গত ২২শে অক্টোবর কলকাতা ছেড়ে বেরিয়েছিলাম উত্তরাখন্ডের পথে । দিল্লী থেকে হরিদ্বার । সন্ধ্যে আর ঊষার গঙারতি দেখে মন ভরে গেল । এই নিয়ে তিনবার হোল আমার হরিদ্বার ভ্রমণ । সেখানে একরাত ; পরদিন, ২৩শে অক্টোবর হরিদ্বার থেকে দেরাদুন জেলার অন্যতম তীর্থক্ষেত্র হৃষিকেশের পথ পড়ল ।
ভাগিরথীর ওপর বিখ্যাত লক্ষ্মণঝুলা সেতুকে ফেলে রেখে আবার চলতে লাগলাম আমরা গুপ্ত কাশীর পথে । গুপ্তকাশীতে থেকে পরদিন ভোর ভোর তুঙ্গনাথের পথে । চোপতা অবধি গাড়িতে । তারপর সেই ভয়ানক দুর্গম অভিযান তুঙ্গনাথের পথে । পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিব মন্দির ( ১২০৯০ ফুট ) উচ্চতায় গাড়োয়াল হিমালয়ের কোলে । তুঙ্গনাথ পঞ্চকেদারের একটি । ১৯৯৭ সালে কেদারনাথ এসেছিলাম গৌরীকুন্ড হয়ে । এবার আরো অন্যরকম লাগল । হরিদ্বার থেকে গুপ্তকাশী যাবার পথে পড়ল দেবপ্রয়াগ যেখানে গঙ্গা তৈরী হয়েছে ভাগিরথী ও অলকানন্দার সঙ্গমস্থলে ।
তারপর পড়ল রুদ্রপ্রয়াগ যেটি হল অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থল । কি অপূর্ব স্থান এবং হিমালয়ের কি অপরূপ সৌন্দর্য্য তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না ।
গুপ্তকাশীতে মহাদেব-পার্বতীর অর্ধনারীশ্বর মন্দির
গুপ্তকাশীর ভোর ছিল বড় সুন্দর । ঘর থেকে গাড়োয়াল হিমালয় দেখলাম দুচোখ ভরে । পাহাড়ের কোলে ছোট্ট পুরোণো শহর গুপ্তকাশী । ব্রেকফাস্ট, স্নান সব সেরে নিয়ে সকাল সাতটায় আমাদের যাত্রা শুরু হল চামোলি জেলার চোপতার পথে । গাড়ি যেই চলতে শুরু করল পাহাড়ের মাথায় বরফ দেখে আমরা যারপরনাই উত্তেজিত । রোদ উঠে গেছে ততক্ষণে আর পাহাড়ের বরফচূড়া সেই আলোয় রূপোর মত চকচক করছে । এ দৃশ্য কখনো পুরোণো হয়না । স্থানকালপাত্র ভেদে অবর্ণনীয় । অমোঘ এই আকর্ষণ । ভাষাতীত এই সৌন্দর্য্য । মন্দাকিনীর ওপর ব্রিজ পেরিয়ে বরফচূড়ায় চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে যেতে লাগলাম । গুপ্তকাশী থেকে চোপতার পথ ৪৫ কিলোমিটার । আরো চড়াই পথ পড়ল । যত এগিয়ে এল চোপতা ততই পথ দুর্গম থেকে দুর্গমতর হ’ল । সরু রাস্তা । গাড়ির পথটুকুও ভয়ানক দুর্গম । না জানি পায়েহাঁটা তুঙ্গনাথের পথ আরো কত দুর্গম হবে সেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম । অবশেষে চোপতা এল সময় মতন । গাড়ি নীচে রেখে সকাল দশটায় চোপতা থেকে আমাদের হাঁটা শুরু করলাম তুঙ্গনাথের পথে । ১৯৯৭ সালে গৌরীকুন্ড হয়ে কেদারনাথ এসেছিলাম ঘোড়ায় করে আর পায়ে হেঁটে ফিরেছিলাম ।কেদারনাথ শিবমন্দির
গৌরীকুন্ড থেকে কেদার ১৪ কিলোমিটার ; কেদারনাথের উচ্চতা ১১৭৫০ ফুট আর তুঙ্গনাথের উচ্চতা ১২০৭০ফুট । তুঙ্গনাথ পৃথীবীর মধ্যে সর্বোচ্চ শিব মন্দির । । তুঙ্গনাথ পঞ্চকেদারের একটি । চোপতা থেকে পায়ে হেঁটে তুঙ্গনাথ যেতে সময় লাগে আড়াইঘন্টা। বাঁধভাঙা আনন্দের উচ্ছ্বাস আর মনের জোর নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম ।তুঙ্গনাথের পথ শুরু থেকেই চড়াই ফলে কিছুদূর গিয়েই মনে হয় আর পারবনা পৌঁছতে, দম ফুরিয়ে যায় । অক্সিজেন কম পড়ছে বোধ হয় । ফুসফুস আর টানতে পারছেনা । কিছুটা চলি তো আবার বসে বিশ্রাম করি পাহাড়ের গায়ে । নির্জনতা আমাদের সঙ্গী আর অদম্য মনের জোর আমাদের পাথেয় । শব্দ বলতে দাঁড়কাকের আওয়াজ আর দু একজন ঘোড়ারোহীর কৃপায় ঘোড়ার গলার টুংটাং, আর রডোডেনড্রণের শুকনো পাতা টুপটাপ ঝরে পড়ার শব্দ । মিষ্টি লাগে শব্দটা কিন্তু পথের ক্লান্তিতে সেটাও উপোভোগ করতে কষ্ট হ’ল ।
হিমালয়ের এলপাইন অঞ্চলে তুঙ্গনাথ । তাই সবুজ গাছপালা অতি বিরল ।
চোপতা থেকে ৩৫০০ ফুট উঠতে হবে এমন চড়াই পথ বেয়ে ! একবার ভেবেছিলাম ঘোড়া নেব কিন্তু কেদারনাথ ঘোড়ায় গিয়ে দেখেছিলাম ঘোড়ায় বসে কেবলি মনে হয় এই বুঝি সে পড়ে যাবে এই বুঝি আমি খাদে পড়ে যাব কিন্তু নিজে হাঁটলে প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যাবে সেই ভেবে পায়েহাঁটার চেষ্টা….তুঙ্গনাথ শিবমন্দির
তুঙ্গনাথে ওঠার ক্লান্তি আপাতত ভুলে গেলাম নীচে নেমে চোপতার পাতি একটা হোটেলে গরম টোম্যাটো স্যুপ এবং আগুণ গরম সবজীমিশ্রিত ম্যাগি খেয়ে । ওই মূহুর্ত্তে গরম খাবারের খুব প্রয়োজন ছিল আমাদের । উখীমঠ
সেদিন রাতে গুপ্তকাশীর হোটেলে ফিরে এসে আবার পরদিন গাড়ি নিয়ে বেরুনো উত্তরকাশীর দিকে । উত্তরকাশী গঙ্গার ধারে বেনারসের মত তীর্থকর মন্দিরময় শহর । বেশ কিছু বছর আগে বিদ্ধংসী ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে যাওয়া এই শহরে এখনো টিকে আছে প্রাচীন মন্দিরগুলি ।গঙ্গার ঘাট বড় মনোরম । নদীর ধার দিয়ে দিয়ে অনেকদূর হেঁটে নিলাম । কেদারঘাট গেলাম । সেদিন ধনতেরস ছিল । বাজার পড়ল । কাশীর রাস্তার মত অলিগলি দিয়ে বাজার আর বাজার । সেখানে দেওয়ালীর পসরা । কি ভীড় সেখানে । ধাতব দ্রব্য কিনতে হয় ধনতেরসে । তাই তামার কিছু সুদৃশ্য ঘটি কিনে ফেললাম । আমার আবার ফুল সাজানোর বাতিক আছে তো ! কাজে লাগবে তাই । শক্তিমন্দির এবং মহেশ্বর মন্দির গেলাম । দর্শনীয় এক রাজকীয় ত্রিশূল দেখলাম সেই শক্তিমন্দিরে । এই ত্রিশূল দিয়ে না কি মহাদেব অকাসুর বধ করেছিলেন । রাতে উত্তরকাশীর সাদামাটা হোটেলে রুটি, ডাল ও সবজী খেয়ে আবার ঘুম । পরদিনের যাত্রা গঙ্গোত্রীর পথে …
অতুলনীয় হিমালয়
আরো হিমালয়
৪টি মন্তব্য:
তোমার ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়তে আগেই এসে গেছি লাফাতে-লাফাতে। এ যে আমার কি প্রিয় ব্যসন...
আমার লেখাটাও পড়ো ইন্দিরা, আজকের আনন্দবাজারে ও মনফসলে আছে।
তোমার মত আমিও হরিদ্বার বার তিনেক গেছি্। কেদারনাথ, আউলী ইত্যাদি কারণে। তবে তোমার এই চোপতা আর তুঙ্গনাথের বিবরণ পড়ে তো আমার এক্ষুনি ফের ঢাকি-কাঁসি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে মন চাইছে।
একটা প্রশ্ন ছিল্। তোমার লেখা এই 'আমরা'টা কি তুমি ও তোমার উনিতেই ফুরিয়ে গিয়েছিল না সঙ্গী আরো ছিল? জানিও। আরেকবার বলি, খুব ভাল লাগল লেখা-ছবি ও স-ব-টা। তোমার দেশের লেখাটাও আমি পড়ে মন্তব্য করে এসেছি গতকাল্। দেখেছ?
আবার ইচ্ছে বাড়িয়ে দিলেন, আর অমন লিখে পড়িয়ে আধেক ভ্রমণ করিয়েও দিলেন। খুব সুন্দর জায়গার সুন্দ্রর ইতিবৃত্ত। আগামীবারে আমাদের এদিকটাতে প্লেন করে ফেলুন।
Dear Indira
Kono mat-e aj blog khule gelo..ek niswas-e Pod-e phel-lam..Darun lekha ar photo..1995 last Tunga nath gie chhi..chopta tourist lodge bando hoe jabar par ar jete ichhe kar-ena. Ebar plan chhilo Diwali-r din Badrinath jabo....end Nov Kumaon - o jaoa hob-e na , khub mon kharap...anyway ..tomar lekha PoDe shanti holo ektu ...bhab-tei parina je Himalaya jaini ek bachhor !!!
Bhalo theko
মঞ্জুশ্রী, সুশান্ত এবং উষ্ণীষ দাকে অনেক ভালোলাগা জানালাম ।
মঞ্জুশ্রী, তুমিও ভ্রমণবেত্তান্ত ভালো লেখ ।
সুশান্ত, একবার পারলে ঘুরে আসবেন জায়গা গুলি । উত্তরপূর্বের হিমালয় একরকম, গাড়োয়াল আবার আরেক রকম ।
আর উষ্ণীষদা, জানতাম না যে আপনি হিমালয়ের এত ফ্যান্, ঠিক আমার কর্তার মত , বেড়ানোর কথা উঠলেই বলে হিমালয় যেতে । সারা ইউরোপের মানুষ আল্পস নিয়ে এত মাতামাতি করে আমাদের হিমালয়ের রেঞ্জ কতটা বলুন তো !
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন