১৫ আগ, ২০১১

এ কি হাসিখেলা নাকি প্রমোদের বেলা ?


আমরা মনুষ্যজন্ম নিয়ে পৃথিবীতে এলাম ।  স্বাধীনদেশে জন্ম নিয়ে ভাবলাম কৃতার্থ । সার্থক জন্ম আমার জন্মেছি স্বাধীনদেশে ।  ভুলেও ভাবিনা যে আমরা মানুষ হয়েছি। আমরা নব্য সংস্কৃতির ধারা বহন করছি মাত্র। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণধরা এই আধুনিক নগরসভ্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যন্ত্রমানবের ন্যায় কর্মবীর হয়ে উঠেছি। আমাদের সুদৃশ্য বাহ্যিক রূপোলী মোড়ক দেখলে  ভুল হয় , অভ্যন্তরের রক্তমাংসের মানুষটির এহেন অন্তঃসার শূন্য রূপ ? আমরা পাশ্চাত্যের কাছ থেকে প্যাকেজিং শিখেছি, কিন্তু প্যাকেটের অন্দরমহলে "quality product" পুরতে অক্ষম, সে মানুষই হোক আর জিনিষই হোক।
তৃতীয়বিশ্বের চতুর্থশ্রেণীর নাগরিকদের কাছ থেকে এর থেকে বেশি কিছু   আশা করাই বৃথা। স্বাধীনতার পরবর্তী কালে দেশনেতা সহ আপামর-জনসাধারণ বহুদিনের আকঙ্খিত স্বাধীনতার স্বাদ  উপভোগ  করার  বাসনা জাগল  আর  বেশ কিছু যুগ ধরে তার  স্রোতে গা ভাসিয়ে মুক্ত হবার আনন্দ লুটেপুটে খেতে লাগল । ফলস্বরূপ অল্পদিনের মধ্যেই দেশের অভ্যন্তরে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হল। দেশবাসী এতদিন  ধরে সম্মিলিত ভাবে বিদেশীশক্তির আধিপত্য মানিয়া  মেনে নিতে পারছিলনা |এখন   তারা  ক্ষমতাশীল মুক্ত বিহঙ্গ  হয়ে একসূত্রের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতো দূরের কথা, স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ এবং নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য যা করণীয় তা  নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ফলস্বরূপ মতভেদের বিভিন্নতা এবং দলের বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হল। ভিন্ন ভিন্ন দলের অগণিত মানুষগণের বিচিত্র বুদ্ধি, বিভিন্ন মতামত প্রধান্য  পেতে লাগল।। এহেন অরাজক পরিস্থিতিতে কিছু ক্ষমতাশালী ব্যক্তি 'বাবু' ব্র্যান্ডের তকমা এঁটে  বুক ফুলিয়ে  সমাজের আনাচে-কানাচে ঘুরতে লাগল, কেবলই দলের 'ব্রান্ডেড বাবুদের'  কাছ থেকে  স্বার্থসিদ্ধির আশায়। স্বার্থান্বেষী ব্র্যান্ডেড বাবুরা ধীরে ধীরে দেশের আপামর -জনসাধারণকে 'রাজনীতি' নামক এক ছদ্ম ও অলীক ন্যায়শাস্ত্রের মুখোশ পরিয়ে  দিল এবং ক্ষমতার অপব্যাবহার করে অশিক্ষিত,মূর্খ অসহায় মানুষদের যেমনটি বোঝাল তারা তেমনটি  বুঝল। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ এক সুষুম্না-স্নায়ু অবশ করানো এক নঞর্থক মানসিকতায় পুষ্ট হল।
এদিকে ব্যাপক বিশ্বায়নের ঢেউ আছড়িয়ে পড়ল ভারতবর্ষের তটভূমিতে। প্রাচ্যের মানুষেরা পাশ্চাত্য রূপ পরমহংসের  সভ্যতারূপ দুগ্ধের নবনীটুকু গ্রহণ করতে শিখল না ,কেবল জলীয় অংশটুকু গ্রহণ  করে  ভাবল "কি না হনু"! প্রাচ্যের জলের সঙ্গে পাশ্চাত্যের দুগ্ধের জলীয় অংশটুকুর মিশ্রণে  সমাজের বুকে আরো নিকৃষ্ট সভ্যতার তরল-গরল উদ্-গিরণ হতে লাগল  | প্রতিনিয়তঃ আমরা সেই গরলের আস্বাদ পাই ।
গ্রামের মানুষ এ যুগেও অশিক্ষা ও কুশিক্ষার বাতাবরণে কালাতিবাহিত করছে।। অনেক নিকটবর্তী গ্রামে মানুষ একালেও চিকিত্সার অভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। এমনকি শহরেও বিদ্যালয়,মহাবিদ্যালয় , বিশ্ব-বিদ্যালয় , হাসপাতাল, পথ-ঘাট, সর্বক্ষেত্রে সুচিন্তিত পরিকাঠামো এবং দেখভালের অভাবে ভেঙে পড়ছে ।শিক্ষক অধ্যাপক এবং চিকিত্সক হারাল মূল্যবোধ । অনেক প্রত্যন্ত গ্রামে একালেও প্রাথমিক বিদ্যালয় , বিদ্যুত এ সব বিরল ; স্বাধীনতার আগে এমনটি কি ছিল ? 
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা, নেতাগণের স্বেচ্ছাচারিতা, 'বীরভোগ্যা' বসুন্ধরার সম্পদের যথেচ্ছাচার, সরকারী অর্থের অপব্যবহার ,মানুষের নেতিবাচক মানসিকতা , পূর্বতন নেতার অযোগ্য উত্তরসুরি ....এই ষড়রিপু দেশের মানুষকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে , দেশের অর্থনৈতিক,সামাজিক, নৈতিক সর্বক্ষেত্রে ঘুণ ধরিয়ে  দিল । স্বাধীনমানুষ মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে সভ্য হল। রাজনৈতিক নেতাগণ কেউ চাকরি, কেউ বসতবাড়ি , কেউ পদমর্যাদা ....এইসব মহত্স্বার্থে গণতন্ত্ররক্ষার বৃহত্-কর্তব্যে অবহেলা করলেন । আমরা শিখলাম বহুতল ফ্ল্যাট-কালচার, লেট্-নাইট পার্টি-কালচার , ডিস্কোথেক কালচার । কম্পিউটারাইজেশন হল | শুরু হল কেব্-ল্-টিভি , ইন্টারনেট , মোবাইলফোন  ইত্যাদি অত্যাধুনিক পরিষেবা |  স্বাধীনদেশের কালচার ।  আরো সভ্য হলাম । শিশু হারাল শৈশব।  যৌবনের আগেই অকাল   যৌবনের  নিতে পেরে  যারপরনাই কৃতার্থ হল। শুরু হল সমাজের সর্বস্তরে অবক্ষয়।স্বাধীনতার আনন্দে সমাজে হল বহু নায়ক... পুরুষ নায়ক, স্ত্রী নায়ক, শিশু নায়ক |মানুষ গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে পড়ল এবং নিজেদের মধ্যে কলহ বাধাল ; দেশব্যাপী 'সভ্য' হবার হিড়িক পড়েছে কিনা! কিশোর উপেক্ষা করল কৈশোরকে আর অচিরেই পদার্পণ করল যৌবনে | সহসাগত যৌবনের আস্বাদ গ্রহণ  রে   নবীন প্রজন্ম আগলহীন নব্য-সংস্কৃতির বোরখা পরে নিল; প্রৌঢ়েরা পাত্তা না পেয়ে    কৃতাঞ্জলিপুটে শিঙ ভেঙে বাছুরের দলে প্রবেশ করল | বৃদ্ধেরা উত্যক্ত  হয়ে ব্যাপক বিশ্বায়নের ঊর্মিমালায় খাবি খেতে খেতে বাণপ্রস্থ নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে বাস করতে লাগল। একান্নবর্তী পরিবার বিভাজিত হয়ে   এককোষী পরিবারে পরিণত হল | সমাজের অলিগলি দুষ্কৃতি দুরাত্মাদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হল। এই কি হল স্বাধীনতার ফল?
স্বাধীনতার প্রাক্কালে যখন দেশশুদ্ধ মানুষ যখন প্রাণ  ঢেলে  স্বাধীনতা দিবস উদ্-যাপনে ব্রতী হয়েছে তখন মনে হয় কিসের জন্য তাদের এত উত্সাহ? পাড়ায় পাড়ায় তরুণ-তরুণী স্বাধীনতা পালন করছে, মাননীয় নেতাগণ বীরবিক্রমে কন্ঠনালী ফুলিয়ে গগনভেদী চিত্কার করে   বাতাস ভারী করছেন, প্রচার মাধ্যমগুলি প্রতি পলে পলে স্বধীনতার সংগীত , প্রতি দন্ডে দন্ডে স্মৃতিচারণ , সকালে স্বাধিনতা সংগ্রামের উপর তথ্যচিত্র তো বিকালে ছায়াছবি, প্রদর্শন করছে | কখনো বিরলকেশ ,বর্ষীয়ান নেতাকে বহুকষ্টে উপস্থিত করে  তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা আমাদের পরিবেশন করছেন ,শহীদ-স্মৃতি ফলক শ্বেত-পুষ্পের অবগুন্ঠনে চলে গেছে   , ব্রিগেডের মৃত্তিকা পুষ্পবৃষ্টিতে ছয়লাপ হয়েছে,শহীদমিনারের পাদদেশে লক্ষ মানুষ ভীড় করে  নেতার জ্বালামুখী বক্তৃতা শুনছে, সারাদেশের আকাশে বাতাসে স্বাধীনতার পাঞ্চজন্যের বজ্রনিনাদ অনুরণিত হচ্ছে  তখন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে , কেনই বা এই উত্সব? কি জন্য পেয়েছিলাম স্বাধীনতা? আমরা কি স্বাধীনদেশের যোগ্য উত্তরসুরী?                                  

কোন মন্তব্য নেই: