"ও বৌমা, ও বৌমা আঁশবটিটা বার করোগো শিকার ধরেছি'
ছোটবেলার রূপকথার গল্প বলতেন বাবা।
যেখানে এক ডাইনি বুড়ি একটি ছোট ছেলেকে তার আঁশ বটিতে কুপিয়ে কাটবে বলে মনের আনন্দে নাচতে নাচতে ছেলের বৌকে কথাগুলো বলছিল।
শুধু রূপকথা কেন? বাঙালী বাড়ির বনেদিয়ানা ছিল বিশাল এই আঁশবটি। আমবাঙালীর গরীব গেরস্থ, সকলেরি ঘরে থাকত একখানা আঁশবটি। এই আঁশবটির সংগে মাছের নিবিড় সম্পর্ক। তাই মত্স্যপ্রিয় বাঙালীর পেল্লায় আঁশবটি ছিল রান্নাঘরের ঐতিহ্য। আমাদের ঘটিবাড়িতে আঁশ-নিরামিষের ছুঁতমার্গ বেশ দাপটের সঙ্গে মানা হত। ঠাকুমার ঝুলকালির রান্নাঘরের কুলুঙ্গীর মধ্যে মাছভাজার লোহার আঁশ কড়া আর সেই আঁশবটি খানি থাকত। আঁশবটির ইজ্জত মাছের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলনা। কোনো বৃহষ্পতিবারে বাড়িতে মাছ না এলে ঠাকুমা তাঁর ছেলের বৌদের বলতেন, আঁশবটি ধুয়ে জল খেতে। এয়োতির বেষ্পতিবারে মাছ না খেলে পাছে ঠাকুমার ছেলেদের অকল্যাণ হয় তাই এই ব্যবস্থা। মায়েরা অবিশ্যি তা খেত না। ঐ আঁশবটিতে পেঁয়াজ কেটে ভাতের সঙ্গে খেয়ে নিত।
অথবা দুপুরবেলায় মা তার নিজের দুই হাঁটুর মধ্যে আমাকে নিয়ে দোল খাওয়াতে খাওয়াতে বলতেন,
ঘুঘু ঘুঘু মতি সই, পুত কই ?
হাটে গেছে।
কি মাছ আনতে?
সরলপুঁটি
কি দিয়ে কুটি?
বোঁচা বঁটি।
কিম্বা
মাছ কুটলে মুড়ো দেব
ধান ভাঙলে কুলো দেব,
কালো গরুর দুধ দেব,
দুধ খাবার বাটি দেব....
এসব ছড়া আজকের ছোটরা শোনেনা তাই রান্না ঘরে আঁশবটি কি জিগেস করলে তারা হয়ত উত্তর দিতেও পারবেনা। তারা জানে মাছ বাজার থেকে কেটে এনেই রান্না করা হয়। আমার বাপু বাবার মুখে এইসব ছড়ার গান না শুনলে একসময় ঘুম আসতনা ছুটির দুপুরে।
বাবা গাইতেন,
আয়রে আয় ছেলের দল মাছ ধরতে যাই,
মাছের কাঁটা পায় ফুটেছে দোলায় চেপে যাই,
দোলায় আছে স্বপনকড়ি গুনতে গুনতে যাই....তখন কড়ি দিয়ে মাছ কেনা যেত।
এই মাছ ধরার প্রসংগে মনে পড়ে আমাদের বাড়ির সবচেয়ে বড়দাদার কথা। আমরা বলতাম দাদাভাই। নিজে ছিলেন স্পোর্টসম্যান। পড়াশুনো শেষে চাকরী সামলিয়ে তাঁর যত ছিল ফুলগাছের নেশা তত ছিল মাছ ধরার নেশা। ঠিক ছুটির সকালে মাছ ধরবার জিনিষপত্র যেমন মাছের চার অর্থাত আটামাখার গুলি, জ্যান্ত কেঁচো, ভাতের মন্ড ইত্যাদি, ছিপ, ফাতনা, সুতো নিয়ে তিনি চলে যেতেন গঙ্গার ধারে। মাছ উঠলেই হত আমাদের পারিবারিক মহামেছো ভোজ।
বাবা আরো জানতেন ছড়ার গান। সেখানেও ঐ মাছ প্রসঙ্গ যেন এসেই পড়ত।
ও পাড়ার ঐ ছেলেগুলো নাইতে নেমেছে
দুইদিকে দুই রুইকাতলা ভেসে উঠেছে...
কীর্তণে কানু বিনে গীত নাই আর বাঙালীর মত্স্য বিনে গতি নাই। তাই বুঝি শয়নে, স্বপনে, জাগরণে মাছ অনুষঙ্গটি এড়াতে পারেনা তারা।
মাছ শুভ। মাছ পুণ্যতার প্রতীক। তাই বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রশনের তত্ত্বে মাছকে তেল, হলুদ, সিঁদুর লাগিয়ে তত্ত্বের তালিকায় রাখা হয়। এমনকি শ্রাদ্ধের পিন্ডদানের পরেও মৃতের আত্মার রসনা তৃপ্তিতে কলাপাতার ওপরে এক টুকরো মাছ ভেজে দেওয়ার রীতিও দেখেছি। যেন তাঁকে নিবেদন করে অশৌচের পর বাড়ির লোকজন আবার মত্স্যমুখী হতে পারে।
তারপর সেই ছড়ার গানটি? আয়ঘুম যায় ঘুম বাগদীপাড়া দিয়ে বাগদীদের ছেলে ঘুমোয় জালমুড়ি দিয়ে। সেসময় জেলে, বাগদী এদের এতই আর্থিক অনটন এতটাই প্রবল ছিল যে মাছ ধরার বাতিল জাল গুলিও তারা বুঝি ফেলত না । গায়ে দেবার কাঁথার কাজ করত সেই মাছ ধরবার জাল। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের সেই মেছুনির গল্প। মাছ নিয়ে যাদের কারবার সেই মেছুনির নাকি রাতে শোবার সময় মাছের ঝুড়িটা মাথার শিয়রে না রাখলে ঘুম আসেনা। অর্থাত মানুষের যেমন আধার তেমন কর্ম। মেছুনির ভাল লাগে মাছের আঁশটে গন্ধ। ঐ গন্ধ না পেলে তার ঘুমই আসবেনা ঠিক যেমন ছোট ছেলেকে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর অভ্যেস অথবা শোবার সময় বইপড়ার অভ্যেস।
এই মীন শরীরের সব ভাল কেবল ঐ আঁশটে গন্ধটা ছাড়া। এই আঁশের কথাতে মনে পড়ে দিদিমার কথা। কালো ভেলভেটের ওপর কইমছের আঁশ দিয়ে যে অপূর্ব শিল্পকর্মের গল্প শুনেছি তা বুঝি আজ হারিয়ে গেছে। কইমাছের আঁশ তো রূপোর মত চকচকে আর ছোট্টছোট্ট। আর এতো নষ্ট হবার নয়। কোনো বাড়িতে কতগুলি কইমাছ এলে অমন শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলা যায় তা ভেবে কুল পাইনা। এখন তো বাজারে বড় কইমাছ অর্ডার না দিলে মেলেনা। ছোটোগুলিতে এত কাঁটা যে কেউ খাবেনা।
এহেন "আমি'র শিরা-উপশিরায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বাঙাল রক্ত ও বাকী পঞ্চাশ ভাগ ঘটি রক্ত বহমান । আমার মায়ের বাবা এবং বাবার মা দুজনের বাংলাদেশের খুলনাজেলার সাতক্ষীরায় জন্ম। তাই এহেন "আমি" সেই অর্থে হাফ বাঙাল ও হাফ ঘটি । অন্তত: আমার শ্বশুরালায়ের মন্তব্য তাই । ইলিশ আর চিংড়ি দুইয়ের সাথেই আমার বড় দোস্তি ।
বাঙালদের সেই চিতলামাছের মুইঠ্যা একবগ্গা মাছের এক্সোটিক ডিশ ফর গ্যাস্ট্রোনমিক তৃপ্তি । আর আছে কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে বেগুণ দিয়া বাদলা দিলে কাদলা মাছের পাদলা ঝোল। ঘটির হল জিরে-মরিচ-ধনে বাটা দিয়ে আলু-পটল-ফুলকপি দিয়ে কাটাপোনার ঝোল, হিং,আদাবাটা, টামেটো আর ডুমোডুমো আলু দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি পোনার কালিয়া ? আমাশা রোগীর জন্য সেই ঝোলে একটুকরো কাঁচকলা ফেলে দিলেও মন্দ নয়। এই শিলে বাটা জিরে-ধনে-গোলমরিচের যে কত গুণ তা আয়ুর্বেদ পড়লে জানা যায়।
এক টুসকী কাগজী লেবুর রস দিয়ে এই পাতলা ঝোল যেন গ্রীষ্মেবর্ষায় অমৃত। বাটির ঝোলে আবার বাকী লেবুটুকুনি নিংড়ে স্যুপের মত খেলেও পুষ্টি। এত রিফ্রেশিং এই ঝোল ভাত যে খেলেই মনে হয় পুকুরে ডুব দেবার অনুভূতি। তবে মা বলতেন ঝোলের মাছ যেন খুব টাটকা হয়। আর সবজীগুলো ভেজে নিয়ে জিরে অথবা পাঁচফোড়ন দিয়ে ভাজা মাছ, সবজী সেদ্ধ হবার পর নামানোর ঠিক আগে দেবে ঐ জিরে-ধনে-গোলমরিচ বাটা। তবেই হবে ঝোলের আসল স্বাদ। মশলার গুণও বজায় থাকবে।
এছাড়া এই একেঘেয়ে রুই কাতলার বাঙালী ঘরোয়া পার্টিতে আরো অনেকভাবে ধরা দেয়। মাছ সেদ্ধ করে মাছের কাঁটা বেছে নিয়ে চপের মত পুর বানিয়ে ফিশ ক্রোকে, মাছের কচুরী, মাছের চপ, টাটকা রুই- কাতলার পেটি দিয়ে দৈ-মাছ, কোর্মা, মাছের পোলাও, আরো কত বলব ! ঘটি হেঁশেলে শুঁটকি ফুটকির নো এন্ট্রি ! তাই বেশীরভাগ ঘটিবাড়িতেই রুই-কাতলা-ভেটকি-পার্শ্বে, চিংড়ি, ইলিশ, কই, ট্যাংরা আর মৌরলা নিয়ে মজে থাকতে হয় বারোমাস।
আমার দিদিমা খাস উত্তর কলকাতার কুটিঘাটের ব্যানার্জি পরিবারের মেয়ে। বয়স মাত্র এগারো। ঐটুকুনি মেয়ে বিয়ের কি বোঝে! সে আবিষ্কার করতে শুরু করেছিল গ্রাম্য পরিবেশের মাধুর্য্য। গাছের ফলপাকড়, টাটকা শাকসব্জী, নদী-পুকুর থেকে মাছ ধরে আনা সেই বিবাহিতা কিশোরীর কাছে যেন বিস্ময় তখন। শ্বশুরবাড়িতে দুপুর হলেই পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা ছিল তার কাছে এক আশ্চর্য্যের বিষয়।
দিদিমার মুখে গল্প শুনেছি শাশুড়ি, ননদ ভাজের মধুর সম্পর্কের কথা। নতুন বৌ হয়ে তিনি শ্বশুরবাড়ি যাবার পর তাঁকে এত যত্ন তাঁরা করেছিল যে তিনি মারা যাবার শেষদিন বধি বলে গেছেন সে কথা। দিদা ছিল বাড়ির মেজবৌ। ননদরা নদী থেকে সদ্য ধরা ট্যাংরামাছ ভাজা আর তেল দিয়ে একথালা ভাত দিয়ে নতুন বৌকে বসিয়ে আদর করে খেতে দিয়েছিল। নদীর টাটকা মাছ আর অমন যত্ন দিদার মাও বুঝি করেনি তাকে..তিনি বলতেন।
অনেকেই এই ট্যাংরামাছ পিঁয়াজ দিয়ে খান তবে আমাদের ঘটিবাড়িতে রাঁধবার ধরণটা সম্পূর্ণ আলাদা। মাছ ভাল করে ভেজে নিয়ে সরষের তেলে পাঁচফোড়ন দিয়ে টমেটো কুচি, কাঁচালঙ্কা, কড়াইশুঁটি আর সর্ষে-শুকনো লঙ্কাবাটা দিতেন মা। মাছ সেদ্ধ হলে বেশ গায়ে মাখামাখা এই ট্যাংরার ঝালে এবার সর্ষের তেল ছড়িয়ে গরগরে করে নামিয়ে যে পাত্রে রাখবে তার মধ্যে ছড়াও একটু গরমমশলা। ব্যাস! দিদিমার হাতে এই রান্নার স্বাদ আর কোথাও পাইনি। শীতকালে গরমমশলার বদলে ধনেপাতা কুচিয়েও দেওয়া যায় ওপর থেকে।
মামাবাড়িতে এক প্রকান্ড বাঁধানো পুকুর ছিল। আমার দিদিমার নেশা ছিল লাল শান বাঁধানো পুকুরের ঘাটের সিঁড়িতে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরা। সেই টাটকা মাছের কাঁচা ঝাল দিয়ে গরম ভাত হত সেদিন রাতের আহার। মায়েরা তাদের ছোটবেলায় ঐ পুকুরে গরমের ছুটিতে সব তুতো ভাইবোনদের সঙ্গে চানে নামত। প্রত্যেকের লাল গামছা পুকুরের জলে ফেলে ছোট ছোট চিংড়িমাছ ধরত। এবার চান সেরে যে যার মত বাগানের কোনে কাঠকুটো জ্বেলে ছোট কলাইয়ের বাটিতে সেই মুঠোমুঠো জ্যান্ত চিংড়িমাছ, ঝিরিঝিরি আলুর কুচি, কাঁচা সর্ষের তেল, নুন, হলুদ আর চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে বসিয়ে দিত। বাটিতে হয় বলে এর নাম বাটিচচ্চড়ি। পংক্তিভোজে দুপুরের খাবার সময় যে যার নিজের বাটি নিয়ে বসে পড়তে মাটিতে। বাড়ির বড়রা তা দেখে তাজ্জব হয়ে যেতেন। এখনো বাটিচচ্চড়ি রাঁধি তবে জ্যান্ত মাছ আর পাই কই?
দাদামশাই এই বাটিচচ্চড়ি খেতেন আর বলতেন, তোমাদের কোফতা কালিয়া চুলোয় যাক্! আজ এটা আর খাবনা, খেলেই তো ফুরিয়ে যাবে। বরং বাটিটা মাথার বালিশের পাশে নিয়ে শুই। কত সম্মান ছিল এই বাটিচচ্চড়ির মত সাধারণ পদটির।
রবিঠাকুরের প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল পান্তাভাত আর চিংড়িমাছ ভাজা। তাঁর লেখা কবিতাতেও প্রচুর পাই এমন চিংড়ির কথা।
তিমি ওঠে গাঁ গাঁ করে
চিঁ চিঁ করে চিংড়ি
ইলিস বেহাগ ভাঁজে
যেন মধু নিংড়ি।
অথবা
মাছ এল সব কাৎলাপাড়া, খয়রাহাটি ঝেঁটিয়ে ,
মোটা মোটা চিংড়ি ওঠে পাঁকের তলা ঘেঁটিয়ে ।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে সহজপাঠ দ্বিতীয় ভাগের সেই কথা...
"কাংলা, তোর ঝুড়িতে কী? ঝুড়িতে আছে পালং শাক, পিড়িং শাক, ট্যাংরা মাছ, চিংড়ি মাছ। সংসারবাবুর মা চেয়েছেন'
সে ছিল অনুঃস্বরের অধ্যায়। চিংড়ি আমাদের নিজের হাতে বেছে খেতে দেওয়া হতনা। কারণ সহজপাঠ পড়ুয়াদের পেটখারাপ হবে তাই।
আজকাল হোটেলে ডাবচিংড়ি নামে একটি মাগ্যির ডিশ সার্ভ করা হয়। মামারবাড়িতে ডাব দিয়ে নয়। নারকোলের শাঁসসুদ্ধ দুটি মালার মধ্যে বাগদাচিংড়ি সর্ষে-পোস্ত-কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে মেখে, কাঁচা সর্ষের তেল, হলুদ, লঙ্কা, নুন দিয়ে নারকোলের মালায় রেখে এবার নারকোলটিকে বন্ধ করে সেই ফাটা অংশে ময়দার পুলটিশ লাগিয়ে মরা উনুনের আঁচে ঐ নারকোলটি রেখে দেওয়া হত ছাইয়ের ভেতরে । ঘন্টা দুই পরে তাক লাগানো স্বাদ ও গন্ধে ভরপুর ভাপা চিংড়ি নাকি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসত নারকোলের শাঁসের সঙ্গে। চিংড়ির মালাইকারীও এভাবে রাঁধা হয়েছে বহুবার। সেখানে সর্ষের বদলে পিঁয়াজ, আদা-রসুন গরমমশলা বাটা আর তেলের বদলে ঘি দেওয়া হত। পোলাও সহযোগে এই মালাইকারী জমে যেত।
চিংড়ি মাছের কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় আমার এক মামার কথা। উনি খুব রগুড়ে ছিলেন। ওনাদের সময় কত্তবড় চিংড়ি খেয়েছিলেন তা বোঝানোর জন্য উনি একবার বলেছিলেন" জানিস? এ আর কি চিংড়ি? এ তো লবস্টার কো বাবালোগ। আমরা যে চিংড়ি খেয়েছি তার খোলাগুলো ডাস্টবিনে পড়ে থাকলে তার মধ্যে দিয়ে কুকুরের বাচ্ছা ঢুকতো আর বেরুত।"
চিংড়ি আর কাঁকড়া মাছ নয় বলে আর সম্পূর্ণ অন্যজাতের সজীব বলে বুঝি ওদের এত স্বাদ। আঁশটে ব্যাপরটা নেই । আছে এক অন্য রসায়ন। সংস্কৃত শ্লোকে পর্যন্ত চিংড়ি নিয়ে ঠাট্টা পড়েছিলাম কল্যাণী দত্তের "থোড় বড়ি খাড়া' য়।
গলদাং বাগদাং রস্যাং নারিকেল সমণ্বিতাম্
অলাবু লোভানাং কৃত্বা তক্ষিতব্যং শুভে যোগে।।
অর্থটি খুব সহজ। নারকেল অথবা লাউয়ের সঙ্গে চিংড়ির কেমিস্ট্রিটা সবচেয়ে ভাল জমে যে কোনও শুভযোগে।
ঘটির হেঁশেলে সবকিছুতে চিংড়ি। রোজকার পদে একটি কুচো বা ঘুষো, চাবড়া (ধানক্ষেতের জলে হয়) কিম্বা বাগদার পদ থাকবেই। সেটি হল সাইড ডিশ। বড় চিংড়ি দিয়ে মোচা, এঁচোড় কিম্বা ফুলকপি দিয়ে ডালনা হল রাজভোগ্য। সবকিছুর রেসিপিতেই সবজী ভেজে নিয়ে আদাবাটা, টমেটো, লঙ্কা দিয়ে গরগরে কালিয়া আর নামানোর আগে মোক্ষম অস্ত্র ঘি আর গরমমশলার কম্বিনেশান।
আমার ঠাকুমার হাতের আরেকটি বিশেষ পদ হল চিংড়ি দিয়ে পটলপোস্ত। শুধু পাঁচফোড়নের মহিমা আর লঙ্কাবাটার প্রশ্রয়ে পোস্তর সাথে ভেজে নেওয়া কুচোনো পটল, আলু আর নামানোর সময় কাঁচা সর্ষের তেল ছড়িয়ে শুকনো ভাতে মেখে খাও।
চিংড়ির পরেই মনে পড়ে কাঁকড়ার কথা। কেউ বলে দশরথ। সকালবেলায় এর নাম নিলে নাকি দিন খারাপ যাবে, যত্তসব কুসংস্কার বাঙালীর। অথচ তার স্বাদ নেয়নি এমন বাঙালীর সংখ্যা বিরল।
রসিক রবির গল্পে পাকড়াশীদের কাঁকড়াডোবা অথবা ডিমভরা কাঁকড়ার কথায় মনে পড়ে মেয়ে কাঁকড়ায় ডিম হয় বলে ছেলে কাঁকড়া কিনলে নাকি মাস বেশী পাওয়া যায়। যাদের এলার্জি তারা এ স্বাদের ভাগ পাবেনা। দাঁড়াগুলো ভেঙে নিয়ে চুষে রস বের করতে ছোটবেলায় আমাদের সারাটা দুপুর কাবার হত। হাতের এঁটো শুকিয়ে যেত। ভাত শেষ হয়ে যেত। কাঁকড়ার এমনি মোহ। কেউ রাঁধে পিঁয়াজ-রসুন-আদা দিয়ে রসা। তার এক স্বাদ। তবে সর্ষে কাঁকড়ার ঝাল অন্যরকম। কাঁকড়ার গন্ধটা পুরো পাওয়া যায়। আর তার পা গুলো দিয়ে পুঁইশাক চচ্চড়ির স্বাদ অনবদ্য।
বৈষ্ণবরা নাকি এ রসে বঞ্চিত তাই ঠাট্টা করে ট্রেনে এক বৈষ্ণবের পাশে বসে একজন শৈব গেয়েছিলেন
"বোষ্টম টমটম, হাঁড়ির ভেতর কাঁকড়া রেখে যায় বৃন্দাবন'
মানে শৈব গায়ক বোঝালেন, বোষ্টমরা চুপিচুপি সবই খায় তাদের যত্তসব হিপোক্রেসি।
আমরা বলি কাঁকড়া অযাত্রা অথচ সংস্কৃতের পঞ্চতন্ত্রের গল্পে রয়েছে এই কাঁকড়াই নাকি সাপকে মেরে এক বণিকের পুত্রের জীবন বাঁচিয়েছিল ।
বিদেশের ট্রাউটের সমগোত্রীয় হল আমাদের ভেটকী। ভেটকীর ফ্রাই বা ব্যাটারে ডুবিয়ে ফিশ ওরলি নেমন্তন্ন বাড়ির মোষ্ট ফেবারিট। ফিশ ফিঙ্গার হল কেতাদুরস্ত ককটেল স্ন্যাক। দুধসাদা টার্টার সসে একটি একটি করে ডুবিয়ে মুখের মধ্যে পুরে আলতো চাপ দিলে আদা-রসুন সমন্বয়ে ভেটকিফিলের এই স্লিম আঙুল তখন ফুলে উঠেছে ডিম আর বেডক্রাম্বের কোটিঙয়ে । কিন্তু ভেটকীর সর্ষেবাটা ও আদা দিয়ে ঝাল অথবা শীতের মরশুমী ফুলকপি দিয়ে কালিয়া কিম্বা কাঁটাচচ্চড়ি হল আটপৌরে বাঙালীর আভিজাত্যপূর্ণ সাবেকী ডিশ। এখন কলাপাতায় মুড়ে ভেটকীর ফিলে দিয়ে পাতুড়ির খুব চল। আমি এই রেসিপিকে একটু মডিফাই করেছি। কলাপাতার বদলে পুঁইশাকের পাতায় কিম্বা লাউপাতায় মুড়ে ননস্টিকে এই পাতুড়ি করলে পাতার মধ্যে লেগে থাকা তেলমশলা সমেত এই পাতুড়িটা ভাতে মেখে খেয়ে ফেলা যায়।
ঘটিবাড়ির আরেকটি প্রধান মাছের রান্না হল মৌরলার টক। তেঁতুল অথবা আমের টক করে নিয়ে তার মধ্যে মুচমুচে করে ভাজা মৌরলা ভেসে থাকবে। আর সরষে ফোড়নের সঙ্গে তার রসায়নে যে রসনা সৃষ্টি হবে তা যেকোনো ঋতুতেই শেষপাতে দৌড়বে। অরুচির রুচি আনবে। এই মৌরলা মাছ শানের মেঝেতে রেখে একপ্রকার ডলে নিতেন মা। তার ন্যানো সাইজের আঁশগুলো বেরিয়ে যাবে আর পেটটা ধরে আলতো করে চাপ দিলে পিত্তিটা বেরিয়ে যাবে। পিত্তিসমেত রান্না করলে দশসের দুধে একফোঁটা গো-চোনার সামিল হবে সেই তেতো পদটি।
এবার আসি বাঙ্গালীর আদরের রূপোলী সজীব শস্যে। ঝিরঝির করে অবিরাম ইলিশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়তেই থাকবে আর ঠিক তখনি ঝাঁকেঝাঁকে গভীর জলের এই ইলিশমাছ সমুদ্রের নোনা জল সাঁতরে, জোয়ারের আনুকূল্যে স্বল্প পরিশ্রমে, নদীর কাছে আসবে, আমাদের ধরা দিতে। বলবে, বাঙ্গালী, তোমার জলকে নেমেছি।
ছোটবেলায় সবচেয়ে মজা ছিল রেনিডেতে হঠাত ইলিশের গন্ধটা। হঠাত ছুটির সাথে বৃষ্টি আর হঠাত পাওয়া ইলিশের অনুষঙ্গে মন কানায় কানায় !
মায়ের সারপ্রাইজ। উনুনের পিঠে হাঁড়ির মধ্যে গরম ভাত আর তার মুখে চাপা দেওয়া একটা টিফিনকৌটোর মধ্যে বন্দী ইলিশমাছের ভাতে বা ভাপা । হলুদ পড়বেনা এই পদে।টাটকা মাছের গন্ধ নষ্ট হয়ে যাবে। কৌটোর মধ্যেই নুন মাখানো ইলিশের গাদা-পেটি সর্ষে, কাঁচালঙ্কা বাটা, কাঁচা সর্ষের তেল আর বেশ কয়েকটি চেরা কাঁচালঙ্কার সাথে জারিয়ে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে মিনিট দুয়েক রেখে দিলেই এই অমূল্য পদ তৈরী। আমার রন্ধন পটিয়সী দিদিমা তার বিশাল সংসারে বিরাট এক হাঁড়ির মুখে বিশাল এক কচুপাতার মধ্যে মাছগুলিকে ম্যারিনেট করে পাতাটি সুতো দিয়ে বেঁধে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে রাখতেন। মা বলত, সে ভাপা ইলিশের নাকি অন্য স্বাদ। দিদিমার নাতনী মানে এহেন আমি একটু ইম্প্রোভাইজ করে এই কায়দাটি করি লাউপাতায় মুড়ে এবং ননস্টিক প্যানে অর্থাত পাতুড়ির স্টাইলে। যাই করো এ কানুর তুলনা নেই। কাঁচা তেলঝাল, ভেজে ফোড়ন দিয়ে ঝাল, গায়ে মাখামাখা হলুদ সর্ষেবাটার ঝাল, বেগুন দিয়ে কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে বাঙালদেশের পাতলা ঝোল...সবই যেন এই বর্ষায় দৌড়তে থাকে গরম ভাতের সঙ্গে।
তাবে আমি বাপু রসুন-পেঁয়াজ-আদা সহযোগে ইলিশমাছের স্বাদ ও গন্ধ কোনোটাই পাইনা। এমনকি কাঁটা বেছে খেতে যারা ভয় পায় তাদের স্মোকড হিলসা অথবা ইলিশ বিরিয়ানীর স্বাদেও আমি বঞ্চিত কারণ সেক্ষেত্রে যেন মনে হয় মাছটাই নষ্ট হল।
ইলিশমাছের কিছুই যায়না ফেলা। মাথা আর তেল দিয়ে ছ্যাঁচড়াও আমাদের ঘটি হেঁশেলের একটি অভিনব বর্ষার পদ। সাদাভাত অথবা খিচুড়ি দিয়ে জমে যায় এই চচ্চড়ি। সর্ষের তেলে মুচমুচে করে মাথা ভেজে নিয়ে ঐ তেলের মধ্যেই পাঁচফোড়ন আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে দুনিয়ার সবজী অর্থাত আলু, মূলো, কুমড়ো, ঝিঙে বেশ করে নেড়ে নিয়ে পুঁইশাক ডাঁটা ও পাতা দিয়ে ঢেকে দাও। নুন, হলুদ ছড়িয়ে দাও। কুচোনো থোড়, বাঁধাকপিও দিতে পারো সাথে। তারপর নুন, হলুদ, লঙ্কাগুঁড়ো, চিনি আর নামানোর আগে সর্ষেবাটা দিয়ে নাড়তে থাকবে। এটাই হল সফল ছ্যাঁচড়া টেষ্টি হবার উপায়। মা বলতেন, যতক্ষণ না অবধি কড়ায় "লাগা লাগা' অর্থাত একটু পোড়া পোড়া হবে ততক্ষণ রাখতে হবে আঁচে। সিল্ক পিওর কিনা পরখ করতে গিয়ে দাদু বলতেন, শাড়ির কোল আঁচল থেকে একগাছি সুতো পুড়িয়ে যদি "ছ্যাঁচড়া পোড়া' অর্থাত একটা মেছো অথচ পোড়া গন্ধ পাওয়া যায় তবেই সেটি আসল সিল্ক। তার মানে বুঝেছিলাম ছ্যাঁচড়া কড়ায় একটু লেগে গেলে তবেই হবে অথেন্টিক।আর যেহেতু পিওর সিল্ক হল ফাইব্রাস প্রোটিন জাতীয় তা পোড়ালে ঐ গন্ধ পাওয়াটা কিছু অস্বাভিক নয়।
ঘটি হেঁশেলে রুই বা কাতলার মুড়ো দিয়ে সোনামুগ ডাল ভেজে নিয়ে করা হয় মুড়িঘন্ট বা মাছের মাথা দিয়ে ডাল। এ এক উপাদেয় যজ্ঞ্যিবাড়ির পদ। বাঙালবাড়িতে এটাই রাঁধা হয় সুগন্ধী আতপচাল দিয়ে। বাকীটুকু একই রকম। শুরুতে মাথা ভেজে নিয়ে পিঁয়াজ, রসুন আদা, টমেটো কষে ওরা দেয় সেদ্ধ করা ভাত আর আমরা তার মধ্যে দি সেদ্ধ করা সোনামুগ ডাল। তারপর ঘি, গরমমশলার ছোঁয়া আর চিনির স্পর্শে তা যেন হয়ে ওঠে অমৃত ডাল। একঘেয়ে ডালের থেকে ধোঁয়া ওঠা এই ডাল বরং ক্ষুধার উদ্রেক করে। আর মাছের মুড়োয় যেন অল্প মাছ থাকে আর ডাল ফোটার সময় মুড়ো একটু ভেঙে দিতে হয়। হলুদ সোনামুগ ডালের মধ্যে চেরা সবুজ কাঁচালঙ্কার অনুষঙ্গে এই ডাল শুধু ডাল নয় বরং একটি সম্পূর্ণ পদ।
মনে পড়ে কোনও এক পৈতেবাড়ি আর সাধভক্ষণের দ্বিপ্রাহরিক নিমন্ত্রণে এই ডাল দিয়ে তপসে মাছের ফ্রাই খেয়েছিলাম। অতুলনীয় সেই যুগলবন্দী। এই তপসে মাছ সন্ন্যাসীর মত শ্বশ্রুগুম্ফ যুক্ত আর তপস্বীর মত গেরুয়া পোষাক পরিহিত অর্থাত তার ল্যাজা মুড়ো, পাখনা, দেহের রং সবেতেই গেরুয়া রঙের ছোঁয়া। এ মাছের ভাজা বানানো অতীব সহজ। আমার শাশুড়িমা বাড়িতে এনে মাথার কাঁটা দিয়ে এর পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি, পিত্তি টেনে বের করতেন। কারণ কেটে ফেললে মাছ ভাজতে গিয়ে ভেঙে যাবে তাই। তারপর ড্রেশ করা সেই মাছ রগড়ে নিয়ে আঁশ বের হয়ে গেলে, ধুয়ে এক টুসকী পাতিলেবুর রস, নুন আর সামন্য হলুদ দিয়ে জারিত করতেন। কিছু পরে এর মধ্যেই আদা-রসুন কাঁচালঙ্কা বাটা নরম হাতে মাখিয়ে দিতেন । পড়ে থাক তেমনি করে অন্ততঃপক্ষে ঘন্টাখানেক। ওদিকে ব্যাটার তৈরী হল দুরকমের বেসন (ছোলা ও মটরের), ঠান্ডা জল, নুন, হলুদ, লঙ্কাগুঁড়ো, পোস্তদানা আর কালোজিরে দিয়ে। এবার ব্যাটারটি হবে নাতি পাতলা নাতি ঘন অর্থাত মাঝামাঝি। এবার সে মিশ্রণ ফ্রিজে রাখতে হবে। তারপর খাবার সময় কড়াইতে সর্ষের তেল গনগনে করে গরম করে ঐ মিশ্রণে চালের গুঁড়ো ছড়িয়ে একটি একটি করে মাছের গায়ে অতি সন্তর্পণে কোটিং করে ভাজতে হবে আঁচ কমিয়ে বাড়িয়ে। ছোট সাইজের গুর্জাওলি মাছও এমন করে ফ্রাই করলে মন্দ লাগেনা খেতে।
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে এই অনুপম তপসে মাছের কথা।
তপ্ত তপ্ত তপসে মাছ, গরম গরম লুচি,
অজামাংস ভাজাকপি আলু কুচি কুচি।
শীতের দিনে খাবে যদি তুলে থাবা থাবা
দশ নম্বর পদ্মপুকুর দৌড়ে এস বাবা।
আরেকটি সামুদ্রিক মাছ হল ফ্যাঁশা। ইলিশের মত রূপোলী, ঝকঝকে দেখতে। দামও বেশ কম। নদীর ফ্যাঁশার স্বাদ সমুদ্রের চেয়ে ঢের ভাল। সমুদ্রের গুলো হয় বড় আর নদীর গুলো হয় অপেক্ষাকৃত ছোট। এই ফ্যাঁশামাছ ডালের সাথে প্রথম পাতে মুচমুচে ভাজা আর বড়ি আর সর্ষেবাটা দিয়ে গায়ে মাখা ঝাল ঘটিদের আরেকটি প্রিয় পদ।
মাছভাজার কথা বললেই মনে পড়ে যায় অরুচির রুচিকারক ঘুষোচিংড়ির বড়ার কথা। এর দোষ একটাই বড্ড তেল লাগে ভাজার সময়। তবে যারা এই ঘুষোচিংড়ির বড়া খায়নি তারা একবার খেলে আর ভুলতে পারবেনা। অনেকের কাছেই এ হল সস্তার মাছ, গরীবের খাবার অথবা খেলে "পেটের অসুখ করবে' টাইপ। কিন্তু ভাল করে ধুয়ে বেছে নুন, হলুদ, পোস্তদানা, কাঁচালঙ্কা কুচি আর বেসন ছড়িয়ে এই বড়া ডালের সাথে অথবা অম্বলে ফেলে খেতে বড়ো ভাল লাগে।
ঘুষোচিংড়ির কথাতে মনে পড়ে কবি ঈশ্বর গুপ্তকে।
"দীনের তারণকারী চিংড়ির ঘুষো
সুমধুর বাতহর পয়সায় দুশো'
আজকের সফিষ্টিকেটেড মডিউলার কিচেনে মাছকাটা কিম্বা আঁশবটি ব্রাত্য কারণ স্থানাভাব। কিন্তু বাবা বলতেন পরিপাটি করে মাছকে কেটে সাজিয়ে রান্নার উপযুক্ত করে তোলাটাও হল এক শিল্প। তাইতে মনে হয় তখনকার দিনে মেয়েরা বেশীর ভাগ বাড়িতেই আটকে থাকতেন। কর্তামশাই বাজার থেকে মাছ এনে দিলে তবে তিনি সেই কর্তণ পারিপাট্য দেখাবেন। কারণ যে রাঁধে সে মাছও কাটে। আর কথাতেই বলে মাছ ধুলে মিঠে, মাংস ধুলে রিঠে। তাই তেল, পোঁটা, আঁশ ফেলে কাটা মাছ ভালো করে ধুলে তবেই তা হবে সুস্বাদু। বাড়ির গিন্নীরাই সেই কাজটি করতেন সে যুগে। এসব আজকের বদলে যাওয়া গতিশীল দুনিয়ায় স্বপ্ন। বিশ্বায়নের যুগে হংকং থেকে হনললু, টরোন্টো থেকে টেক্সাস কিম্বা লন্ডন থেকে লাসভেগাস সর্বত্র মাছ কিচেনে প্রবেশ করে বরফের সমাধি থেকে। কখনো বা ক্যানবন্দী হয়ে। এমনকি আমাদের ভারতেও ডিপারটমেন্টাল স্টোরসের দুর্গন্ধময় ফিশকর্ণার থেকে কেটেকুটে সোজা প্রবিষ্ট হয় বাড়ির ফ্রিজে। রান্নার মাসী তাকে কিভাবে ধুয়েছে তা দেখবার সময় নেই বাড়ির ব্যস্ত গৃহিণীর। এখনকার চালানীর মাছে শুনছি আধিক্য রয়েছে পর্যাপ্ত কীটনাশক অথবা মাছকে বহুদিন তাজা রাখবার রাসায়নিক। তাই বারেবারে ধোয়াটাও খুব জরুরী। তার চেয়ে মনে হয় বাজার থেকে জিওল মাছ খাওয়া অনেক বেশী পুষ্টিকর। আর অল্পসংখ্যক চুনোচানা মাছ নিয়ে যারা বাজারে বসে সেগুলি বোধহয় স্বাস্থ্যকর । এদের মাছের স্বাদও ভাল আর রিস্কফ্যাক্টরও কম।
শিলাদিত্য ডিসেম্বর সংখ্যা ২০১৬
ছোটবেলার রূপকথার গল্প বলতেন বাবা।
যেখানে এক ডাইনি বুড়ি একটি ছোট ছেলেকে তার আঁশ বটিতে কুপিয়ে কাটবে বলে মনের আনন্দে নাচতে নাচতে ছেলের বৌকে কথাগুলো বলছিল।
শুধু রূপকথা কেন? বাঙালী বাড়ির বনেদিয়ানা ছিল বিশাল এই আঁশবটি। আমবাঙালীর গরীব গেরস্থ, সকলেরি ঘরে থাকত একখানা আঁশবটি। এই আঁশবটির সংগে মাছের নিবিড় সম্পর্ক। তাই মত্স্যপ্রিয় বাঙালীর পেল্লায় আঁশবটি ছিল রান্নাঘরের ঐতিহ্য। আমাদের ঘটিবাড়িতে আঁশ-নিরামিষের ছুঁতমার্গ বেশ দাপটের সঙ্গে মানা হত। ঠাকুমার ঝুলকালির রান্নাঘরের কুলুঙ্গীর মধ্যে মাছভাজার লোহার আঁশ কড়া আর সেই আঁশবটি খানি থাকত। আঁশবটির ইজ্জত মাছের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলনা। কোনো বৃহষ্পতিবারে বাড়িতে মাছ না এলে ঠাকুমা তাঁর ছেলের বৌদের বলতেন, আঁশবটি ধুয়ে জল খেতে। এয়োতির বেষ্পতিবারে মাছ না খেলে পাছে ঠাকুমার ছেলেদের অকল্যাণ হয় তাই এই ব্যবস্থা। মায়েরা অবিশ্যি তা খেত না। ঐ আঁশবটিতে পেঁয়াজ কেটে ভাতের সঙ্গে খেয়ে নিত।
অথবা দুপুরবেলায় মা তার নিজের দুই হাঁটুর মধ্যে আমাকে নিয়ে দোল খাওয়াতে খাওয়াতে বলতেন,
ঘুঘু ঘুঘু মতি সই, পুত কই ?
হাটে গেছে।
কি মাছ আনতে?
সরলপুঁটি
কি দিয়ে কুটি?
বোঁচা বঁটি।
কিম্বা
মাছ কুটলে মুড়ো দেব
ধান ভাঙলে কুলো দেব,
কালো গরুর দুধ দেব,
দুধ খাবার বাটি দেব....
এসব ছড়া আজকের ছোটরা শোনেনা তাই রান্না ঘরে আঁশবটি কি জিগেস করলে তারা হয়ত উত্তর দিতেও পারবেনা। তারা জানে মাছ বাজার থেকে কেটে এনেই রান্না করা হয়। আমার বাপু বাবার মুখে এইসব ছড়ার গান না শুনলে একসময় ঘুম আসতনা ছুটির দুপুরে।
বাবা গাইতেন,
আয়রে আয় ছেলের দল মাছ ধরতে যাই,
মাছের কাঁটা পায় ফুটেছে দোলায় চেপে যাই,
দোলায় আছে স্বপনকড়ি গুনতে গুনতে যাই....তখন কড়ি দিয়ে মাছ কেনা যেত।
এই মাছ ধরার প্রসংগে মনে পড়ে আমাদের বাড়ির সবচেয়ে বড়দাদার কথা। আমরা বলতাম দাদাভাই। নিজে ছিলেন স্পোর্টসম্যান। পড়াশুনো শেষে চাকরী সামলিয়ে তাঁর যত ছিল ফুলগাছের নেশা তত ছিল মাছ ধরার নেশা। ঠিক ছুটির সকালে মাছ ধরবার জিনিষপত্র যেমন মাছের চার অর্থাত আটামাখার গুলি, জ্যান্ত কেঁচো, ভাতের মন্ড ইত্যাদি, ছিপ, ফাতনা, সুতো নিয়ে তিনি চলে যেতেন গঙ্গার ধারে। মাছ উঠলেই হত আমাদের পারিবারিক মহামেছো ভোজ।
বাবা আরো জানতেন ছড়ার গান। সেখানেও ঐ মাছ প্রসঙ্গ যেন এসেই পড়ত।
ও পাড়ার ঐ ছেলেগুলো নাইতে নেমেছে
দুইদিকে দুই রুইকাতলা ভেসে উঠেছে...
কীর্তণে কানু বিনে গীত নাই আর বাঙালীর মত্স্য বিনে গতি নাই। তাই বুঝি শয়নে, স্বপনে, জাগরণে মাছ অনুষঙ্গটি এড়াতে পারেনা তারা।
মাছ শুভ। মাছ পুণ্যতার প্রতীক। তাই বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রশনের তত্ত্বে মাছকে তেল, হলুদ, সিঁদুর লাগিয়ে তত্ত্বের তালিকায় রাখা হয়। এমনকি শ্রাদ্ধের পিন্ডদানের পরেও মৃতের আত্মার রসনা তৃপ্তিতে কলাপাতার ওপরে এক টুকরো মাছ ভেজে দেওয়ার রীতিও দেখেছি। যেন তাঁকে নিবেদন করে অশৌচের পর বাড়ির লোকজন আবার মত্স্যমুখী হতে পারে।
তারপর সেই ছড়ার গানটি? আয়ঘুম যায় ঘুম বাগদীপাড়া দিয়ে বাগদীদের ছেলে ঘুমোয় জালমুড়ি দিয়ে। সেসময় জেলে, বাগদী এদের এতই আর্থিক অনটন এতটাই প্রবল ছিল যে মাছ ধরার বাতিল জাল গুলিও তারা বুঝি ফেলত না । গায়ে দেবার কাঁথার কাজ করত সেই মাছ ধরবার জাল। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের সেই মেছুনির গল্প। মাছ নিয়ে যাদের কারবার সেই মেছুনির নাকি রাতে শোবার সময় মাছের ঝুড়িটা মাথার শিয়রে না রাখলে ঘুম আসেনা। অর্থাত মানুষের যেমন আধার তেমন কর্ম। মেছুনির ভাল লাগে মাছের আঁশটে গন্ধ। ঐ গন্ধ না পেলে তার ঘুমই আসবেনা ঠিক যেমন ছোট ছেলেকে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর অভ্যেস অথবা শোবার সময় বইপড়ার অভ্যেস।
এই মীন শরীরের সব ভাল কেবল ঐ আঁশটে গন্ধটা ছাড়া। এই আঁশের কথাতে মনে পড়ে দিদিমার কথা। কালো ভেলভেটের ওপর কইমছের আঁশ দিয়ে যে অপূর্ব শিল্পকর্মের গল্প শুনেছি তা বুঝি আজ হারিয়ে গেছে। কইমাছের আঁশ তো রূপোর মত চকচকে আর ছোট্টছোট্ট। আর এতো নষ্ট হবার নয়। কোনো বাড়িতে কতগুলি কইমাছ এলে অমন শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলা যায় তা ভেবে কুল পাইনা। এখন তো বাজারে বড় কইমাছ অর্ডার না দিলে মেলেনা। ছোটোগুলিতে এত কাঁটা যে কেউ খাবেনা।
এহেন "আমি'র শিরা-উপশিরায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বাঙাল রক্ত ও বাকী পঞ্চাশ ভাগ ঘটি রক্ত বহমান । আমার মায়ের বাবা এবং বাবার মা দুজনের বাংলাদেশের খুলনাজেলার সাতক্ষীরায় জন্ম। তাই এহেন "আমি" সেই অর্থে হাফ বাঙাল ও হাফ ঘটি । অন্তত: আমার শ্বশুরালায়ের মন্তব্য তাই । ইলিশ আর চিংড়ি দুইয়ের সাথেই আমার বড় দোস্তি ।
বাঙালদের সেই চিতলামাছের মুইঠ্যা একবগ্গা মাছের এক্সোটিক ডিশ ফর গ্যাস্ট্রোনমিক তৃপ্তি । আর আছে কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে বেগুণ দিয়া বাদলা দিলে কাদলা মাছের পাদলা ঝোল। ঘটির হল জিরে-মরিচ-ধনে বাটা দিয়ে আলু-পটল-ফুলকপি দিয়ে কাটাপোনার ঝোল, হিং,আদাবাটা, টামেটো আর ডুমোডুমো আলু দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি পোনার কালিয়া ? আমাশা রোগীর জন্য সেই ঝোলে একটুকরো কাঁচকলা ফেলে দিলেও মন্দ নয়। এই শিলে বাটা জিরে-ধনে-গোলমরিচের যে কত গুণ তা আয়ুর্বেদ পড়লে জানা যায়।
এক টুসকী কাগজী লেবুর রস দিয়ে এই পাতলা ঝোল যেন গ্রীষ্মেবর্ষায় অমৃত। বাটির ঝোলে আবার বাকী লেবুটুকুনি নিংড়ে স্যুপের মত খেলেও পুষ্টি। এত রিফ্রেশিং এই ঝোল ভাত যে খেলেই মনে হয় পুকুরে ডুব দেবার অনুভূতি। তবে মা বলতেন ঝোলের মাছ যেন খুব টাটকা হয়। আর সবজীগুলো ভেজে নিয়ে জিরে অথবা পাঁচফোড়ন দিয়ে ভাজা মাছ, সবজী সেদ্ধ হবার পর নামানোর ঠিক আগে দেবে ঐ জিরে-ধনে-গোলমরিচ বাটা। তবেই হবে ঝোলের আসল স্বাদ। মশলার গুণও বজায় থাকবে।
এছাড়া এই একেঘেয়ে রুই কাতলার বাঙালী ঘরোয়া পার্টিতে আরো অনেকভাবে ধরা দেয়। মাছ সেদ্ধ করে মাছের কাঁটা বেছে নিয়ে চপের মত পুর বানিয়ে ফিশ ক্রোকে, মাছের কচুরী, মাছের চপ, টাটকা রুই- কাতলার পেটি দিয়ে দৈ-মাছ, কোর্মা, মাছের পোলাও, আরো কত বলব ! ঘটি হেঁশেলে শুঁটকি ফুটকির নো এন্ট্রি ! তাই বেশীরভাগ ঘটিবাড়িতেই রুই-কাতলা-ভেটকি-পার্শ্বে, চিংড়ি, ইলিশ, কই, ট্যাংরা আর মৌরলা নিয়ে মজে থাকতে হয় বারোমাস।
আমার দিদিমা খাস উত্তর কলকাতার কুটিঘাটের ব্যানার্জি পরিবারের মেয়ে। বয়স মাত্র এগারো। ঐটুকুনি মেয়ে বিয়ের কি বোঝে! সে আবিষ্কার করতে শুরু করেছিল গ্রাম্য পরিবেশের মাধুর্য্য। গাছের ফলপাকড়, টাটকা শাকসব্জী, নদী-পুকুর থেকে মাছ ধরে আনা সেই বিবাহিতা কিশোরীর কাছে যেন বিস্ময় তখন। শ্বশুরবাড়িতে দুপুর হলেই পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা ছিল তার কাছে এক আশ্চর্য্যের বিষয়।
দিদিমার মুখে গল্প শুনেছি শাশুড়ি, ননদ ভাজের মধুর সম্পর্কের কথা। নতুন বৌ হয়ে তিনি শ্বশুরবাড়ি যাবার পর তাঁকে এত যত্ন তাঁরা করেছিল যে তিনি মারা যাবার শেষদিন বধি বলে গেছেন সে কথা। দিদা ছিল বাড়ির মেজবৌ। ননদরা নদী থেকে সদ্য ধরা ট্যাংরামাছ ভাজা আর তেল দিয়ে একথালা ভাত দিয়ে নতুন বৌকে বসিয়ে আদর করে খেতে দিয়েছিল। নদীর টাটকা মাছ আর অমন যত্ন দিদার মাও বুঝি করেনি তাকে..তিনি বলতেন।
অনেকেই এই ট্যাংরামাছ পিঁয়াজ দিয়ে খান তবে আমাদের ঘটিবাড়িতে রাঁধবার ধরণটা সম্পূর্ণ আলাদা। মাছ ভাল করে ভেজে নিয়ে সরষের তেলে পাঁচফোড়ন দিয়ে টমেটো কুচি, কাঁচালঙ্কা, কড়াইশুঁটি আর সর্ষে-শুকনো লঙ্কাবাটা দিতেন মা। মাছ সেদ্ধ হলে বেশ গায়ে মাখামাখা এই ট্যাংরার ঝালে এবার সর্ষের তেল ছড়িয়ে গরগরে করে নামিয়ে যে পাত্রে রাখবে তার মধ্যে ছড়াও একটু গরমমশলা। ব্যাস! দিদিমার হাতে এই রান্নার স্বাদ আর কোথাও পাইনি। শীতকালে গরমমশলার বদলে ধনেপাতা কুচিয়েও দেওয়া যায় ওপর থেকে।
মামাবাড়িতে এক প্রকান্ড বাঁধানো পুকুর ছিল। আমার দিদিমার নেশা ছিল লাল শান বাঁধানো পুকুরের ঘাটের সিঁড়িতে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরা। সেই টাটকা মাছের কাঁচা ঝাল দিয়ে গরম ভাত হত সেদিন রাতের আহার। মায়েরা তাদের ছোটবেলায় ঐ পুকুরে গরমের ছুটিতে সব তুতো ভাইবোনদের সঙ্গে চানে নামত। প্রত্যেকের লাল গামছা পুকুরের জলে ফেলে ছোট ছোট চিংড়িমাছ ধরত। এবার চান সেরে যে যার মত বাগানের কোনে কাঠকুটো জ্বেলে ছোট কলাইয়ের বাটিতে সেই মুঠোমুঠো জ্যান্ত চিংড়িমাছ, ঝিরিঝিরি আলুর কুচি, কাঁচা সর্ষের তেল, নুন, হলুদ আর চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে বসিয়ে দিত। বাটিতে হয় বলে এর নাম বাটিচচ্চড়ি। পংক্তিভোজে দুপুরের খাবার সময় যে যার নিজের বাটি নিয়ে বসে পড়তে মাটিতে। বাড়ির বড়রা তা দেখে তাজ্জব হয়ে যেতেন। এখনো বাটিচচ্চড়ি রাঁধি তবে জ্যান্ত মাছ আর পাই কই?
দাদামশাই এই বাটিচচ্চড়ি খেতেন আর বলতেন, তোমাদের কোফতা কালিয়া চুলোয় যাক্! আজ এটা আর খাবনা, খেলেই তো ফুরিয়ে যাবে। বরং বাটিটা মাথার বালিশের পাশে নিয়ে শুই। কত সম্মান ছিল এই বাটিচচ্চড়ির মত সাধারণ পদটির।
রবিঠাকুরের প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল পান্তাভাত আর চিংড়িমাছ ভাজা। তাঁর লেখা কবিতাতেও প্রচুর পাই এমন চিংড়ির কথা।
তিমি ওঠে গাঁ গাঁ করে
চিঁ চিঁ করে চিংড়ি
ইলিস বেহাগ ভাঁজে
যেন মধু নিংড়ি।
অথবা
মাছ এল সব কাৎলাপাড়া, খয়রাহাটি ঝেঁটিয়ে ,
মোটা মোটা চিংড়ি ওঠে পাঁকের তলা ঘেঁটিয়ে ।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে সহজপাঠ দ্বিতীয় ভাগের সেই কথা...
"কাংলা, তোর ঝুড়িতে কী? ঝুড়িতে আছে পালং শাক, পিড়িং শাক, ট্যাংরা মাছ, চিংড়ি মাছ। সংসারবাবুর মা চেয়েছেন'
সে ছিল অনুঃস্বরের অধ্যায়। চিংড়ি আমাদের নিজের হাতে বেছে খেতে দেওয়া হতনা। কারণ সহজপাঠ পড়ুয়াদের পেটখারাপ হবে তাই।
আজকাল হোটেলে ডাবচিংড়ি নামে একটি মাগ্যির ডিশ সার্ভ করা হয়। মামারবাড়িতে ডাব দিয়ে নয়। নারকোলের শাঁসসুদ্ধ দুটি মালার মধ্যে বাগদাচিংড়ি সর্ষে-পোস্ত-কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে মেখে, কাঁচা সর্ষের তেল, হলুদ, লঙ্কা, নুন দিয়ে নারকোলের মালায় রেখে এবার নারকোলটিকে বন্ধ করে সেই ফাটা অংশে ময়দার পুলটিশ লাগিয়ে মরা উনুনের আঁচে ঐ নারকোলটি রেখে দেওয়া হত ছাইয়ের ভেতরে । ঘন্টা দুই পরে তাক লাগানো স্বাদ ও গন্ধে ভরপুর ভাপা চিংড়ি নাকি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসত নারকোলের শাঁসের সঙ্গে। চিংড়ির মালাইকারীও এভাবে রাঁধা হয়েছে বহুবার। সেখানে সর্ষের বদলে পিঁয়াজ, আদা-রসুন গরমমশলা বাটা আর তেলের বদলে ঘি দেওয়া হত। পোলাও সহযোগে এই মালাইকারী জমে যেত।
চিংড়ি মাছের কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় আমার এক মামার কথা। উনি খুব রগুড়ে ছিলেন। ওনাদের সময় কত্তবড় চিংড়ি খেয়েছিলেন তা বোঝানোর জন্য উনি একবার বলেছিলেন" জানিস? এ আর কি চিংড়ি? এ তো লবস্টার কো বাবালোগ। আমরা যে চিংড়ি খেয়েছি তার খোলাগুলো ডাস্টবিনে পড়ে থাকলে তার মধ্যে দিয়ে কুকুরের বাচ্ছা ঢুকতো আর বেরুত।"
চিংড়ি আর কাঁকড়া মাছ নয় বলে আর সম্পূর্ণ অন্যজাতের সজীব বলে বুঝি ওদের এত স্বাদ। আঁশটে ব্যাপরটা নেই । আছে এক অন্য রসায়ন। সংস্কৃত শ্লোকে পর্যন্ত চিংড়ি নিয়ে ঠাট্টা পড়েছিলাম কল্যাণী দত্তের "থোড় বড়ি খাড়া' য়।
গলদাং বাগদাং রস্যাং নারিকেল সমণ্বিতাম্
অলাবু লোভানাং কৃত্বা তক্ষিতব্যং শুভে যোগে।।
অর্থটি খুব সহজ। নারকেল অথবা লাউয়ের সঙ্গে চিংড়ির কেমিস্ট্রিটা সবচেয়ে ভাল জমে যে কোনও শুভযোগে।
ঘটির হেঁশেলে সবকিছুতে চিংড়ি। রোজকার পদে একটি কুচো বা ঘুষো, চাবড়া (ধানক্ষেতের জলে হয়) কিম্বা বাগদার পদ থাকবেই। সেটি হল সাইড ডিশ। বড় চিংড়ি দিয়ে মোচা, এঁচোড় কিম্বা ফুলকপি দিয়ে ডালনা হল রাজভোগ্য। সবকিছুর রেসিপিতেই সবজী ভেজে নিয়ে আদাবাটা, টমেটো, লঙ্কা দিয়ে গরগরে কালিয়া আর নামানোর আগে মোক্ষম অস্ত্র ঘি আর গরমমশলার কম্বিনেশান।
আমার ঠাকুমার হাতের আরেকটি বিশেষ পদ হল চিংড়ি দিয়ে পটলপোস্ত। শুধু পাঁচফোড়নের মহিমা আর লঙ্কাবাটার প্রশ্রয়ে পোস্তর সাথে ভেজে নেওয়া কুচোনো পটল, আলু আর নামানোর সময় কাঁচা সর্ষের তেল ছড়িয়ে শুকনো ভাতে মেখে খাও।
চিংড়ির পরেই মনে পড়ে কাঁকড়ার কথা। কেউ বলে দশরথ। সকালবেলায় এর নাম নিলে নাকি দিন খারাপ যাবে, যত্তসব কুসংস্কার বাঙালীর। অথচ তার স্বাদ নেয়নি এমন বাঙালীর সংখ্যা বিরল।
রসিক রবির গল্পে পাকড়াশীদের কাঁকড়াডোবা অথবা ডিমভরা কাঁকড়ার কথায় মনে পড়ে মেয়ে কাঁকড়ায় ডিম হয় বলে ছেলে কাঁকড়া কিনলে নাকি মাস বেশী পাওয়া যায়। যাদের এলার্জি তারা এ স্বাদের ভাগ পাবেনা। দাঁড়াগুলো ভেঙে নিয়ে চুষে রস বের করতে ছোটবেলায় আমাদের সারাটা দুপুর কাবার হত। হাতের এঁটো শুকিয়ে যেত। ভাত শেষ হয়ে যেত। কাঁকড়ার এমনি মোহ। কেউ রাঁধে পিঁয়াজ-রসুন-আদা দিয়ে রসা। তার এক স্বাদ। তবে সর্ষে কাঁকড়ার ঝাল অন্যরকম। কাঁকড়ার গন্ধটা পুরো পাওয়া যায়। আর তার পা গুলো দিয়ে পুঁইশাক চচ্চড়ির স্বাদ অনবদ্য।
বৈষ্ণবরা নাকি এ রসে বঞ্চিত তাই ঠাট্টা করে ট্রেনে এক বৈষ্ণবের পাশে বসে একজন শৈব গেয়েছিলেন
"বোষ্টম টমটম, হাঁড়ির ভেতর কাঁকড়া রেখে যায় বৃন্দাবন'
মানে শৈব গায়ক বোঝালেন, বোষ্টমরা চুপিচুপি সবই খায় তাদের যত্তসব হিপোক্রেসি।
আমরা বলি কাঁকড়া অযাত্রা অথচ সংস্কৃতের পঞ্চতন্ত্রের গল্পে রয়েছে এই কাঁকড়াই নাকি সাপকে মেরে এক বণিকের পুত্রের জীবন বাঁচিয়েছিল ।
বিদেশের ট্রাউটের সমগোত্রীয় হল আমাদের ভেটকী। ভেটকীর ফ্রাই বা ব্যাটারে ডুবিয়ে ফিশ ওরলি নেমন্তন্ন বাড়ির মোষ্ট ফেবারিট। ফিশ ফিঙ্গার হল কেতাদুরস্ত ককটেল স্ন্যাক। দুধসাদা টার্টার সসে একটি একটি করে ডুবিয়ে মুখের মধ্যে পুরে আলতো চাপ দিলে আদা-রসুন সমন্বয়ে ভেটকিফিলের এই স্লিম আঙুল তখন ফুলে উঠেছে ডিম আর বেডক্রাম্বের কোটিঙয়ে । কিন্তু ভেটকীর সর্ষেবাটা ও আদা দিয়ে ঝাল অথবা শীতের মরশুমী ফুলকপি দিয়ে কালিয়া কিম্বা কাঁটাচচ্চড়ি হল আটপৌরে বাঙালীর আভিজাত্যপূর্ণ সাবেকী ডিশ। এখন কলাপাতায় মুড়ে ভেটকীর ফিলে দিয়ে পাতুড়ির খুব চল। আমি এই রেসিপিকে একটু মডিফাই করেছি। কলাপাতার বদলে পুঁইশাকের পাতায় কিম্বা লাউপাতায় মুড়ে ননস্টিকে এই পাতুড়ি করলে পাতার মধ্যে লেগে থাকা তেলমশলা সমেত এই পাতুড়িটা ভাতে মেখে খেয়ে ফেলা যায়।
ঘটিবাড়ির আরেকটি প্রধান মাছের রান্না হল মৌরলার টক। তেঁতুল অথবা আমের টক করে নিয়ে তার মধ্যে মুচমুচে করে ভাজা মৌরলা ভেসে থাকবে। আর সরষে ফোড়নের সঙ্গে তার রসায়নে যে রসনা সৃষ্টি হবে তা যেকোনো ঋতুতেই শেষপাতে দৌড়বে। অরুচির রুচি আনবে। এই মৌরলা মাছ শানের মেঝেতে রেখে একপ্রকার ডলে নিতেন মা। তার ন্যানো সাইজের আঁশগুলো বেরিয়ে যাবে আর পেটটা ধরে আলতো করে চাপ দিলে পিত্তিটা বেরিয়ে যাবে। পিত্তিসমেত রান্না করলে দশসের দুধে একফোঁটা গো-চোনার সামিল হবে সেই তেতো পদটি।
এবার আসি বাঙ্গালীর আদরের রূপোলী সজীব শস্যে। ঝিরঝির করে অবিরাম ইলিশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়তেই থাকবে আর ঠিক তখনি ঝাঁকেঝাঁকে গভীর জলের এই ইলিশমাছ সমুদ্রের নোনা জল সাঁতরে, জোয়ারের আনুকূল্যে স্বল্প পরিশ্রমে, নদীর কাছে আসবে, আমাদের ধরা দিতে। বলবে, বাঙ্গালী, তোমার জলকে নেমেছি।
ছোটবেলায় সবচেয়ে মজা ছিল রেনিডেতে হঠাত ইলিশের গন্ধটা। হঠাত ছুটির সাথে বৃষ্টি আর হঠাত পাওয়া ইলিশের অনুষঙ্গে মন কানায় কানায় !
মায়ের সারপ্রাইজ। উনুনের পিঠে হাঁড়ির মধ্যে গরম ভাত আর তার মুখে চাপা দেওয়া একটা টিফিনকৌটোর মধ্যে বন্দী ইলিশমাছের ভাতে বা ভাপা । হলুদ পড়বেনা এই পদে।টাটকা মাছের গন্ধ নষ্ট হয়ে যাবে। কৌটোর মধ্যেই নুন মাখানো ইলিশের গাদা-পেটি সর্ষে, কাঁচালঙ্কা বাটা, কাঁচা সর্ষের তেল আর বেশ কয়েকটি চেরা কাঁচালঙ্কার সাথে জারিয়ে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে মিনিট দুয়েক রেখে দিলেই এই অমূল্য পদ তৈরী। আমার রন্ধন পটিয়সী দিদিমা তার বিশাল সংসারে বিরাট এক হাঁড়ির মুখে বিশাল এক কচুপাতার মধ্যে মাছগুলিকে ম্যারিনেট করে পাতাটি সুতো দিয়ে বেঁধে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে রাখতেন। মা বলত, সে ভাপা ইলিশের নাকি অন্য স্বাদ। দিদিমার নাতনী মানে এহেন আমি একটু ইম্প্রোভাইজ করে এই কায়দাটি করি লাউপাতায় মুড়ে এবং ননস্টিক প্যানে অর্থাত পাতুড়ির স্টাইলে। যাই করো এ কানুর তুলনা নেই। কাঁচা তেলঝাল, ভেজে ফোড়ন দিয়ে ঝাল, গায়ে মাখামাখা হলুদ সর্ষেবাটার ঝাল, বেগুন দিয়ে কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে বাঙালদেশের পাতলা ঝোল...সবই যেন এই বর্ষায় দৌড়তে থাকে গরম ভাতের সঙ্গে।
তাবে আমি বাপু রসুন-পেঁয়াজ-আদা সহযোগে ইলিশমাছের স্বাদ ও গন্ধ কোনোটাই পাইনা। এমনকি কাঁটা বেছে খেতে যারা ভয় পায় তাদের স্মোকড হিলসা অথবা ইলিশ বিরিয়ানীর স্বাদেও আমি বঞ্চিত কারণ সেক্ষেত্রে যেন মনে হয় মাছটাই নষ্ট হল।
ইলিশমাছের কিছুই যায়না ফেলা। মাথা আর তেল দিয়ে ছ্যাঁচড়াও আমাদের ঘটি হেঁশেলের একটি অভিনব বর্ষার পদ। সাদাভাত অথবা খিচুড়ি দিয়ে জমে যায় এই চচ্চড়ি। সর্ষের তেলে মুচমুচে করে মাথা ভেজে নিয়ে ঐ তেলের মধ্যেই পাঁচফোড়ন আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে দুনিয়ার সবজী অর্থাত আলু, মূলো, কুমড়ো, ঝিঙে বেশ করে নেড়ে নিয়ে পুঁইশাক ডাঁটা ও পাতা দিয়ে ঢেকে দাও। নুন, হলুদ ছড়িয়ে দাও। কুচোনো থোড়, বাঁধাকপিও দিতে পারো সাথে। তারপর নুন, হলুদ, লঙ্কাগুঁড়ো, চিনি আর নামানোর আগে সর্ষেবাটা দিয়ে নাড়তে থাকবে। এটাই হল সফল ছ্যাঁচড়া টেষ্টি হবার উপায়। মা বলতেন, যতক্ষণ না অবধি কড়ায় "লাগা লাগা' অর্থাত একটু পোড়া পোড়া হবে ততক্ষণ রাখতে হবে আঁচে। সিল্ক পিওর কিনা পরখ করতে গিয়ে দাদু বলতেন, শাড়ির কোল আঁচল থেকে একগাছি সুতো পুড়িয়ে যদি "ছ্যাঁচড়া পোড়া' অর্থাত একটা মেছো অথচ পোড়া গন্ধ পাওয়া যায় তবেই সেটি আসল সিল্ক। তার মানে বুঝেছিলাম ছ্যাঁচড়া কড়ায় একটু লেগে গেলে তবেই হবে অথেন্টিক।আর যেহেতু পিওর সিল্ক হল ফাইব্রাস প্রোটিন জাতীয় তা পোড়ালে ঐ গন্ধ পাওয়াটা কিছু অস্বাভিক নয়।
ঘটি হেঁশেলে রুই বা কাতলার মুড়ো দিয়ে সোনামুগ ডাল ভেজে নিয়ে করা হয় মুড়িঘন্ট বা মাছের মাথা দিয়ে ডাল। এ এক উপাদেয় যজ্ঞ্যিবাড়ির পদ। বাঙালবাড়িতে এটাই রাঁধা হয় সুগন্ধী আতপচাল দিয়ে। বাকীটুকু একই রকম। শুরুতে মাথা ভেজে নিয়ে পিঁয়াজ, রসুন আদা, টমেটো কষে ওরা দেয় সেদ্ধ করা ভাত আর আমরা তার মধ্যে দি সেদ্ধ করা সোনামুগ ডাল। তারপর ঘি, গরমমশলার ছোঁয়া আর চিনির স্পর্শে তা যেন হয়ে ওঠে অমৃত ডাল। একঘেয়ে ডালের থেকে ধোঁয়া ওঠা এই ডাল বরং ক্ষুধার উদ্রেক করে। আর মাছের মুড়োয় যেন অল্প মাছ থাকে আর ডাল ফোটার সময় মুড়ো একটু ভেঙে দিতে হয়। হলুদ সোনামুগ ডালের মধ্যে চেরা সবুজ কাঁচালঙ্কার অনুষঙ্গে এই ডাল শুধু ডাল নয় বরং একটি সম্পূর্ণ পদ।
মনে পড়ে কোনও এক পৈতেবাড়ি আর সাধভক্ষণের দ্বিপ্রাহরিক নিমন্ত্রণে এই ডাল দিয়ে তপসে মাছের ফ্রাই খেয়েছিলাম। অতুলনীয় সেই যুগলবন্দী। এই তপসে মাছ সন্ন্যাসীর মত শ্বশ্রুগুম্ফ যুক্ত আর তপস্বীর মত গেরুয়া পোষাক পরিহিত অর্থাত তার ল্যাজা মুড়ো, পাখনা, দেহের রং সবেতেই গেরুয়া রঙের ছোঁয়া। এ মাছের ভাজা বানানো অতীব সহজ। আমার শাশুড়িমা বাড়িতে এনে মাথার কাঁটা দিয়ে এর পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি, পিত্তি টেনে বের করতেন। কারণ কেটে ফেললে মাছ ভাজতে গিয়ে ভেঙে যাবে তাই। তারপর ড্রেশ করা সেই মাছ রগড়ে নিয়ে আঁশ বের হয়ে গেলে, ধুয়ে এক টুসকী পাতিলেবুর রস, নুন আর সামন্য হলুদ দিয়ে জারিত করতেন। কিছু পরে এর মধ্যেই আদা-রসুন কাঁচালঙ্কা বাটা নরম হাতে মাখিয়ে দিতেন । পড়ে থাক তেমনি করে অন্ততঃপক্ষে ঘন্টাখানেক। ওদিকে ব্যাটার তৈরী হল দুরকমের বেসন (ছোলা ও মটরের), ঠান্ডা জল, নুন, হলুদ, লঙ্কাগুঁড়ো, পোস্তদানা আর কালোজিরে দিয়ে। এবার ব্যাটারটি হবে নাতি পাতলা নাতি ঘন অর্থাত মাঝামাঝি। এবার সে মিশ্রণ ফ্রিজে রাখতে হবে। তারপর খাবার সময় কড়াইতে সর্ষের তেল গনগনে করে গরম করে ঐ মিশ্রণে চালের গুঁড়ো ছড়িয়ে একটি একটি করে মাছের গায়ে অতি সন্তর্পণে কোটিং করে ভাজতে হবে আঁচ কমিয়ে বাড়িয়ে। ছোট সাইজের গুর্জাওলি মাছও এমন করে ফ্রাই করলে মন্দ লাগেনা খেতে।
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে এই অনুপম তপসে মাছের কথা।
তপ্ত তপ্ত তপসে মাছ, গরম গরম লুচি,
অজামাংস ভাজাকপি আলু কুচি কুচি।
শীতের দিনে খাবে যদি তুলে থাবা থাবা
দশ নম্বর পদ্মপুকুর দৌড়ে এস বাবা।
আরেকটি সামুদ্রিক মাছ হল ফ্যাঁশা। ইলিশের মত রূপোলী, ঝকঝকে দেখতে। দামও বেশ কম। নদীর ফ্যাঁশার স্বাদ সমুদ্রের চেয়ে ঢের ভাল। সমুদ্রের গুলো হয় বড় আর নদীর গুলো হয় অপেক্ষাকৃত ছোট। এই ফ্যাঁশামাছ ডালের সাথে প্রথম পাতে মুচমুচে ভাজা আর বড়ি আর সর্ষেবাটা দিয়ে গায়ে মাখা ঝাল ঘটিদের আরেকটি প্রিয় পদ।
মাছভাজার কথা বললেই মনে পড়ে যায় অরুচির রুচিকারক ঘুষোচিংড়ির বড়ার কথা। এর দোষ একটাই বড্ড তেল লাগে ভাজার সময়। তবে যারা এই ঘুষোচিংড়ির বড়া খায়নি তারা একবার খেলে আর ভুলতে পারবেনা। অনেকের কাছেই এ হল সস্তার মাছ, গরীবের খাবার অথবা খেলে "পেটের অসুখ করবে' টাইপ। কিন্তু ভাল করে ধুয়ে বেছে নুন, হলুদ, পোস্তদানা, কাঁচালঙ্কা কুচি আর বেসন ছড়িয়ে এই বড়া ডালের সাথে অথবা অম্বলে ফেলে খেতে বড়ো ভাল লাগে।
ঘুষোচিংড়ির কথাতে মনে পড়ে কবি ঈশ্বর গুপ্তকে।
"দীনের তারণকারী চিংড়ির ঘুষো
সুমধুর বাতহর পয়সায় দুশো'
আজকের সফিষ্টিকেটেড মডিউলার কিচেনে মাছকাটা কিম্বা আঁশবটি ব্রাত্য কারণ স্থানাভাব। কিন্তু বাবা বলতেন পরিপাটি করে মাছকে কেটে সাজিয়ে রান্নার উপযুক্ত করে তোলাটাও হল এক শিল্প। তাইতে মনে হয় তখনকার দিনে মেয়েরা বেশীর ভাগ বাড়িতেই আটকে থাকতেন। কর্তামশাই বাজার থেকে মাছ এনে দিলে তবে তিনি সেই কর্তণ পারিপাট্য দেখাবেন। কারণ যে রাঁধে সে মাছও কাটে। আর কথাতেই বলে মাছ ধুলে মিঠে, মাংস ধুলে রিঠে। তাই তেল, পোঁটা, আঁশ ফেলে কাটা মাছ ভালো করে ধুলে তবেই তা হবে সুস্বাদু। বাড়ির গিন্নীরাই সেই কাজটি করতেন সে যুগে। এসব আজকের বদলে যাওয়া গতিশীল দুনিয়ায় স্বপ্ন। বিশ্বায়নের যুগে হংকং থেকে হনললু, টরোন্টো থেকে টেক্সাস কিম্বা লন্ডন থেকে লাসভেগাস সর্বত্র মাছ কিচেনে প্রবেশ করে বরফের সমাধি থেকে। কখনো বা ক্যানবন্দী হয়ে। এমনকি আমাদের ভারতেও ডিপারটমেন্টাল স্টোরসের দুর্গন্ধময় ফিশকর্ণার থেকে কেটেকুটে সোজা প্রবিষ্ট হয় বাড়ির ফ্রিজে। রান্নার মাসী তাকে কিভাবে ধুয়েছে তা দেখবার সময় নেই বাড়ির ব্যস্ত গৃহিণীর। এখনকার চালানীর মাছে শুনছি আধিক্য রয়েছে পর্যাপ্ত কীটনাশক অথবা মাছকে বহুদিন তাজা রাখবার রাসায়নিক। তাই বারেবারে ধোয়াটাও খুব জরুরী। তার চেয়ে মনে হয় বাজার থেকে জিওল মাছ খাওয়া অনেক বেশী পুষ্টিকর। আর অল্পসংখ্যক চুনোচানা মাছ নিয়ে যারা বাজারে বসে সেগুলি বোধহয় স্বাস্থ্যকর । এদের মাছের স্বাদও ভাল আর রিস্কফ্যাক্টরও কম।
শিলাদিত্য ডিসেম্বর সংখ্যা ২০১৬