কালীপুজোর অমাবস্যার দিনে পশ্চিমবঙ্গীয়দের রীতি দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজো করার। ব্রতকথা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম অনেক কিছু। লক্ষ্মীপুজো করলেই যে অর্থাগম হবে, ঐশ্বর্য্যপ্রাপ্তি হবে এ বিশ্বাস আমি করিনা তবে সব ধর্মের মূল কথা "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর" এই আপ্তবাক্যটি আমি মানি। আর গল্পটি এযুগেও বেশ যুক্তিসম্মত বলে মনে হল। কারণ আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী। ঈশ্বর, মানুষ, পুজোআর্চা এসবকিছুই তো মানুষের মনগড়া। এই অনুষঙ্গগুলি জীবনযাপনের উপলক্ষ্যমাত্র।
দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজো ব্রত কথা
এক
রাজার পাঁচ মেয়ে ছিল। একদিন
সকলকে একত্র করে রাজা তাঁদের
জিগেস করলেন,
তোমরা
কে কার ভাগ্যে খাও?
ছোটমেয়েটি
অত্যন্ত সপ্রতিভ উত্তর দিল।
সে
বলল "মা
লক্ষ্মী খাওয়ান আমাদের।
মানুষের কি সাধ্য যে সে নিজে
খাবে। মানুষতো উপলক্ষ্য মাত্র।
আমরা সকলেই নিজের ভাগ্যে খাই
বাবা"
কন্যার
কথায় রাজা তো অগ্নিশর্মা।
সাথেসাথে তিনি জ্বলে উঠে
বললেন, "রাজার
মেয়ে তাই কিছু বুঝতে পারলিনা।
এ জীবনে অর্থ,
যশ
প্রতিপত্তির জোরেই আমরা সকলে
বেঁচে আছি। ঠিক আছে,
ভালো
কথা। কাল সকালে আমি যার মুখ
আগে দেখব তার সাথে তোর বিয়ে
দেব। তখন দেখব তুই কি করে আর
কার ভাগ্যে খাস"
রাণী
সেই কথা শুনতে পেয়ে প্রমাদ
গনলেন। রাজপুরীতে সকলকে সাবধান
করে দিলেন,
কেউ যেন
পরদিন রাজবাড়ির মুখো না হয়
আর রাজধানীর সব দোকানপাট সব
বেশ বেলায় খোলার পরামর্শ
দিলেন। যাতে রাজার চোখের সামনে
কোনো ব্যক্তি এসে পড়ে। প্রজারা
ঢেঁড়া পিটিয়ে সেই খবর চালু
করে দিল। সেই কথা জানতে পেরে
অন্য একপ্রদেশের গরীব বামুন
তার ছেলেকে সঙ্গে করে চুপিচুপি
রাজ অন্তঃপুরে এসে লুকিয়ে
থাকল সেদিনের মত। পরদিন ঘুম
ভাঙতে রাজার চোখে পড়ল সেই গরীব
বামুনের ছেলেটি। রাজা তাঁর
ছোটমেয়ের বিয়ের আয়োজন করলেন
সেই ছেলের সাথে আর বিদায়বেলায়
মেয়েকে বললেন,
"দেখি
এবার কেমন তুই নিজের ভাগ্যে
খাস!”
গরীব
বামুন রাজকন্যাকে ছেলের বৌ
করে, পুত্র
আর বৌমাকে সাথে নিজের কুঁড়েতে
ফিরে এল। রাজকন্যা স্বামী-শ্বশুরকে
বলে রাখল, যখনি
তারা বাড়ির বাইরে থেকে ঘরে
ফিরবে রাস্তায় যা পাবে তা যেন
কুড়িয়ে নিয়ে আসেন,
খালি
হাতে যেন না ফেরেন। একদিন
বামুন ফেরার পথে রাস্তায় একটি
মরা কালকেউটে পড়ে থাকতে দেখল।
সেটিকে ঘরে এনে রাজকন্যাকে
দেখালো। রাজকন্যা বললে ওটিকে
ঘরের চালে ফেলে রাখুন,
কাজে
আসবে। এবার সেদেশের আরেক রাজার
ছেলে কঠিন অসুখে পড়েছে। রাজবৈদ্য
এসে জানালো কালকেউটের মাথাটা
পেলে তিনি রাজপুত্রকে সারিয়ে
তুলতে পারেন। রাজা ঢেঁড়া
পিটিয়ে খবর করলেন,
যে ব্যক্তি
তাঁকে মরা কালকেউটের মাথা
দিতে পারবে সে যা চাইবে তাই
পাবে।
রাজকন্যা
সেই কথা শুনে শ্বশুরকে বললে,
"ঢ্যাঁড়াদারদের
ডেকে আমাদের ঘরের চালে যে মরা
কেউটে রাখা আছে তার মাথাটা
রাজাকে দিয়ে আসুন তবে তার
বিনিময়ে কিছু চাইবেননা"
রাজবৈদ্য
সেই মরা কেউটের মাথা থেকে ওষুধ
তৈরী করে রাজ্পুত্রকে তা
খাওয়াতে সে সুস্থ হয়ে উঠল।
রাজা মহা খুশিতে বামুনকে ডেকে
পাঠালেন। যাবার আগে রাজকন্যা
শ্বশুরকে বলে দিল যে কার্তিকমাসের
অমাবস্যা তিথিতে রাজধানীর
কোথাও যেন বিন্দুমাত্র আলো
না জ্বলে। এইকথাটুকু রাখলেই
হবে, বিনিময়ে
কিছু চাইনা তাদের। বামুন
সেকথা রাজাকে জানালো। রাজা
বললেন কার্তিকমাসের অমাবস্যায়
রাজধানীতে যেন নিশ্ছিদ্র
অন্ধকার থাকে। যে আলো জ্বালাবে
তাকে দন্ড পেতে হবে।
এদিকে
রাজকন্যা সেদিন নিজে উপোস
করে তার কুঁড়েটি গোবর দিয়ে
নিকিয়ে পিটুলিগোলার আলপনা
দিয়ে ফুলচন্দন-মালা,
ধূপ-ধুনো
দিয়ে যতসামান্য আয়োজনে
মালক্ষ্মীর জন্য ঘট পেতে তাঁর
আগমনের অপেক্ষায় বসে রইল।
ঐদিনে
সর্বত্র ঘোর আঁধার আর রাজকন্যার
কুঁড়েতে প্রদীপের আলো জ্বলা
দেখে মালক্ষ্মী সেখানে অবতরণ
করলেন। তুষ্ট হয়ে নিজের পায়ের
নূপুরটি রেখে গেলেন কমলাসনে।
এরপর যা হয় বামুনের ঐশ্বর্য
আর দেখে কে!
ধীরে
ধীরে তাদের মালক্ষ্মীর কৃপায়
অবস্থা ফিরে গেল। একদিন বামুন
ঠিক করল বাড়ির পাশে একটি পুকুর
কাটাবে। পুকুর প্রতিষ্ঠার
দিনে দলেদলে লোক এল। রাজকন্যা
জানলা দিয়ে হঠাত দেখতে পেল
তার একদা রাজ-চক্রবর্তী
বাপকে। তিনি আজ হতদরিদ্র।
পুকুর খননের কাজে এসেছেন তাদের
গ্রামে। পুকুর খননের কাজ শেষ
হলে রাজকন্যা সকলকে খাওয়ালে।
দরিদ্র পিতাকে যখন ভাত বেড়ে
দিতে যাবে তখন তিনি কেঁদে
বললেন, আমার
ঠিক তোমার মত একটি মেয়ে ছিল।
এদ্দিনে সে কোথায় আছে,
কেমন আছে
কিছুই জানিনা আমি। রাজকন্যা
বাবার কন্ঠস্বর চিনে ফেলেছে
এর মধ্যে। বাবাকে নিজের পরিচয়
দিয়ে বললে,
বাবা,
তুমি যে
আমায় নিজের ভাগ্য পরীক্ষা
করতে পাঠিয়েছিলে ,
এই দ্যাখো
আমি কেমন এখনো নিজের ভাগ্যেই
খেয়ে পরে বেঁচে আছি। সেই
পরীক্ষার শেষ হয়েছে বাবা।
দরিদ্র বাপ তখন মেয়েকে জড়িয়ে
ধরে বললেন,
তোর কথাই
ঠিক মা, আজ
আমি নিজের অহঙ্কারে সর্বস্বান্ত।
সত্যিই বলেছিলি তুই। মানুষ
নিজের ভাগ্যেই খায়।অর্থ-যশ-প্রতিপত্তি
থাকলেই হয়না রে। মানুষের
ভাগ্যই মানুষকে টেনে নিয়ে
যায়। নয়ত আমি আজ ফকির হয়ে গেছি
আর তুই আজ রাজরাণী!
ঈশ্বরবিধাতাই
সব মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ
করেন।
রাজকন্যা
বললে, "বাবা
এবার থেকে তোমার ঘরে কার্তিকমাসের
অমাবস্যার দিনে লক্ষ্মীপুজো
করো। আবার তোমার হৃত ঐশ্বর্য্য
সব ফেরত পাবে।"
…......
শেষলাইনটি
কতটা সত্যি জানিনা তবে ভাগ্যে
আমিও কিছুটা বিশ্বাসী। আর
তোমরা?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন