক চালিয়ে পুজো পালন করে এরা । যে মেয়েটির কথা বলেছিলাম সে এবার মাধ্যমিকে স্টার পেয়েছে । মেয়েটির নাম আলো । তার ভাইদুটো মানুষ হয়নি তা নয় তবে সারাদিন খেলে বেড়িয়ে যেমন মানুষ হয় তেমন আর কি । একটা ভাই কোনোরকমে উচ্চমাধ্যমিক আর আরেকজন লোকাল পোষ্ট অফিসে চা, জল ইত্যাদি দিয়ে প্রাইভেটে মাধ্যমিক অবধি পেরিয়েছে । আলোদের বাবা মারা গেছেন অনেকদিন
হল । মা ক্যানসারে ভুগছিলেন । দারিদ্র্য আর মানসিক চাপে বেশিদিন ভোগেন নি । ভগবান অভাবের সংসারে তাকেও মুক্তি দিয়েছেন । আলো মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়েই সেই শহুরে গ্রামের ছোটদের বাড়িতে টিউশান দিয়ে সংসার চালিয়ে আসছে । একে একে পেরিয়েছে উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগ, জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে ঢুকেছে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে । মুখ্যমন্ত্রীর তরফ থেকে ভাল রেজাল্টের জন্য কিছুটা অনুদান পেয়েছে । তার পাড়ার স্বেচ্ছাসেবী সংঘেরা বাকীটুকুর ব্যবস্থা করেছে এক এনজিওর কাছ থেকে । তারপর বিটেক পাশ করেছে কম্পিউটার সায়েন্সে এবং জিআরই, টয়ফেল দিয়ে আমেরিকায় চলে গেছে আজ থেকে মাস ছয় আগে । নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলও পেয়েছে । এম.এস, পি.এইচ.ডি করে ফিরবে একেবারে । আলো দুভাইকে বাড়িভাড়া সমেত তাদের খাইখরচ ডলারে পাঠায় প্রতিমাসে ।
ভাগ্য
এরপর কেটে গেছে বহুবছর । সেই শহুরে গ্রাম বা গ্রাম্য শহরের আর কোনো নতুন উন্নতি হয়নি কয়েকটা পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন ফ্ল্যাটছাড়া । আর হয়েছে দুএকটা মিষ্টি, শাড়ি আর গয়নার ছোট ছোট দোকান । দ্রুত শহরায়নের ঢেউ যেন আছড়ে পড়ে এ গ্রামের মানুষকে কিছুটা গতিশীল করে তুলেছে । অভাবের তাড়নায় গেরস্ত বাবা মায়েরা এখন ছেলেপুলের লেখাপড়ার দিকে বিশেষ মন দিয়েছে । আমি একে "আলো এফেক্ট" বলি।
নিদেন পক্ষে ছেলেছোকরারা মাধ্যমিক পেরিয়ে সিকিউরিটির চাকরী করছে । আরো এক ধাপ ওপরের স্মার্ট যুবকযুবতীরা বিপিওর চাকরী করতে যায়|প্রায়শই সকাল সাঁঝে গাড়ি এসে বাড়ির দোরগোড়ায় নামিয়ে দিয়ে যায় তাদের । রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারা কালচারটার একটু একটু পরিবর্তন হচ্ছে তখন ।
আলোর চোখে অনেক স্বপ্ন । নিজের মাটির রঙ বদলে দেবার স্বপ্ন । আলো বিদেশে গিয়ে বৈভব দেখে মনে মনে কল্পনার অনেক কুসুম ফুটিয়েছে তার মনের বনে। তার পড়াশুনো আজ শেষের মুখে । শুধু বাকী শেষের কিছু ফর্মালিটি ।
পিটসবার্গে আলোর পাশের ঘরের এক রিসার্চ স্কলার অনুভব কুমার বিহারের ছেলে ।কিন্তু কলকাতাতেই বড় হয়েছে । বাংলা বলতে ও লিখতে পারে খাসা । আলোর সাথে এই পাঁচ বছরে অনুভবের একটু বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক । সব ব্যাপারেই দুজনের খুব মতের মিল কেবল একটা ব্যাপার ছাড়া । আলো দেশে ফিরতে চায় ; আর অনুভব থেকে যেতে চায় এই আমেরিকার বৈভবকে আঁকড়ে ধরে ।
সেদেশে বসে তার পুরোণো গ্রাম্য শহরের কথা এখনো ভাবে আলো । কোনো সুখ স্মৃতি নেই সেখানে । নেই কোনো পিছটান । কিন্তু তবুও তার প্রাণ কেঁদে ওঠে বারেবারে । কিছু একটা করতে হবে সেখানে । কিছু একটা গড়তে হবে সেখানে যাতে রাতারাতি বদলে যায় সেই শহুরে গ্রামের খোলনলচে । স্বার্থপরের মত ভাইদের কথা ভাবেনা সে । আজ যেখান থেকে বড় হয়ে সে এত বড় আকাশটাকে দেখতে পেয়েছে সেই মূলটাকে তো অস্বীকার করার উপায় নেই । কথা বলেছে কয়েকজন এন.আর.আই বিজনেস ম্যাগনেটের সাথে । আর সেই থেকেই স্বপ্নের ভেলায় চড়ে ভাসতে থাকা তার ।
পিটসবার্গের আকাশে সেদিন শুক্লা একাদশীর চাঁদের জ্যোত্স্না। নিজের এপার্টমেন্টের তলায় সুইমিংপুলের ধারে স্নান সেরে সদ্য উঠে এসেছে পঁচিশ বছরের আলো । এ ক'বছরে তার রূপে ধরেছে জৌলুস । চেহারায় এসেছে তরতাজা স্মার্টনেস । সদ্য স্নানের পর তন্দ্রা এসেছে আলোর ; চাঁদের আলোয় অবগাহন করতে করতে আলো পৌঁছে গেছে ততক্ষণে সেই গ্রামে । ঝাঁ চকচকে ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেস ওয়ে আর উদ্ধত সব ল্যাম্পপোষ্টে অবনত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা হ্যালোজেন আলোর মাঝে তাদের গ্রাম্য শহরকে চেনা দায় ! রাস্তার ধারে শপিংমল, তার সামনে ফোয়ারা । হালকা গানের সুর ভেসে আসছে সেখান থেকে । রাস্তা দিয়ে সব গাড়ির ঢল নেমেছে । এমন কখনো দেখেনি তো সে । বড় বড় রেস্তোরাঁ। আর যে রাস্তায় তারা থাকত সেখানে হয়েছে একটা ছিমছাম টাউনশিপ । বাড়িগুলোর কি চমতকার আর্কিটেকচার ! চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে আলোর ।আলো দেখতে পেল সেই তাদের বাড়ির পাশে সেই প্রেসার কুকারের মালকিন মহিলা যিনি হোম ডেলিভারি করতেন তাঁর একটা হোটেল হয়েছে যার নাম "পঞ্চব্যাঞ্জন" আর সেই যে রূপশ্রী নামের বিউটিপার্লার সেটি এখন একটা মাল্টিজিম আর স্কিন ক্লিনিকের মর্যাদায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তার জায়গায় । নিশ্চিহ্নপুরের মন্দিরগুলোয় মার্বেল বসেছে । মন্দিরের পেতলের চূড়ো চকচক করছে চাঁদের আলোয় ।কত নতুন স্কুল হয়েছে এখানে । আর দেখতে পেল তাদের মাকে । কতদিন দেখেনি । মায়ের হাতে শুধু থাকত দুগাছা লাল পলা । আর গলায় একরত্তি রূপোর চেন । মা আজও কেমন লাবণ্যময়ী । হাত ভর্তি সোনার চুড়ি, গলায় সোনার চেন । মা চলেছে সেই মন্দিরে পুজো দিতে । মা তো বেঁচে নেই । আজ থেকে কত দিন আগে মা চলে গেছে তাদের ছেড়ে । আলোর মনে হল গলা দিয়ে সুর উঠছে তার "আজ যেমন করে গাইছে আকাশ" । ঠিক তেমনি করেই একটা নতুন নিশ্চিহ্নপুর সে দেখতে চাইছে। আহা বেচারা ভাইদুটো তার ! তাদের জন্য বড় মায়া হতে লাগল ।
স্বপ্নের ঝিমধরা নেশা কেটে গেছে অনেকক্ষণ আগে । আলো ছ'মাস পর দেশে ফিরছে । তার রিসার্চের ফাইনাল ডিসার্টেশন এগিয়ে আসছে ক্রমশ: ; অনুভবের মন খুব খারাপ । তার কাজ এখনো বাকি অনেকটাই । আলো ফিরে এসেছে কোলকাতায় ডাঃ আলো ব্যানার্জি হয়ে । অনুভবকে ছেড়ে আসতে কষ্ট কিছুটা হলেও আলোর অনুভবের প্রতি ভালোবাসা একটুও কমেনি । কমিউনিকেশানের অগ্রগতিকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় আলো । মোবাইল আর ই-মেল তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে | সল্টলেকে সেক্টর ফাইভে একটি চাকরী নিয়ে এসেছে সে । সেখানেই একটি বাড়িতে পি.জি হয়ে আছে । শুধু স্বপ্ন নিশ্চিহ্নপুরকে আলো দেখানো । রোজ ই-মেল আদানপ্রদানে নিশ্চিহ্নপুরের একটু একটু করে অগ্রগতি খুঁজতে থাকে আলো । এনা.আর.আই শিল্পপতিদের সাথে যোগাযোগ রাখে নিয়মিত । আর মধ্যস্থতা করে অনুভব ।
স্বপ্ন-মেল
অনুভবের মেলবক্স :
অক্টোবর ২০০৫
আলো :
সবশুদ্ধ বিরাট একটা প্রজেক্ট বুঝলে? তারপর নিশ্চিহ্নপুরকে আর কেউ চিনতে পারবে না । আজ অফিসের তিনজনকে নিয়ে সার্ভে করতে গেছিলাম নিশ্চিহ্নপুরের নতুন প্রোজেক্ট। জমি, ফ্ল্যাট, দোকানপাট রেস্তোরাঁ, স্কুল, হসপিটাল সব নিয়ে নিশ্চিহ্নপুরের নতুন টাউনশিপের প্ল্যান যা ডা: রায় আর মি: শর্মার সাথে আলোচনা হয়েছিল তোমার অফিসে বসে তা আজ নিজের চোখে দেখে এলাম অনুভব ।
একটা একটা করে তিন তিনটে ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হল । আমাদের ভাড়াবাড়ির পেছনে যে লো লায়িং বস্তি এরিয়া ছিল তা সব ভাঙা হয়ে গেছে । মানুষ গুলোকে রিহাবিলিটেটও করেছে ইষ্টার্ণ মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে । আইআইটির এক ইঞ্জিনিয়ারের আর্কিটেকচারে আমাদের এই মফস্বলে টাউনশিপ গড়ে উঠতে চলেছে । নিশ্চিহ্নপুরের মধ্যে এই টাউনশিপ হবে স্বতন্ত্র তার নাম দেওয়া হয়েছে "রোশনি"।
এপ্রিল ২০০৬
আলো :
এদিকে একটা ঝামেলা শুরু হয়েছে অনুভব । জমি নিয়ে স্থানীয় মানুষদের সাথে । আর কাজ এগুচ্ছে না । তুমি পারলে মি: শর্মাকে একটা ফোন কোরো । আমি একদম সময় পাচ্ছিনা । আজ খবরে দেখলাম তাই জানতে পারলাম । জানিনা কাজটা থেমে গেল নাকি । ভাবছি এই উইকএন্ডে সময় করে একবার সাইটে যাব । এই এক সমস্যা এখানে । কাজ আর এগুবে কি করে জানিনা ।
আক্টোবর ২০০৬
আলো :
অনুভব, ব্যাঙ্ক লোনের কথাটা এগুলো কিছু? মি: শর্মা কিছু জানালেন কিনা জানিও । এখানে আবার কাজ এগুচ্ছে ঠিকমত । আমি আর যেতে পারিনা বহু দিন । নতুন চাকরীতে জয়েন করে এতবার ব্যাঙ্গালোর যেতে হল যে ছুটি পেলেই মনে হয়
একটু রেস্ট নি । তুমি এই সময় এখানে থাকলে খুব ভালো হত । বড্ড মিস করি তোমাকে অনুভব! তুমি কি সত্যি পোস্টডক করবে ওখানে ? কিন্তু ফিরে তোমাকে আসতেই হবে এদেশে । কথা দিয়েছিলে তুমি। নতুন বছরে আমাদের কোম্পানির পার্টনাররা আরো অনেককে পার্টনার করবে । তোমার মত ব্রাইট ক্যান্ডিডেটকে লুফে নেবে । কিছু শেয়ার তোমাকে কিনতে হবে । মানে ইনভেস্ট করে পার্টনার হয়ে ঢুকবে তুমি এখানে । আমিও ভাবছি অফারটা নেব । তাহলে আমরা দুজনেই হব কোম্পানির মালিক ।
এপ্রিল ২০০৭
আলো :
আমাকে এবার ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে ছ'মাস থাকতে হবে, অনুভব । তুমি কিন্তু ডা: রায় আর মি: শর্মার সাথে লোনের ব্যাপারটা ফয়সালা করে জানিও আমায় । যাওয়ার আগে আমি ঘুরে আসব নিশ্চিহ্নপুর থেকে একবার । কাজ খুব দ্রুত এগুচ্ছে । রাস্তাগুলো তৈরী হয়ে আসছে । এখন সলটলেক থেকে যেতে গেলে নতুন ফ্লাইওভার দিয়ে যাই । খুব সুন্দর ঝকঝকে রাস্তা । খুব কম সময় লাগে জানো ?
আলো : কি হল এত ইরেগুলার হয়ে গেছ কেন? রোজ একটা করে ই-মেল পাঠাতেও তোমার কষ্ট হয় । মেলবক্সটা চেক কোরো রোজ । এটা আমার অনুরোধ ।আমার আর তর সইছে না অনুভব ! কবে তোমার কাজ শেষ করে তুমি চলে আসবে সল্টলেকে ? জানো? আমার বড়ভাই তো উচ্চমাধ্যমিক আগেই পাশ করেছিল । এবছর সে ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ করেছে । সল্টলেকে একটা বিপিওতে ছোট চাকরী করছে । আর ছোট ভাই আমার পাশের অফিসে আউটসোর্স এর কাজ করে । এখন আর আমাকে ওদের টাকা পাঠাতে হয়না |
অক্টোবর ২০০৭
আলো :
অনুভব, আজ আমাদের নিশ্চিহ্নপুরের টাউনশিপ "রোশনি"র লে-আউটের এডটা দেখ নীচের নিউজপেপারের ওয়েবসাইটে । তুমি তো বি-আর্ক করেছিলে । কাজেই কিছুটা অন্তত: বুঝবে । জানো আমাদের পিটসবার্গের সেই রাস্তার আলোগুলোর মত আলো দিয়েছে নিশ্চিহ্নপুরের রাস্তায়; সেই একটা আলোর নীচে ডাউনটাউন পিটসবার্গে তুমি বলেছিলে তোমার কথা ? মনে পড়ে অনুভব? আমার সেদিন বলার মত কিছুই ছিলনা তাই আজ বলছি প্রাণ খুলে তোমাকে । আমার ভালোলাগার সেই গ্রাম্য শহরের কথা । আমার নিশ্চিহ্নপুরের নতুন গল্পের কথা । রোজ সকাল আটটা থেকে রাত আটটা অবধি অফিস করতে ভালই লাগছে এখানে । কিন্তু আরো ভালো লাগত যদি তোমার সান্নিধ্য পেতাম ! কাজে ফাঁকি দিও না প্লিজ ! যত তাড়াতাড়ি পারো ফিরে এস প্লিজ !
এপ্রিল ২০০৮
আলো :
অনুভব, আজ আমাদের রাজ্যপাল "রোশনি" টাউনশিপের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন । ডাঃ রায়কে ইমেল করলাম আর ধন্যবাদ দিলাম । গতকাল রাতে ফোন করেছিলাম মিস্টার শর্মাকে ।যেটুকু লোন স্যাংশান বাকী ছিল সেটুকুও ব্যবস্থা করে
ফেলেছেন বললেন ।"রোশনি" টাউনশিপের বুকিংও শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ বেসিসে । সেই টাকা কিছুটা পেলেই মিষ্টার শর্মার কন্ট্রাকটর ছাদ ঢালাই করবে । তার আগে নয় | প্রত্যেক বাড়ির সামনে থাকবে
ম্যানিকিওর্ড ছোট্ট ছোট্ট সবুজ লন । রাস্তাগুলোয় এই বর্ষাতেই লাগিয়ে দিয়েছে এরিকা পাম যাতে বাড়ির পজেশন পেলেই একটা শ্যামলিমার ছোঁয়া পাই আমরা । আমাদের সেই ম্যাগনোলিয়া গাছটার কথা মনে আছে তোমার ? আমাদের বাড়ির
সামনে আমি কিন্তু ঐ গাছ একটা লাগাবোই লাগাবো । আজ এই পর্যন্তই থাক ।
অক্টোবর ২০০৮
আলো :
দেখতে দেখতে কতদিন কেটে গেল আমি ফিরে এসেছি দেশে । কতটা সুন্দর হয়ে গেছে নিশ্চিহ্নপুর তা তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না অনুভব। আমি ও পাড়ায় গেলে আর চিনতে পারিনা আমার পুরোণো সেই রঙচটা খোলস ছাড়ানো গেঁয়ো শহরটাকে । কনস্ট্রাকশানের আওয়াজে, রঙে, কাঠে, সিমেন্ট-বালিতে নব নির্মিয়মাণ নিশ্চিহ্নপুরকে দেখলে আমার বাবা মায়ের জন্য বড় কষ্ট হয় অনুভব । আমি ওখানে গেলে এখনো দেখতে পাই আমাদের ভাড়াবাড়ির সেই একফালি বারান্দা
যেখানে বসে আমার হাতেখড়ি হত ক্যালকুলাসের সাথে । প্রতিনিয়ত খুনসুটি হত কেমিষ্ট্রির শক্ত শক্ত ফর্মুলার সাথে! ল্যাম্পপোষ্টের চুঁইয়ে পড়া একফালি আলোর মাঝে খুঁজে পেতাম সেই সব কঠিন বিজ্ঞানের সমাধান সূত্র । খিদে পেলে মা
এক বাটি মুড়ি নিয়ে আসতেন । শুধু মুড়ি । মা কে বলতাম একটু পাঁপড় ভাজা হবে না মা ? যাক বাবা ভাই দুটোর যে একটা হিল্লে হয়েছে এতেই আমি বড় শান্তি পেয়েছি ।
এপ্রিল ২০০৯
আলো :
অনুভব, একটা শপিং মল হবে এখানে । আর একটা সিনেমা হল । শপিং মলে সব থাকবে । ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ফার্মেসী থেকে ইন্টিরিয়ার ডেকরেশান অবধি । আমাদের খুব সুবিধে হবে । কি বল ? যা ব্যস্ত চাকরী আমাদের ! এক জায়গায় সব
কিছু পেয়ে যাবার সুবিধে যে কতটা তা আমেরিকায় গিয়ে টের পেয়েছি । একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ হচ্ছে জানো ? আমাদের টাউনশিপের পাশেই । আমি কিন্তু আমাদের ফ্ল্যাট এর এপ্লিকেশান আর সাথে বুকিং এর টাকা দিয়ে এলাম গতকাল
। আমাদের বাড়ির নাম কি হবে জানিও । আমি ভেবেছি কয়েকটা ইন্টারেস্টিং নাম । তারপর অকদিন অনলাইন হয়ে দুজনে বসে ঠিক করব । সেই মত একটা টেরাকোটার টালির অর্ডার দেব যাতে নামটা খোদাই করা থাকবে ।
অক্টোবর ২০০৯
আলো :
তুমি তাহলে শেষ পর্যন্ত চাকরীটা নিলেনা এখানে অনুভব । যা ভালো বোঝ তাই কোরো । আমার নিশ্চিহ্নপুর নিয়ে আমি ঠিক ভালো থাকার চেষ্টা করে যাব । জীবনে এত লড়াই করেছি যে কোনো কষ্টকেই আর কষ্ট বলে মনে হয়না । আমার নতুন
ফ্ল্যাটের নাম দিয়েছি "আলোক-রেণু" | আমার মায়ের নাম ছিল রেণু তাই । আমার দিন গুলো কেটে যাচ্ছে । আর তোমার জন্যে মন কেমন করে না । মেলের জন্য অপেক্ষা করাও ফুরিয়ে গেছে । ভাইরাও ফোন করেনা | তাদের নিজের
নিজের সংসার হয়েছে |বোধ হয় তোমার সাথে "আলোক-রেণু"র স্বপ্ন বাঁধা হোলো না । এখনো নিশ্চিহ্নপুরের গাছ-গাছালিরা আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে, পাখ-পাখালিরা আমাকে এসে গান শুনিয়ে যায় । আমি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে আমার অফিসের ঘরটা নিয়ে পড়ে থাকি । আমার সঙ্গী এই ল্যাপটপকে নিয়ে ।এই পাঁচ বছরে তোমার আলো ঠিক আগের মতই আছে । সেই নিশ্চিহ্নপুরের আলো হয়ে । আমি দেখতে পাচ্ছি অফুরন্ত আলোর মাঝে জ্বলজ্বল করছে আমার নিশ্চিহ্নপুর । নতুন নিশ্চিহ্নপুরের বুকে দাঁড়িয়ে "রোশনি" নামের মাল্টিস্টোরিড যার মধ্যে আমার-তোমার স্বপ্নের "আলোক-রেণু" । আমার অফিসের পাশে যে খালটা ছিল সেটা সংস্কার হওয়ার কথা ছিল | খালটি পুব-পশ্চিমে কোলকাতাকে বয়ে নিয়ে যায় আর মেশে গঙ্গার সঙ্গে। আজ দেখছি সেই আলোর মাঝে , সেই খালপাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছি কিছু পরেই নৌকো করে ওপারে যাব আমরা । আমার স্বপ্নগুলো হারিয়ে যেতে যেতে বেঁচে রয়ে গেল তবুও ! তবুও বলব আমি ভালো আছি । খুব ভালো আছি অনুভব । তুমিও ভালো থেকো ।
সত্যি-মেল
এপ্রিল ২০১০
"মনোময়" বিকাশ কেন্দ্র থেকে হসপিটাল সুপার ল্যাপটপটি উদ্ধার করলেন ডা: আলো ব্যানার্জির ঘর থেকে । ইয়াহু মেল একসেস করে ইউসার আইডি তে এ টাইপ করতেই চলে এল alo1976আর নিজের ল্যাপটপকে ইয়াহুর পাসওয়ার্ডও মনে করিয়ে রেখেছিল আলো । তাই মেলবক্স খুলে গেল চোখের সামনে ; সেন্ট মেলে অনেক অফিসিয়াল মেল রয়েছে আর সেভড মেলে অনুভবকে পাঠানোর জন্য কম্পোজ করে রাখা রয়েছে এক গুচ্ছ ইলেকট্রনিক মেল । শুধু পাঠানোর অপেক্ষায় ! শেষ পাঁচবছর ধরে যতগুলো মেল সে শুধু লিখে গেছে অনুভবকে । ইনবক্সে একটাও মেসেজ নেই অনুভবের কাছ থেকে পাওয়া । "মনোময়" বিকাশ কেন্দ্রের সুপার অনুভবের মেল আইডি নিয়ে নিজের আইডি থেকে অনুভবকে মেল করলেন ।
"ডা: আলো ব্যানার্জি এখন "মনোময়" বিকাশ কেন্দ্রে আছেন । সত্বর যোগাযোগ করুন নীচের ঠিকানায়"
দৈনিক স্টেটসম্যান ২৮শে অক্টোবর ২০১১ এ প্রকাশিত