১৭ ডিসে, ২০১১

মা গঙ্গার বডিগার্ড শিব

 আনন্দবাজার পত্রিকা ১৭ই ডিসেম্বর ২০১১ ওয়ান স্টপ ট্র্যাভেলগ 

তাকিয়ে দেখি ভাগিরথী আমার চোখের সামনে । গঙ্গোত্রীর মন্দিরের বাজারের মধ্যে দিয়ে, মাগঙ্গাকে পুজো দেবার পসরা নিয়ে অলিগলি দিয়ে চলেছি আর ডানদিকে উঁকি মারছে ভাগিরথী । কি তার কলকলানি ! উত্তরকাশী থেকে ভোর ভোর বেরিয়েছিলাম গঙ্গোত্রীর পথে । উত্তরকাশী থেকে ৯৯কিমি দূরে ৩০৪৮ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত গঙ্গোত্রী । ভাগিরথীর উত্সমুখ হল গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার যার টার্মিনাস হল আরো ১৮কিমি দূরে গোমুখে । স্থান মাহাত্ম্য বলে, পুরাকালে রাজা ভগীরথ শিবের তপস্যা করে গঙ্গাকে শিবের জটা থেকে গঙ্গোত্রীতে নামিয়ে আনেন । এই ভাগিরথী দেবপ্রয়াগে অলকানন্দার সাথে মিলিত হয়ে গঙ্গা হয়েছে । ভাগিরথীর তীর ঘেঁষে চলতে লাগলাম অজস্র মন্দিরময় শহরতলীকে ফেলে । ভাটোয়াড়ি এল, সামনে অগণিত ভেড়ার পাল পাহাড় থেকে নেমে আসছে সমতলে । দীপাবলী অবধি তীর্থযাত্রা তারপরদিনই প্রবল তুষারপাতের জন্য রাস্তা বন্ধ । মেষশাবকরা আপাততঃ মাস ছয়েকের জন্য সমতলে ঘরকন্না করতে আসছে । সেই জ্যামে কিছুক্ষণ । প্রথমে নদীর সমতলে কিছুটা, আবার উঁচুতে উঠতে শুরু করল গাড়ি ।বীভত্স সরু পাহাড়ের চড়াই পথ । উল্টোদিক থেকে একটা বাস বা গাড়ি এলে বিপদে। অতি সন্তর্পণে পিছু হটে সামনের গাড়িকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে আবার চলা । সাথে বুকধড়পড়ানি , এই বুঝি পড়ে যায় গাড়ি ! রাস্তার একপাশে পাথরের দেওয়াল আর অন্যদিকে গভীর খাদ । ততক্ষণে ভাগিরথী এক চিলতে নীল সূতোর মত হয়েছে । আর দুর্গম থেকে দুর্গমতর পাহাড়ী পথ । ১৯৯১ সালে ভূমিকম্পের ফলে উত্তরকাশীর রাস্তাঘাট এখনো ভয়ানক । অজস্র ল্যান্ডস্লাইড । বড় বড় পাথরের চাঙড় এখনো ঝুলে পাহাড়ের গা ঘেঁষে । রাস্তা যেন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে রয়েছে ! পরের পিটস্টপ গঙ্গনানী । উত্তরকাশী থেকে গঙ্গনানী ৩৯কিমি দূরে । নীল আকাশের গায়ে বরফের টুপি পরা হিমালয়ের চূড়ো । সামনে ঘন সবুজ পাহাড়, স্তরে স্তরে সাজানো । সম্ভবতঃ ঐ বরফচূড়োই গোমুখ গ্লেসিয়ার । গঙ্গনানীর পথ আরো দুর্গম । ভয়ে রক্ত হিম হয়ে গেল । গঙ্গোত্রী পৌঁছে আবার ফিরতে হবে এই ভয়ঙ্কর পথ দিয়ে ! আরো সরু রাস্তা আর মধ্যে মধ্যে ল্যান্ডস্লাইডের নজির ; ভরাবর্ষায় না জানি কি অবস্থা ছিল এখানকার ! একবার ভাগিরথীকে ওপর থেকে দেখতে পাই তো আবার সে হারিয়ে যায় বহুনীচে । উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গায়ে গরম জামাকাপড়ের আস্তরণ একেএকে । গঙ্গনানীতে একটি গরমজলের কুন্ড ও পরাশর মুনির মন্দির আছে । পাহাড়ের ধাপে ধাপে ঝর্ণার জল গড়িয়ে পড়ছে অবলীলায় । পাহাড়ী ঝোরায় রাস্তা জলময় । এল লোহারীনাগ জলবিদ্যুত কেন্দ্র । কিছুদূরে পাহাড়ের ওপর শৈল শহর হর্ষিল । এবার আবার দেখা গেল ভাগিরথীকে এক ঝলক । ভাগিরথীর ওপর মানেরী ড্যাম আরো সুন্দর করেছে স্থানটিকে । কিছুটা সমতলের মত আর ধারে ধারে কোনিফেরাস পাইন, ক্যাসুরিনার দল সারে সারে । অনেকটা মনোরম রাস্তা ক্যাসুরিনার ছায়াবীথি ধরে । বেশ উপভোগ্য ড্রাইভ । চওড়া রাস্তা, রোদমাখা আকাশ অথচ আমরা চলেছি ছায়ার হাত ধরে । নীল আকাশ আর সবুজ পাহাড়ে মিলে মিশে একাকার । এল লঙ্কা ভিউ পয়েন্ট । খুব সুন্দর দেখায় এখান থেকে । এবার এক চমত্কার দৃশ্য । দুটি পাহাড়ের মধ্যে তৈরী গর্জ দিয়ে ফেনার মত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে ভাগিরথীর স্রোত । পাহাড়ের সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নামছে অবিরাম । অসাধারণ দৃশ্য! এতক্ষণের পথের দুর্গমতা, ভয় ভুলে ছবি নেওয়া শুরু । এবার এল ভৈরোঘাঁটির প্রাচীন শিবমন্দির সেখানে রয়েছেন আনন্দ ভৈরবনাথ, মাগঙ্গার পাহারায় । লেখা "ওয়েলকাম টু গঙ্গোত্রী" । মহাদেব এখানে মাগঙ্গার সিকিউরিটি গার্ড । ততক্ষণে সেই বরফের চূড়ার বেশ কাছে এসেছি । তাপমাত্রাও কমে গেছে অনেকটা । গঙ্গোত্রীর কাছাকাছি এসে মা গঙ্গাকে দেখবার জন্য আকুলি বিকুলি প্রাণ । সেদিন কালীপুজো আর দীপাবলী । গাড়ি গিয়ে নামিয়ে দিল সমতলে। । যার পাশ দিয়ে উঠে গেছে পাহাড়ের চড়াই পথ গোমুখের দিকে । সুদীর্ঘ ১৮ কিমি ট্রেক করতে হয় । আর নীচে চোখের সামনে তখন গঙ্গোত্রী। ভাগিরথীর হৈ হৈ করে বয়ে চলা । কি প্রচন্ড গর্জন তার । কি অপূর্ব রূপ তার । কত উপন্যাস, মানচিত্র, ভূগোল তখন বর্তমান হয়ে ভাসছে চোখের সামনে । বর্ণণা পড়েছি ভাগিরথীর, ছবি দেখেছি এতদিন অবধি এখন সে আমার সামনে; ভাগিরথীকে রাজা না রাণী কি আখ্যা দেওয়া যায় সে বিচার করার ধৃষ্টতা আমার নেই তবে তার যে রাজকীয়তা আছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না । সেই মূহুর্তে আমি তাকে রাণী ভেবে নিলাম । স্রোতস্বিনী তখন নীল ঘাগরার কুঁচি দুলিয়ে, সাদা ওড়না উড়িয়ে নেচে চলেছে আপন মনে । অবিরত তার কোলের কচিকাঁচা নুড়িপাথরকে চুম্বন করে চলেছে । জল নয়, নদী পান্নার কুচি বয়ে নিয়ে চলেছে । অবিরল কুলকুচি সেই পান্নাপাথরের । তার গর্জন ঢেকে ফেলেছে সবকিছু । তার সামনে রোদ্দুরকে মনে হচ্ছে কম তেজী ! দীপাবলীতেই এবছরের মত তাকে দেখে নিতে হবে । ঐদিন সন্ধ্যা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে সব মন্দির । সেদিন পাহাড়ের শেষরাত । দীপাবলীর রাত । পরদিন ঘরে ফিরবে সকলে মিলে । কেদারনাথ ফিরে আসবেন উখীমঠে । বদ্রীবিশাল যোশীমঠে । গঙ্গোত্রীর মাগঙ্গার ডুলি-পালকিও পৌঁছে গেল আমাদের সাথে সেই এক‌রাস্তায় । সূর্যের দক্ষিণায়নের সাথে সাথে পাহাড়চূড়োয় বরফ পড়বে। তুষারপাত হবে ওপরে । রাস্তা বন্ধ তাই শীতের ছ'মাস সকলে নীচে এসে ঘর পাতবে । আবার সূর্যের উত্তরায়নের সাথে সাথে এরা ওপরে উঠবে । কালীপুজোর দিন গঙ্গাস্নান । পাথর ভেঙে জলে দাঁড়াতেই মনে হল পা দুটো শিথিল । শূণ্য ডিগ্রীর কম বৈ তো বেশি নয় জলের তাপমাত্রা । কোনোক্রমে তিনডুব দিয়ে সকলে পারমার্থিক আনন্দ লাভ করছে । আবার পাথর নুড়ি, উপল সিঁড়ি ভেঙে জল থেকে উঠে ডাঙায় পা দিয়ে চেঞ্জরুম । তারপর গঙ্গারতি, গঙ্গাপুজো আর পিতৃতর্পণ । দেবী সুরেশ্বরী তখনো নাচের ভঙ্গীমায় । মাথার ওপর দুপুর সূর্য । তার ঝলক ভাগিরথীর বুকে । উত্তরদিকে ঘন সবুজ দুইপাহাড়ের মাঝখানে বরফঢাকা গোমুখ । ভাগিরথীর তরল তরঙ্গ নেমেছে সেখান থেকে ।

(কিভাবে যাবেনঃ হাওড়া থেকে হরিদ্বার ও সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে গুপ্তকাশী । পরদিন গুপ্তকাশী থেকে উত্তরকাশী হয়ে গঙ্গোত্রী ।
 http://www.youtube.com/watch?v=RHq3VNix0R8&feature=player_embedded#!

২৬ নভে, ২০১১

ডুবাইলি রে, ভাসাইলি রে..

http://sonartoree.files.wordpress.com/2011/09/pujo02.jpg
"আমার ঘরে বসত করে কয় জনা" এর উত্তরে সারা পৃথিবীর অন্ততপক্ষে এক তৃতীয়াংশ মানুষ সোশ্যাল নেটওয়ার্কের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চিত্কার করে সমস্বরে বলবে " এই তো অর্কুট ক্লাবঘরে শ'তিনেক ছাড়িয়ে ট্যুইটার খুপরিতে শ'পাঁচেক আর কেল্লাফতে ফেসবুক পাড়ায় । হাজার ছাড়িয়ে গেলে তুমি তো সেলেব ! স্মার্টফোনের সাথে সোশ্যালনেটের দোস্তি যত বাড়ছে তার ইউসারদের মধ্যেও বাড়ছে সেই বন্ধুত্বের হাতছানি । আর মানুষের ইঁদুর দৌড়ের গতিবেগ যত বাড়ছে তত বাড়ছে স্ট্রেস এবং স্ট্রেন । ফলে কম সময়ে মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে যাবার এই সুবিধে গুলোও মানুষ কাজে লাগাতে শিখেছে বুদ্ধিমানের মত । তাই দোল-দুর্গোত্সবে গ্রিটিংস থেকে শুরু করে জন্মদিন-বিয়ের তারিখ আর হাতের পাঁচ সুপ্রভাত-শুভরাত্রি তো আছেই । তারপর আমি হংকং থেকে হনললু কিম্বা বন্ধু সিকিম থেকে সিঙ্গাপুর পৌঁছিয়েই বার্তা বিনিময় । আমি আজ চিংড়ি না ইলিশ রাঁধলাম তাও জেনে গেল বন্ধু ছবিসমেত । আমার মায়ের রক্তচাপ ঊর্দ্ধমুখী সেও জানলো সারা পৃথিবী । কেউ বা তার বোনের জন্মদিনের কেক কাটার ছবি কেউ আবার শিকাগো কিম্বা টরোন্টোর এয়ারপোর্টে পা দিয়েই সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিল আমি " হেথায় "; কিন্তু কেউ যদি লেখে " আমার খুব বিপদ, কে আছো কোথায় , ছুটে এসো আমার কাছে " তাহলে সেই অগণিত বন্ধুগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কেউ কি আসবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ?অচেনা, অজানা উড়োমিতে-মিতেনীর দলে কে বন্ধু আর কেই বা অ-বন্ধু বোঝা মুশকিল ।
এখন তো কিটিপার্টি থেকে শুরু করে ঘরোয়া পার্টিতে গৃহবধূদের মুখেও সেই এক কথা । দেখা হলেই " তুই ফেসবুকে আছিস্" কিম্বা " গুগ্‌ল প্লাসে একাউন্ট খুলেছিস? " নয়তো যেন তার সোশ্যাল স্টেটাস রক্ষা করাই দায় । কিন্তু একবার বন্ধু হয়ে যাও । ব্যাস! তারপর আর বন্ধুত্বকে কে পায়! সেই অঞ্জন দত্তর গানের মত " তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হত না " বলে চালিয়ে যাও স্টেটাস আপডেট । আর যদি তুমি ছন্দের কারসাজি জানো তাহলে তো ফিদা হয়ে যাবে বন্ধুকুল তোমার । দুকুল ছাপিয়ে কাব্য ঝরবে ফেসবুকের আঙিনায় । উপছে পড়বে নাতি-১৪০ সনেট । আর ছন্দ না এলেও,
ক্ষতি কি ! না হয় আজ পড়বে , ফেসবুকে লিটারারি কাব্য !
পড়ল কথা সবার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে !
তবু বেঁচে থাক সোশ্যালনেট । একাকীত্বের অবসাদে ভুগছেন এমন অনেক সিনিয়ার সিটিজেনের জন্য, একরাশ মনখারাপের দুপুর নিয়ে অপেক্ষমানা হোমমেকারটির জন্য , প্রোষিতভর্তিকার জন্য আর প্রবাসী ছেলেপুলেদের মা-বাপের জন্য ; ডুবাইলিরে, আমায় ভাসাইলি রে " বলে ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ুন অর্কুট থেকে ফেসবুকে ও সেখান থেকে গুগ্‌লপ্লাসে । ট্যুইট করুন গোটাকতক। বদল করুন প্রোফাইল ছবি মাঝে মাঝে । জগতের হাটের মাঝে আপনার হাঁড়ি ভাঙুন । দেখবেন আপনি আর একা নন । বন্ধুত্বের পারদ যত চড়বে ওপরে আপনিও তত ভালো থাকবেন । সদা থাকো আনন্দে ! হ্যাপি সোশ্যালনেটওয়ার্কিং !  

১৪ নভে, ২০১১

ভাগিরথীর উত্স সন্ধানে



উত্তরকাশী থেকে ভোর ভোর বেরিয়ে পড়লাম গঙ্গোত্রীর পথে ।  ভাগিরথীর তীর ঘেঁষে চলতে লাগলাম অজস্র মন্দিরময় শহরতলীকে ফেলে ।

সামনে এল ভেড়ার পাল । অগণিত মেষ শাবক গড্ডলিকা প্রবাহে পাহাড় থেকে নেমে আসছে সমতলে । কারণ সেইদিনই এই পথ বন্ধ হয়ে যাবে । দীপাবলী অবধি তীর্থ যাত্রা হয় তারপর শুরু হয় প্রবল তুষারপাত ফলে রাস্তা বন্ধ থাকে । যাই হোক সেই মেষ শাবকের দল আপাততঃ মাস ছয়েকের জন্য সমতলে ঘরকন্না করতে আসছে । সেই জ্যামে পড়লাম কিছুক্ষণ ।
প্রথমে নদীর সমতলে কিছুটা চলার পর আবার উঁচুতে উঠতে শুরু করল আমাদের গাড়ি ।বীভত্স সরু পাহাড়ের চড়াই পথ । উল্টোদিক থেকে একটা বাস বা গাড়ি এসে গেলে আমাদের গাড়িকে সামলে নিতে হচ্ছিল বারবার । অতি সন্তর্পণে পিছু হটে সামনের গাড়িকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে আবার চলা ।  ১৯৯১ সালে ভয়ানক ভূমিকম্পের ফলে উত্তরকাশী জেলার রাস্তাঘাট খুব ভয়ানক হয়ে রয়েছে ।  তবে ভাল গাড়ি ও অভিজ্ঞ চালক থাকলে তেমন কিছু ভয় নেই ।

পথে পড়তে লাগল অজস্র ল্যান্ডস্লাইড । বড় বড় পাথরের চাঙড় এখনো ঝুলে রয়েছে পাহাড়ের গা ঘেঁষে । আর ধ্বসের কারণে রাস্তাগুলির আকৃতি হয়েছে ভয়ানক । যেন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে রয়েছে !

নীল আকাশের গায়ে  বরফের টুপি পরা হিমালয়ের চূড়ো । সামনে ঘন সবুজ পাহাড়, স্তরে স্তরে সাজানো । সম্ভবতঃ ঐ বরফচূড়োই গোমুখ গ্লেসিয়ার ।
গঙ্গনানী পড়ল । সেখানে একটি গরম জলের কুন্ড আছে । সালফার হট স্প্রিং আর কি ! জলে পা ডুবিয়ে খানিক বসে তুঙ্গনাথের ক্লান্তি কমল কিছুটা;  ফুটন্ত প্রায় জল । কি অপূর্ব সৃষ্টি । বাইরে কি ঠান্ডা আর জলটা কি ভীষণ গরম । স্থানীয় নাম “গর্মকুন্ড”  ।

এবার আবার দেখা গেল ভাগিরথীকে এক ঝলক । পথে ভাগিরথীর ওপর মানেরী ড্যাম আরো সুন্দর করে তুলেছে স্থানটিকে ।  কিছুটা সমতলের মত আর
কিছুদূরে পাহাড়ের ওপর শৈল শহর হর্ষিল   ( উত্তরকাশী থেকে ৭৩কিমি দূরে) । হর্ষিল বিখ্যাত সুমিষ্ট আপেলের জন্যে ।

এবার এক চমত্কার দৃশ্য চোখে পড়ল ।
দুটি পাহাড়ের মধ্যে তৈরী হয়েছে গর্জ আর সেই গর্জ দিয়ে ফেনার মত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে ভাগিরথীর স্রোত ।

এবার এল ভৈরোঘাঁটি বা প্রাচীন এক শিব মন্দির সেখানে রয়েছেন আনন্দ ভৈরবনাথ,  মা গঙ্গাকে পাহারা দিচ্ছেন । সেখানেই লেখা রয়েছে “ওয়েলকাম টু গঙ্গোত্রী” । মহাদেব এখানে মা গঙ্গার দ্বারী বা সিকিউরিটি গার্ড ।  ততক্ষণে সেই বরফের চূড়ার বেশ কাছে এসে গেছি ।

গঙ্গোত্রীর কাছাকাছি এসে মা গঙ্গাকে দেখবার জন্য আকুলি বিকুলি প্রাণ  আমাদের । সেদিন কালীপুজো আর দীপাবলী ।
উত্তরদিকে ঘন সবুজ দুইপাহাড়ের মাঝখানে বরফঢাকা গোমুখ । ভাগিরথীর নেমেছে সেখান থেকে ।

আমার ভূগোল ব‌ইয়ের খোলাপাতা তখন চোখের সামনে
বরফ গলা জলের তাপমাত্রা শূণ্য ডিগ্রীর কম বৈ তো বেশি নয় । ভাবছি বসে নামব কেমন করে জলে ! জলে পা দিয়ে মনে হল শরীরের নীচের দিকটা অবশ হয়ে গেছে । এদিকে কালীপুজোর দিন এসে তিনবার ডুব না দিলে পুণ্যি হবেনা । খুব দোটানায় মন !

অন্য জন ততক্ষণে জলে নেমেই বলে ভিডিও তোলো, জলের এমন গর্জন আর শুনতে পাবেনা ….

স্নান সেরে মা গঙ্গার  তীরে বসে পুজো আর আরতি সারলাম । তারপর আসল মন্দিরে গিয়ে আবার পুজো । দেওয়ালী বলে খুব সাজিয়েছিল ফুল দিয়ে । তবে সেদিন মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে বলে তীর্থযাত্রীর ভীড় নেই বললেই চলে । কিছু লোকাল মানুষজন এসেছিলেন পুজো দিতে আর দু চার জন দূর থেকে, আমাদের মত ।

ভাগিরথীর ব্রিজের ওপরে মন্দিরে পুজো দেবার পর
এবার যুদ্ধজয়ের আনন্দ নিয়ে প্রাক্‌গঙ্গা বিজয়ের দ্বিপ্রহর , অবাঙালী ফুড জয়েন্টে । আগুন গরম তন্দুরী রুটি, ডাল ও পনীর । সেই মূহুর্তে খিদেও চরম…..

১১ নভে, ২০১১

দেবভূমিতে দিনকয়েক





গত ২২শে অক্টোবর কলকাতা ছেড়ে বেরিয়েছিলাম  উত্তরাখন্ডের পথে । দিল্লী থেকে হরিদ্বার । সন্ধ্যে আর ঊষার গঙারতি দেখে মন ভরে গেল । এই নিয়ে তিনবার হোল আমার হরিদ্বার ভ্রমণ ।   সেখানে একরাত ;  পরদিন, ২৩শে  অক্টোবর হরিদ্বার থেকে দেরাদুন জেলার অন্যতম তীর্থক্ষেত্র হৃষিকেশের পথ পড়ল ।
ভাগিরথীর ওপর বিখ্যাত লক্ষ্মণঝুলা সেতুকে ফেলে রেখে  আবার চলতে লাগলাম আমরা  গুপ্ত কাশীর পথে ।  গুপ্তকাশীতে থেকে পরদিন   ভোর ভোর তুঙ্গনাথের পথে । চোপতা অবধি গাড়িতে । তারপর সেই ভয়ানক দুর্গম অভিযান তুঙ্গনাথের পথে । পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিব মন্দির ( ১২০৯০ ফুট ) উচ্চতায় গাড়োয়াল হিমালয়ের কোলে । তুঙ্গনাথ পঞ্চকেদারের একটি । ১৯৯৭ সালে কেদারনাথ এসেছিলাম গৌরীকুন্ড হয়ে । এবার আরো অন্যরকম লাগল ।  হরিদ্বার থেকে গুপ্তকাশী যাবার পথে পড়ল দেবপ্রয়াগ যেখানে গঙ্গা তৈরী হয়েছে ভাগিরথী ও অলকানন্দার সঙ্গমস্থলে ।
তারপর পড়ল রুদ্রপ্রয়াগ যেটি হল অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থল । কি অপূর্ব স্থান এবং হিমালয়ের কি অপরূপ সৌন্দর্য্য তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না ।
 গুপ্তকাশীতে মহাদেব-পার্বতীর অর্ধনারীশ্বর মন্দির 
গুপ্তকাশীর ভোর ছিল বড় সুন্দর । ঘর থেকে গাড়োয়াল হিমালয় দেখলাম দুচোখ ভরে । পাহাড়ের কোলে ছোট্ট পুরোণো শহর গুপ্তকাশী । ব্রেকফাস্ট, স্নান সব সেরে নিয়ে সকাল সাতটায় আমাদের যাত্রা শুরু হল চামোলি জেলার চোপতার পথে । গাড়ি যেই চলতে শুরু করল পাহাড়ের মাথায় বরফ দেখে আমরা যারপরনাই উত্তেজিত । রোদ উঠে গেছে ততক্ষণে আর পাহাড়ের বরফচূড়া সেই আলোয় রূপোর মত চকচক করছে । এ দৃশ্য কখনো পুরোণো হয়না । স্থানকালপাত্র ভেদে অবর্ণনীয় । অমোঘ এই আকর্ষণ । ভাষাতীত এই সৌন্দর্য্য । মন্দাকিনীর ওপর ব্রিজ পেরিয়ে বরফচূড়ায় চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে যেতে লাগলাম । গুপ্তকাশী থেকে চোপতার পথ ৪৫ কিলোমিটার । আরো চড়াই পথ পড়ল । যত এগিয়ে এল চোপতা তত‌ই পথ দুর্গম থেকে দুর্গমতর হ’ল । সরু রাস্তা । গাড়ির পথটুকুও ভয়ানক দুর্গম । না জানি পায়েহাঁটা তুঙ্গনাথের পথ আরো কত দুর্গম হবে সেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম । অবশেষে চোপতা এল সময় মতন । গাড়ি নীচে রেখে   সকাল দশটায় চোপতা থেকে আমাদের হাঁটা শুরু করলাম তুঙ্গনাথের পথে ।   ১৯৯৭ সালে গৌরীকুন্ড হয়ে কেদারনাথ এসেছিলাম ঘোড়ায় করে আর পায়ে হেঁটে ফিরেছিলাম ।

 কেদারনাথ শিবমন্দির
গৌরীকুন্ড থেকে কেদার ১৪ কিলোমিটার ;  কেদারনাথের উচ্চতা ১১৭৫০ ফুট আর তুঙ্গনাথের উচ্চতা ১২০৭০ফুট । তুঙ্গনাথ পৃথীবীর মধ্যে সর্বোচ্চ শিব মন্দির ।  । তুঙ্গনাথ পঞ্চকেদারের একটি । চোপতা থেকে পায়ে হেঁটে তুঙ্গনাথ যেতে সময় লাগে আড়াইঘন্টা।  বাঁধভাঙা আনন্দের উচ্ছ্বাস আর মনের জোর নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম ।তুঙ্গনাথের পথ শুরু থেকেই চড়াই ফলে কিছুদূর গিয়েই মনে হয় আর পারবনা পৌঁছতে, দম ফুরিয়ে যায় । অক্সিজেন কম পড়ছে বোধ হয় । ফুসফুস আর টানতে পারছেনা । কিছুটা চলি তো আবার বসে বিশ্রাম করি  পাহাড়ের গায়ে । নির্জনতা আমাদের সঙ্গী আর অদম্য মনের জোর আমাদের পাথেয় । শব্দ বলতে দাঁড়কাকের আওয়াজ আর দু একজন ঘোড়ারোহীর কৃপায় ঘোড়ার গলার টুংটাং, আর রডোডেনড্রণের শুকনো পাতা টুপটাপ ঝরে পড়ার শব্দ । মিষ্টি লাগে শব্দটা কিন্তু পথের ক্লান্তিতে সেটাও উপোভোগ করতে কষ্ট হ’ল ।
 হিমালয়ের এলপাইন অঞ্চলে তুঙ্গনাথ । তাই সবুজ গাছপালা অতি বিরল ।
চোপতা থেকে ৩৫০০ ফুট উঠতে হবে এমন চড়াই পথ বেয়ে ! একবার ভেবেছিলাম ঘোড়া নেব কিন্তু কেদারনাথ ঘোড়ায় গিয়ে দেখেছিলাম ঘোড়ায় বসে কেবলি মনে হয় এই বুঝি সে পড়ে যাবে এই বুঝি আমি খাদে পড়ে যাব কিন্তু নিজে হাঁটলে প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যাবে সেই ভেবে পায়েহাঁটার চেষ্টা….

তুঙ্গনাথ শিবমন্দির
তুঙ্গনাথে ওঠার ক্লান্তি  আপাতত   ভুলে গেলাম নীচে নেমে চোপতার পাতি একটা হোটেলে গরম টোম্যাটো স্যুপ এবং আগুণ গরম সবজীমিশ্রিত ম্যাগি খেয়ে । ওই মূহুর্ত্তে গরম খাবারের খুব প্রয়োজন ছিল আমাদের ।

এবার যাত্রা চোপতা হয়ে উখীমঠের দিকে । উখীমঠ হিমালয়ের গায়ে গুছোনো পরিপাটি এক শহর । এই মন্দিরে কেদারনাথের বিগ্রহ এবং পুরোহিত শীতকালে তুষারপাতের সময় নেমে এসে বসবাস করেন । প্রচন্ড ঠান্ডায় কেদারের পথ তখন বন্ধ হয়ে যায় । পুরোহিতের জন্য একটি আশ্রম ও আছে । মন্দিরটিও বেশ সুন্দর আর শান্ত ও নির্জন পরিবেশ ।  উখীমঠ থেকে দূরে গুপ্তকাশী শহরকে বেশ দেখায় ।
উখীমঠ
  সেদিন রাতে গুপ্তকাশীর হোটেলে ফিরে এসে আবার পরদিন গাড়ি নিয়ে বেরুনো উত্তরকাশীর দিকে । উত্তরকাশী গঙ্গার ধারে বেনারসের মত তীর্থকর মন্দিরময় শহর । বেশ কিছু বছর আগে বিদ্ধংসী ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে যাওয়া এই শহরে এখনো টিকে আছে প্রাচীন মন্দিরগুলি ।
গঙ্গার ঘাট বড় মনোরম । নদীর ধার দিয়ে দিয়ে অনেকদূর হেঁটে নিলাম । কেদারঘাট গেলাম । সেদিন ধনতেরস ছিল । বাজার পড়ল । কাশীর রাস্তার মত অলিগলি দিয়ে বাজার আর বাজার । সেখানে দেওয়ালীর পসরা । কি ভীড় সেখানে । ধাতব দ্রব্য কিনতে হয় ধনতেরসে । তাই তামার কিছু সুদৃশ্য ঘটি কিনে ফেললাম । আমার আবার ফুল সাজানোর বাতিক আছে তো ! কাজে লাগবে তাই ।   শক্তিমন্দির এবং মহেশ্বর মন্দির গেলাম । দর্শনীয় এক রাজকীয় ত্রিশূল দেখলাম সেই শক্তিমন্দিরে । এই ত্রিশূল দিয়ে না কি মহাদেব অকাসুর বধ করেছিলেন ।   রাতে উত্তরকাশীর সাদামাটা হোটেলে রুটি, ডাল ও সবজী খেয়ে আবার ঘুম । পরদিনের যাত্রা গঙ্গোত্রীর পথে …
অতুলনীয় হিমালয়
 আরো হিমালয় 

১ নভে, ২০১১

কোন সে আলোর স্বপ্ন-মেলে



সত্যি সত্যি

এ জায়গাটার নাম "নিশ্চিহ্নপুর"| খুব কাছ থেকে এই নিশ্চিহ্নপুরকে আমি দেখেছি । একটা শহুরে পাড়া গাঁ বলা যেতে পারে । বা গেঁয়ো শহরও বলা যায়। কেউ বলে মফ:স্বল, কেউ বলে শহরতলী; পল্লীপ্রকৃতির সারল্য নেই এখানে আবার নেই শহরের ধূলো-ধোঁয়া, তেলকালি ভারি করা বাতাস। আমার ঘরের পাশে যাদের ঘর তাদের দুটি ছেলে সারাক্ষণ খালি গায়ে, খালি পায়ে বুকের পাঁজরা বের করা শরীর শুদ্ধ বারমুডা পরে ঘুড়ি ওড়ায় । একজন ধরে লাটাই আর অন্যজন প্রাণপনে আকাশের কোনো না কোনো ঘুড়িকে কাটার চেষ্টা করে । তার হাতে আকাশের লক্ষ্যে ছোঁড়া ঘুড়ির সূতো । একটা মেয়ে বোধহয় ছেলেদুটোর বড়বোন, সাদামাটা স্কার্ট-ব্লাউজ পরে থাকে । রোজ নিয়ম করে সকাল দশটা নাগাদ দুপাশে দুটো বেণী দুলিয়ে, নীল ছোপ ধরা সাদা স্কুলড্রেস পরে ইস্কুলে যায় । ফেরে সেই বিকেলে । তাদের একফালি বারান্দায় রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের চুঁইয়ে পড়া হলদে আলোয় মেয়েটির লড়াই শুরু হয় । মাধ্যমিকের ভৌতবিজ্ঞান, ত্রিকোণমিতি কিম্বা উপপাদ্যেরা উঁকি মারে তখন ।ছেলেদুটি তখন বোনের পাশে বসে ঢুলতে থাকে সারাদিনের ক্লান্তিতে আর অপেক্ষা করে কখন রান্নাঘর থেকে ডাক পড়বে নৈশাহারের.. মানে গরম ভাতের ।

উল্টোদিকের বাড়ির একফালি রান্নাঘর থেকে সারাদিন ধরে বেজে চলে প্রেসারকুকারের হুইস্‌ল | প্রেসারকুকারের মালকিনের একজন সহকারী আছে যে দিনের ভেতর প্রায় বিশ পঁচিশবার শাট্‌ল ককের মত একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে হোমডেলিভারির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে তার গন্তব্যস্থলে । বাড়ির নীচে একটা বিউটিপার্লার আছে। নাম "রূপশ্রী"| এ পাড়ার মেয়েরা সব নাকি কাজ করে সেখানে । আইব্রো, মেহেন্দি, ম্যানিকিওর এত সব দরজায় লেখাও আছে। বাড়ির মালিক একদম ওপরে মানে তিনতলায় থাকে । ছাপোষা গেরস্ত । নীচের দুঘর মানে ঐ একতলার বিউটিপার্লার আর দোতলার ছেলেমেয়ে তিনটিরা যেখানে থাকে বোধ হয় এনার ভাড়াটে। এই ভাড়ার টাকাতেই তার দিন চলে বলে মনে হয় আমার । সকালে রোজ লুঙ্গি পরে বাজারে যান আর ব্যাগ হাতে করে কিছু পরেই ফেরেন | কোন দিন ডাঁটা কোনদিন পুঁইশাক, কোনদিন লাউডগা উঁকি মারে ব্যাগ থেকে তার । সারাদিন বাড়ি থাকেন এই ভদ্রলোক । ছাদের ওপর টবে কটা শখের ফুলগাছ আছে তার বিকেলে রোদ পড়লেই ছাদে গিয়ে পরিচর্যা করেন । একটা ছেলে আছে তাঁর । স্মার্ট চেহারা কিন্তু ছোকরা যে কি করে জানতাম না । সেদিন ভোরে উঠে দেখি ও খবরের কাগজ দেয় এ পাড়ার বাড়ি বাড়িতে । একটা পত্রিকা কিনব বলে কথায় কথায় জিগেস করতে বলল বিএসসি পাশ করেছে গত বছর। এই জায়গাটিতে ঘরের কাজ করার লোকের অভাব নেই । কিন্তু সকলে একবেলার ঠিকের কাজ করে । বিকেলে এরা পালা করে করে ঐ বিউটিপার্লারে কাজ করে । এদের মধ্যে কেউ আবার সন্ধ্যের ঢল নামতে না নামতেই সেজেগুজে মুখে রঙ মেখে সব সফেদাসুন্দরী হয়ে বিদ্দ্যুল্লতার মত বড় রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ট্রাক ড্রাইভারদের মনোরঞ্জনের জন্য, যেখানে সব পেট্রোলপাম্প আছে| আছে চায়ের ঠেক,
ব্রেড-ওমলেট, তড়কা-রুটি, আর আলুপরোটার ধাবা । একটা মন্দির আছে এখানে । শুনেছি খুব জাগ্রত । সকালসন্ধ্যে পুজোর ঘন্টা শুনতে পাই আমি । শনিবারে সন্ধ্যায় উপচে পড়ে ভীড় সেখানে । খুব ধর্মভীরু এখানকার মানুষজনেরা । শ্রাবণে মহাধূম করে তারকনাথে যায় দলবেঁধে । চৈত্রে চড়কের সময় দন্ডী কাটে আর সম্বচ্ছর বারোমাসের তেরোপাব্বনে মাইক চালিয়ে পুজো পালন করে এরা । যে মেয়েটির কথা বলেছিলাম সে এবার মাধ্যমিকে স্টার পেয়েছে । মেয়েটির নাম আলো । তার ভাইদুটো মানুষ হয়নি তা নয় তবে সারাদিন খেলে বেড়িয়ে যেমন মানুষ হয় তেমন আর কি । একটা ভাই কোনোরকমে উচ্চমাধ্যমিক আর আরেকজন লোকাল পোষ্ট অফিসে চা, জল ইত্যাদি দিয়ে প্রাইভেটে মাধ্যমিক অবধি পেরিয়েছে । আলোদের বাবা মারা গেছেন অনেকদিন
হল । মা ক্যানসারে ভুগছিলেন । দারিদ্র্য আর মানসিক চাপে বেশিদিন ভোগেন নি । ভগবান অভাবের সংসারে তাকেও মুক্তি দিয়েছেন । আলো মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়েই সেই শহুরে গ্রামের ছোটদের বাড়িতে টিউশান দিয়ে সংসার চালিয়ে আসছে । একে একে পেরিয়েছে উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগ, জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে ঢুকেছে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে । মুখ্যমন্ত্রীর তরফ থেকে ভাল রেজাল্টের জন্য কিছুটা অনুদান পেয়েছে । তার পাড়ার স্বেচ্ছাসেবী সংঘেরা বাকীটুকুর ব্যবস্থা করেছে এক এনজিওর কাছ থেকে । তারপর বিটেক পাশ করেছে কম্পিউটার সায়েন্সে এবং জিআরই, টয়ফেল দিয়ে আমেরিকায় চলে গেছে আজ থেকে মাস ছয় আগে । নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলও পেয়েছে । এম.এস, পি.এইচ.ডি করে ফিরবে একেবারে । আলো দুভাইকে বাড়িভাড়া সমেত তাদের খাইখরচ ডলারে পাঠায় প্রতিমাসে ।

ভাগ্য

এরপর কেটে গেছে বহুবছর । সেই শহুরে গ্রাম বা গ্রাম্য শহরের আর কোনো নতুন উন্নতি হয়নি কয়েকটা পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন ফ্ল্যাটছাড়া । আর হয়েছে দুএকটা মিষ্টি, শাড়ি আর গয়নার ছোট ছোট দোকান । দ্রুত শহরায়নের ঢেউ যেন আছড়ে পড়ে এ গ্রামের মানুষকে কিছুটা গতিশীল করে তুলেছে । অভাবের তাড়নায় গেরস্ত বাবা মায়েরা এখন ছেলেপুলের লেখাপড়ার দিকে বিশেষ মন দিয়েছে । আমি একে "আলো এফেক্ট" বলি।

নিদেন পক্ষে ছেলেছোকরারা মাধ্যমিক পেরিয়ে সিকিউরিটির চাকরী করছে । আরো এক ধাপ ওপরের স্মার্ট যুবকযুবতীরা বিপিওর চাকরী করতে যায়|প্রায়শই সকাল সাঁঝে গাড়ি এসে বাড়ির দোরগোড়ায় নামিয়ে দিয়ে যায় তাদের । রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারা কালচারটার একটু একটু পরিবর্তন হচ্ছে তখন ।
আলোর চোখে অনেক স্বপ্ন । নিজের মাটির রঙ বদলে দেবার স্বপ্ন । আলো বিদেশে গিয়ে বৈভব দেখে মনে মনে কল্পনার অনেক কুসুম ফুটিয়েছে তার মনের বনে। তার পড়াশুনো আজ শেষের মুখে । শুধু বাকী শেষের কিছু ফর্মালিটি ।
পিটসবার্গে আলোর পাশের ঘরের এক রিসার্চ স্কলার অনুভব কুমার বিহারের ছেলে ।কিন্তু কলকাতাতেই বড় হয়েছে । বাংলা বলতে ও লিখতে পারে খাসা । আলোর সাথে এই পাঁচ বছরে অনুভবের একটু বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক । সব ব্যাপারেই দুজনের খুব মতের মিল কেবল একটা ব্যাপার ছাড়া । আলো দেশে ফিরতে চায় ; আর অনুভব থেকে যেতে চায় এই আমেরিকার বৈভবকে আঁকড়ে ধরে ।
সেদেশে বসে তার পুরোণো গ্রাম্য শহরের কথা এখনো ভাবে আলো । কোনো সুখ স্মৃতি নেই সেখানে । নেই কোনো পিছটান । কিন্তু তবুও তার প্রাণ কেঁদে ওঠে বারেবারে । কিছু একটা করতে হবে সেখানে । কিছু একটা গড়তে হবে সেখানে যাতে রাতারাতি বদলে যায় সেই শহুরে গ্রামের খোলনলচে । স্বার্থপরের মত ভাইদের কথা ভাবেনা সে । আজ যেখান থেকে বড় হয়ে সে এত বড় আকাশটাকে দেখতে পেয়েছে সেই মূলটাকে তো অস্বীকার করার উপায় নেই । কথা বলেছে কয়েকজন এন.আর.আই বিজনেস ম্যাগনেটের সাথে । আর সেই থেকেই স্বপ্নের ভেলায় চড়ে ভাসতে থাকা তার ।

পিটসবার্গের আকাশে সেদিন শুক্লা একাদশীর চাঁদের জ্যোত্‌স্না। নিজের এপার্টমেন্টের তলায় সুইমিংপুলের ধারে স্নান সেরে সদ্য উঠে এসেছে পঁচিশ বছরের আলো । এ ক'বছরে তার রূপে ধরেছে জৌলুস । চেহারায় এসেছে তরতাজা স্মার্টনেস । সদ্য স্নানের পর তন্দ্রা এসেছে আলোর ; চাঁদের আলোয় অবগাহন করতে করতে আলো পৌঁছে গেছে ততক্ষণে সেই গ্রামে । ঝাঁ চকচকে ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেস ওয়ে আর উদ্ধত সব ল্যাম্পপোষ্টে অবনত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা হ্যালোজেন আলোর মাঝে তাদের গ্রাম্য শহরকে চেনা দায় ! রাস্তার ধারে শপিংমল, তার সামনে ফোয়ারা । হালকা গানের সুর ভেসে আসছে সেখান থেকে । রাস্তা দিয়ে সব গাড়ির ঢল নেমেছে । এমন কখনো দেখেনি তো সে । বড় বড় রেস্তোরাঁ। আর যে রাস্তায় তারা থাকত সেখানে হয়েছে একটা ছিমছাম টাউনশিপ । বাড়িগুলোর কি চমতকার আর্কিটেকচার ! চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে আলোর ।আলো দেখতে পেল সেই তাদের বাড়ির পাশে সেই প্রেসার কুকারের মালকিন মহিলা যিনি হোম ডেলিভারি করতেন তাঁর একটা হোটেল হয়েছে যার নাম "পঞ্চব্যাঞ্জন" আর সেই যে রূপশ্রী নামের বিউটিপার্লার সেটি এখন একটা মাল্টিজিম আর স্কিন ক্লিনিকের মর্যাদায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তার জায়গায় । নিশ্চিহ্নপুরের মন্দিরগুলোয় মার্বেল বসেছে । মন্দিরের পেতলের চূড়ো চকচক করছে চাঁদের আলোয় ।কত নতুন স্কুল হয়েছে এখানে । আর দেখতে পেল তাদের মাকে । কতদিন দেখেনি । মায়ের হাতে শুধু থাকত দুগাছা লাল পলা । আর গলায় একরত্তি রূপোর চেন । মা আজও কেমন লাবণ্যময়ী । হাত ভর্তি সোনার চুড়ি, গলায় সোনার চেন । মা চলেছে সেই মন্দিরে পুজো দিতে । মা তো বেঁচে নেই । আজ থেকে কত দিন আগে মা চলে গেছে তাদের ছেড়ে । আলোর মনে হল গলা দিয়ে সুর উঠছে তার "আজ যেমন করে গাইছে আকাশ" । ঠিক তেমনি করেই একটা নতুন নিশ্চিহ্নপুর সে দেখতে চাইছে। আহা বেচারা ভাইদুটো তার ! তাদের জন্য বড় মায়া হতে লাগল ।

স্বপ্নের ঝিমধরা নেশা কেটে গেছে অনেকক্ষণ আগে । আলো ছ'মাস পর দেশে ফিরছে । তার রিসার্চের ফাইনাল ডিসার্টেশন এগিয়ে আসছে ক্রমশ: ; অনুভবের মন খুব খারাপ । তার কাজ এখনো বাকি অনেকটাই । আলো ফিরে এসেছে কোলকাতায় ডাঃ আলো ব্যানার্জি হয়ে । অনুভবকে ছেড়ে আসতে কষ্ট কিছুটা হলেও আলোর অনুভবের প্রতি ভালোবাসা একটুও কমেনি । কমিউনিকেশানের অগ্রগতিকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় আলো । মোবাইল আর ই-মেল তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে | সল্টলেকে সেক্টর ফাইভে একটি চাকরী নিয়ে এসেছে সে । সেখানেই একটি বাড়িতে পি.জি হয়ে আছে । শুধু স্বপ্ন নিশ্চিহ্নপুরকে আলো দেখানো । রোজ ই-মেল আদানপ্রদানে নিশ্চিহ্নপুরের একটু একটু করে অগ্রগতি খুঁজতে থাকে আলো । এনা.আর.আই শিল্পপতিদের সাথে যোগাযোগ রাখে নিয়মিত । আর মধ্যস্থতা করে অনুভব ।

স্বপ্ন-মেল

অনুভবের মেলবক্স :
অক্টোবর ২০০৫
আলো :
সবশুদ্ধ বিরাট একটা প্রজেক্ট বুঝলে? তারপর নিশ্চিহ্নপুরকে আর কেউ চিনতে পারবে না । আজ অফিসের তিনজনকে নিয়ে সার্ভে করতে গেছিলাম নিশ্চিহ্নপুরের নতুন প্রোজেক্ট। জমি, ফ্ল্যাট, দোকানপাট রেস্তোরাঁ, স্কুল, হসপিটাল সব নিয়ে নিশ্চিহ্নপুরের নতুন টাউনশিপের প্ল্যান যা ডা: রায় আর মি: শর্মার সাথে আলোচনা হয়েছিল তোমার অফিসে বসে তা আজ নিজের চোখে দেখে এলাম অনুভব ।
একটা একটা করে তিন তিনটে ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হল । আমাদের ভাড়াবাড়ির পেছনে যে লো লায়িং বস্তি এরিয়া ছিল তা সব ভাঙা হয়ে গেছে । মানুষ গুলোকে রিহাবিলিটেটও করেছে ইষ্টার্ণ মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে । আইআইটির এক ইঞ্জিনিয়ারের আর্কিটেকচারে আমাদের এই মফস্বলে টাউনশিপ গড়ে উঠতে চলেছে । নিশ্চিহ্নপুরের মধ্যে এই টাউনশিপ হবে স্বতন্ত্র তার নাম দেওয়া হয়েছে "রোশনি"


এপ্রিল ২০০৬
আলো :
এদিকে একটা ঝামেলা শুরু হয়েছে অনুভব । জমি নিয়ে স্থানীয় মানুষদের সাথে । আর কাজ এগুচ্ছে না । তুমি পারলে মি: শর্মাকে একটা ফোন কোরো । আমি একদম সময় পাচ্ছিনা । আজ খবরে দেখলাম তাই জানতে পারলাম । জানিনা কাজটা থেমে গেল নাকি । ভাবছি এই উইকএন্ডে সময় করে একবার সাইটে যাব । এই এক সমস্যা এখানে । কাজ আর এগুবে কি করে জানিনা ।

আক্টোবর ২০০৬
আলো :
অনুভব, ব্যাঙ্ক লোনের কথাটা এগুলো কিছু? মি: শর্মা কিছু জানালেন কিনা জানিও । এখানে আবার কাজ এগুচ্ছে ঠিকমত । আমি আর যেতে পারিনা বহু দিন । নতুন চাকরীতে জয়েন করে এতবার ব্যাঙ্গালোর যেতে হল যে ছুটি পেলেই মনে হয়
একটু রেস্ট নি । তুমি এই সময় এখানে থাকলে খুব ভালো হত । বড্ড মিস করি তোমাকে অনুভব! তুমি কি সত্যি পোস্টডক করবে ওখানে ? কিন্তু ফিরে তোমাকে আসতেই হবে এদেশে । কথা দিয়েছিলে তুমি। নতুন বছরে আমাদের কোম্পানির পার্টনাররা আরো অনেককে পার্টনার করবে । তোমার মত ব্রাইট ক্যান্ডিডেটকে লুফে নেবে । কিছু শেয়ার তোমাকে কিনতে হবে । মানে ইনভেস্ট করে পার্টনার হয়ে ঢুকবে তুমি এখানে । আমিও ভাবছি অফারটা নেব । তাহলে আমরা দুজনেই হব কোম্পানির মালিক ।
এপ্রিল ২০০৭
আলো :
আমাকে এবার ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে ছ'মাস থাকতে হবে, অনুভব । তুমি কিন্তু ডা: রায় আর মি: শর্মার সাথে লোনের ব্যাপারটা ফয়সালা করে জানিও আমায় । যাওয়ার আগে আমি ঘুরে আসব নিশ্চিহ্নপুর থেকে একবার । কাজ খুব দ্রুত এগুচ্ছে । রাস্তাগুলো তৈরী হয়ে আসছে । এখন সলটলেক থেকে যেতে গেলে নতুন ফ্লাইওভার দিয়ে যাই । খুব সুন্দর ঝকঝকে রাস্তা । খুব কম সময় লাগে জানো ?
আলো : কি হল এত ইরেগুলার হয়ে গেছ কেন? রোজ একটা করে ই-মেল পাঠাতেও তোমার কষ্ট হয় । মেলবক্সটা চেক কোরো রোজ । এটা আমার অনুরোধ ।আমার আর তর স‌ইছে না অনুভব ! কবে তোমার কাজ শেষ করে তুমি চলে আসবে সল্টলেকে ? জানো? আমার বড়ভাই তো উচ্চমাধ্যমিক আগেই পাশ করেছিল । এবছর সে ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ করেছে । সল্টলেকে একটা বিপিওতে ছোট চাকরী করছে । আর ছোট ভাই আমার পাশের অফিসে আউটসোর্স এর কাজ করে । এখন আর আমাকে ওদের টাকা পাঠাতে হয়না |

অক্টোবর ২০০৭
আলো :
অনুভব, আজ আমাদের নিশ্চিহ্নপুরের টাউনশিপ "রোশনি"র লে-আউটের এডটা দেখ নীচের নিউজপেপারের ওয়েবসাইটে । তুমি তো বি-আর্ক করেছিলে । কাজেই কিছুটা অন্তত: বুঝবে । জানো আমাদের পিটসবার্গের সেই রাস্তার আলোগুলোর মত আলো দিয়েছে নিশ্চিহ্নপুরের রাস্তায়; সেই একটা আলোর নীচে ডাউনটাউন পিটসবার্গে তুমি বলেছিলে তোমার কথা ? মনে পড়ে অনুভব? আমার সেদিন বলার মত কিছুই ছিলনা তাই আজ বলছি প্রাণ খুলে তোমাকে । আমার ভালোলাগার সেই গ্রাম্য শহরের কথা । আমার নিশ্চিহ্নপুরের নতুন গল্পের কথা । রোজ সকাল আটটা থেকে রাত আটটা অবধি অফিস করতে ভালই লাগছে এখানে । কিন্তু আরো ভালো লাগত যদি তোমার সান্নিধ্য পেতাম ! কাজে ফাঁকি দিও না প্লিজ ! যত তাড়াতাড়ি পারো ফিরে এস প্লিজ !


এপ্রিল ২০০৮
আলো :
অনুভব, আজ আমাদের রাজ্যপাল "রোশনি" টাউনশিপের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন । ডাঃ রায়কে ইমেল করলাম আর ধন্যবাদ দিলাম । গতকাল রাতে ফোন করেছিলাম মিস্টার শর্মাকে ।যেটুকু লোন স্যাংশান বাকী ছিল সেটুকুও ব্যবস্থা করে
ফেলেছেন বললেন ।"রোশনি" টাউনশিপের বুকিংও শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ বেসিসে । সেই টাকা কিছুটা পেলেই মিষ্টার শর্মার কন্ট্রাকটর ছাদ ঢালাই করবে । তার আগে নয় | প্রত্যেক বাড়ির সামনে থাকবে
ম্যানিকিওর্ড ছোট্ট ছোট্ট সবুজ লন । রাস্তাগুলোয় এই বর্ষাতেই লাগিয়ে দিয়েছে এরিকা পাম যাতে বাড়ির পজেশন পেলেই একটা শ্যামলিমার ছোঁয়া পাই আমরা । আমাদের সেই ম্যাগনোলিয়া গাছটার কথা মনে আছে তোমার ? আমাদের বাড়ির
সামনে আমি কিন্তু ঐ গাছ একটা লাগাবোই লাগাবো । আজ এই পর্যন্তই থাক ।

অক্টোবর ২০০৮
আলো :
দেখতে দেখতে কতদিন কেটে গেল আমি ফিরে এসেছি দেশে । কতটা সুন্দর হয়ে গেছে নিশ্চিহ্নপুর তা তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না অনুভব। আমি ও পাড়ায় গেলে আর চিনতে পারিনা আমার পুরোণো সেই রঙচটা খোলস ছাড়ানো গেঁয়ো শহরটাকে । কনস্ট্রাকশানের আওয়াজে, রঙে, কাঠে, সিমেন্ট-বালিতে নব নির্মিয়মাণ নিশ্চিহ্নপুরকে দেখলে আমার বাবা মায়ের জন্য বড় কষ্ট হয় অনুভব । আমি ওখানে গেলে এখনো দেখতে পাই আমাদের ভাড়াবাড়ির সেই একফালি বারান্দা
যেখানে বসে আমার হাতেখড়ি হত ক্যালকুলাসের সাথে । প্রতিনিয়ত খুনসুটি হত কেমিষ্ট্রির শক্ত শক্ত ফর্মুলার সাথে! ল্যাম্পপোষ্টের চুঁইয়ে পড়া একফালি আলোর মাঝে খুঁজে পেতাম সেই সব কঠিন বিজ্ঞানের সমাধান সূত্র । খিদে পেলে মা
এক বাটি মুড়ি নিয়ে আসতেন । শুধু মুড়ি । মা কে বলতাম একটু পাঁপড় ভাজা হবে না মা ? যাক বাবা ভাই দুটোর যে একটা হিল্লে হয়েছে এতেই আমি বড় শান্তি পেয়েছি ।

এপ্রিল ২০০৯
আলো :
অনুভব, একটা শপিং মল হবে এখানে । আর একটা সিনেমা হল । শপিং মলে সব থাকবে । ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ফার্মেসী থেকে ইন্টিরিয়ার ডেকরেশান অবধি । আমাদের খুব সুবিধে হবে । কি বল ? যা ব্যস্ত চাকরী আমাদের ! এক জায়গায় সব
কিছু পেয়ে যাবার সুবিধে যে কতটা তা আমেরিকায় গিয়ে টের পেয়েছি । একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ হচ্ছে জানো ? আমাদের টাউনশিপের পাশেই । আমি কিন্তু আমাদের ফ্ল্যাট এর এপ্লিকেশান আর সাথে বুকিং এর টাকা দিয়ে এলাম গতকাল
। আমাদের বাড়ির নাম কি হবে জানিও । আমি ভেবেছি কয়েকটা ইন্টারেস্টিং নাম । তারপর অকদিন অনলাইন হয়ে দুজনে বসে ঠিক করব । সেই মত একটা টেরাকোটার টালির অর্ডার দেব যাতে নামটা খোদাই করা থাকবে ।

অক্টোবর ২০০৯
আলো :
তুমি তাহলে শেষ পর্যন্ত চাকরীটা নিলেনা এখানে অনুভব । যা ভালো বোঝ তাই কোরো । আমার নিশ্চিহ্নপুর নিয়ে আমি ঠিক ভালো থাকার চেষ্টা করে যাব । জীবনে এত লড়াই করেছি যে কোনো কষ্টকেই আর কষ্ট বলে মনে হয়না । আমার নতুন
ফ্ল্যাটের নাম দিয়েছি "আলোক-রেণু" | আমার মায়ের নাম ছিল রেণু তাই । আমার দিন গুলো কেটে যাচ্ছে । আর তোমার জন্যে মন কেমন করে না । মেলের জন্য অপেক্ষা করাও ফুরিয়ে গেছে । ভাইরাও ফোন করেনা | তাদের নিজের
নিজের সংসার হয়েছে |বোধ হয় তোমার সাথে "আলোক-রেণু"র স্বপ্ন বাঁধা হোলো না । এখনো নিশ্চিহ্নপুরের গাছ-গাছালিরা আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে, পাখ-পাখালিরা আমাকে এসে গান শুনিয়ে যায় । আমি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে আমার অফিসের ঘরটা নিয়ে পড়ে থাকি । আমার সঙ্গী এই ল্যাপটপকে নিয়ে ।এই পাঁচ বছরে তোমার আলো ঠিক আগের মতই আছে । সেই নিশ্চিহ্নপুরের আলো হয়ে । আমি দেখতে পাচ্ছি অফুরন্ত আলোর মাঝে জ্বলজ্বল করছে আমার নিশ্চিহ্নপুর । নতুন নিশ্চিহ্নপুরের বুকে দাঁড়িয়ে "রোশনি" নামের মাল্টিস্টোরিড যার মধ্যে আমার-তোমার স্বপ্নের "আলোক-রেণু" । আমার অফিসের পাশে যে খালটা ছিল সেটা সংস্কার হওয়ার কথা ছিল | খালটি পুব-পশ্চিমে কোলকাতাকে বয়ে নিয়ে যায় আর মেশে গঙ্গার সঙ্গে। আজ দেখছি সেই আলোর মাঝে , সেই খালপাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছি কিছু পরেই নৌকো করে ওপারে যাব আমরা । আমার স্বপ্নগুলো হারিয়ে যেতে যেতে বেঁচে রয়ে গেল তবুও ! তবুও বলব আমি ভালো আছি । খুব ভালো আছি অনুভব । তুমিও ভালো থেকো ।


সত্যি-মেল

এপ্রিল ২০১০
"মনোময়" বিকাশ কেন্দ্র থেকে হসপিটাল সুপার ল্যাপটপটি উদ্ধার করলেন ডা: আলো ব্যানার্জির ঘর থেকে । ইয়াহু মেল একসেস করে ইউসার আইডি তে এ টাইপ করতেই চলে এল alo1976আর নিজের ল্যাপটপকে ইয়াহুর পাসওয়ার্ডও মনে করিয়ে রেখেছিল আলো । তাই মেলবক্স খুলে গেল চোখের সামনে ; সেন্ট মেলে অনেক অফিসিয়াল মেল রয়েছে আর সেভড মেলে অনুভবকে পাঠানোর জন্য কম্পোজ করে রাখা রয়েছে এক গুচ্ছ ইলেকট্রনিক মেল । শুধু পাঠানোর অপেক্ষায় ! শেষ পাঁচবছর ধরে যতগুলো মেল সে শুধু লিখে গেছে অনুভবকে । ইনবক্সে একটাও মেসেজ নেই অনুভবের কাছ থেকে পাওয়া । "মনোময়" বিকাশ কেন্দ্রের সুপার অনুভবের মেল আইডি নিয়ে নিজের আইডি থেকে অনুভবকে মেল করলেন ।
"ডা: আলো ব্যানার্জি এখন "মনোময়" বিকাশ কেন্দ্রে আছেন । সত্বর যোগাযোগ করুন নীচের ঠিকানায়"
দৈনিক স্টেটসম্যান ২৮শে অক্টোবর ২০১১ এ প্রকাশিত 

৮ অক্টো, ২০১১

শুভ বিজয়াদশমী

থিম পুজোর শুচিবায়ুতায় মা তার ছেলেপুলেদের নিয়ে ভালোয় ভালোয় এসে আলোয় আলোয় ফিরে গেলেন । 
থিম থিম করে পাগলু  হয়ে পুজোয় চমক হল ।  দেব-দেবীদের চক্ষু চড়কগাছ।  হিংসায় উন্মত্ত ধরায় শান্তির বাণী বরষাতে এসে সব প্ল্যান ভন্ডুল ।  পিচঢালা ঝকঝকে  রাস্তায় প্যান্ডেলের খুঁটি পোঁতা হল । হোতারা গর্ত খুঁড়েই খালাস  । মা চলে যাবার পর সেই গর্ত গুলোর কি হবে তা নিয়ে কেউ ভাববেন না একটিবারও ।   একই পাড়ায় চারটে দলের আলাদা আলাদা পুজো হল । দলবাজির মা, রকবাজির মা, রঙবাজির মা, দাদাগিরির মা । আফটার অল ভাগের মা  বলে কথা । গঙ্গা পাবেন অবিশ্যি । কিন্তু গঙ্গার কি হবে ? একেই তো বুঁজে আছে পর্যাপ্ত প্লাস্টিকে ।  ক্লিন কোলকাতা, গ্রিন কোলকাতা থিম ততক্ষণে বিসর্জন । মহানগরের ড্রেনগুলি আবার ভর্তি হল । ঠাকুর দেখলেন প্রচুর দর্শনার্থী । জলের বোতল, কোল্ড ড্রিংক্সের বোতল, কফির কাপ, আইসক্রিমের কাপ, আরো কতকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারা রেখে চললেন এই মহানগরের রাস্তাঘাটে । তেরঙ্গা, গুটখা, শিখরময় হল এই মহানগর ।   চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে মাইক্রোফোনের স্পীকারে গান বাজতেই থাকল উচ্চৈ:স্বরে  । হোতারা বললেন 'বাজাতে রহো'। সদ্যোজাতের কর্ণপটহে তালা  সেই শব্দে ।  আলোর রোশনাই কোজাগরীর চাঁদের জোছনাকে আড়ালে রাখল। বিদ্যুত বিদ্যুত বিদ্যুত ! কত চাই এসময় ? জয়েন্ট পরীক্ষার আগের দিন না হয় অন্ধকারে ডুববে বঙ্গ তাই বলে পুজোতে আঁধার আমার ভালো লাগবে কি ? রমরমিয়ে ব্যবসা চলল ট্রান্সফ্যাটের । আবার ওজন বাড়ল বাঙালীর । পুজোতো রোজরোজ হবেনা । তাই বলে কি রসনা অতৃপ্ত থাকবে ? চক্ষুশুদ্ধি হল প্যান্ডেল হপিং করে । জিনস-কুর্তা, কুর্তি-কেপরি, স্কার্ট-লাচ্ছায়  লাস্যময়ী, হাস্যময়ীরা মাতালেন ম্যাডক্স স্কোয়ার,  তিনকোণা,  দেশপ্রিয়,  বাদামতলা, মুদিয়ালি । চিনে জোঁকের মত মানুষ ভীড় করলেন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে । ততক্ষণে মা উধাও সেই প্যান্ডেল থেকে । পড়ে থাকল মৃন্ময়ী মূর্তি । চিন্ময়ী মায়ের বিরহী আত্মাটুকু পাড়ি  দিল   দয়িত ভোলেবাবার কাছে । ভীড়ভাট্টা থেকে রক্ষা পাবে বলে ।  কোলকাতার ভূষণ হল   দূষণ । মাননীয় নেতারা বিজয়া টিজয়া সেরে টেরে সিদ্ধান্ত নেবেন । মহানগরকে দূষণ মুক্ত করার জন্য অনেক মিটিং হবে ।ততক্ষণে শারদসম্মান এওয়ার্ড সেরিমনি শেষ ।
আকাশতলে, অনিলে জলে, দিকে দিগন্তলে,  বনে বনান্তরে বাজতে থাকল   'বলো দুগ্গা মাইকি জয়! আসছে বছর আবার হবে ! ' 
 নাড়ু মুখে, পান হাতে, সিঁদুর খেলে  মা মুচকি হেসে বললেন ' আবার আসিব ফিরে ধানসিঁডিটির তীরে এই বাংলায় '  
 সিংহমশাইয়ের পিঠে চেপে মা,  মায়ের দু জোড়া ছেলেপুলে , একাই একশো উগ্রপন্থী মহিষাসুর আর এক গন্ডা নির্বিবাদী পশুপাখি  বাক্স প্যাঁটরা প্যাক করে রেডি হয়ে ঝুলঝুল করে দেখছে তখন ।   কোথায় পাব বলরাম-যুগল? কোথায় পাব বাঞ্ছারামের পান্তুয়া? হায়রে সেনমশাইয়ের  মিষ্টি দৈ ! যাদবের দিলখুশ আর কেসি দাসের রসোমালাই  ।
মা বললেন ' চলো চলো চলো সবে , কৈলাসে গিয়ে হবে , চমরীর দুধে  মিষ্টিমালাই , বানাবো সকলে খাবে '  
বড়মেয়ে বলল 'শুধু যাওয়া আসা, শুধু পয়সা খসা' 
ছোটমেয়ে বললে ' চল রাস্তায় নামি ট্রামলাইন '
বড়ছেলেটা বলে বসল 'আহা কতদিন শুনতে পাবনা এ সব, বড্ড মিস করব রে ! '
মা কোলের ছেলেকে বললেন ' কি রে তুই কিছু বল্‌ '
অমনি ছোটছেলে বললে ' আমাকে আমার মত থাকতে দাও মা, কিচ্ছু ভাল্লাগছেনা ' 
পাড়ার ছেলেমেয়েরা দৌড়ে এসে খবর দিল 'আই এসডি কল এসেছে মাগো, একটিবার চলো । বোধহয় কৈলাস থেকে শিবুদা ফোন করেছে' 
ওনারা তো চলে গেলেন আমাদের ডুবাইলিরে ভাসাইলিরে করে ।  এবার লে ছক্কা! ভাঙারাস্তা, খোঁড়া গর্ত, তেরঙা-গুটখার স্যাশেতে, পলি বোতলে, সুরাশীতলে, ছয়লাপ মহানগরের অলিগলি, ব্যস্ত রাস্তা।  সাতমণ তেল পুড়েছে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে । লাস্যময়ী শ্রীরাধিকাদের উদরপূর্তি হয়েছে ব্যাপক। তেলেজলে, অম্বলে শ্রীরাধিকারা নতুন জুতোর ফোস্কা নিয়ে দিন কয়েকের মধ্যেই আপিস ছুটলেন ।  পেত্থমদিন কি আর কাজ হবে? বড়বাবুর বিজয়ার ট্রিট, ছোটবাবুর শালীর সাথে প্যান্ডেল হপিং, মেজোবাবুর গার্লফ্রেন্ডের ক্রিসপি গসিপ নিয়ে চলবে সারাদিন ।  তারপর পাশের কিউবিকলে ফেসবুক খুলে কুশল বিনিময়, আরো আরো শঙ্খিনী, দামিনী, চাপিনীদের উঁকিঝুঁকি, বোল্ড ড্রেসের গল্প,  পাড়ার  রতনের হ্যাংলার মত বাংলু খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা। মায়ের ব্যাটেলিয়ন ততক্ষণে কৈলাস ছুঁই ছুঁই । এদিকে সময় চলিয়া যায় , নদীর স্রোতের প্রায় । বড়বাবু গোমড়া মুখে  ফাইলের তাগাড় নিয়ে বসেই র‌ইলেন । পুজোর পর যেন "মন লাগেনা কাজে" ........

৫ অক্টো, ২০১১

সন্ধিপুজো


আশ্বিনের শুক্লপক্ষ । শুক্লাষ্টমীর জ্বলজ্বলে বাঁকাচাঁদ আকাশের গায়ে । অষ্টমীর সকালের পুষ্পাঞ্জলি, আরতি, ভোগরাগ সন্ধ্যার শীতল, সন্ধ্যারতি, সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে নিষ্ঠায় পালন হয়েছে । রাত বাড়ে । নিশাচরী খেচরদের কূজনে অষ্টমী তখন যাই যাই । মেঘমুক্ত আকাশে ফুটফুটে তারা । মাদুর্গার মৃন্ময়ীমূর্তি চিন্ময়ী হয়ে উঠছে ক্রমশঃ । এগিয়ে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ । রাত বারোটার পর থেকেই তোড়জোড় শুরু । একশো আট লাল পদ্ম ফোটাতে শুরু করেছে সকলে মিলে । একশো আট প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের  তত্পরতায় রাত্রি দেবীও অবগুন্ঠন খুলে এগিয়ে এসেছেন ।  একশো আট প্রদীপের সলতে, ঘৃত, কর্পূর সহকারে স্থাপন করা হল পিতলের প্রদীপদানে । সময় তখন রাত বারোটা বেজে একান্ন মিনিট  ; সন্ধিপূজা শুরু হল ।  অস্টমী আর নবমী তিথির শুভ সন্ধিক্ষণ  রাত একটা বেজে পনেরো মিনিটে  । মন্ত্রের অণুরণনে মুখরিত রাতের হিমেল বাতাস । কাশ্মীর থেকে কণ্যাকুমারিকা, কামরূপ থেকে কাঠিয়াবাড় সবস্থানই একযোগে আলোড়িত হল  ।  পটকা,  দামামা,  শঙ্খধ্বনি, ঢাকের বাদ্যি, উলুধ্বনি, ঘন্টা  সব মিলিয়ে একটা শব্দের স্রোত ভারতের আসমুদ্র হিমাচলের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিল । গড়িয়ে চলল সেই শব্দ । মায়ের ঘামতেলযুক্ত মুখমন্ডল উদ্ভাসিত সেই শব্দে ।  অষ্টমীতিথির বিদায় আর নবমীর আগমনে চিত্রনেত্রা অদ্রিজার সন্ধিপূজা চলতে লাগল ।
দেবী দুর্গা নাকি এই দুইতিথির মিলনক্ষণেই আবির্ভূতা হন দেবী চামুন্ডারূপে ।  চন্ড এবং মুন্ড এই দুই উগ্রমূর্ত্তি ভয়ানক অসুরকে বধ করেছিলেন এই সন্ধিক্ষণে । আশ্বিনমাসে রামচন্দ্রের অকালবোধন এবং অপ্রতিরোধ্য রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করার জন্য যে দুর্গাপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসের রামায়ণে সেখানেও দেখি রামচন্দ্র সন্ধিপূজা সমাপন কালে দেবীর চরণে একশো আট পদ্ম নিবেদন করার আশায় হনুমানকে দেবীদহ থেকে একশো আটটি পদ্মফুল তুলে আনতে বলেন । হনুমান একশোসাতটি পদ্ম পেলেন । দেবীদহে আর পদ্ম ছিলনা । এবার প্রশ্ন কেন দেবীদহে একটি পদ্ম কম ছিল । তার কারণ স্বরূপ কথিত আছে , দীর্ঘদিন অসুর নিধন যজ্ঞে মাদুর্গার ক্ষত বিক্ষত দেহের অসহ্য জ্বালা দেখে মহাদেব কাতর হলেন । মায়ের সারা শরীরে একশো আটটি স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল । মহাদেব তাঁকে দেবীদহে স্নান করতে বললেন সেই জ্বালা জুড়ানোর জন্য । দেবীদহে মায়ের অবতরণে একশো সাতটি ক্ষত থেকে সৃষ্টি হয়েছিল একশো সাতটি পদ্মের । মহাদেব দুর্গার এই জ্বালা  সহ্য করতে না পারায় তাঁর চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু নিক্ষিপ্ত হল মায়ের একশো আটতম ক্ষতের ওপর । দেবীদহে স্নানকালে সেই অশ্রুসিক্ত ক্ষতটির থেকে যে পদ্মটি জন্ম নিয়েছিল সেটি মা নিজে হরণ করেছিলেন । কারণ স্বামীর অশ্রুসিক্ত পদ্মফুলটি কেমন করে তিনি চরণে নেবেন । আবার কৃত্তিবাসের রামায়নে পাই রাবণ নিধন যজ্ঞের প্রাক্কালে রামচন্দ্র বলছেন
" যুগল নয়ন মোর ফুল্ল নীলোত্পল
সংকল্প করিব পূর্ণ বুঝিয়ে সকল ।।
একচক্ষু দিব আমি দেবীর চরণে "
রাম ধনুর্বাণ নিয়ে যখন নিজের নীলোত্পল সদৃশ একটি চক্ষু উত্পাটন করতে উদ্যত তখন দেবী রামচন্দ্রের হাত ধরে তাঁকে নিবৃত্ত করে বলেন
"অকালবোধনে পূজা কৈলে তুমি, দশভুজা বিধিমতে করিলা বিন্যাস।
লোকে জানাবার জন্য আমারে করিতে ধন্য অবনীতে করিলে প্রকাশ ।।
রাবণে ছাড়িনু আমি, বিনাশ করহ তুমি এত বলি হৈলা অন্তর্ধান "
সন্ধিপূজার এই মাহেন্দ্রক্ষণে কেউ বলি দেন । কেউ সিঁদুর সিক্ত একমুঠো মাসকলাই বলি দেন  । সবকিছুই প্রতিকী । সর্বকালের সর্বক্ষণের দুষ্টের দমন হয় দেবীর দ্বারা । রক্ত বীজের ঝাড় অসুর কুল যেন বিনষ্ট হয় । ঢাকের বাদ্যি বেজে ওঠে যুদ্ধজয়ের ভেরীর মত । একশো আট প্রদীপের আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয় ভারতবর্ষের আনাচকানাচ । উত্তিষ্ঠত ভারতবাসীর জাগ্রত মননে দুষ্কৃতের বিনাশিনী এবং সাধুদের পরিত্রাণ কারী মা দুর্গা কান্ডারী হয়ে প্রতিবছর অবতীর্ণ হন মর্ত্যলোকে ।  

৪ অক্টো, ২০১১

মহাষ্টমী



শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী ছেড়ে খোয়াইয়ের পথ ধরে চলে, ক্যানালের পাশ দিয়ে বেশ খানিকটা পথ গেলে বল্লভপুরে বনেরপুকুরডাঙার বিখ্যাত আদিবাসী দুর্গাপূজা দেখতে পাওয়া যাবে যার নাম হিরালিনী দুর্গোত্সব । বিশ্বভারতী চত্বরে কোনো পুজো হয়না । বিশ্বভারতীর তথাকথিত ব্রহ্ম উপাসনা থেকে বেরিয়ে এসে বনের মধ্যে এই মূর্তিপূজার অভিনবত্ব  চোখ ধাঁধিয়ে দেয় ।   ২০০১ সাল থেকে সোনাঝুড়ি বনে এই পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা হলেন বাঁধন দাস । গভর্মেন্ট আর্ট কলেজের ছাত্র বাঁধন দাস তাঁর দিদি হীরা এবং পিতা নলিনী দাসের নামে এই পুজোর নাম দেন হিরালিনী ।

পূজোমেলার প্রধান রূপকারেরা আসে  অঞ্চলের সাঁওতাল গ্রামগুলোর থেকে ।  এছাড়াও দুমকা, ঝাড়খন্ডের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শিল্পীরা এসে যোগ দেন ম্যারাপ বাঁধার কাজে,  প্রতিমা গ,ডার কাজে, পুজোর যোগাড় যন্ত্রে আর ভীড় সামলানোর কাজে ।  মেলা, হৈ চৈ নাচ-গান এই পুজোর অন্যতম অঙ্গ । পরিবেশ দূষণ এড়াতে এবারের পুজোর থিম হোল গ্রিন পুজো, ক্লিন পুজো । ধূমপান্, প্লাসটিক ও গারবেজ নৈব নৈব চ ।  ২০০১ সালে প্রথমবার পুজোয় মূর্তি আনা হয়েছিল কলকাতা থেকে ।  সেবার পোড়ামাটির প্রতিমা আনা হয়েছিল । পরেরবার ২০০২ সালে বাঁধনদা তার আর্ট কলেজের ছাত্রদের নিয়ে কাঠের প্রতিমা বানান ।
   সেই বছর ডিসেম্বর মাসে বাঁধনদা মারা যান । তখন থেকে তাঁর ছাত্ররাই সেই পুজো এগিয়ে নিয়ে চলেছে । ২০০৩ সালে লোহার প্রতিমা, ২০০৪ সালে  বাঁশে বোনা  ও ২০০৫ সালে  মাটির প্রতিমা তৈরী হয় । আসলে বাঁধনদার ইচ্ছেতেই প্রতিবার বৈচিত্র্যময় হয় এই পুজো ।  গাঁয়ের প্রচুর মানুষ নিঃস্বার্থ ভাবে পরিশ্রম করে এই পুজোতে আর ঐ চারটে দিন নাচ গান যাত্রাপালায় , জঙ্গলের পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে ঢাকের বাদ্যি আর মাদলের তানে মিলেমিশে এক হয়ে যায় মানুষ ও পল্লীপ্রকৃতি ।  

৩ অক্টো, ২০১১

আজ মহাসপ্তমী

সপ্তমী (১)
প্রান্তিকে ইরিগেশন ক্যানেলে নবপত্রিকার স্নান 

মহাসপ্তমীর ভোরের সূচনা হয় নবপত্রিকার স্নানপর্ব দিয়ে । নবপত্রিকা দেবীদুর্গার প্রতিনিধি । শ্বেত অপরাজিতা লতা এবং হরিদ্রাক্ত সূতা দিয়ে ন'টি উদ্ভিদ {কলা–ব্রহ্মাণী(শক্তিদাত্রী), কালো কচু– কালিকা (দীর্ঘায়ুদাত্রী),হলুদ– ঊমা( বিঘ্ননাশিনী),জয়ন্তী–জয়দাত্রি,  কার্তিকী(কীর্তিস্থাপয়িতা), বেল–শিবাণী(লোকপ্রিয়া), ডালিম–রক্তবীজনাশিনী( শক্তিদাত্রী), অশোক–দুর্গা(শোকরহিতা), মানকচু– ইন্দ্রাণী( সম্পদদায়ী), ধান–মহালক্ষ্মী( প্রাণদায়িনী)}চারাকে একসাথে বেঁধে নদীতে স্নান করানো হয় । দেবীর প্রিয় গাছ বেল বা বিল্ব । নদীতে নবপত্রিকা স্নানের পূর্বে কল্পারম্ভের শুরুতে   দেবীর মুখ ধোয়ার জন্য যে দাঁতন কাঠি ব্যাবহৃত হয় তাও আট আঙুল পরিমিত বিল্বকাঠেরই তাছাড়া
"ওঁং চন্ডিকে চল চল চালয় চালয় শীঘ্রং ত্বমন্বিকে পূজালয়ং প্রবিশ।
ওঁ ং উত্তিষ্ঠ পত্রিকে দেবী অস্মাকং হিতকারিণি"
 মন্ত্রে সম্বোধন করে নবপত্রিকাকে দেবীজ্ঞান করা হয় । শস্যোত্পাদনকারিণি দেবী দুর্গা স্বয়ং কুলবৃক্ষদের প্রধান অধিষ্ঠাত্রীদেবতা ও যোগিনীরা দেবীর সহচরী ।   স্নানান্তে নতুন শাড়ি পরিয়ে তিনটি মঙ্গলঘটে আমপাতা, সিঁদুর স্বস্তিকা এঁকে জল ভরে একসাথে ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ, ঘন্টা এবং উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করে, মন্ডপে মায়ের মৃন্ময়ীমূর্তির সাথে স্থাপন করা হয় । এই তিনটি ঘটের  একটি মাদুর্গার ঘট, একটি গণেশের এবং তৃতীয়টি শান্তির ঘট । নবপত্রিকার পূজা একাধারে কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষের বৃক্ষপূজা অন্যদিকে রোগব্যাধি বিনাশকারী বনৌষধির পূজা । মহাষষ্ঠীর রাতে বোধন হয়েছে গতকাল । মহাসপ্তমীর ভোরে বিল্ববৃক্ষের পূজা, নবপত্রিকা এবং জলপূর্ণ ঘটস্থাপন এর দ্বারাই দেবীপূজার সূচনালগ্ন ঘোষিত হয় ।   

২ অক্টো, ২০১১

আজ মহাষষ্ঠী

ষষ্ঠীর আনমনা সকাল। শিউলির হালকা গন্ধ তখন  প্রান্তিকের হাওয়ায় । খালবিল থৈ থৈ জলে । শাপলা, পদ্ম ফুটে রয়েছে আপনমনে । পঞ্চমীর ভোরে র‌ওনা দিয়েছি কোলকাতা ছেড়ে । ষষ্ঠীর ভোরে স্নান সেরে পাটভাঙা শাড়িতে একরাশ শারদীয়ার আনন্দ নিয়ে পৌঁছালাম কঙ্কালীতলার মায়ের মন্দিরে । এটি সতীর একান্ন পিঠের অন্যতম । মায়ের কাঁখাল পড়েছিল । এখনো কুন্ডের জল টৈটুম্বুর । উত্তরবাহিনী কোপাই তীরে মহাশ্মশান ।
                                                                                        পুণ্যতোয়া কোপাই বয়ে চলেছে তিরতির করে…
মন্দির চত্তরে রাঙামাটির বাউল সম্প্রদায় আপনমনে গান গেয়ে চলেছে । একতারাতেও আগমনীর সুর । ফাঁকায় ফাঁকায় ষষ্ঠীর পুজো দিলাম । অঞ্জলি দিলাম । তারপর কঙ্কালীমায়ের পুরুষ রুরু ভৈরব মন্দিরে শিবলিঙ্গে জল ঢাললাম । বাঙলার কুখ্যাত নবাব সুলেমন করনানির ধর্মান্তরিত অত্যাচারী সেনাপতি কালাপাহাড়ের অত্যাচারে শিবলিঙ্গটি ধ্বংসপ্রাপ্ত । তবে সতীপিঠের জন্য স্থান মাহাত্ম্য আজো অমলিন । পুরুষ ও প্রকৃতি এক আকাশের নীচে আজো বিরাজমান । 
                                                           ছমছমে রুরু ভৈরব মন্দির বাউলের আখড়া তবে বিন্দুমাত্র নষ্ট হয়নি পরিবেশ
                                           “হৃদ-মাঝারে রাখিব যেতে দিব না …”কানে আমার তখনো বেজে চলেছে সেই  বিবাগী  বাউলের সুর
ফেরার পথে আবার শরত প্রকৃতি সাথে । শাপলাশালুক, লেবেলক্রসিং,  আশ্বিনের ভোরের রোদ্দুর  নিয়ে প্রান্তিক ।