তিনি সব্বোঘটে ক্যাঁটালি কলা। তিনি সব কাজ করতে পারেন। তিনি জ্যাক অফ অল ট্রেডস আবার মাষ্টার অফ অল ও। সবেতেই পারদর্শী। তিনি একাধারে আর্কিটেক্ট অন্যধারে প্রোমোটার। একাধারে ইঞ্জিনিয়ার অন্যদিকে কার্পেন্টার। আবার তিনি নাকি ছিলেন ফ্যাশান কাম জুয়েলারি ডিজাইনার । তাঁর আবার অস্ত্রশস্ত্র বানানোর ফ্যাক্টরিও আছে। তাই বুঝি তিনি দেবলোকের স্থপতি, কারিগর, শিল্পী। মর্ত্যে যাকে বলে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার কিম্বা ওয়েল্ডার, বা আর্কিটেক্ট বা পাতি মিস্ত্রী। সমুদ্রমন্থনের একটি অনবদ্য ফলস্বরূপ তাঁর জন্ম। সত্যযুগে যিনি স্বর্গ, ত্রেতায় লঙ্কাপুরী, দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা ও পান্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থের রাজধানী নির্মাণ করেছিল। তিনি যেন ত্রিযুগের পারদর্শী এক স্থপতি। প্রতিবছর ১৭ই সেপ্টেম্বর তাঁর পুজো হয়। কেন হয়? সেদিন নাকি তাঁর জন্মদিন। বিশ্বকর্মাজয়ন্তী বলে অন্য প্রদেশে। একাধারে তিনি ডিজাইনার আবার একাধারে তিনি স্থপতি। দেবতাদের রথ থেকে অস্ত্রশস্ত্র, অলঙ্কার থেকে নানাবিধ ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পের প্রস্তুতকারক। বিশ্বকর্মার চারহাতের একটিতে জলভর্তি কমন্ডলু, অন্যহাতে কুঠার। অপরদুটি হাতে ফাঁসযুক্ত দড়ি এবং বই থাকে। ঠিক যেমন বাস্তব জগতের মিস্ত্রির মত। পুরাণের মতে বাস্তু হল বিশ্বকর্মার পিতা। প্রতিবছর কন্যাসংক্রান্তির দিনে, ১৭ই সেপ্টেম্বর বা ভাদ্রমাসের শেষদিনে তাঁর পুজো হয়। সূর্য সেইদিন থেকে কন্যারাশিতে গমন করে তাই এই সংক্রান্তির অপর নাম কন্যাসংক্রান্তি।
বেদে বলা হয়, বিষ্ণুর সুদর্শণ চক্র, মহাদেবের ত্রিশূল, দেবরাজ ইন্দ্রের বজ্র এবং পুষ্পক রথ তিনি বানিয়েছিলেন। সীতার স্বয়ংবর সভায় যে বিশাল ধনুকটিতে জ্যা পরিয়ে ধনুকটি ভঙ্গ করে রামচন্দ্র সীতাকে পেয়েছিলেন সেই হরধনুটিও বিশ্বকর্মার হাতে তৈরী।
দক্ষিণবঙ্গে বর্ষার পরে সরীসৃপের বাড়বাড়ন্ত হয়। জলে জঙ্গলে মানুষদের কাল কাটানো, বিশেষতঃ সাপখোপেদের সাথে তাদের অহোরাত্র ওঠাবসা। একটু অসতর্ক হলেই বনে জঙ্গলে সাপেকাটার খবর। তাই বর্ষা গিয়ে ভাদ্রের জল থৈ থৈ গ্রামবাংলায় শরতের নীল আকাশের আবাহনে আগমনীর সুর যেন সবে শুনতে পায় গ্রামবাসীরা। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে তারা করে রান্না পুজো। রাঁধে ভাদ্রের শেষ দিনে। আর সেই বাসি খাবার খায় আশ্বিনের প্রথমদিনে। তাদের বিশ্বাস তাদের প্রত্যেকের ঘরের নীচে যে বাস্তুসাপ আছে , যে সারাবছর তাদের বালবাচ্ছাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, যার নজরদারিতে তারা সম্বচ্ছর বেঁচেবর্তে রয়েছে তাকে এবছরের একটা দিন মনে করে পুজো করা। সাপেদের দেবী মা মনসার পুজো এটাই। মা মনসা তুষ্ট করলে তবেই সাপেরা উত্পাত করবেনা। এই তাদের বিশ্বাস। গোবরছড়া দিয়ে রান্নাঘর, উঠোন নিকিয়ে, শুকনো করে, ধোয়ামোছা করে, ঘর রং করে ষোড়শ উপচারে সংক্রান্তির দিন রাতে তারা নতুন উনুনে রান্না করে।
ভাত, তরকারি, ডাল চচ্চড়ি, কচুশাক, ইলিশমাছ, চিংড়িমাছ, চালতার টক, পাঁচ রকম ভাজা, আবার পিঠেপুলি, পায়েস...সব রেঁধে বেড়ে মনসাদেবীকে উত্সর্গ করে তারপর দিন সব ঠান্ডা খাবে তারা। যদি রান্নাবান্নায় কোনো অসংগতি থাকে কিম্বা পরিচ্ছন্নতায় দোষত্রুটি থাকে তবে ঐ দিন মনসাদেবী সাপকে পাঠিয়ে সব খাবার বিষাক্ত করে দেন তাই দক্ষিণবাংলার মানুষদের এই পুজোতে নিষ্ঠা চোখে দেখবার মত।
তারা কাঁটা মনসার ঝোঁপেঝাড়ে এখনো রেখে আসে দুধের বাটি আর কলা। সাথে কিছু রান্নাপুজোর ভোগদ্রব্য। দক্ষিণবঙ্গের মেয়েরা অনেকে আজো বলে আন্নাপুজো। তারা "র" উচ্চারণে অক্ষম। তারা বলে আন্নাপুজোয় পান্না খাওয়া। পান্না হল পান্তাভাত। ভাদ্রের পচা গরমে কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি। তাই বাসিভাতে ঠান্ডা জল ঢেলে রাখার রেওয়াজ। পরদিন ভাত টাটকা থাকবে। আর এই পান্তাও নাকি খুব স্বাস্থ্যকর। সাথে কেউ রাঁধে ডালবড়া, মাছভাজা। কেউ উচ্ছেচিংড়ি, গাঁটিকচুর দম। কেউ আবার মহা উদ্যমে রাঁধে ঘেঁটুফুল ও কচুপাতা বাটা, নারকোল কোরা, সর্ষে-বাটা আর সর্ষের তেল দিয়ে মাখা, সর্ষে দিয়ে কচুর লতি আর শাপলা ডাঁটার ডাল । তবে ডালচচ্চড়ি, কচুরশাক, ইলিশ-চিংড়ি রাঁধতেই হয়। আর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে তারা সেই পঞ্চ ব্যঞ্জন নিবেদন করে মনসা ঠাকুরাণী আর তাঁর চ্যালা নাগনাগিনীদের।
বিশ্বকর্মাপুজোর দিনে এই উত্সবকে বলা হয় অরন্ধন বা রান্না পুজো।
এই বিশ্বকর্মা তথা মনসাপুজোর পর আমাদের আর কোনো উত্সব নেই। আবার সেই শরত্কালের দুর্গোত্সব হবে মহালয়ার পর, সুপর্বে। তখন হবে সুসময়, পুণ্যকাল। আমাদের পরবের দিন শুরু হবে। তাই তো মাদুর্গার অরেক নাম "সুপর্বা"। তাই বুঝি আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, বিশ্বকর্মা পুজো শেষ হল মানেই দুর্গাপুজোর ধুম লেগে গেল হৃদিকমলে। আর হিন্দুদের এই পরব চলবে চৈত্রের সংক্রান্তিতে চড়কপুজো অবধি । পুরণো বছর চলে যাবে আবার নতুন বাংলা সন পড়বে তারপর।
এই দিনে বাংলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উত্সব হল ঘুড়ি উত্সব। সব কলকারখানা বন্ধ বিশ্বকর্মা পুজোর কারণে। সব যন্ত্রপাতি ধোয়া মোছা করে তাদের সম্বচ্ছরি বিশ্রাম ঐদিন। আর তাই বুঝি সেই আনন্দযজ্ঞে মেতে ওঠে ছোটবড় সকলেই। অনাবিল আনন্দ। অফুরন্ত সময় ঘুড়ি ওড়ানোর। শরতের নীল, মেঘমুক্ত আকাশে রং বেরংয়ের ঘুড়ি আর ঘুড়ি। কত রকমের নাম তাদের। কত রং তাদের। দুদিন আগে থেকে ঘুড়ি তৈরী আর সেই সাথে ঘুড়ি ওড়ানোর সূতোয় মাঞ্জা দেওয়া। কাঁচের গুঁড়োর সাথে গদের আঠা মিশিয়ে কড়কড়ে করে সেই মিশ্রণ সূতোয় লাগানো। এ প্রান্তে একটা গাছের গুঁড়িতে সুতো বেঁধে ও প্রান্তে আরেকটা গাছের গায়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাক দিয়ে সুতোয় মাঞ্জা দেবার পালা। তারপর সেই সুতো গুটিয়ে নেওয়া কাঠের লাটাইয়ে। রান্নাবান্না বন্ধ। মেয়েদের আজ জিরেন। আর ছেলেদের মনের সুখে ঘুড়ি ওড়ানো। নীল আকাশে ঘুড়ির মেলা। আর এ পাড়ার টুবলুর দল ও পাড়ার বাপ্পার দল। কে কাকে কাটবে আজ? অসীম আকাশে উভয়েরি ঘুড়ির রাজ্যপাট । কে কার এক্তিয়ার অতিক্রম করে কাকে কাটতে পারে সেই হল গোল। একবার কাটতে পারলেই চীতকার..."ভোকাট্টা....দুয়ো, দুয়ো" আর সাথে সাথেই যারা অন্যপক্ষের ঘুড়ি কাটলো তাদের বাঁশী, কাঁসি, ঢাক, ঢোল পিটিয়ে প্রতিপক্ষকে হিউমিলিয়েট করা। সেই ফাঁকে মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় হাত কেটে রক্তারক্তি। রোদ্দুরে ঘুড়ি উড়িয়ে ছাদ থেকে তরতর করে নেমে গিয়ে ঠান্ডা জলে ঢকঢক। ব্যাস্! সর্দ্দিগর্মি। মায়ের বকুনি। পেটকাটি, চাঁদিয়াল, একতে, দোতে, বাতিয়াল, ঘয়লা, ময়ূরপঙ্খী, শতরঞ্চি, বামুনপেড়ে, রসোগোল্লা, মুখপোড়া, চৌখোপ্পি, জয়হিন্দ... আরো কত নাম সব ঘুড়ির। আর আছে হরেক কিসিমের ঘুড়ির সুতো.. ডেক্রণ, স্পেকট্রা, ডিকট। কাজ সকলের একই কিন্তু কোন্ ঘুড়ি যে কাকে কাটবে ঐদিনে আর কার সুতোয় যে কত জোর অথবা পাড়ার কোন ছেলে সেদিন সবচেয়ে বেশী ঘুড়ি কাটবে আর গলা ফাটিয়ে তার বন্ধুরা তার জন্য চীতকার করবে তা ছিল দেখার মত।
মফঃস্বলে আজো দেখি ঘুড়ির দোকান। কিন্তু নিজের বাড়ির ছাদ তো অপ্রতুল শহরে। তাই শহুরে ছেলেপুলেদের ঘুড়ি ওড়ানোয় সেই মাদকতা চোখে পড়েনা। ঘুড়ির পাতলা, ফিনফিনে রঙীন কাগজের বদলে এখন পলিথিন হয়েছে ঘুড়ির অঙ্গশোভা। আজ সে আমাকে তেমন করে টানেওনা। আর শহরের হাইরাইজের ছেলেপুলের এখন সময়ই বা কোথায় ঘুড়ি ওড়ানোর? সব ফ্ল্যাটবাড়ির ছেলেরা তো একত্র হয়ে মেতে উঠতেই পারে এই ঘুড়ি উত্সবে??
৮টি মন্তব্য:
adhbhut lekha hoeche
thanks Barnik ! Bless you dear!
ঘুড়ির দিন মনে পড়ল l এখন তো বাড়ির গিন্নী l ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াবো তার সুযোগ নেই l আন্নাপুজো আছে মামাশ্বশুর বাড়িতে l আর বিশ্বকর্মা আছেন ক্লিনিকে l আপাতত যাত্রা সেইদিকে l লেখাটা দারুণ স্মৃতিমেদুর l
বাংলার তেরো পার্বণের দিনগুলো এলেই ইন্দিরাদির লেখা পড়ার জন্য বসে থাকি এজন্যই,ভীষণ ভীষণ ভাল লাগে। ~শাশ্বতী সরকার
Khub khub valo laglo...... riddho holam
এখনকার ছেলেমেয়েরা বোধহয় ঘুড়ি ওড়ায় না। একটাও ঘুড়ি দেখছি না আকাশে। আমি ছোটবেলায় ঘুড়ি উড়িয়েছি। মাঞ্জা দিতে গিয়ে হাত কেটেছে বকুনি খেয়েছি। আর রান্নাপুজোর নেমনতন্ন খেতে যেতাম বন্ধুর বাড়িতে দল বেঁধে স্কুলে থাকতে। কী আনন্দে কাটতো!! মৌসুমীগুপ্ত
ভালো লাগল লেখাটা পড়ে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। সব কেমন বদলে যাচ্ছে দ্রুত। মন খারাপ হয় ফেলে আসা শৈশবের উৎসবমুখর দিনগুলোর জন্য। নতুন করে ঘুড়ি উৎসব নতুন আঙ্গিকে মন্দ হয় না।
খুব ভালো লাগলো দিদি। আপনার লেখার টানে পড়তে শুরু করলে শেষ না করা অব্ধি থামা যায় না।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন