১৭ জুন, ২০১০

ভুবনমোহিনী ভুটান ভ্রমণ ২

 আজ ১৩ইজুন । গতকাল রাতে ওয়াংডির ড্রাগন নেষ্ট হোটেলে ইন্টারনেট কানেক্সান পেয়ে আমরা   তিন জনেই যারপরনাই খুশী হলাম। রাতে ইন্ডিয়ান ফুড খেলাম,  গরম গরম  চাপাটির সাথে পনীর বাটার মশালা । সবশেষে ফ্রুট প্ল্যাটারে আম দেখে আমরা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লাম । ডিনার খেয়ে ঘরে ফিরে ফিফার উন্মাদনা । সকাল হতেই স্নান খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়া । আজ গেলাম ওয়াংডির বাজারে ।বাজারে শুঁটকি মাছ বিক্রি হচ্ছে তার গন্ধে টেঁকা দায় ।   সেখান থেকে ভুটানের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফোর্ট্রেস দেখতে। রবিবার বলে মন্দির বন্ধ ছিল কিন্তু খুব প্রাচীন এই জ্ং টি পরিদর্শন করে ভাল লাগল । আজ বেশ গরম ছিল । আর বিরাট সেই নদী পুনাটাং চু পাশে বলেই খুব হিউমিড ওয়েদার পেলাম এই স্থানটির  । পাহাড় পরিবেষ্টিত নদীর ধার মনে করিয়ে দিল ১৯৮৯ এ জার্মানির রাইন নদীর কথা । তবে রাইনের ধারে প্রচুর গ্রেপ ভিনিয়ার্ডস দেখেছিলাম । এখানে  কোনো ফ্রুট অর্চার্ড দেখলাম না  । সিনিক বিউটি জার্মানির তুলনায় কোনো অংশে কম নয় সেখানে জার্মান আল্পস আর এখানে ইস্টার্ন হিমালয়ান মাউন্টেন রেঞ্জ ।  সেবার রাইনক্রুজ নিয়েছিলাম । কিন্তু এখানে কোনো রিভার ক্রুজের ব্যবস্থা নেই দেখে বিস্মিত হলাম । নদীর ধারে তৈরী হচ্ছে ওয়াংডিফোদরং শহরের নিউটাউনশিপ । নদীর ওপর তৈরী হচ্ছে হাইডেল পাওয়ার স্টেশন ।  চাষ-আবাদ, টুরিজম, পাওয়ার স্টেশনে কাজ, গাড়িচালানো এই সব করেই জীবিকা নির্বাহ হয় এদেশের মানুষের । হোটেলে ফেরার পথে এক জায়গায় দুটি নদীর সঙ্গম স্থলে এক অভিনব রঙয়ের খেলা দেখলাম পো চু আর মো চু এই দুই নদীর রঙ দু রকম ; একটি  জল নীলাভ, ক্রিস্টাল ক্লিয়ার আর একটির রঙ ঘোলা । একটা নিদ্দির্ষ্ট পয়েন্টে দুজনের রঙকে পরিষ্কার তফাত করা যায় । খুব সুন্দর ছবি নিল পৃথ্বীশ । 


বাতাসীয়া ওয়াংডুফোদরং শহরে মাঝরাতে হয় বৃষ্টি আর ভোরে মিষ্টি রোদ ওঠে। এবার মজা হল, বেলা বাড়ার সাথে সাথে শুরু হয় হাওয়ার নাচন । মেতে ওঠে ওয়াংডি শহরতলী  সেই হাওয়ায় । আর সেই সাথে মেতে ওঠে শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি !  হাওয়া লাগে নদীর জলে, জ্যৈষ্ঠমাসে ফাগুন হাওয়ায়  আমরা বিকেলে  হাঁটতে গেলাম পাহাড়ের ধারে। ধুলো-বালি চোখে মুখে মেখে হোটেলে ফিরলাম সন্ধ্যের আগেই । মধ্যরাতে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখি হাওয়ার নাচন কোঁদন  সব শেষ ।

  পরদিন ১৪ইজুন  সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়েই বেরিয়ে পড়ার তাড়া কারণ ওয়াংডি থেকে সেদিন আমাদের যাত্রা ভুটানের অন্যতম শহর পারোর দিকে । সাড়ে তিনঘন্টার পথ  । যাত্রাপথের শুরুটা আমাদের চেনা কারণ ঐ পথেই আমরা এসেছিলাম পুনাখা থেকে ওয়াংডির দিকে । তার পরেই অচেনা রাস্তা শুরু হল থিম্পুর দিকে যেতে গিয়ে। পাহাড়ের এক এক রকম রং লক্ষ্য করলাম । কাছের পাহাড় গুলো হালকা সবুজ আর দূরের গুলো ঘন সবুজ কার্পেটে যেন মোড়া। এই জায়গাটায় কোনো বড় সাইপ্রাস গাছগুলো চোখে পড়ল না । উঁচু পাহাড়ের মাথায় মেঘের দলেরা যথারীতি আমাদের সাথে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল ।  পথে পড়ল সিমটোকা জ্ং । দূর থেকে প্রণাম করলাম ।থিম্ফু শহরকে পাশ কাটিয়ে কিছুটা পথ গেলাম ওয়াংচু নদীর উপত্যকা দিয়ে , ধানের ক্ষেতে, রোদের ছাওয়ায় । ভ্যালির দুপাশে শুধু সবুজ  ধান ক্ষেত , ভুট্টার ক্ষেত আর বাক-হুইট এর ক্ষেতের পাশ দিয়ে । রেড রাইসের সাথে এই বিশেষ গমটিও এদেশের মানুষের  স্টেপল ফুড, জানলাম ড্রাইভার বন্ধুর কাছ থেকে । ছোটবেলায় ভূগোল ব‌ইতে পড়েছিলাম ধান-গম চাষের উপযুক্ত জমি হল নদীর ধার  মিলে গেল । এর পরেই এল পারো চু নদী কেউ বলে পা চু । বুঝলাম পারো শহরের খুব কাছেই আমরা । 
 বিশাল নদী তবে বর্ষার জল পেলে ফুলে ফেঁপে উঠবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না । খরস্রোতা পারো নদী বয়ে চলেছে সমতলে দূরে পাহাড়ের কোলআলো করা দিগন্তরেখা । নদীর নীলচে সবুজ জল, পাহাড়ের ঘন সবুজ আর আকাশের নীলে মিলেমিশে একাকার পারোর প্রকৃতি। পথে পড়ল সাবা আর্মি ক্যাম্প। তার পরেই রাহুল চেঁচিয়ে উঠল দুটি সমান্তরাল পাহাড়ের মাঝখানে দ্রুক এয়ারের উড়োজাহাজ কে ভাসতে দেখে । কাছ থেকে এত সুন্দর আকাশ-পাহাড়-মাটীর বুকে এরোপ্লেনের গতিময়তায় থমকে গেলাম আমরা । পাহাড়ের গা দিয়ে নামছিল সে  | দমদম-বারাসতের পথে দেখেছি এ দৃশ্য বহুবার কিন্তু সেখানে পাহাড় ক‌ই? 

এর পরেই পৌঁছে গেলাম আমাদের ট্যান্ডিলিং রেসর্টে । একরাশ বাহারী মরশুমি ফুলের মধ্যে কটেজ আমাদের । এ দেশে ফুলেদের যত্ন করতে । শুধু বীজ বা চারা লাগিয়ে দিলেই হল; আপন খেয়ালে ফুলেরা ফুটে এলিয়ে দেয় নিজেদেরকে পারোর পার্বত্য উপত্যকায় । ওয়াংডি গ্রামে হাওয়ার সাথে কথা হয়েছে, হাওয়ার সাথে পথ চলেছি, হাওয়ার সাথে  ভেসে এসেছি । পারোয় খেলছি ফুলেদের সাথে, কথা বলছি, হাসছি , আর মাখছি গায়ে ফুলের রেণু।
১৫ই জুনের ভোরে উঠে দেখি ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে । এদিকে আমাদের যাওয়ার কথা টাক্সং পাহাড়ে । ঘোড়ায় করে কিম্বা পায়ে হেঁটে পাহাড়ের মাথায় বহু পুরোণো এক মন্দির দেখতে ।  মনটা খারাপ হলেও আকাশের গায়ে পূবের সূয্যির আলো একটু একটু করে ফুটতে দেখে তাড়াতাড়ি  টোষ্ট-অমলেট-চা খেয়ে সাড়ে সাতটার সময়   রওনা দিলাম আমরা তিনজনে টাক্সং পাহাড়ের উদ্দেশ্যে  । পারো নদীর ব্রিজ পেরিয়ে রোদ ঝলমলে নীল আকাশ সঙ্গে নিয়ে পৌঁছালাম পাহাড়ের নীচে গাড়ী করে ।  প্রচুর টুরিস্টের আগমনে ঘোড়া পাওয়া গেলনা  । অগত্যা পা'যুগলই ভরসা আমাদের । লাঠি সাথে নিলাম। আপেল অর্চার্ড পেরিয়ে পাগলা ঝোরাদের কলকল হাসি আর অজানা পাখিদের কূজনকে সঙ্গে নিয়ে খাড়াই পাহাড়ে চড়া শুরু হল । এক ধারে পাহাড় অন্যধারে সাইপ্রাসের ঘন জঙ্গল , নীচে তাকানো যায়না এত গভীর।  কিছুটা ওঠার পরেই শ্বাস কষ্ট শুরু হল আমার । তবুও আমি হাল ছাড়ার পাত্রী নই ।


তাপমাত্রাও কমতে লেগেছে ইতিমধ্যে । কিন্তু  রোদের তাপ বাড়তে শুরু করায় গায়ে গরম জামাকাপড় খুলতে শুরু করলাম আমরা । হঠাত চোখে পড়ল ঘন অরণ্য আলো করে দূর থেকে হাতছনি দিচ্ছে আমার অতিপ্রিয় রডোডেনড্রণ পুষ্প গুচ্ছ।  কোথাও টুকটুকে লাল কোথাও গাঢ় গোলাপী, কোথাও হালকা বেবি পিঙ্ক কোথাও বা হলুদ রঙের । শুনেছি ১৩ রকমের ভ্যারাইটি আছে এই ফুলের । বসন্তে আসিনি তাই ভেবেছিলাম এর দেখা পাবনা । 

 রডোডেনড্রণের  অপ্রত্যাশিত দর্শনে  আপ্লুত হয়ে আমি উঠতে শুরু করলাম অবলীলাক্রমে। প্রায় ৩কিলোমিটার চড়াই অতিক্রম করে পৌঁছালাম পাহাড়ের মাথায় ভিউ পয়েন্টে সেখানে টাক্সং কাফেতে কফি খেয়ে বিশ্রাম নিলাম । তার চেয়ে আর ও ওপরে মন্দিরে চড়ার মত অবস্থা ছিলনা আমার যদিও রাহুল আর পৃথ্বীশ খুব উতসাহী ছিল কিন্তু আমার জন্য বেচারীদেরও যাওয়া হল না ।  তখন সময় সাড়ে দশটা । এবার নীচে নামার পালা । তখন আর শ্বাস কষ্ট নয়, পায়ের পেশীতে টান পড়ছিল । যাক প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে উতরাই পথে নেমে এলাম নীচে।  গাড়িতে ফিরে এসে আবার হোটেল । গরম ভাত-মুসুরডাল-ফ্রেঞ্চফ্রাই সহযোগে লাঞ্চ সেরে সোজা এসে শয্যা নিলাম আমি ।   

 ১৬ই জুন একটু দেরী করে ঘুম ভাঙল । আগের দিনের হাইকিংয়ের ফলে শরীরের ট্রমা ভাব ঘুমিয়ে কেটে গেছে তাই রক্ষে । অবশ্য আমি বেশী হাঁটাহাঁটি হলেই প্যারাসিটামল খেয়েনি  সেফ গার্ড হিসেবে যাতে পরের দিন ব্যথা না বাড়ে। আজ কোনো তাড়া নেই । স্নান-প্রাতরাশ সেরে নটায় বেরিয়ে পড়লাম । প্রথমেই পারো নদীর ব্রিজের ওপর গিয়ে শান্ত-স্নিগ্ধ নদীটির  ছবি নিলাম কারণ আগের দিন মেঘ ছিল আকাশে । নদীর জলে মেঘের ছায়া পড়লে নদীর ছবি ভাল হয়না  । আজ পারোয় আমাদের শেষ দিন ও রাত তাই বুঝি পারো সুন্দরী মেঘমালাদের মানা করে দিয়েছিল তার ত্রিসীমানায় আসতে। নদীতীরকে শেষবারের মত দেখে নিয়ে গেলাম কিচু মন্দিরে । সপ্তদশ শতাব্দীর এই মন্দিরটি ইন্ডিয়ান সাধু পদ্মসম্ভবের (যিনি ভুটানের গুরু রিংপোচি নামে খ্যাত)   স্মারক হিসেবে  নির্মিত। মন্দিরটি অতি প্রাচীন, তা দেখলেই বোঝা যায় | মন্দির চত্বরে কমলালেবু গাছে ভর্তি লেবু ধরে আছে ।  মন্দিরের ভিতরে গুরুর প্রায় ৩০ফুট লম্বা ধাতব মূর্তি । মন্দিরের বাগানে বহু পুরোণো ফলন্ত একটি ওক গাছ এবং প্রচুর আপেল গাছ । সব মিলিয়ে মন্দিরটির অন্দরে ও বাইরে কিছু মাহাত্ম্য অনুভব করলাম । এরপর গেলাম পারোনদীর অপর পারে অবস্থিত তা জ্ং পরিদর্শন করতে ; তা জংটি একটি অতি প্রাচীন  এবং অভূতপূর্ব একটি ফোর্ট্রেস যেটি একটি চোঙাকৃতি আটতলা কাঠ ও পাথর দিয়ে তৈরী বাড়ি । ১৭১৪ সালে ভুটানের ১৫দিন ব্যাপী ভয়ংকর ভূমিকম্পেও তার গায়ে আঁচ পড়েনি  । এই তা জ্ংটি বর্তমানে  ন্যাশানাল মিউজিয়াম অফ ভুটান  হিসেবে  ব্যবহৃত হচ্ছে । 
 এখানে ভুটানের ঐতিহ্য থেকে শুরু করে  বুদ্ধের অসাধারণ সব মূর্তি , মহাকালীর মূর্তি,  যমরাজের বিশালাকার একটি মুখোশ, প্রাচীনতংখা, ফ্রেস্কো, বাসন পত্র, পূজার সামগ্রী, ভুটানের পুরুষের পোশাক "ঘো" আর মহিলাদের পোশাক " কিরা", রূপোর অলঙ্কার সুন্দর ভাবে রক্ষিত । গোলকধাঁধার মত এই  মিউজিয়াম । ঘুরতে খুব ভাল লাগল ।  জ্ংএর ৬তলায় রাখা রয়েছে  চারটি ধর্মীয় ধারার গুরুদের মূর্তি ; একটি স্থাপত্যকীর্তির মাধ্যমে  সেটিকে দেখানো হয়েছে, যেটিকে বলে  Tshogzing  ।    মিউজিয়ামের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ।  মিউজিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচ্ছন্নতা প্রশংসার দাবী রাখে।
মিউজিয়াম দেখে মন ভরে গেল আমাদের । সেখান থেকে আমরা গেলাম পারো জং পরিদর্শন করতে। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার বন্ধুটি হঠাত খেয়াল করল পাহাড়ের নীচে সমতলে আর্চারী ট্যুর্নামেন্ট হচ্ছে। ধনুর্বিদ্যা এখানকার জাতীয় স্পোর্টস । রাহুল আর সেখান থেকে নড়তে চাইল না । অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে সেখানেই যাওয়া হবে স্থির হল ।  বিরাট একটা ইভেন্ট হচ্ছে। এদেশের কলির কর্ণ-অর্জুনেরা হাইটেক ধনুক নিয়ে তীর  ছুঁড়ে লক্ষ্যভেদ করছে । এই ধনুক অর্জুনের গান্ডীব নয় বা রামের হরধনু নয়, সফিস্টিকেটেড ধনুক যাতে আমাদের দেশের দোলা ব্যানার্জিও সাবলীল  । একজন ধনুর্ধর লক্ষ্যভেদে সফল হলে সমগ্র টিম তাকে অভিবাদন জানাল জংখায় গান ধরে আর সাথে আমাদের মাদলের মত সম্মিলিতভাবে তালে তালে নেচে   । আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা হল। 

 সেখানে এক স্থানীয় মহিলার কাছ থেকে গার্ডেন ফ্রেস পিচ ফল কিনলাম । মহিলার ছবি নিলাম । সে বেজায় খুশি হয়ে আমাকে আরো ক'টি পিচ ফল উপহার দিল । এবার পারোর বাজারের দিকে গেলাম। মা অনেকদিন ধরে আম কেনবার জন্য ব্যস্ত হয়েছিলেন । তাই বাজারে ঢুকে প্রথমে বেজায় দামে ল্যাংড়া আম কেনা হল । তারপরে বেকারী শপে এসে কেক কেনা হল । টুকটাক কেনাকাটির পরে আমরা গেলাম একটি হ্যান্ডিক্রাফ্ট শপে । সেখানে ইয়াকের হাড় দিয়ে তৈরী একটি বুদ্ধ মূর্তি কিনে ফেললাম। এবার লাঞ্চ খাবার পালা । খুব সুন্দর রেস্তোঁরায় স্যুপ, চাউমিন আর চিলি চিকেন দিয়ে লাঞ্চ সেরে হোটেলে ফেরা হল । এবার বিশ্রাম নিয়ে গুছোনোর পালা ; পরদিন ভোরেই রওনা হলাম ফুন্টশোলিংয়ের পথে, দেশের দিকে, আমাদের জার্নির শেস ধাপ ডুয়ার্সের পথে হাসিমারার কাছে চিলাপাতা রেসর্টে ।