২৮ ফেব, ২০২১

রেওয়া পত্রিকা, অভিজিৎ দত্ত গল্প পুরষ্কার ২০২০ "পাসপোর্ট"

 


 

পাসপোর্ট

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 

তদিন বাদে প্রণতি পিসি কে দেখে চমকে উঠেছিল রূপা। কি আশ্চর্য! মানুষটার বিয়েই হলনা কোনোদিন আর সে কি না বিধবার বেশে? দেখেই জিগেস করেছিল সে, কেন গো এমন সাদা শাড়ি পরে রয়েছ তুমি? আমার কিন্তু মোটেও ভালো লাগছে না তোমায় এমন দেখে।  

প্রণতি বলেছিলেন, বয়স তো ভালোই হল রে। তুই যখন বিদেশ চলে গেলি তখন তোর বয়স কত বল তো? 

কেন ? চার বছর। আর তোমার আঠেরো বছর বোধহয় । এই তো? দেখো দিব্যি মনে আছে আমার। তাই বলে বুড়োরা কেউ রঙ্গিন শাড়ি পরে না?  

প্রণতি বললেন, হ্যাঁ। আমি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিলাম সেবছরেই। 

রূপা বলল, আমায় কিন্তু চিঠে লিখে জানাওনি পাশের খবরটা। বাবা বলেছিল আমায়, দেখও আমার বোন লেটার নিয়ে পাশ করেছে । তখন তো কেমন রঙীন শাড়ি পরতে গো। এখন কেন এমনি পর? 

আরে চল্‌, চল্‌ দিকিনি। কত বছর পর এলি বলত? তোর দিকে চেয়ে দেখি, দাঁড়া তুই! চকচক করছে স্কিন একেবারে। সেদেশে জারাই থাকে তাদেরই এমন। 

তুমি থামবে? রূপা বলে 

হ্যাঁ রে, তোর বর কবে আসবে? 

আমি ঠিক একমাস থাকব পিসি । যাবার সাতদিন আগে তিনি আসবেন ছেলে কে নিয়ে। বাবার অফিস, ছেলের কলেজ । সেদেশে ছুটি অত সুলভ নয় পিসি। বুঝেছ? 

আচ্ছা, বেশ। নে, নে চল, চল এবার। জামা প্যান্ট ছাড়। কিছু মুখে দে। 

সত্যি কি গরম এখানে! 

রূপার কষ্ট দেখে প্রণতি বললেন, তবু তো শীতকালে এলি রে। এখন তো বেশ আরাম আমাদের। 

রূপা বলল, আচ্ছা মন্টু কাকা কোথায় ? দেখছি না যে। 

 

প্রণতি এড়িয়ে যান। তুই হাত মুখ ধুয়ে আয়। রাত হয়েছে। ডিনার খেতে খেতেই সব কথা হবে। তোরা ওখানে শুনেছি খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে নিস। 

হ্যাঁ, আর্লি ডিনার সেদেশে। বলে রূপা তার স্ট্রলি ব্যাগ টানতে টানতে বলে, এই ফ্ল্যাট টা কিন্তু বেশ ছোট যাই বল পিসি। আমাদের আগের বাড়িটা অনেক বড় ছিল। 

প্রণতি কিচেনের দিকে এগিয়ে যান। প্রশ্নগুলি কিছুটা এড়িয়ে। 

বাড়ির সঙ্গে কি ফ্ল্যাটের তুলনা চলে রে? বাড়ি হল বাড়ি আর ফ্ল্যাট হল ফ্ল্যাট। কোনও তুলনাই চলে না। 


রূপা যখন সেই ছোটবেলায় এ শহর ছেড়েছিল তখন তাদের সেই পুরনো বড় বাড়িটায় কত মানুষ একসঙ্গে, এক ছাদের নীচে বাস করতেন। রূপার ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, বাবা, মা, আরো এক পিসি আর মন্টুকাকা। বাবা সবার বড়। প্রণতি তারপরেই । সবচেয়ে সুন্দরী বাড়ির মধ্যে। মন্টু সকলের ছোট। মাঝে রূপার আরেক পিসি। রূপার বাবা পরিতোষ শিবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরী পেলেন কলকাতায়। তখন পাত্রী দেখে তাকে বিয়ে দেওয়া হল। বিদেশ থেকে আরো ভালো চাকরীর অফার এল। এর মধ্যে জন্মেছে রূপা। বছর চারেকের মেয়ে নিয়ে তারা বিদেশে সেটল করল।  দেশে থাকাকালীন প্রণতি পিসির সঙ্গেই ছিল রূপার যত দোস্তি, যত বায়না। বাবা, মায়ের সঙ্গে বিদেশে যাবার বেশ কিছুদিন পরে ছোট পিসি শম্পার  বিয়ে হল। রূপারা আসতে পারেনি বিয়েতে। শম্পা এম এ, বিএড করে ইস্কুলে পড়াতেন। তারপর পোষ্ট এন্ড টেলিগ্রাফে বেশ কিছুদিন চাকরি করার পর তার বিয়ে । রূপা এসব শুনেছে বাবার মুখে।  

প্রণতি টেবিল সাজালেন ভাইঝির জন্য। পিসির হাতে এতদিন পর গরম ভাত, আলুপোস্ত আর মাছের ঝোল খেয়ে তৃপ্তিতে সুখঢেকুর তুলতে তুলতে রূপা বলে, এবার তোমার জন্যে সেদেশ থেকে কি এনেছি দেখবে চল।  

প্রণতি বললেন, আমি কি ছাই বেরোই নাকি? রূপা তার ঢাউস ব্যাগ খুলে পিসির জন্যে একে একে সুগন্ধী সাবান, বডি লোশন, ঘরে পরার নরম চটি আর চকোলেট বের করে।   

প্রণতি বলেন, যাক! এগুলো সব কাজের জিনিষ। চকোলেটের মোড়ক খুলে পিসির মুখে আদরে একটা ডার্ক চকোলেট পুরে দেয় রূপা। অনেকদিন বাদে কেউ এমন আদর করে কিছু দিল প্রণতি কে। । পরিতৃপ্তিতে মন ভরে ওঠে তাঁর । আশীর্বাদ করেন রূপাকে। 

আজ রাতে তোমার কাছে শোব কিন্তু পিসি । সেই ছোটবেলাকার মত। রূপার আবদারে শুখোরুখো মনের ভেতরে অনেকদিন পর যেন নতুন করে বৃষ্টি ঝরে তাঁর। কি আনন্দ সেই ভেজায়।  

বলেন, সে আর বলতে! আমার কাছে শুবি না তো কার কাছে আর শুবি? এ বাড়িতে আর কে আছে? 

মন্টুকাকার খবর কি বললে না তো? 

প্রণতি বললেন, সব খবর এক্ষুণি চাই মেয়ের। আগে চল। এবার কোমর ফেটে যাচ্ছে আমার। শুয়ে শুয়ে সব বলব। রূপা বলল, তা ভাল। আমার তো এখন জেট ল্যাগ। ঘুম আসবে না।  

তবে চল শুয়ে শুয়েই দেদার আড্ডা দেব আজ।  

যা বলছিলাম,তোর  মন্টু কাক আর বিয়েই  করেনি রে। সে আমার কাছেই ছিল এতদিন। দুই ভাইবোনে থাকতাম সেই বড় বাড়িটায়। তারপর তোর দাদু যেমন উইল করে গেল । সেই অনুযায়ী সব ভাগ হল। তবে বাড়ি আর রাখা গেল না। যখন আমাদের বাড়ি প্রোমোটারকে দিয়ে দিলাম তখন মন্টুর আর আমার প্রাপ্য আলাদা ফ্ল্যাট বা টাকা। বাবা কি আর জানত যে মন্টু জীবনে বিয়েই করবে না? 

মন্টুকাকা গান শেখাত না? 

হ্যাঁ, এখনো শেখায় সেই ফ্ল্যাটবাড়িতেই। ওটাই তো তার একমাত্র রুজিরোজগার। তোর বাবা আর ছোট পিসি বাড়ির অংশ ছেড়ে দিয়ে টাকা নিয়ে নিল তখন। আর আমি এসে উঠলাম এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে। আমার প্রাপ্য বাকী টাকা ব্যাঙ্কে রেখেছি। বড় ফ্ল্যাট নিয়ে কি করব। শেষ বয়সে টাকা থাকলে সে আমাকে দেখবে। 

এই ফ্ল্যাট প্রণতি রূপাকে দিয়ে যাবেন। এবারে সেই সব কাগজেকলমে করতেই রূপার আসা। তার পিসির ইচ্ছে ।

তা বাবা, ছোটপিসিকে অত পড়াশুনো করালো আর তুমি হায়ার সেকেন্ডারির পর আর পড়লে না কেন পিসি? তুমি পড়াশোনায় অত ভাল ছিলে শুনেছি । 

কি আর করি বল? বাড়িতে পড়তে দিল না কেউ। তখন বাড়ি থেকে বেরুনো বারণ। 

তা তোমার বোন যে বেরুলো?  

আমার কপালটাই খারাপ রে। 

তোমার বিয়ে দিলেন না কেন ঠাম্মা, দাদু?  

সারাজীবন ধরে এত টানাপোড়েন সহ্য করে এতবছর পর এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ভাল না লাগলেও রূপা কে তিনি বলেই দেবেন সব। এই ভাবলেন।  

কি হল পিসি? চুপ করে র‌ইলে যে।  

আমাদের বাড়ি সে অর্থে কনসারভেটিভ ছিল না। নয়ত আমার বোন অতদূর পড়ে, চাকরী করে তারপর বিয়ের পিঁড়িতে বসে? 

তবে?  

তবে আর কি? এই যেমন তুই সেদেশে তোর বরকে ভালোবেসেছিলি, তোর বাবা মা বিয়েও দিয়ে দিলেন।  

রূপা বলল, সেটাই তো ন্যাচারাল।


জানিস? আমার জীবনটা অনেকের থেকে আলাদা রে। 

কেন পিসি? 

আর কেন? তাঁর জন্য আমিই দায়ী। 

তার মানে? 

আমাদের মস্ত সেই পুরোনো বাড়িটার পাশেই থাকত সুবিমলরা। দুই পরিবারে আসা যাওয়াও ছিল। তবে ঐ যেমন হয় সুবিমল আর আমি তখন ভেসে গেলাম। আমরা প্রেম করতাম ছাদে উঠে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এইরকম চলছিল। সে পড়ত কলেজে। আমি তখন ক্লাস টেন। 

তো ? কি হল তারপর? রূপা বলে 

তার পিসি বলল, মা একদিন মাসীদের সঙ্গে থিয়েটার দেখতে গেল রংমহলে। শম্পা কে সঙ্গে নিয়ে গেল।আর আমাকে রেখে দিয়ে গেল কারণ আমার সামনেই টেস্ট পরীক্ষা। বাবা অনেক রাতে ফিরতেন অফিস থেকে। তোর বাবা তখন শিবপুরের হষ্টেলে। 

রূপা বলল তারপর ? 

সুবিমল সেদিন আমাদের বাড়ির মধ্যেই সোজা চলে এসেছিল। তারপর যা হয়। এতদিনের দূর থেকে প্রেম হঠাত অত কাছাকাছি এসে আর বাঁধ মানেনি। আর কি বলি? সব তো বুঝিস । 

আই মিন গুড তো। ক্ষতি কি তাতে? রূপা বলল। 

তোরা বলবি কি আর হয়েছে এসবে? যাকে বিয়ে করবেই ঠিক করেছ তার সঙ্গে শোয়াই যায়। প্রণতি বললেন। 

ইয়েস। অফ কোর্স। নো  ঢাক ঢাক গুড়গুড় । 

আমি চুপচাপ ছিলাম। পরীক্ষার রেজাল্টও ভাল হল। কিন্তু আমার শরীরের হাবভাব দেখে মা বুঝে ফেলল মাস তিনেক পর। আমার পেটে তখন সুবিমলের সন্তান। মা চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে আমাকে বাবার কাছে নিয়ে গেল। আর তারপরেই সব খালাস হয়ে আমায় মুক্ত করল। তবে মা'কে সুবিমলের কথা আমি খুলে জানিয়েছিলাম সব। বাবা, মায়ের চরম আপত্তি। ভ্যাগাবন্ড ছেলে। পাড়ার লোক। পাশেই থাকে। তাদের সঙ্গে প্রবল অশান্তি, ঝগড়াঝাটি কিছুই বাকী র‌ইল না। তদ্দিনে সুবিমল চুপিচুপি বম্বে পাড়ি দিয়ে সিনেমা করতে গেছে। রাগে, ঘেন্নায় আমার তখন সুবিমলের প্রতি প্রেম উধাও। 


রূপার চোখে তখন জল টলটল করছে। ও তাই জন্যে এমন বৈধব্য বেশ তোমার? সেই কাপুরুষ লোকটার জন্যে? এত্ত মায়া? এটা আমি মেনে নিতে পারলাম না কিন্তু।  

প্রণতি বললেন, মোটেও না। আমার অভিমান অন্যখানে। এই ঘটনার পর অষ্টাদশীর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হল বাড়িতে। আর জারি করল কারা? তার বাবা আর মা। বাড়ির বড় মেয়ে, সুন্দরী বুদ্ধিমতী মেয়ে তাদের সব আশায় জল ঢেলে দিয়েছে তাই। বাবা আলমারী খুলে আমার রঙীন সব শাড়ি পুড়িয়ে দিল। আর সাদাশাড়িগুলো এনে আমাকে বলল, কাল থেকে বাইরে বেরুনো বন্ধ। পড়াশুনো আর চলবে না। এখন থেকে যেন বাড়ির সব রান্নাবান্না আমি‌ই দেখি। মা'কে সাহায্য করি। যেমন আগেকারদিনে হত। ভাইবোনদের পড়াশুনো দেখতে হবে। অনেক কষ্টে হায়ারসেকেন্ডারি পরীক্ষাটা দিলাম। ভাবলাম বাবা-মায়ের মন গলবে। আবারো পড়তে দেবে। কিন্তু নাহ্! পরীক্ষার পর থেকেই মা খুব অসুস্থ হয়ে বিছানায় শোয়া। তাও নাকি আমার দোষে। বাবা বলত প্রায়শঃই। মন ভেঙ্গে গিয়ে মা শয্যা নিয়েছে নাকি।  আর আমার দায়িত্ত্বে এই পুরো সংসার। দুটো ভাইবোনের ইস্কুল, পড়াশুনো, রান্নার মাসীর যোগাড়, ধোপা, নাপিত বাজারের হিসেব সবকিছু। ভাল রেজাল্ট করেও আর ভর্তি হওয়া হলনা কলেজে। আর সেইথেকেই এমনি আছে রে তোর প্রণতি পিসি।  


রূপা বলল

- হাউ স্যাড পিসি। জাষ্ট ভাবতে পারছিনা যে বাবা, মা কি করে এমন ক্রুয়েল হতে পারে। 

- আর কি হবে এসব ভেবে? রাখ তো।  

- আর সেই লোকটা? সে ই বা কি করে পারল এমন করতে? 

- কাপুরুষ একটা। ওকে একবার পেলে আমি বুঝিয়ে ছাড়তুম । লোকটা পালিয়ে বাঁচল। জানিস? সেদিন কেউ আমার পাশে দাঁড়ায় নি। এমন কি তোর বাবাও না। 

- এস্কেপিস্ট একজন। তোমার জীবনটা নষ্ট করল। রূপা বলে ওঠে। 

- নে, নে এবার বাদ দে ওসব কথা। এবার ছবি দেখা দিকিনি সেদেশের। তোর ঘর সংসার, ছেলে, বর সকলের। 

রূপা এবার তার হাতের সেলফোন খুলে নিজের শহরের ছবি দেখাতে শুরু করে দিল। সেদেশের ছবি কি সুন্দর। কোন্‌টা ছেড়ে কোন্‌টা দেখে? 

ওদেশের আকাশ বড্ড নীল রে। আর জলবায়ু কত ভাল বল্‌ তো! এখানকার মত এত গরম নেই। 

রূপা বলল, তুমি এবার আমার সঙ্গে চলে চলো প্লিজ। খুব আরামে থাকবে বাকী জীবনটা। 

এই মধ্য ষাটে নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাব? কি যে বলিস বাপু! 

তোমার নিজের দেশের পুরনো স্মৃতিগুলো কি খুব সুখের ? সেই বিশাল বাড়িও নেই। না আছে লোকজন। কিসের জন্য মায়া তোমার? 

প্রণতি চুপ করে থাকেন। সত্যিসত্যি তাঁর কোনোই পিছুটান নেই। কিন্তু এত বয়সে সেদেশের জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা কি মুখের কথা? কথায় বলে পর ভাতী হয়ো কিন্তু পর ঘরী হয়ো না। 


সেলফোনের ফোটো অ্যালবামের পাতা উল্টে যায় রূপা একে একে। দুজনের খুচরো, এলোমেলো সংলাপ চলতে থাকে। হঠাত একটি ছবিতে গিয়ে চোখ আটকে যায় প্রণতির। এ কি! এ ছবি কার? কোথায় পেলি তুই?  


রূপা বলে, কেন? তুমি চেনো নাকি এনাকে? আরে সেবার বঙ্গ সম্মেলনে আলাপ হল। মুম্বাই থেকে এসেছিলেন। ওখানে স্ক্রিন প্রেজেন্স ছিল ওনার। বাঙালী অভিনেতা বিমল দা। দারুণ দোস্তি হয়ে গেছে । আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড হয়ে গেছেন তারপর থেকে। উনি অ্যামেরিকায় আমাদের বাড়িতে এসে দুরাত ছিলেন। কি ভাল অভিনয় করেন গো পিসি। এখনো যোগাযোগ আছে। 


ঝটকা মেরে প্রণতি উঠে পড়েন বিছানা থেকে। আমি তোর সঙ্গে সেদেশে চলেই যাব রূপা। সেদেশেই গিয়ে থাকব তবে। চল তবে পাসপোর্ট, ভিসার সব ব্যবস্থা করে ফেলি। যদি সেই লোকটার সঙ্গে আরেকটি দেখা হয়! 

রূপা বলল কে? কার কথা বলছ তুমি?  

প্রণতি বললেন ঐ যে, সুবিমল থেকে এখন শুধু বিমল হয়েছে যে। মুম্বাই গিয়ে ভোল বদলেছে তার । এইবার এতদিন বাদে তার সঙ্গে বোঝাপড়াটা সেরে নেওয়া দরকার।     



৫ ফেব, ২০২১

ইমিউনিটি কারে কয়?

 

সেই যে লকডাউনে শেফ সঞ্জীব কাপুর লাখ কথার এক কথা কয়েছিলেন নাইন্ডিয়ান কিচেনে মশলার তাকটি হল ইমিউনিটি বুস্ট্যার এর জায়গা। খুব মনে ধরেছিল কথাগুলি। কথাগুলো কিয়দাংশে কিন্তু সত্যি প্রমাণিত হয়েছেও । তাইনাআমাদের ছেলেপুলেদের আমরা ছোটো থেকে অত হাত ধোয়াইওরা হামা দিতে শুরু করলেই খুঁটে খায়। তা সে আরশোলার পা হোক কিম্বা টিকটিকির গু। দু চারদিন নলিখলি যায় হেগে। তারপর ঠিক হয়ে যায় চিঁড়েকাঁচকলাআপেল সেদ্ধ খেয়ে। আমরা একটু বড় হলেই স্কুল কলেজে এক আকাশের নীচেখোলা হাওয়ায় হজমি,আলুকাবলিফুচকারোল খেয়ে অভ্যস্ত। এটা শুধু আমার রাজ্যেই নয়। আসমুদ্র হিমাচলেই এমন। তাই আমাদের এই HARD immunity কি HERD immunity তে গিয়ে ঠেকলএই অভিশাপ আজ আমাদের আশীর্বাদ। আমাদের ন্যাংটা খোকার শিঙনি ঝরা নাকথুতু মাড়িয়ে রাস্তা থেকে এসে জুতো না ধুয়েই গটমট করে ঘরে ঢুকে পড়াথুতু দিয়ে বড়বাজারের গদির ব্যাবসায়ীর নোট গোনা আর বাজারের চকচকে আপেল বা পেয়ারা না ধুয়েই নোংরা জিনসের প্যান্টে ডিউস বলের মত দুবার ঘষে নিয়ে কামড় দেওয়া... এসবের একটা মাহাত্ম্য আছে কি বল?

১ ফেব, ২০২১

"এবং রংপুর লাইম" পথের আলাপ পত্রিকার আয়োজনে সেরা দশে পুরস্কৃত গল্প

 



(১) 

নমস্কার! আমার নাম সুতনুকা রায়। আপনাদের নাম্বার পেলাম এক বন্ধুর কাছ থেকে । 

হাঁসের ডিম আছে তো এখনও? নাকি ফুরিয়ে গেছে? জানান তবে। 

আচ্ছা সোনারপুরে  ডেলিভারি করবেন? 


এতসব লিখেই খটখট নিজের ঠিকানা টাইপ করে ফেললেন। 

একতরফাই যেন বকে চলেছেন সুতনুকা। মনখারাপের মেঘ এক নিমেষে উড়িয়ে দেবার এ এক উপায় হল বেশ। কিন্তু ওদিকের প্রাপক কথা বলেনা কেন যে ? দুটো টিক নীল হয়ে গেল। 


অনেকক্ষণ হয়ে গেছে হোয়াটস্যাপের ওদিক থেকে কোনও উত্তর না আসায় সুতনুকা বিচলিত হলেন। মধ্যবয়সীর শরীর মনে খুব টানাপোড়েন। মায়ের সঙ্গে একা থাকেন। বাবার কেনা ফ্ল্যাট আর সঞ্চিত বেশ কিছু টাকাপয়সা আছে তাই এখনও দিব্য চলে যায়। সমস্যা একটাই। ঘরে কেউ নেই কথা বলার মত। অশীতিপর প্যারালিটিক মা দীর্ঘদিন বিছানায় শয্যাশায়ী। কথাবার্তাও জড়ানো। সুতনুকা কোভিডের লকডাউনে মায়ের দিনেরাতের কাজের লোকটিকেও কাছে পায়নি। সে রাতারাতি কানাঘুষো লকডাউনের কথা শুনেই পালিয়েছিল বাড়ি। ট্রেনে করে আসা যাওয়া করত। অগত্যা মা কেও দেখতেই হয়। ফেলে তো আর দেওয়া যায় না। একাই রাঁধে বাড়ে। ঘরের কাজ কোনোমতে সারে। টিভি দেখলে মন খারাপ লাগে। মনোবল কমে যায়। দু একজন আত্মীয় বন্ধু থাকলেও কোভিডের কালে কেউ আগ বাড়িয়ে কিছু জিগ্যেস করেনা সুতনুকা কে, এমনি স্বার্থপর মানুষ এখন। যদি রাতবিরেতে মায়ের জন্য তাদের কোনও দরকার পড়ে । তাই হয়ত। দিন দিন আত্মীয়, পরিজন সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে সুতনুকা একদিন খুব একা হয়ে পড়লেন এই মারণ কোভিডের রাজত্বকালে। এবছরটায় শুধু নিজেকে বাঁচতে হবে আর মা কে নিয়ে বন্দী হয়ে ঘরে থাকতে হবে। এ আর এমন কি? বন্দীই তো ছিলেন তিনি । তবে কোভিডের আগে কাজের মেয়েটা আসত যেত দিনে দু বার। বিকেলে সে চা করতে এসে। টিভি দেখতে দেখতে গল্পগাছা করত। এখন কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে সুতনুকার সেইসব ভাবলে। 


আবার টাইপ করলেন... 

আর কি কি আইটেম আছে আপনাদের? জানালে ভালো হয়। অবিশ্যি ডেলিভারি না করলে আলাদা কথা... 

অতঃপর উত্তর আসে ও প্রান্ত থেকে। সুতনুকা উৎফুল্ল হোয়াটস্যাপে "টাইপিং" দেখে।  

নমস্কার। আপনি কি ফেসবুকে আছেন ম্যাম? তাহলে আমাদের পেজটি লাইক করলে জানতে পারবেন। 


 না আমি ফেসবুকে নেই। "হাটেবাজারে" র  সুন্দরবনের ভালো হাঁসের ডিমের কথা জেনে মনে হল। 

আপনি আমায় এখানেই জানাতে পারেন কি কি জিনিষ আছে হাটেবাজারে তে । আপনাদের প্রডাক্ট রেঞ্জ জানলে আমার অর্ডার দিতে সুবিধা হয় একটু। 


ওদিকে হাটেবাজারে আবারো টাইপিং... 

আপনার কি লাগবে ম্যাম? চাল থেকে চালতা, ডাল থেকে ডালডা, আম থেকে আমড়া সব রাখি আমরা। 

বাহ! কি সুন্দর কথা বলেন আপনি! 

হাসির ইমোটিকন আসে ওপ্রান্ত থেকে। 

খুশি হন সুতনুকা। লিখে ফেলেন ঝপাঝপ... 

তার মানে দুধ থেকে দুধেরসর চাল, গাছপাঁঠা থেকে কচি পাঁঠা সব? 

ইয়েস ম্যাম। এভরিথিং । আপনার কি লাগবে শুধু বলুন। হাজার টাকার ওপরে ফ্রি হোম ডেলিভারি। প্রথম কাস্টমার হিসেবে আপনি অ্যাডিশানাল টেন পারসেন্ট ডিসকাউন্টও পাবেন। 

আরও খুশি সুতনুকা। তড়িঘড়ি বলেন 

সুন্দরবন থেকে সোনারপুর কাছেই হবে আপনাদের  

আবারো হাটেবাজারে টাইপিং ... 

আমরা দক্ষিণ থেকে উত্তর সর্বত্র ডেলিভারি করে থাকি ম্যাম। 

"বেশ"  

শব্দটা লেখার পরেই মায়ের গোঙানিতে সুতনুকার মেসেজিংয়ে ভাটা পড়ে। 

মায়ের ঘরে যেতেই সুতনুকার চোখে পড়ে মা অনেকক্ষণ বিছানা ভিজিয়ে পড়ে আছে তেমনি। বোধহয় শীত করছিল তাই চেঁচিয়ে মেয়েকে জানান দিয়েছেন। মা কে হাগিস পরিয়ে রাখেনা সে। এক হল তার দাম আর দুই মায়ের অ্যালারজি। খুব র‍্যাশ বেরুতো আগে আগে। তাই মা কে উঠিয়ে সে নিজেই বেড প্যান দেয় নিয়মিত। 

ওদিকে হাটেবাজারে তাদের প্রডাক্ট প্রোমোশানের খবরাখবর দিয়েই চলে... 

আমাদের সব প্রডাক্ট আমাদের নিজস্ব ফার্মের। কয়েকটা ফলের ছবি, মাছের ছবি। ম্যাম, ইফ ইউ আর ইন্টারেস্টেড প্লিজ ভিজিট আওয়ার ফার্ম ওয়েবসাইট। লিংক দিয়েই সে যাত্রায় কথোপকথনে ইতি টানে হাটেবাজারে। 

এসেই তাকে অফলাইন দেখে মন খারাপ হয় সুতনুকার। ডাউনলোড করে ছবিতে চোখ রাখেন। 

কাঁঠালিকলাও? কাগচি লেবু, ছড়া তেঁতুল, রংপুরের লেবুর ছবি দেখে মোহিত হন সুতনুকা। তার মানে লকডাউনে মামাবাড়ির সেই স্পেশ্যাল হাতঅম্বল অ্যাসিওরড। কি ভালো রাঁধত তাঁর মা। হাতায় করে তেলের মধ্যে সর্ষে লংকা ফোড়ন দিয়েই ঢেলে দিত তেঁতুলগোলা, নুন, মিষ্টি । লেবুর রস আর লেবুপাতা দিয়েই ফুটে উঠলে নামিয়ে ঢেলে দিত সুতনুকার  কাঁঠালিকলা চটকানো ঠাণ্ডা ভাতের মধ্যে।গরমকালে ইশকুল থেকে ফিরে এই হাত অম্বল খেতে খুব ভালো লাগত তাঁর। তাই কাঁঠালিকলা আর রংপুর লেবু একসঙ্গে দেখে চোখ চকচক করে উঠল সুতনুকার।  

হাটেবাজারের নিজস্ব ফার্মের ওয়েবসাইটের লিংকে ক্লিক করেই নিমেষের মধ্যে হাজির হলেন তিনি খোলা আকাশের নীচে । যেখানে রঙিন, ঝলমলে সব টাটকা আনাজপাতি, মুদিখানা, মাছমাংস, ডিমের পসরা থরেথরে সাজানো । 

মনের আনন্দে ওপারে  ছুঁড়ে দিলেন একগুচ্ছ প্রশ্ন  । 


পায়েসের গোবিন্দভোগ খুঁজে পেলাম না। আচ্ছা মুরগীর ডিম দিশী? তাহলে হাঁসের ডিমের সঙ্গে এটাও দবেন । মানে হাঁস, মুরগী মিলিয়ে ছ' টি করে মোট এক ডজন। 

ছড়া তেঁতুল দেখেই লোভ লাগছে। বাজারে তো পাইই না আর । ওটা দেবেন আড়াইশো গ্রাম। 

গন্ধরাজ লেবুর পাশে রংপুর লাইমস দেখলাম । কতদিন পর নাম শুনেই জিভে জল এল! বাংলাদেশের রংপুরের লেবু? আমার মামারবাড়ি জানেন? দু দুটো লেবুগাছও ছিল সেখানে। সব কেমন ছেড়ে আসতে হয়েছিল দাদুদের। নাম শুনেছি মায়ের মুখে । খুব টক অথচ ভীষণ রস ঐ লেবুর। বাইরেটা ঘন সবুজ, ভেতরটা মুসাম্বীর মত হলুদ। তাইতো ছবি দেখেই চিনতে পেরেছি। ওটার বড্ড দাম। তবুও দেবেন দুটো। বাপের বাড়ির লেবু শুনলে মা একটু খুশি হবেন। 


ওপ্রান্তে  কেউ আর তখন অনলাইন হয়না দেখে বিফল মনোরথ সুতনুকা মনের দুঃখে হোয়াটস্যাপের ঝাঁপি বন্ধ করে দেন। সেরাতের মত । 

ভোরে উঠেই দেখেন উত্তর এসেছে। 

আমাদের সব নিজস্ব ফার্মের প্রোডাক্ট ম্যাম। গোবিন্দভোগ চালের মত আমাদের নিজস্ব একটা সুগন্ধি চাল আছে। নাম গোপালভোগ। ওটা নিয়ে দেখুন। এক কেজি দিচ্ছি তবে। 

সুতনুকা ঝটিতি টাইপ করতে শুরু করে দেন... 

তাহলে মুরগীর ডিম, হাঁসের ডিম মিলিয়ে একডজন, পাঁচ কেজি দুধের সর চাল, এক কেজি গোপালভোগ। ও হ্যাঁ, সোনামুগ ডাল দেবেন এক কিলো। আড়াইশো তেঁতুল, দুটো গন্ধরাজ লেবু আর দুটো রংপুর লাইমস। মোট কত হয় জানাবেন। আমি কিন্তু ক্যাশে পেমেন্ট করব। আমার দ্বারা ওসব নতুন ডিজিটাল ওয়ালেট হবেনা।  

ফোন রেখেই এবার মনে হল কোভিডের যুগে খুচরো নেওয়া যাবে না। অতএব রাউন্ড ফিগারে দুহাজার টাকার মত জিনিষ নিতে হবে। তাই আবার ঢুকে দেখতে হবে সাইটে। 

কিন্তু ও প্রান্তে নীরব। কোনও উত্তর আসেনা। 

ধুস! সকাল সকাল অনেক কাজ। মায়ের কাজ, নিজের কাজ। রাঁধাবাড়া। টবের গাছ থেকে তুলসী পাতা তুলে এনে মধুর শিশি হাঁটকাতে গিয়ে দেখেন  তলানিতে ঠেকেছে। মনে পড়ে গেল। 

আচ্ছা ওদের মধুও তো দেখলাম মনে হল। সুন্দরবনের চাক ভাঙা খাঁটি মধু। তাহলে তো দু' হাজার হয়েই যাবে। এবার সোজা ফোন করেই ফেললেন তিনি। কেউ ধরল না ফোন। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল... 

স্যরি! দিস ইজ হোয়াটস্যাপ নং। শ্যাল কন্ট্যাক্ট ইউ সুন... 

কি যন্ত্রণা রে বাবা! আবার টাইপ করতে বসলেন সুতনুকা। এক কেজি মধু দেবেন। আচ্ছা এই মধু চিনির রসে ক্যারামেলাইজড নয় তো? তাহলে নেব না। 

খটখট উত্তর এল ওদিক থেকে। 

কি যে বলেন ম্যাম! সুন্দরবনের খাঁটি মধুর নাম সারা বিশ্বে। আমাদের মধু এক্সপোর্ট হয়। 

সুতনুকার মনে পড়ে, রংপুরের মামাবাড়ির লোকজনের মুখে সুন্দরবনের মধুর নাম শুনেছে। বাংলাদেশে সুন্দরবনের যে অংশটা ঢুকে আছে সেখানেও এই মধু পাওয়া যেত। 

আবার লিখলেন... 

দেখুন যা যা জিনিষ অর্ডার করলাম সব মিলিয়ে ২০০০ পুরো হয় যেন। আমি খুচরো নেব না কিন্তু। 

ওকে ম্যাম। শ্যাল রাউন্ড আপ উইথ লেবু কিম্বা তেঁতুল। 

(২) 

সেদিন মা মেয়ের চা-টোস্ট পর্ব শেষে ভাত রেঁধে বসে রইলেন সুতনুকা। এমন প্রায়ই হয় আজকাল তাঁর। কোনদিন ডালটা প্রেসারে সেদ্ধ করে গ্যাস নিভিয়ে দিয়ে টিভি খোলেন। কোনদিন আনাজপাতি কেটে নিয়ে হাঁফিয়ে মরেন। কোনদিন মিক্সারে পোস্তটা কাঁচালঙ্কা দিয়ে দুবার ঘুরিয়ে ক্ষান্ত দেন। ভাবেন আর কদ্দিন এভাবে? মায়ের জীবনটাও তেমনি। কোভিডও তেমনি। এই দুয়ের টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত হতে হতে আজ ক্লান্ত এই অবিবাহিতা। আর কদ্দিন নিজের জন্য রান্না করে চলবেন তিনি? মা তো নামমাত্র বেঁচে আছেন। তাঁর খাওয়াদাওয়া শুধু বাঁচার জন্য। তিনি কি খান, কেন খান তাও সবসময় বোঝেন না। সর্বগ্রাসী এক মনখারাপ ঘিরে ধরে কুয়াশার মতন। এসে দাঁড়ান মায়ের বিয়ের ড্রেসিং মিররের সামনে ।  পুবের রোদ এসে আছড়ে পড়েছে  পুরনো পলকাটা আয়নার কাচে । সুতনুকার সিঁথির পাশের আরও আরও চুলগুলিতে রঙ ধরে গেছে এই কোভিডের কালে। অর্থাৎ আরেকটু বয়স বেড়ে গেল বুঝি। আগে শখের নেল পালিশ লাগানো সব ঘুচে গেছে । বেরুনোর সময় লিপস্টিক, ম্যাচিং ব্লাউজ, শখের শাড়ি সব শিকেয় তোলা রইল। কিসের জন্য তবে এই বেঁচে থাকা? দিনের পর দিন। 

এখন আবার আরেকটা ভয় কুরেকুরে খায় তাঁকে। তাঁকে  যদি কোভিড ধরে? তিনি যদি মায়ের আগে চলে যান এই দুনিয়া থেকে? মায়ের কি হবে তবে? এর নাম ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশনের আরেক নাম মনখারাপ। কেউ যেন বলে ওঠে নেপথ্যে। 


একটা ফোন এসে সেই চিন্তায় ভাটা পড়ে তখনকার মত। অচেনা নম্বর। 

হাটেবাজারে থেকে বলছি। আপনার টোটাল বিল অ্যামাউন্ট ২০১০ টাকা। এক্সপেক্টেড ডেলিভারি টাইম, কাল সকাল ১০টা। 

কথাগুলো বলেই ফোন কেটে যায় না কেউ কেটে দেয় বুঝতে পারেন না । পরেই মনে হল ভয়েস মেসেজ ছিল সেটি। 

মানুষের সঙ্গে আর ইন্টারঅ্যাক্ট করা যাবেনা তবে? কি মারাত্মক অতি যান্ত্রিক হয়ে উঠল জীবন! তবে বাবা একটা কথা বলতেন বটে। "প্ল্যানেট  আর্থ ইজ সিক। অ্যান্ড দ্যা ডিজিজ ইজ ম্যান"  মানুষের থেকে দূরে থাকতে শেখ । ভালো থাকবি। 

সেদিন অনেক তর্ক হয়েছিল বাবার সঙ্গে।  কি যে বল তুমি! মানুষ কি জন্তু জানোয়ার? মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। 

বাবা বলেছিলেন পশুপাখিদের অতীত নেই, ভবিষ্যতের চিন্তা নেই। আছে কেবল বর্তমান। যত মানুষের সঙ্গে মিশবি তত বুঝবি। আনন্দ যেমন পাবি তেমনি ততটাই আঘাত পাবি, দুঃখ পাবি।

 

ভূপেনবাবুর বিখ্যাত গান "মানুষ মানুষের জন্যে" মিথ্যে তবে? সুতনুকা বলেছিল। 


আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধব সবার থেকে বাবা ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন একদিন। তখন ইন্টারনেট আসছে সবেমাত্র। সোশ্যাল মিডিয়াও ছিলনা। বাবা একা হয়ে পড়লেন অবসর নেওয়ার পরেই। প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে বয়স্ক ছেলেরা অনেকেই  এমন অবসাদগ্রস্ত  হয়ে পড়ছে আজকাল। এর নাম মেল মেনোপজ। কাগজে পড়েছেন তিনি। গুমরে গুমরে নিজের খোলসের মধ্যেই গুটিয়ে রাখতে রাখতে একদিন দুম করে বাবা চলে গেলেন। সুতনুকার তখন কলেজ জীবন। তারপর এম এ ক্লাসে ঢুকেই মায়ের স্ট্রোক হল। পড়া শেষ হল তারমাঝেই কিন্তু সুতনুকার জন্য জীবনের আর কিছু নতুন ইশারা রইল না। নাথিং টু লুক ফরোয়ার্ড। কেউ তার বিয়ের চেষ্টাও করেনি কোনোদিন । আর প্রেমে পড়তেও শেখেননি সুতনুকা। ঐ যে বাবার কথাই মাথায় গেঁথে ছিল বোধহয়। মানুষের থেকে দূরেই থেকে গেলেন তিনি। নতুন করে নিজের জীবনে বিপদ ডেকে আনার কোনও ইচ্ছেই মাথায় আর আসেনি।  

ফোন হাতে নিয়েই দেখতে পেলেন হোয়াটস্যাপে মেসেজ এসেছে আবারো। যে কথাগুলি তখন ফোনে শোনালো সেটাই আরও একবার। তিনি শুধু থ্যাংক্স জানালেন তখনকার মত। 

মনে মনে বলে উঠলেন, উফ! কি নিরুত্তাপ সারা দুনিয়া!

(৩) 

এভাবেই চলছিল বেশ। কাঁঠালি কলায়, থোড়-বড়ি-মোচায়।  দুধেরসর থেকে দুধকচু সবের মধ্যেও ঐ অচেনার সঙ্গে কথোপকথন সুতনুকাকে এক পশলা সুবাতাস দিয়ে যায়। গলার স্বর শুনে অভ্যস্ত ও প্রান্তের মানুষটিকে খুব দেখতে, জানতে ইচ্ছে করলেও উপায় নেই তার। আরও কথা বলারও ইচ্ছে থেকেই যায়। 

হঠাত একদিন গ্রসারী আইটেমের অর্ডার দিয়ে সুতনুকা ঝাঁঝের সঙ্গে লিখেই ফেলেন, এত এত জিনিষ কিনছি কিছু ফ্রি দেন না তো?  


সঙ্গেসঙ্গে ওদিক থেকে উত্তর আসে। 

আপনার কি চাই বলুন? নেক্ট টাইম ফর শিওর। 

সুতনুকা কি বলবেন ভেবে পান না। 

ওদিক থেকে আবারো প্রশ্ন আসে... 

বলবেন ম্যাম। কি দিতে পারি ফ্রি হিসেবে। 

সুতনুকা স্মাইলি পাঠান খুশি হয়ে

প্রত্যুত্তরে হাটেবাজারের করজোড়ে নমস্কারের ইমোজি ফুটে ওঠে স্ক্রিনে।  

থেমে যায় বার্তালাপ। 


(৪) 

ইলিশমাছ বড্ড দাম। তার চেয়ে চিংড়ি দিন। মাছের ডিম আছে? এইসব আদুরে খুচরো সংলাপে বানভাসি হয় সুতনুকার হোয়াটস্যাপ। তবে আগে যেমন বেশীটাই কেজো কথা হত এখন আরেকটু আবেগ মাখানো সেই সংলাপের ভাষা। হাটেবাজারের ভাষাতেও  বেশ আত্যিশ্যের ছোঁয়া।  

বিজনেস ডিল বাদ দিয়ে সুপ্রভাত, শুভরাত্রির সঙ্গে দিব্য জায়গা করে নিল সুন্দরবনের আমফানের ক্ষয়ক্ষতি । সুতনুকা একদিন লিখেই ফেললেন, 

আপনাদের ফার্মের ঘরবাড়ির কোনও ক্ষতি হয় নি তো? জানাবেন। যদি সাধ্যমত কিছু সাহায্য করতে পারি। 

ওদিক থেকে উত্তর আসে বিনয়ের সঙ্গে, 

সো নাইস অফ ইউ ম্যাম।

উদ্বেল হয়ে পড়েন সুতনুকা। 

এসব কথা ছাড়াও "কি টাটকা মাছ ছিল" অথবা "খুব মিষ্টি ছিল পেয়ারা” ...এসব শুনে  হাটেবাজারেও তাদের ব্যাবসায়ী  মনোবৃত্তি, নিক্তিতে ওজন মাপা ছেড়ে সুতনুকা ম্যামের জন্য স্পেশ্যাল ডিল দিতে শুরু করল অচিরেই। 

দু কিলো আলুর সঙ্গে কাঁচা হলুদ ফ্রি, এক কিলো সোনামুগ ডালের সঙ্গে একশো হলুদ গুঁড়ো ফ্রি আবার কোনদিন একডজন কলা দিল দশটার দামে। 

সুতনুকা ছেড়েই দিয়েছেন প্রায় পাড়ার দোকান থেকে বাজার আনা। এই বেশ ভালো ব্যাবস্থা। আজকাল প্রতিদিন ভোরে উঠেই তিনি হাটেবাজারের মেসেজ পান। নতুন কি ফল এল, কি শাক এল, কোন মাছ এল ... মন ভালো হয়ে যায় তাঁর। ইচ্ছে হয় সামনাসামনি মানুষটির সঙ্গে একটিবার আলাপ করার। 

(৪) 

ম্যাম ইউ উইল লাভ দিজ গুডি ব্যাগ ফর্ম আওয়ার ফার্ম! শ্যাল ডেলিভার ইউ টুডে। 

সুতনুকা হতবাক। কিছু তো অর্ডার করেন নি তবু কেন? হয়ত ভ্যালিউড ক্লায়েন্ট ভেবে কিছু দিচ্ছে। 

সেদিন গুডি ব্যাগ খুলতেই চোখে পড়ল রংপুর লাইমস, কাঁচা হলুদ, তুলসীপাতা, আদা, ছোট্ট মধুর শিশি আর গোলমরিচের প্যাকেট। বেশ অবাক হলেন খুলে। বেশ দামী সব জিনিষ। আর সঙ্গে একটা চিরকুটে লেখা "স্টে হেলদি, স্টে সেফ" 

হাটেবাজারে তার মানে তাদের ক্লায়েন্টের কোভিড কেয়ারের জন্য বেশ সচেতন। ফার্ম ফ্রেশ গুডিজ পাঠিয়েছে তাই। 

হোয়াটস্যাপ খুলে সুতনুকা লেখেন খুব ভালো লাগছে এইসময় এত কিছু দরকারি জিনিষ হাতে পেয়ে। নিশ্চয়ই পাঁচন বানিয়ে খাব। থ্রোট কেয়ার হবে আমাদের। মনে করার জন্য থ্যাংকস। বাই দ্যা ওয়ে জ্যান্ত কাতলার কি স্টেট্যাস? ল্যাজা মুড়ো বাদ দিয়ে সলিড মাছ দেবেন এবার এক কেজি । ঘাড়ের বা নীচের দিকের মাছ নেব না অ্যাজ ইউজ্যুয়াল। মা কে কাঁটা বেছে দিতে হয় আমার।  

ওপাশ থেকে উত্তর আসে জানি তো ম্যাম। তবে এবার আরেকটা সারপ্রাইজ দি? 

প্লিজ... 

ইয়োর ফেবারিট মালাবার স্পিনাচ ফাইনালি অ্যারাইভড। কাতলা মাছের সঙ্গে ওটা ফ্রি যাবে, সঙ্গে আড়াইশো হরিণা চিংড়ি ফ্রি। অসুবিধে নেই তো ? বাই দ্যা ওয়ে, একফালি কুমড়ো দেব কি তবে? উইকেন্ডে পুঁইশাক দিয়ে চিংড়ি চচ্চড়ি জমে যাবে ম্যাম। 

সুতনুকা ভাবেন, আমার আবার উইকেন্ড! আমি কি চাকরী করি ছাই? তবে কি করে জানলো ওরা? দিন কয়েক ধরে পুঁইশাকের জন্য বড্ড মনকেমন করছিল তার। মা ও খুব ভালো রাঁধতেন একসময়। 

হাটেবাজারের সঙ্গে কেনাকাটিতে মন ভালো করতে করতে একসময় ডিপ্রেশন একটু একটু করে মুক্তি দিয়েছিল সুতনুকা কে। ফেসবুকে ঢুকে নিজেই একটা অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেছিলেন তিনি। প্রোফাইলের ছবিও একই আছে মানে যেটি হোয়াটস্যাপে লাগানো। মানুষ কে হঠাত করেই ভালো লাগতে শুরু করেছে তাঁর। বাবা ভুল বলতেন। বাবার কপাল সেটা। খুঁজে পেয়েছেন  ইশকুল, কলেজ, ইউনিভারসিটির কয়েকজন বন্ধু বান্ধব কে। 

বেশ কাটছিল দিন। অসুস্থ মা ঘরে। তবুও অভ্যেসে সব সয়ে গেছে। কোভিড ও বশে আছে এখনও অবধি। 

হঠাত করেই একদিন রাতে মায়ের শ্বাস উঠল। পাশে শুয়েই টের পেলেন সুতনুকা। মায়ের নাড়ী ছেড়ে দিচ্ছে। ভোর রাতে মা চলে গেলেন। পাড়ার ছেলেদের খবর দিলেন। মা কে তারা নিয়ে গেল।  সুতনুকার গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল বেরিয়ে এল। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নতজানু হয়ে জানালেন ধন্যবাদ। মা কে মুক্তি দিলেন তিনি। কোভিডও ধরতে পারেনি তাই  মায়ের শেষ যাত্রায় তিনিই সঙ্গী হলেন। মুখাগ্নি করলেন। 


বাড়ি ফিরে দেখেন হাটেবাজারের ডেলিভারি পড়ে আছে তাঁর দরজার সামনে। একমধ্যে কিছু অর্ডার দিয়েছেন বলে  তো মনে পড়ছে না। তাহলে? 

প্যাকেট খুলে দেখতে পেলেন একটি চিরকুটে লেখা শোকবার্তা ..মে ইওর মাদার'স সোল বি অ্যাট পিস! ওম শান্তি! ফ্রম টিম  হাটেবাজারে। 

চিরকুটের সঙ্গে এসব আবার কি? হবিষ্যির আয়োজন? সুতনুকার জন্য? আতপ চাল, মটর ডাল, সৈন্ধব লবণ, ঘিয়ের শিশি আর কাঁচকলা। ওরা জানলো কি করে? তিনি তো এখনও মায়ের মৃত্যুর কথা বলেন নি ওদের সঙ্গে। 


কোভিডের যুগে সংক্রমণের "ট্রেস দ্য পাথ" এ অভ্যস্ত শিক্ষিত মানুষজন। হঠাত মাথায় এল তাঁর। মা চলে যাবার পরেই ভোর রাতে ফেসবুকে স্টেট্যাস দিয়েছিলেন বটে। বন্ধুদের জানাতে । হাটেবাজারেও সেখানে সুতনুকার প্রকৃত বন্ধু কিনা!