১৪ মে, ২০২০

অতঃপর

সেদিন টিভিতে দুই অর্থনীতি বিশেষজ্ঞের আলোচনা শুনে বেশ ভালো লাগল। তাঁদের একজনের মতে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের সঞ্চিত কিছু পয়সাকড়ি রয়েছে। গত দুমাস তারাও খুব সীমিতভাবে নিজস্ব চাহিদা সীমাবদ্ধ রেখে খরচাপাতি করেছে।ব্যুটিকে যায়নি, গয়নার দোকানে, শপিংমলে যায়নি, মাল্টিপ্লেক্সে যায় নি, রেস্তোরাঁয় গিয়ে খায়নি, দেদার স্যুইগি জ্যোম্যাটোতে হোম ডেলিভারি নেয় নি। ক্লাবে গিয়ে মদ্যপান করেনি এমন কি গাড়িতে তেল ভরে কোথাও যায়নি।বিদেশে বা স্বদেশে বেড়ানোর জন্য প্লেন বা ট্রেনের টিকিট কাটেনি।খরচের মধ্যে ওষুধপালা, রোজকার গ্রসারি, ফলমূল, সব্জি, মাছ মাংস, ডিম আর সরকারি অনুদানে কিম্বা কাজের লোকেদের নেট ট্রান্সফারে পয়সাকড়ি পাঠিয়েছে। এবার সেই অর্থনীতিবিদ তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, তাঁরা এবার জিনিষপত্র কেনা শুরু করুন। কারণ সেই চেইন টা অর্থাৎ তাঁদের টাকাকড়ি বাজারে আসুক। সংসারের জিনিষপত্র কিনেই হোক, কাউকে সাবানের প্যাকেট বা টয়লেট সোপ দান করেই হোক কিম্বা কেক কিনে হোক নিদেনপক্ষে স্যানিটাইজার অর্ডার দিয়েই হোক। তাহলে সেই টাকা বাজারে আসতে থাকলে একটা ভালো দিক তৈরী হবে, আমরা জিনিষ কিনলে সরকারের কিছু ট্যাক্স ঘরে আসবে, বিক্রেতার রেভিনিউ আসবে। ধীরে ধীরে এভাবেই চাঙ্গা হতে পারে কিন্তু অর্থনীতি। সেদিন এক নামকরা মিষ্টির দোকানে ফোন করে বলেছি, দোকান খুললে দোহাই আপনাদের দরবেশ, সন্দেশ করবেন না। রসগোল্লা, পান্তুয়া আর পনীর ভাজা, ছানাভাজা বানান। কাটতি হবে। আমরা কিনে ফুটিয়ে নেব। তিনি বললেন, "ভালো আইডিয়া দিলেন দিদি। দোকান খুল্লেই ফোন করব। দুধ তো নিতেই পারছি না কারিগরের অভাবে"
আমার একটি এসি খারাপ, ওয়াশিংমেশিনের একটি পার্টস লাগবে। কিচেন চিমনি, গ্যাস, ওয়াটার ফিলটারের সার্ভিসিং এর ছেলেটি পয়লা বৈশাখের আগে আসতে পারেনি। বছরে দুবার আসে ওরা। পুজো আর পয়লা বৈশাখের আগে। এসির মেকানিক আসতে চাইছে রিপেয়ারের জন্য । টাকার দরকার তার। কিন্তু আমি আসতে বলতে পারছি না তাকে। কারণ আবাসনে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। চোখে জল এসে গেল আমার। আমার চাই সার্ভিস। তার চাই কাজ কিন্তু আমি অপারগ। যোগব্যায়ামের ছেলেটি বেতন পেয়েই বলল, কেন দিলেন ম্যাম? আমি তো যেতেই পারছি না। বললাম এ দুমাস তো দেব। তারপর পারব কিনা জানিনা। তোমার চলছে কি করে? বলল যেটুকু জমি আছে বারুইপুরে সেটুকুন চাষাবাদ করছি আপাতত। হতদরিদ্র মালি আসতে চাইছে হেঁটে হেঁটে। বললাম টাকা পাঠিয়ে দেব। এসো না এই গরমে আর ঢুকতেও দেবেনা তোমায়। চিন্তা নেই কাজ থাকবে তোমার। মালী, যোগ শিক্ষক কেউ জরুরী পরিষেবা নয়। কিন্তু এই টেকনিক্যাল মানুষ গুলো? অনেক ভেবেচিন্তে তাই ঠিক করেছি ১৭ তারিখের পরে এসি মেকানিক কে আর চিমনি, ওয়াটার ফিলটার, গ্যাস মেকানিককে (একজনই করে এসে তাই রক্ষে) মাস্ক পরে ঘরে ঢোকাবো আর নিজেরাও মাস্ক পরে থাকব অন্য ঘরে বসে।আর তাদের প্রাপ্যটুকুনির সঙ্গে দুতিনশো বেশী দেব এবার।কতদিন বেড়াতে যেতে পারব না, রেস্তোরাঁয় খেতে পারব না। তারা তো আমার দেওয়া সেই সামান্য টাকায় বাঁচুক আগে। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে, হাত, মুখ, কাপড়চোপড় সাবানে ধুয়ে, নিজে পরিচ্ছন্ন থাকব। এত ভয় পেলে চলবে না আমাদের। দেশের ও দশের ইকনমির কথা ভেবে।

৬ মে, ২০২০

রবিঠাকুর তোমাকে নিয়ে

ন্মের একশোটা বছর পেরিয়ে সালটা ১৯৬১। অভিজাত মহলে তখন রবীন্দ্রচর্চা হয়। গান, কবিতায় শিক্ষা নেয় তাদের ছেলেপুলেরা। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের জমানা তখন। ঠিক হল রবীন্দ্রজন্মোত্সব পালন হবে। শতবর্ষে সরকারী আনুকুল্যে রাজ্যজুড়ে রবীন্দ্রভবন, রবীন্দ্রসদন, রবীন্দ্র নামাঙ্কিত অডিটোরিয়াম হল।সুলভ মূল্যে সম্পূর্ণ রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশিত হল মাত্র ৭৫টাকায়।  এই শতবর্ষ উদ্‌যাপনের হিড়িক হল সর্বত্র। কোচবিহার থেকে কলকাতা সহ প্রতিটি জেলাতেই রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে বেশ উত্সবের মেজাজ তখন। জারি হল সরকারী আদেশনামা। সরকারী আদেশনামা পাবার পর প্রতিটি জেলার বিডিওদের মত কোচবিহারের বিডিও এলাহী অয়োজন করলেন। ঢাক ঢোল পিটিয়ে সর্বত্র প্রচারিত হল যে,  আগামী ২৫শে বৈশাখ রবিঠাকুরের জন্মশতবর্ষ পালনের জন্য নির্দ্দিষ্ট সময়ে, নির্ধারিত স্থানে সব মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হল। ঐ দিন সকালে সেই উত্সবে উপস্থিত হয়ে বিডিও সাহেব দেখলেন, মানুষজনের ঢল নেমেছে। অতএব তাঁর প্রচার সার্থক। সমবেত জনতার সিংহভাগ মহিলা। মনে মনে তিনি খুশি হলেন আত্মতুষ্টিতে। কিন্তু অচিরেই তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হল। বিডিওসাহেবকে দেখেই মহিলারা জনায় জনায় প্রশ্ন করতে লাগলেনঃ 
" কোথায় তোমার ঠাকুর? কোথায় হবে পূজা? আমরা সেই কখন থেকে দুধভর্তি ঘটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এসব ঢালব কোথায়?" 
ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল বিডিও সাহেব তাদের বোঝালেন, এ ঠাকুর তোমাদের পুজো করার ঠাকুর নন।   
এনার পুজোর রকমসকম প্রথাগত পুজোর থেকে ভিন্ন। সেই শুনে উপস্থিত মহিলার দল নিরাশ হয়ে একে একে প্রস্থান করেছিলেন।    কারণ এমন ঠাকুরের  পুজোয় তাঁরা অংশ নিতে চান না। দুদিন পর আনন্দবাজার পত্রিকায় ছবিসহ খবরটি প্রকাশিত হয়। কোচবিহারের এই ঘটনার পর থেকেই নাকি রবি নামক ঠাকুরটিকে অভিজাত সরণী থেকে জনতার দরবারে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু হল সেদিন থেকে। মানুষের মনে তাঁকে স্থায়ীভাবে ঠাঁই দেবার প্রক্রিয়াকরণ আজো অব্যাহত। 
তিনি মিশে গেলেন আমজনতার মাঝে। আকাশেবাতাসে আজ শুনি রবীন্দ্রগানের অণুরণন। রবীন্দ্রকবিতায় আজ সাধারণ মানুষ বিভোর। আমাদের ড্র‌ইংরুম থেকে বেডরুম, গাড়ির সাউন্ড সিষ্টেম থেকে ট্রাফিক সিগনাল, কলেজ ফেষ্ট থেকে নবীনবরণ, চলচিত্র থেকে চালচিত্র সর্বত্র তাঁর অবাধ বিচরণ। কারণ তিনি রবীন্দ্রনাথ।    

তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও মানুষ ছিলেন 
আবদুস শাকুর 
(দীপ প্রকাশন)    

রবিঠাকুর তোমাকে.......

তোমার ভাবনাগুলো আজ আমার সুরে গাইছে । আমার ব্যাথা যখন হানে আমায় তোমার দ্বারে/ তখন তুমিই এসে পথ দেখাও, দ্বার খুলে দাও, ডাকো তারে। ঠিক তখনই ঠাকুর আবারো তোমায় মনে পড়ে।  যখন সেই ছোট্টটি ছিলেম তখন থেকে শুনেছি তোমার নাম । আমাদের পুরোণো বাড়ির সেই তাকের ওপর তোলা ঢাউস রেডিও থেকে, মায়ের কাছে আর স্কুলের রচনার  খাতায় । সেই থেকে হাতে খড়ি ।  তারপর হোঁচট খেয়েছি ব‌ইয়ের পাতায় তোমার সঙ্গে । সাহিত্যের ধারাপাত অধরা তখনো । তারপর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে  মেঘের কোলে রোদ আর রোদের  উঠোনে কথা-কাহিনীর বৃষ্টি মেখেছি। তখন আমি মাধ্যমিক । জীবনস্মৃতি আমার ভালোলাগায়, মন্দলাগায়  আমার হয়ে উঠেছে । নতুন বছর আর বোশেখ মানেই তোমার পথ চাওয়া ।  কালবোশেখির বিকেল গড়িয়ে আমার গীতবিতানের পাতায় গানভাসি সাঁঝ  । আমারো সদ্য টিন-পেরোনো জীবনসিঁড়ি । ওঠানামা , স্কুলের নবীনবরণ, নতুন বর্ষার সবুজ উত্‌সব, আবার তোমার সঙ্গে  যেন মরুবিজয়ের আনন্দ বুকে, তোমার কবিতার বৃষ্টির ফোঁটা নতুন করে গায়ে মেখে। 

অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য্যের সম্পাদনায় “দশজন নারীকে লেখা রবীন্দ্রনাথঠাকুরের শ্রেষ্ঠ পত্রগুচ্ছ এর এক চিঠিতে  পেলাম তাঁর নিজের জন্মদিনেরই  কথা। 

চিঠিটি লেখা কবি অনুরাগী হেমন্তবালা দেবীকে এবং তারিখ হল ২৩শে বৈশাখ :
জন্মদিনের প্রভাতে ঘুম থেকে উঠতেই নানা লোকের কাছ থেকে নানা উপহার এসে পৌঁছ্ত । তখন জীবনের প্রভাতের আকাশ ছিল উজ্জ্বল, স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ; মন ছিল সুকুমার সরস , স্নেহের ছোঁয়া লাগলেই বেজে উঠত মনোযন্ত্রের তার ; তখন জন্মদিনগুলির সমস্ত দিনই গুঞ্জরিত হয়ে থাকত তার রেশ থামতে চাইত না। কারণ তখন পৃথিবী প্রায় ছিল আমার সমবয়সী, পরস্পর এক সমতলে ব‌ইত হৃদয়ের আদানপ্রদানের প্রবাহ; এখনকার জন্মদিন তো আর কাঁচা নয়, কচি নয় ,মন তার সকল প্রত্যাশার শেষসীমায় এসে পৌঁচেছে । সেই আমার অল্প বয়সের ২৫শে বৈশাখের স্নিগ্ধ ভোরবেলাটা মনে পড়ছে ….
শোবার ঘরে নিঃশব্দচরণে ফুল রেখে গিয়েছিল কারা প্রত্যুষের শেষ ঘুম ভরেগিয়েছিল তারি গন্ধে, তার পরে হেসেছি ভালবাসার এই সমস্ত সুমধুর কৌশলে, তারাও হেসেছে আমার মুখের দিকে চেয়ে,
সার্থক হয়েছে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ । 
শোকাতাপা সেই মানুষটির জন্ম হয় বারেবারে আমাদের অন্তরে। তাঁর লেখায়, গানে। 

৩ মে, ২০২০

দিনগোনা কফি






না না সোশ্যালমিডিয়ায় নেট নাগরিকদের তুফান না তোলা অবধি জানতাম না ডালগোনা শব্দটা কোরিয়ার এক জনপ্রিয় টফির নাম থেকে এসেছে। মৌচাকের মত দেখতে এই টফির নাম ডালগোনা। কফির ইতিহাস জানাচ্ছে ভারতেই এই কফির প্রচলন বেশি। একে সবাই "ফেঁতি হুই" বলত।কারণ তুমুল ফেটিয়ে ফেনার মত করে তা বানানো হয়। কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় লকডাউনে ইচ্ছে কফি, হঠাত কফি কিম্বা আবারও কফির জন্য মন উচাটন হয়েই রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে গেছে এই ডালগোনা কফি।অতএব ডালগোনা শব্দ কোরিয়া থেকে আমদানি হলেও ঐ সিঙ্গারার মতই কপি পেস্ট ইন্ডিয়ান কফি ছাড়া আর কিস্যু নয়। আমরা ছোটো থেকেই দেখে এসেছি ইনস্ট্যান্ট কফি এভাবে বানানো। মানে কাপের মধ্যে চিনি, কফি আর একটু গরম জল দিয়ে ফেটিয়ে ফেটিয়ে ক্রিমের মত হলেই ফুটন্ত দুধ বা গরমকালে ঠাণ্ডা দুধ ওপর থেকে ঢেলে কিম্বা কাপের মধ্যে দুধ নিয়ে সেই ফেটানো কফি ফেনার মত ওপরে ঢেলে দিলেই এমন ফ্রদি, টেস্টি কফি তৈরী হতে। 
তা বাপু সে ডালগোনাই হোক, চালগোনাই হোক কিম্বা সর্ষে গোনাই হোক আপাতত এর নাম আমি দিয়েছি দিনগোনা কফি। কারণ এখন আমরা সেই দিনটার দিকে সবাই তাকিয়ে রয়েছি যেদিন সত্যিই আমাদের দেশের তথা রাজ্যের কভিড-১৯ গ্রাফটি ফ্ল্যাট হবে, এবং হতেই থাকবে আর সেই আশায় বুক বেঁধে ততক্ষণ লকডাউনের দমবন্ধ করা বিকেলগুলোতে বানাতেই থাকি এই ডালগোনা কফি। আমি যেমন করে বানাই এই দিনগোনা কফি তার রেসিপি দিলাম।

এর জন্য নেসক্যাফের ১০০ গ্রামের একটা খালি শিশি লাগবে। তিনজনের কফি বানাতে আমি যা যা দিয়ে থাকি...
ইনস্ট্যান্ট কফি পাউডার ২ চামচ
চিনি ২ চামচ
ফুটন্ত গরমজল দুচামচ
ফিলটার কফি ২ চামচ ( যেটি দিয়ে কফিমেকারে দুকাপ জলে ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নি)
ফুটন্ত দুধ ২ কাপ
ওপর থেকে কোকো পাউডার (ছড়ানোর জন্য)

এবার চিনি, ইনস্ট্যান্ট কফি আর দুচামচ গরম জল ঐ শিশির মধ্যে ভরে, ছিপি এঁটে ডুগডুগি বাজানোর মত নেড়েই চলতে হবে... হবে... এবং হয়...গুলে যেতে যেতে দিন বয়ে যায়...মানে ডালের দানা গুনতে যেমন ধৈর্য লাগবে আর কি...এবার শিশির ভেতরে তৈরী হল ফেনা বা ক্রিম বা ফেটানো মিশ্রণ যাই বল।
এবার লম্বা কফির কাপে প্রথমে ব্ল্যাক কফি, তারপর ফুটন্ত দুধ । তারমধ্যে এবার ওপর থেকে শিশির মধ্যে থেকে উজাড় করে টপ আপ কর সেই ক্রিম দিয়ে আর স্প্রিংকল কর উদার হস্তে কোকো পাউডার। এভাবে বানানো দিনগোনা কফিতে আমি খুব মিষ্টি দিই না বলে একটু তিতকুটে হয় কিন্তু টেস্ট হয় ফাটাফাটি।