বিদেশের মাটিতে পা রেখেছিলাম অনেকদিন আগে । সেই নিয়ে আমার স্মৃতিচারণা আদরের ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে ।
২১ সেপ, ২০১৩
৭ সেপ, ২০১৩
পর্বঃ রাজাবাজার
কলেজ
থেকে ইউনিভার্সিটির একলাফে
ট্রানজিশান যেন একফোঁটা
দস্যি ইলেকট্রনের গ্রাউন্ড
লেভেল থেকে এক্সাইটেড স্টেটে
ফার্স্ট ঝাঁপিয়ে পড়া । কত
এনার্জি ওইটুকুনি ইলেকট্রনের
!
চার্জড
হয়ে তো আছেই সে ।
কো-এড
বাতাবরণ । রঙীন চশমা চোখে আর
সদ্য ফুটিফুটি যৌবনে পা রাখার
আনন্দ । হেদোর মোড়ে ফুচকা
তদ্দিনে পার্শিবাগানে পাড়ি
দিয়েছে । বিধানসরণীর চাচার
রোল তখন রাজাবাজারে ঊত্তীর্ণ
।
জীবনের
সবচেয়ে ব্যস্ততার বছর দুটো
কেটেছিল রাজাবাজার বিজ্ঞান
কলেজে । বেথুন কলেজের রক্ষণশীলতার
লক্ষণরেখা ডিঙিয়ে সেই প্রথম
কো-এড
বাতাবরণে গা ভাসানো ।
সে
ছিল বৃষ্টিভেজা শ্রাবণ সকাল
। রাজাবাজারে ক্লাস শুরু হ'ল
। রোজ সাড়ে দশটায় ক্লাস শুরু
। দক্ষিণেশ্বর থেকে ব্রেকজার্নি
। অধিকাংশ দিন শ্যামবাজারে
নেমে লেডিস ট্রাম ১২ নম্বরে
চড়ে বসতাম । তারপর সার্কুলার
রোড ধরে ট্রাম আমাকে বয়ে নিয়ে
পৌঁছে দিত সায়েন্স কলেজ ।
শুরু হ'ল
প্রতিনিয়ত যাতায়াতের লড়াই
। কিন্তু দুবছরে কোনোদিনো
আমি ফার্স্ট ক্লাস মিস করিনি
। যারা কাছে থাকত তারা বরং লেট
করে পৌঁছাত । স্যার একদিন
বলেছিলেন "একে
দেখে শেখো,
She is nearest to the God, farthest from the Church!"
থিয়োরি
ক্লাসের পর লাঞ্চব্রেক । তারপর
প্র্যাকটিকাল ক্লাস । রোজ
সাতটা সাড়ে সাতটা নাগাদ ক্লাস
শেষ হত । তারপর অফিসের ভীড়
ঠেলে বাড়ি ফেরা ।
কলেজে
ক্লাস শুরুর ঠিক পরেপরেই চোখে
নিদারুণ কনজাংটিভাইটিস সংক্রমণ
হল । নতুন ক্লাস আর দ্বিতীয়
কেউ নেই যে আমার পড়া বুঝিয়ে
দেবে । ক্লাস-নোটসের
ওপর ভিত্তি করেই পড়া আর পরীক্ষা
দেওয়া । তাই শুরু থেকেই হুঁশিয়ারি
সেকেন্ড ইয়ারের দাদাদিদিদের
"কোনো
ক্লাস কামাই করবে না"
।
ইউনিভার্সিটিতে যারাই রক্ষক,
তারাই
ভক্ষক অতএব ক্লাসে যা পড়ানো
হবে সেটা নিয়মিত ফলো করে গেলে
আর তাকে ভিত্তি করে নিজে পাঁচটা
জার্নাল আর বই ঘেঁটে নোটস
বানিয়ে নিলেই ফার্স্টক্লাস
অবধারিত । তাই নিদারুণ
চক্ষুশূলেতেও বাসবদল করে
আলমবাজার থেকে রাজাবাজারে
গেছি ক্লাস করতে । ইউনিভার্সিটিতে
প্রোমোশানের জন্য নতুন রোদচশমা
চোখে সেদিন দুগ্গা দুগ্গা
বলে কলেজে গেছি । ক্লাসরুমে
ঢোকার মুখে আমার ক্লাসেরই
একপাল ছেলে (তখনো
আলাপ পরিচয় হয়নি তাদের সাথে
) তুমুল
শব্দ করে উঠল । বুঝলাম যে আমাকে
দেখে ওরা অমন করছে । চশমাটা
কায়দা করে মাথায় তুলে তাদের
দিকে চেয়ে বললাম "
এই
তো সবে ক্লাস শুরু হল,
দুবছর
তোদের সাথে ঘর করব কি করে!
ক্লাসের
বন্ধুকে তোরা আওয়াজ দিস বুঝি!
বুঝতাম
তোরা আমার সিনিয়ার তাহলেও নয়
একটু আধটু raggingভেবে
ক্ষমাঘেন্না করে দিতাম !"
সাথে
সাথে আমার বন্ধুরা sorry
বলেছিল
। তারপর ওরা যে আমার কি ভালো
এবং হেল্পফুল বন্ধু হয়ে উঠেছিল
যে কি বলব ।
প্রতি
শুক্রবার আমাদের থিয়োরি ক্লাস
হত প্রেসিডেন্সি কলেজে । সেখান
থেকে দল বেঁধে পায়ে হেঁটে
ট্রাম রাস্তা,
অলিগলি
দিয়ে পার্সিবাগান লেন ও সব
শেষে সায়েন্স কলেজে এসে
প্র্যাকটিকাল ক্লাস করা ।
সেই ফাঁকে পরিচয় হল কফিহাউসের
সাথে । ঐ দুটো বছর অনেক ভালো
বন্ধু পেয়েছিলাম । কফিহাউস
ছাড়াও সায়েন্স কলেজের ক্যান্টিন,
সাহা
ইনস্টিটিউট ও বোস ইনস্টিটিউটের
ক্যান্টিনে দুপুরের টিফিন
খাওয়ার মজাটাই ছিল অন্য স্বাদের
। ন্যাশানাল লাইব্রেরীতে
পড়াশুনোও চলত সেই ফাঁকে ।
মনে
পড়ে যায়...
দুপুরবেলার
নিঝুম স্মৃতি,
শান্ত
পায়ে পথ চলা,
ক্লান্ত
গায়ে কথা বলা রাজাবাজার কলেজ
পারে,
ট্রামলাইনকে
ক্রস করে,
এপিসি
রোড ছুঁতো শেষে
পার্শিবাগান
লেন,
কলিকাতা
সাতলক্ষনয় ।
আমরা
তখন স্নাতোকোত্তর,
আমরা
খোলা হাওয়া
স্বপ্ন
নেশা চোখে মেখে,
রঙীন
হয়ে যাওয়া
খগেনদাদার
চায়ের ঠেকে,
ল্যাবের
সেই কোণা
মিনিট
পাঁচেক জিরেন,
টেস্টটিউব
হাতে নিয়ে...
সুলগ্নার
বাসের প্রেমিক,
কমলিকার
দেখতে আসা,
সুদীপের
স্বপ্ন দেখা,বিদেশ
যাবার কত আশা !
অমৃতা
আর সুমন জুটি,
পাশাপাশি
থাকত কেবল
গোপন
প্রেমের কেমিস্ট্রিতে,
গসিপ
গিলি বন্ধু সকল..
সূয্যি
ডোবে আঁধার নেমে আসে
কলিকাতা
সাতলক্ষনয়,
পার্শিবাগান
লেনে ।
ফার্স্ট
ইয়ারেই ভিসা পেল সুমন-অনীক-জয়দীপরা
হলনা
কো অমৃতার সুমনের সাথে বাড়ি
ফেরা..
রইলো
পথের ধূলোগুলো,
উড়ে
গেল কিছু
পার্শিবাগান
চললে তুমি আমার পিছুপিছু
রইলে
নীরব প্রেমের তুমি ,
সাক্ষী
হয়ে শুধু
রাজাবাজার,
কলিকাতা
সাতলক্ষনয় ।
আমরা
তখন সেকেন্ড ইয়ার,
একশো
কুড়ি জন
কফিহাউস,
বইপাড়া,
জটিল
সমীকরণ ।
মাতাল
হাওয়ায়
উড়ে গেল,
বুদবুদ
উদ্বায়ী
হারিয়ে
গেল ওরা যেন আজব পরিযায়ী ।
কফিহাউসের
সাদা টেবিল লিনেনে
রইল
ছোঁয়া সাতাশি সালের ব্যাচ
রইলে
তুমি পড়ে পার্শিবাগান লেন
আর
এপিসি রোড,
কলিকাতা
সাতলক্ষনয় ।
বিশুদ্ধ
রসায়নের সিলেবাসের চাপে ঐ
দুটো বছর কোথা দিয়ে সূর্যোদয়
আর সূর্যাস্ত হয়েছিল তা টের
পাইনি । তখনো
আমার সাহিত্যের ধারাপাত অধরা,
অনবরত
মস্তিষ্কের রাসায়নিক বিক্রিয়ার
টানাপোড়েনে ।
দিক্পাল
সব কেমিষ্ট্রির অধ্যাপকের
সান্নিধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল
ভবিষ্যতের দিশা । একদিকে
ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স,
অন্যদিকে
কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর
তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এহেন
আমি হাবুডুবু খেতে খেতে
অর্গ্যানিক কেমিষ্ট্রিতে
স্পেশালাইজ করলাম । ডাঃ অসীমা
চট্টোপাধ্যায়,
ডাঃ
জুলি ব্যানার্জি,
ডাঃ
অভিজিত্ ব্যানার্জি,
প্রোফেসর
তলাপাত্র,
ডাঃ
প্রিয়লাল মজুমদার,
ডাঃ
শিবদাস রায় এদের সাথে সর্বক্ষণের
ওঠাবসা আমার জীবন রসায়নকে
অনেকটাই বদলে দিয়েছিল । জৈব
রসায়নের সবচেয়ে আকর্ষণীয়
বিষয় ন্যাচারাল প্রোডাক্টস
নিয়ে পড়াশুনো করতে করতে
আশ্চর্য্য হতে লাগলাম । সকালে
ঘুম ভাঙা থেকে রাতে শুতে যাওয়া
অবধি জৈব রসায়ন আমাদের আষ্টেপৃষ্টে
জড়িয়ে রেখেছে এই কথা ভেবে ।
চায়ের মধ্যে ফ্ল্যাবোনয়েডস,
তারপর
প্রাতরাশের ফ্রুট প্ল্যাটার
ভর্তি রঙীন সব এন্টি কার্সিনোজেনিক
বিটা ক্যারোটিন !
পরণের
সূতির কাপড়...
সে
ন্যাচারাল পলিমার ফাইবার,
আবার
সিন্থেটিক শাড়ি বা ড্রেস
মেটিরিয়াল সে সিন্থেটিক পলিমার
। এইভাবে অর্গ্যানিক কেমিষ্ট্রি
তখন আমার শয়নে,
স্বপনে,
জাগরণে
। সিনথেটিক অর্গ্যানিক
কেমিষ্ট্রি আমাকে আবিষ্ট করে
রাখত সে সময় । এন্টিবায়োটিক্স
পড়াতেন প্রোফেসর কে এম বিশ্বাস
। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
স্নাতক ছিলেন । ডাঃ শিবদাস
রায় পড়াতেন হেটেরোসাইক্লিক
কম্পাউন্ডস । ডাঃ প্রিয়লাল
মজুমদার পড়াতেন নিউক্লিয়ার
ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স আর
এরোমেটিক কম্পাউন্ডস । প্রতিটি
ক্লাস ছিল ভীষণ উপভোগ্য ।
স্যারের সাথে আমার খুব দোস্তি
হয়েছিল । বাবা চাকরী করতেন
ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে
। বাবাদের নতুন প্রোডাক্ট
লঞ্চ হলেই সেই ওষুধের লিটারেচার
নিয়ে স্যারের সাথে আলোচনায়
বসতাম । স্যার শিখিয়েছিলেন
ডক্টর কোনো ওষুধ প্রেসক্রাইব
করলেই ওষুধের কম্পোজিশান পড়ে
নিতে । সেই ট্র্যাডিশন এখনো
চলছে আমার বাড়িতে । কাশির ওষুধ
সেই যে বাড়িতে ব্যান করেছিলাম
আজো তেমনি আছে । এফিড্রিন
দেওয়া কাফ সিরাপ যে কত ক্ষতিকারক
স্যার বোঝাতেন । এছাড়াও হলুদের
কারকিউমিনের কত গুণ বা খয়েরের
ক্যাটেচিন যে কতখানি ক্ষতিকারক
সেগুলো জেনেছিলাম । সালফার
ড্রাগে আমার চিরকাল এলার্জি
। এন্টিবায়োটিক সালফার ফ্রি
কিনা ডক্টর প্রেসক্রাইব করলে
এখনো নেট ঘেঁটে দেখে নি ।
এভাবেই চলছিল আমার জৈব রাসায়নিক
দোস্তি ।
সায়েন্স
কলেজের শেষবছর অর্থাত ১৯৮৬
সালে আমরা চুটিয়ে দিল খেলেছিলাম
সকলে মিলে । তখন বসন্তে
প্রাপ্তবয়স্ক হবার পাসপোর্ট
যেন পাওয়া হয়েই যেত সরস্বতী
পুজোতে । তারপরেই দোল । অতএব
সেই পাসপোর্ট হাতে পেয়েই
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসা পেয়ে
গেছি । তাই সব কিছুতেই মায়ের
সায় । দোলের আগের দিন ক্লাস
শেষ হবার পর কলেজের মাঠে
ছেলেমেয়ে একত্র হলাম । সাথে
নানা রংয়ের আবীর এনে প্রথমে
স্যারেদের ঘরে ঘরে ঢুকে পায়ে
দিয়ে প্রণাম করে আসা হল ।
সেবার প্রচুর ফাগ খেলা হল
একপাল ছেলে মেয়েতে মিলে । সেই
প্রথম ছেলে বন্ধুদের সাথে
দোল খেলে লালটুকটুকে হয়ে
লজ্জায় সবুজ হয়ে মিনিবাসে
বাড়ি ফেরা । তবুও আনন্দ আকাশে
বাতাসে । কারণ মম যৌবন নিকুঞ্জে
তখন পাখিডাকার শুরু হয়ে গেছে
। মা বরং খুশিই হলেন । এই তো
জগতের নিয়ম । প্রকৃতির গাছে
পাতা ঝরে নতুন পাতা আসবে ।
আমগাছে মুকুল আসবে । বাদাম
গাছের পাতা ঝরে গিয়ে লাল ফুল
সর্বস্ব গাছ হবে এই তো বসন্তের
নিয়ম !
মায়ের
একরত্তি মেয়েটা কেমন বড়ো হয়ে
গেল!
কিন্তু
পুরোটাই খুব সুন্দর ভাবে ।
শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না
করে । বছর দুয়েক আগে দোলের
আগের দিন কোলকাতার এক নামী
কলেজের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম
। দেখলাম ছেলেগুলি মেয়েদের
সিঁথিতে সিঁদুরে আবীর ঢেলে
দিচ্ছে নিপুণ ভাবে তারপর সেই
লাল টুকটুকে সিঁথিতে মেয়েটি
ছেলেটিকে জাপটে ধরে মোটরসাইকেলে
করে এক নিঃশ্বাসে অন্তর্হিত
হল সেখান থেকে ।
এখন
ফাগুনের ফুল ঝরতে না ঝরতেই
চকোলেট-ডে,
প্রোপোজ
ডে,
হাগ-ডে,
কিসিং-ডে,
ভ্যালেন্টাইনস-ডে
পেরিয়ে দোল দে । দোলের আবীরগুঁড়ো
অহোরাত্র উড়তেই থাকে ফেসবুক
জানলায়,
দেওয়ালে,
বারান্দায়
। দোলের রঙের গড়িয়ে পড়তে লাগল
অর্কুট অলিন্দ দিয়ে । সেই রঙ
গিয়ে পড়ল ফেসবুক উঠোনে ।
এখন
দোলের রঙের ওপরেও টেকশো !
রূপ
সচেতন বঙ্গতনয়ারা স্কিনফ্রেন্ডলি
রং চায় !
ইকোফ্রেন্ডলি
আবীর,
ভেষজ
গুলালে ফ্যাশন ইন !
তাই
ডিজিটাল দোল খেলো বাবা!
নো
হ্যাপা !
আমার
যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভিজাব
না,
রং
খেলবোনা !
ভাগ্যি
সোশ্যালনেটওয়ার্ক ছিল প্রেমের
সাথে !
দোলখেলার
বৃত্তটা কিন্তু ছড়িয়েছে আগের
থেকে । দোলখেলার প্রেম বেঁচে
বরতে থাকে দিনের পর দিন রাতের
পর রাত । এখন দোলখেলার বাতাস
সোশ্যালনেটওয়ার্ক ময়তায় ।
ফেসবুক উজাড় করে ঘন্টার পর
ঘন্টা দোলখেলা পেরয় ডিঙিনৌকো
করে । ডিজিটাল ঢেউ পেরিয়ে
ট্যুইটারের চিলেকোঠাতেও মুখ
লুকোয় সেই দোলখেলা । দোলের
রং ঝরছে সর্বত্র । ফাগ উড়ছে
অনাবিল আনন্দে ।
পড়াশোনোর
চাপে আমাদের দোল ছিল প্রকৃত
দোলের মতন । অন্যরকমের মাদকতা
আর একটা বিশেষ ছুটির দিনে
দোলকে দোলের মত করে পাওয়া ।
তখন
না ছিল ইন্টারনেট না মোবাইল
ফোন অথবা হাজারো কেবল চ্যানেল
। অগত্যা দূরদর্শনের দোলের
বৈঠকি !
তবে
মায়ের হাতে স্পেশ্যাল রান্না
ছিল সেদিনের মুখ্য আকর্ষণ ।
বেথুন
কলেজে যেমন দুই মহিলা চন্দ্রমুখী
দেবী এবং কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর
প্রথম স্নাতক হওয়ার শতবর্ষে
আমি ছিলাম ঠিক তেমনি সায়েন্স
কলেজে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র
রায়ের রসায়ন বিভাগ প্রতিষ্ঠার
শতবর্ষ উদযাপনের সামিল হবার
সৌভাগ্য হয়েছিল আমার । ১৮৮৬
সাল থেকে ১৯৮৬ এই একশো বছরে
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কত
নাম করা মানুষেরা কেমিষ্ট্রি
পড়েছিলেন আর এহেন আমিও সেই
ডিপার্টমেন্টের ১০০ বছরের
একরত্তি ছাত্রী !
একসপ্তাহ
ধরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ও
রাজাবাজারে সায়েন্স কলেজে
কত সেমিনার,
লেকচার,
সিম্পোশিয়াম
হয়েছিল তার ইয়ত্ত্বা নেই ।
আমি ছিলাম প্রথম দিনের
রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্ত্বে
। তারপর শেষদিনের খাওয়াদাওয়া
ও নাচাগানা । ল্যাবের মধ্যে
বিশাল বিশাল বাক্স প্যাকিং
। পাশেই হচ্ছে রান্নাবান্না
। লুচি,
মুর্গির
মাংস সব প্যাকিংয়ের দায়িত্ত্বে
আমরা । সবশেষে প্রত্যেকের
জন্য কেসিদাসের রসোমালাইয়ের
ছোট্ট হাঁড়ির ভার নিয়েছিলেন
কেসি দাসের বাড়ির মেয়ে মল্লিকার
ঠাকুমা । মল্লিকা আমার সহপাঠিনী
। আমি গিয়ে হাসিমুখে ঠাকুমাকে
একটি বিজ্ঞাপন দিতে অনুরোধ
করেছিলাম । ঐ বাড়ির অনেকেই
সায়েন্স কলেজের স্টুডেন্ট
ছিলেন তাই এই কলেজের ভালোমন্দে
ওনাদের একটু দুর্বলতা ছিল
।এই যজ্ঞির দুমাস আগে থেকে
সারা কলকাতা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন
কোম্পানির থেকে বিজ্ঞাপন
চেয়ে আনার দায়িত্ত্বও ছিল
আমি সহ একটি টিমের । কোথায়
পাস্তুর ল্যাব,
কোথায়
ক্যালকাটা কেমিক্যালস,
কোথায়
বেঙ্গল কেমিক্যালস,
হিন্দুস্তান
লিভার ,
রেকিট
এন্ড ক্যোলম্যান ও নামীদামী
ফার্মাসিউটিকালের অফিস থেকে
শুরু করে কলেজ স্ট্রীটে ছোট
বড় সব ল্যাব ইকুয়িপমেন্টসের
অফিসে পায়ে হেঁটে হেঁটে,
ট্রামে,
বাসে
দৌড়ে মরেছি আমরা পয়সার জন্যে
। তবে সায়েন্স কলেজের নাম শুনে
কেউ মুখের ওপর দরজা বন্ধ করেনি
সেটাই রক্ষে । আরো একটি কারণ
হল এই সব কোম্পানিগুলোতে তখন
সায়েন্স কলেজের পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট
স্টুডেন্টরা চাকরীতেও জয়েন
করতে যেত । তখন ছাত্রদের মধ্যে
বিদেশ যাওয়ার ঢল এতটা নামেনি
।
কত
বাদামী
বিকেল পেয়েছিলাম আমরা ।
জন্মদিনের সন্ধ্যে হত সেখানে
। পরীক্ষার ভালো ফলের পার্টি
হত অথবা কারোর সফল কোর্টশিপ
। সেদিনের কফির পেয়ালার বিকেল
আজো রয়ে গেছে...
একমুঠো
রোদ ভর্তি সকাল গড়িয়ে নোট তৈরী
হতে হতে বিকেলের চৌকাঠে পা
দেওয়া ।
শিল্পীর
ক্যানভাসেও ছিল সেই রঙ !
মেহগিনি
টেবিলের ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
পড়ত সেই রং । কবিতার খোলাখাতায়
টুপটাপ ঝরে পড়ত সাবলীল শব্দকণা
সেই মেহগিনি টেবিলে । যার
ওপরে ধূমায়িত কফিবিন্সের
গুঁড়ো গুঁড়ো গন্ধ হাওয়া ভেসে
বেড়াত অনবরত ।
আমার
একভুবন আকাশ জুড়ে তখন রাজাবাজার
সায়েন্স কলেজ আর কফিহাউসের
আড্ডা ।
পেরেছ
চিনতে বিকেল আমার?
একরাত
স্বপ্ন নিয়ে,
একসন্ধ্যে
নেশা নিয়ে,
একভর্তি
হুল্লোড় নিয়ে
চেয়েছিলাম
তোমায়,
পেয়েওছিলাম
তোমায়
রঙতুলির
টানে সজীব হয়েছিল একরাশ
চিন্তা-দৃশ্যপট
!
আর
সেই টেবিল !
সেই
রাশিরাশি আড্ডা,
তুফানি
তর্কের মুঠো মুঠো সংলাপ,
যুক্তির
খেল!
সেই
সাদা নীলছোপ ধরা টেবিলক্লথ
!
কত
কাপ কফির উষ্ণতা !
কত
ত্রিকিণমিতি,
হাতে
হাত ছুঁয়ে যাওয়া স্মৃতির
পরিমিতি,
উপপাদ্যের
ছেঁড়া পাতা,
চিকেন
কাটলেটের গন্ধ !
মনে
পড়েছে তোমার ?
সেই
পড়ন্ত বিকেলের ফুটপাথের
বইপাড়া,
সেই
আমাদের চলার সাক্ষী সব পুরোণো-নতুন
বইয়েরা !
সেই
রঙচটা,
তার
ছিঁড়ে দাঁড়িয়ে পড়া ট্রামেদের
সারি।
কফির
বাদামী গন্ধ কেড়ে নিয়েছিলে
আমার থেকে,
নিয়ে
গেছিলে সব রঙ তুমি ।
তবুও
বেঁচে রয়ে গেলে সেই পুরোণো
রঙচটা
ছাল ওঠা খোলসের শহরে..
সেই
শ্রাবণের তুমি,
ধরেছিলে
বৃষ্টির রঙিন ছাতা,
কলেজবেঞ্চে
থকে যাওয়া শীতের দুপুরে
দিয়েছিলে
এককাপ
ভর্তি অতিচেনা উষ্ণতা,
গ্রীষ্মের
ল্যাব-পালানো
চুপকথার গোপন দুপুর,
আরো
কত কি!
আমি
আজও শুনতে পাই
সেই
ভেঙে যাওয়া আড্ডা-বিকেলগুলোর
কলকল শব্দ,
সেই
ক্লান্ত একব্যাগ দুপুরের বয়ে
চলার ফিসফিস
আর
সেই টেবিলের চাদরের একটুকু
ছোঁয়া লাগা কফির ধোঁয়ার ওম
সেই
উর্দিপরা আমাদের আবদারের
ক্লান্ত মানুষগুলো,
মাথার
ওপরে পুরোনো গন্ধের পাখাদের
বনবন শব্দকণারা
ঝরে
পড়েছিল আমাদের কথাবৃষ্টির
বর্ণমালার সাথে
মিশে
গেছিল দুকূল ছাপানো কফির
বাদামী গন্ধ নিয়ে..
আমি
তখন ঊনিশ কুড়ির সাঁঝবেলা
তোমার
আকাশ আমার আকাশকে
চিনিয়েছিল
সেই বাদামী গন্ধ
আমি
দাঁড়িয়ে রইলাম সেই গন্ধ নিয়ে
সেই
ওম নিয়ে,
সেই
রঙ নিয়ে
২ সেপ, ২০১৩
বেথুন জার্ণাল- পর্ব ৩
কলেজগেটের পাশে রোজ সকাল দশটা থেকে বিকেল সাতটা অবধি দাঁড়িয়ে থাকত মতিদা ।
এ পাড়ার বিখ্যাত ফুচকাওয়ালা । তার ফুচকা যেমন বড়বড়, গোল্লা গোল্লা, ও মুচমুচে আর তেমনি সুস্বাদু তার যাবতীয় অনুপান। একদম ঠিকঠাক টক, ঝাল ও নুনের কম্বিনেশন । আমাদের অনেক গবেষণা হত সেই তেঁতুল জলের রসায়ন নিয়ে । বাড়িতে অনেক বকুনিও খেতাম রোজ রোজ ফুচকাখাওয়া নিয়ে । কিন্তু এক মতিদা মানুষটা আর দুই তার ফুচকার টানকে কিছুতেই এড়াতে পারতাম না । মতিদার ছিল একটাই শ্লোগান "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো মতিদাকা গুণ গাইও " "আমার ফুচকায় অসুখ করবে না । কলেজের ফিল্টারের জলে তৈরী এই তেঁতুলজল" । আমার দিদি তখন পড়ত অন্য কলেজে ।
দিদিকে বলতাম " একদিন তোকে মতিদার ফুচকা খাওয়াব " তা সে আর হয়ে উঠত না । সেবার পয়লাবোশেখের ঠিক আগে মা নতুন জামাকাপড় কেনার টাকা দিলেন । আমরা দু'বোনে হাতিবাগান থেকে জামাকাপড় কিনে একটা চায়ের দোকানে এসে চা-জলখাবারের অর্ডার দিয়ে দেখি পার্সের সব টাকা শেষ। মাত্র একটা কয়েন পড়ে আছে । এদিকে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে আর বাড়িও ফিরতে হবে । হাঁটা লাগালাম কলেজের দিকে| বাসে উঠব সে পয়সাও নেই কাছে । হাঁটতে হাঁটতে দুজনে পৌঁছলাম কলেজ অবধি । সেখানে মতিদা তখনো দাঁড়িয়ে । দিদিকে দেখামাত্রই মতিদা যথারীতি তার স্লোগান আওড়ালো "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো মতিদাকা গুণ গাইও "
"আমার ফুচকায় অসুখ করবে না । কলেজের ফিল্টারের জলে তৈরী এই তেঁতুলজল"
দিদিকে কথা দিয়েছিলাম একদিন ফুচকা খাওয়াব । মতিদা শালপাতা ভাঁজ করে এগিয়ে দিল আমাদের সামনে ।
আমি বললাম " না, মানে একটা কথা ছিল মতিদা ,"
মতিদা বলল " খাও খাও , কিচ্ছু হবে না "
আমি বললাম " না না সে কথা নয় "
মতিদা বলল "মা বকবে ?” আমি বললাম " না না পয়সা ফুরিয়ে গেছে যে "
মতিদা বলল "কাল দিও, আগে তো খাও "
আমি বললাম " বাড়িফেরার পয়সাও নেই "
মতিদা বলল " আমি দিচ্ছি, কাল দিও "
আমরা পেট পুরে ফুচকা খেলাম । এত ভাল বোধ হয় আগেও লাগেনি কখনো । আরো যেন বড়বড়, গোল্লাগোল্লা, মুচমুচে ফুচকা ! আরো পার্ফেক্ট টক-ঝাল-নুনের কম্বিনেশন !
দু'জনের বাসের ভাড়াও চেয়ে নিলাম মতিদার কাছ থেকে ।
আমরা তখন বেথুন কলেজ, আমি তখন শাড়ি
কেমিষ্ট্রিল্যাব, লেকচার হল, আর মিনিবাসে বাড়ি ।।
কেমন যেন দিনগুলো সব হঠাত ফুরিয়ে এল
হেদোর ধারে ফুচকা-আচার সায়েন্স কলেজ গেল !!!
এ পাড়ার বিখ্যাত ফুচকাওয়ালা । তার ফুচকা যেমন বড়বড়, গোল্লা গোল্লা, ও মুচমুচে আর তেমনি সুস্বাদু তার যাবতীয় অনুপান। একদম ঠিকঠাক টক, ঝাল ও নুনের কম্বিনেশন । আমাদের অনেক গবেষণা হত সেই তেঁতুল জলের রসায়ন নিয়ে । বাড়িতে অনেক বকুনিও খেতাম রোজ রোজ ফুচকাখাওয়া নিয়ে । কিন্তু এক মতিদা মানুষটা আর দুই তার ফুচকার টানকে কিছুতেই এড়াতে পারতাম না । মতিদার ছিল একটাই শ্লোগান "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো মতিদাকা গুণ গাইও " "আমার ফুচকায় অসুখ করবে না । কলেজের ফিল্টারের জলে তৈরী এই তেঁতুলজল" । আমার দিদি তখন পড়ত অন্য কলেজে ।
দিদিকে বলতাম " একদিন তোকে মতিদার ফুচকা খাওয়াব " তা সে আর হয়ে উঠত না । সেবার পয়লাবোশেখের ঠিক আগে মা নতুন জামাকাপড় কেনার টাকা দিলেন । আমরা দু'বোনে হাতিবাগান থেকে জামাকাপড় কিনে একটা চায়ের দোকানে এসে চা-জলখাবারের অর্ডার দিয়ে দেখি পার্সের সব টাকা শেষ। মাত্র একটা কয়েন পড়ে আছে । এদিকে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে আর বাড়িও ফিরতে হবে । হাঁটা লাগালাম কলেজের দিকে| বাসে উঠব সে পয়সাও নেই কাছে । হাঁটতে হাঁটতে দুজনে পৌঁছলাম কলেজ অবধি । সেখানে মতিদা তখনো দাঁড়িয়ে । দিদিকে দেখামাত্রই মতিদা যথারীতি তার স্লোগান আওড়ালো "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো মতিদাকা গুণ গাইও "
"আমার ফুচকায় অসুখ করবে না । কলেজের ফিল্টারের জলে তৈরী এই তেঁতুলজল"
দিদিকে কথা দিয়েছিলাম একদিন ফুচকা খাওয়াব । মতিদা শালপাতা ভাঁজ করে এগিয়ে দিল আমাদের সামনে ।
আমি বললাম " না, মানে একটা কথা ছিল মতিদা ,"
মতিদা বলল " খাও খাও , কিচ্ছু হবে না "
আমি বললাম " না না সে কথা নয় "
মতিদা বলল "মা বকবে ?” আমি বললাম " না না পয়সা ফুরিয়ে গেছে যে "
মতিদা বলল "কাল দিও, আগে তো খাও "
আমি বললাম " বাড়িফেরার পয়সাও নেই "
মতিদা বলল " আমি দিচ্ছি, কাল দিও "
আমরা পেট পুরে ফুচকা খেলাম । এত ভাল বোধ হয় আগেও লাগেনি কখনো । আরো যেন বড়বড়, গোল্লাগোল্লা, মুচমুচে ফুচকা ! আরো পার্ফেক্ট টক-ঝাল-নুনের কম্বিনেশন !
দু'জনের বাসের ভাড়াও চেয়ে নিলাম মতিদার কাছ থেকে ।
আমরা তখন বেথুন কলেজ, আমি তখন শাড়ি
কেমিষ্ট্রিল্যাব, লেকচার হল, আর মিনিবাসে বাড়ি ।।
কেমন যেন দিনগুলো সব হঠাত ফুরিয়ে এল
হেদোর ধারে ফুচকা-আচার সায়েন্স কলেজ গেল !!!
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)