ছোটবেলায় জ্ঞান হবার পর থেকে আমরা সকলেই দুর্গাপুজোর সপ্তমীর ভোরে মহা সমারোহে ঢাকের বাদ্যির সাথে সাথে গঙ্গায় বা নদীতে “কলা-বৌ” স্নান করানোর আয়োজন দেখি । স্নান করিয়ে সেই কলাবৌটিকে নতুন লালপাড় শাড়ি পরিয়ে মাদুর্গার পাশে রাখা হয় এবং পুজোর পাঁচটাদিন পুজো করা হয় ঐ কলাবৌটিকে । বিসর্জনের দিন প্রতিমার সাথে তাকে ও বিসর্জন দেওয়া হয় । ছোটবেলায় প্রশ্ন করলে বলা হত ওটি গণেশের কলা-বৌ । আদতে গণেশ কিন্তু বিয়েই করেন নি । মা দুর্গাকেই ঐ রূপে পুজো করা হয় । আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে এই কলাবৌটির পুজোটি এই প্রসঙ্গে যথেষ্ট তাতপর্য পূর্ণ । বেদে আছে ভূমি হল মাতা, মৃত্শক্তি যা ধারণ করে জীবনদায়িনী উদ্ভিদকে । আযুর্বেদের ঐতিহ্যবাহী ভারতবর্ষে রোগভোগের প্রাদুর্ভাব ও কিছু কম নয় । এবং মা দুর্গার চিন্ময়ীরূপটি এই কলা-বৌয়ের অবগুন্ঠনেই যে প্রতিস্থাপন করা হয় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । এই কলাবৌকে বলা হয় নবপত্রিকা । নয়টি প্রাকৃতিক সবুজ শক্তির সঙ্গে আধ্যাত্মিক চেতনশক্তির মিলন হয় দেবীবন্দনায় । সম্বচ্ছর যাতে দেশবাসীর রোগ ভোগ কম থাকে এবং দেশ যেন সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠে সেই বাসনায় এই নবপত্রিকাকে দুর্গারূপে পুজো করা হয় । ন’টি উদ্ভিদের প্রত্যেকটির গুরুত্ব আছে । প্রত্যেকটি উদ্ভিদ ই দুর্গার এক একটি রূপ এবং তার কারিকাশক্তির অর্থ বহন করে । এরা সমষ্টিগত ভাবে মাদুর্গা বা মহাশক্তির প্রতিনিধি । যদিও পত্রিকা শব্দটির অর্থ হল পাতা কিন্তু নবপত্রিকায় নয়টি চারাগাছ থাকে । আবক্ষ অবগুন্ঠনের আড়ালে নববধূর একটি প্রতিমূর্তি কল্পনা করা হয় । বাসন্তী এবং দুর্গা এই দুই পুজোতেই নবপত্রিকা অর্চনার নিয়ম আছে । যে ক’টি চারাগাছের সমষ্টিকে একত্রিত করে অপরাজিতার রজ্জু দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকা তৈরী করা হয় সেই নয়টি উদ্ভিদের নাম শ্লোকাকারে লেখা আছে আর এই ন’টি গাছের প্রত্যেকের আবার অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেন
রম্ভা, কচ্বী, হরিদ্রা চ জয়ন্তী বিল্বদাড়িমৌ। অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা ।।
অর্থাত
(১) কলা–ব্রহ্মাণী(শক্তিদাত্রী)
(২) কালো কচু– কালিকা (দীর্ঘায়ুদাত্রী)
(৩) হলুদ– ঊমা( বিঘ্ননাশিনী)
(৪) জয়ন্তী–জয়দাত্রি, কার্তিকী( কীর্তিস্থাপয়িতা )
(৫) বেল–শিবাণী(লোকপ্রিয়া)
(৬) ডালিম–রক্তবীজনাশিনী( শক্তিদাত্রী)
(৭) অশোক–দুর্গা(শোকরহিতা)
(৮) মানকচু– ইন্দ্রাণী( সম্পদদায়ী)
(৯) ধান–মহালক্ষ্মী( প্রাণদায়িনী)
মহাসপ্তমীর সূচনা হয় নবপত্রিকার স্নানপর্ব দিয়ে । নবপত্রিকা দেবীদুর্গার প্রতিনিধি । শ্বেত অপরাজিতা লতা এবং হরিদ্রাক্ত সূতা দিয়ে এই ন’টি উদ্ভিদ একসাথে বেঁধে নদীতে স্নান করানো হয় । দেবীর প্রিয় গাছ বেল বা বিল্ব । নদীতে নবপত্রিকা স্নানের পূর্বে কল্পারম্ভের শুরুতে দেবীর মুখ ধোয়ার জন্য যে দাঁতন কাঠি ব্যাবহৃত হয় তাও আট আঙুল পরিমিত বিল্বকাঠেরই তাছাড়া মন্ত্রে সম্বোধন করে নবপত্রিকাকে দেবীজ্ঞান করা হয় । শস্যোত্পাদনকারিণি দেবী দুর্গা স্বয়ং কুলবৃক্ষদের প্রধান অধিষ্ঠাত্রীদেবতা ও যোগিনীরা দেবীর সহচরী । স্নানান্তে নতুন শাড়ি পরিয়ে তিনটি মঙ্গলঘটে আমপাতা, সিঁদুর স্বস্তিকা এঁকে জল ভরে একসাথে ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ, ঘন্টা এবং উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করে, মন্ডপে মায়ের মৃন্ময়ীমূর্তির সাথে স্থাপন করা হয় । এই তিনটি ঘটের একটি মাদুর্গার ঘট, একটি গণেশের এবং তৃতীয়টি শান্তির ঘট । নবপত্রিকার পূজা একাধারে কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষের বৃক্ষপূজা অন্যদিকে রোগব্যাধি বিনাশকারী বনৌষধির পূজা । মহাসপ্তমীর ভোরে বিল্ববৃক্ষের পূজা, নবপত্রিকা এবং জলপূর্ণ ঘটস্থাপন এর দ্বারাই দেবীপূজার সূচনালগ্ন ঘোষিত হয় ।
“ওঁং চন্ডিকে চল চল চালয় চালয় শীঘ্রং ত্বমন্বিকে পূজালয়ং প্রবিশ।
ওঁং উত্তিষ্ঠ পত্রিকে দেবী অস্মাকং হিতকারিণি”
এঁরাই আবার নবদুর্গা রূপে পূজিতা হ’ন । তাই দুর্গাপূজার মন্ত্রে পাই
“ওঁ পত্রিকে নবদুর্গে ত্বং মহাদেব-মনোরমে”
ভবিষ্যপুরাণে পাওয়া যায়..
"অথ সপ্তম্যং পত্রিকাপ্রবেশন বিধিঃ"
নবপত্রিকাকে জনপদে মঙ্গলের দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে পূজা করা হয় । একাধারে এটি কৃষিপ্রধান দেশের চিরাচরিত কৃষিলক্ষ্মী যা প্রাক্-আর্যসভ্যতার নিদর্শন অন্যাধারে জীবজগতের কল্যাণকর এই উভিদগুলির রোগনিরাময়ক গুণাবলীর জন্য বনৌষধিও বটে । তাই এই ন’টি গাছকে অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে দেওয়ার অর্থ হল জনকল্যাণকর এই উদ্ভিদগুলি যেন রোগ-ব্যাধির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে বা মানুষ যেন এই পুজার মাধ্যমে রোগ ব্যাধিকে জয় করতে পারে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন