২১ মে, ২০১৮

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / তথ্যচুরি ভুরিভুরি


গেল গেল রব উঠল। সব ডেটা নাকি উধাও। ফেসবুক থেকে সব তথ্য নাকি চুরি হচ্ছে। এমন কি অ্যান্ড্রয়েড ফোনে লোকেশান অন্  করলেও গুগল আমাদের সব গতিবিধি জেনে যাচ্ছে। জি-মেইল এর প্রত্যেকটি ই মেইলের অ্যালগরিদম নাকি ওরা পড়ে । আর সেই বুঝে আমাকে অ্যাড দেখায়।  হোয়াটস্যাপের প্রত্যেকটি মেসেজ নাকি ফেসবুক কর্তাদের রেকর্ডে থাকে। কি জ্বালা রে বাবা! অথচ আমরা এখন প্রত্যেকেই সোশ্যালনেটওয়ার্কিং সাইটের দলদাস। আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা। তাই বলে আমার একান্ত আপন জীবনপঞ্জীতে নাক গলানোর কে হে তুমি ? কোথাকার হরিদাস পাল ই বা আমি যে আমার সবকিছু ডেটা তোমার নখদর্পণে রাখাটা জরুরী? সেদিন এই নিয়ে একজন ডেটা সায়েন্টিস্ট এর পোস্ট টা মনে রাখার মত । “if you are not paying for the product then you are the product” আর তাই বুঝি এইসব ফ্রি সার্ভিস। যা কিছু ফ্রি তাই সস্তার। কথায় বলে সস্তার তিন অবস্থা। তাই বলে আলাপচারিতার তথ্যও সস্তা। হ্যাঁ, ওদের মারফত তথ্য যখন অবাধে বিকোচ্ছে তখন সস্তা ত বটেই । যত্তসব ধান্দাবাজের কারবারি। ফ্রি তে পাওয়া বলেই এত বাড়বাড়ন্ত ওদের। অতএব  যখনি ফ্রি কোনো পরিষেবা পাচ্ছ তখনি কেয়ারফুল। আমাকে কেন সে দিচ্ছে এই পরিষেবা? নিশ্চয়‌ই বিনিময়ে আমাকে ইউজ করছে। আমাকে মানে আমার প্রোফাইল সম্বলিত ডেটাকে বা তথ্যপঞ্জী কে।

হঠাত সেদিন ঘুম ভেঙে গেল মাঝরাত্তিরে। চোর ঢুকেছে। রাতবিরেতে চোর ঢুকলে চীত্কার করে সিকিউরিটি ডেকে, থানায় ফোন করে কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে পারি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখছি গুগল, ট্যুইটার, ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ এ আমার ডেটা বেস থেকে আমার ডেটাগুলো নিয়ে ওরা কিসব করছে। শুধু আমার নয়। সকলেরি এই প্রবলেম। ইউজারদের তথ্য ভান্ডারে উঁকি দিচ্ছে ওরা প্রতিনিয়ত। শুধু উঁকি নয়। রীতিমত হানা দিয়ে তথ্য চুরি করে বিজনেস অ্যানালিসিস করাই ওদের কাজ। ডেটা পরখ করেন এইসব ডেটা অ্যানালিস্ট রা।  কি করেন ডেটা পরখ করে? মেঘের মধ্যে বসে আছি আমি আর আমার সোশ্যাল নেটের বন্ধুবান্ধবরা। আড্ডা জমে উঠেছে। কেউ ব্লগ লিখছিলাম মনের সুখে। কেউ ইমেইল পাঠাচ্ছি দরকারে। কেউ ফেসবুক অলিন্দে কমেন্টের ফোয়ারা ছোটাচ্ছি। কেউ হোয়াটস্যাপে গুলতানি । আর ডেটা সায়েন্টিস্ট রা আমাদের আড্ডা মহলের প্রলোভন দেখানোর সুযোগে সব ডেটা মাইনিং করে ফেলছে। আসলে এটাই তাদের রুজি রোজগার। থৈ থৈ ডেটা চাই তাদের।
আমরা কি তবে এদের হাতে বিক্রী হয়ে যাচ্ছি প্রতি মূহুর্তে?  
এইসব ছাইপাঁশ ভাবছিলাম আর ঘন নীল মেঘ সমুদ্রে বোঝাই করছিলাম তথ্য। কেউ কবিতা, কেউ গল্প, ভ্রমণবেত্তান্ত, কেউ রাজনীতির কূটকাচালী আর ছবি। তথ্য প্রযুক্তির ভাষায় একেই কয় ক্লাউড কম্পিউটিং। নিজের মেশিনে ডেটা না বোঝাই করে মেঘের মধ্যে মানে ডিজিটাল মেঘ সমুদ্রে থরে থরে ভরে দাও তথ্য। দরকার মত ঘাড় ধরে মেঘের মধ্যে ঢুকে বের করে নাও তোমার ডেটা। সবই ত ক্লাউড কম্পিউটিং।  ওরা জানছে। আর সেইজন্যেই তো আমাকে টার্গেট করে সুতীক্ষ্ণ বিজ্ঞাপন দেখিয়ে প্রভাবিত করছে। ক্লিক করলেই রেভিনিউ পাচ্ছে। ব্যাবসার প্রোটোকল। ধরুণ আমি একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের পোষাক পচ্ছন্দ করি। ফেসবুকে ঢুকলেই তাদের রঙচঙে সেই বিজ্ঞাপনে ক্লিক করি। আর সেই সুযোগ নেয় ওরা। যতবার আমি ফেসবুকে ঢুকি সেই বিজ্ঞাপন ওরা আমাকে দেখাতে বাধ্য। ই কমার্সের সুযোগ নেব কি নেব না সেটা অন্য কথা।জিনিষটি কিনলে লাভ সেই কোম্পানির।কিন্তু এক ক্লিকেই তথ্য প্রযুক্তির কৌশল "আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স' প্রযুক্ত হল আমার ওপর। এ আই এর চোখ ঘুরছে অহোরাত্র। ফেসবুক ইউজারের ক্লিক ক্লিক মানেই তাদের ফেসবুক থেকে রেভিনিউয়ের ঝুড়ি উপচে ওঠা। এই ত সুযোগ মুরগী করার।
আসলে "ব্যাবসার জাল পাতা যন্ত্রজালে, কখন কে ধরা পড়ে তলে তলে'  
এর সঙ্গে রয়েছে  গরগরে প্রলোভনে পা দেবার তথ্যচক্র। তোমার প্রিয়, প্রিয়তর, প্রিয়তম বন্ধু কে,  মানের ক্রমানুসারে উঠে আসবে মাত্র একটি ক্লিকে। তুমি যাকে যত বেশী মেসেজ কর সে প্রিয়তম হতে বাধ্য। যার ছবি বা স্টেটাস আপডেটে নিয়মিত কমেন্ট কর সে প্রিয়তর আর যার পোষ্ট কেবল বুঝে বা না বুঝে লাইক মেরে পালাও সে থাকছেই প্রিয়র তালিকায়। জানো কি? 
আরো আছে। তুমি কোন বলিউড সুন্দরীর মত দেখতে অথবা কোন সেলিব্রিটি কে তোমার সবচেয়ে পছন্দ, শচীন না সৌরভ এসব জানতে চেয়েও ফাঁদে ফেলা যায়। একটাই উদ্দেশ্য কাজের ফাঁকে মুঠোফোনের এক ক্লিকে ফেসবুক বা গুগল আইডি দিয়ে লগ ইন, দেন স্টার্ট(ওদের কাছে তোমার ডেটা পৌঁছচ্ছে কিন্তু)। আর তারপর বিন্দাস! উতল হাওয়া। ঝলমল করে উঠল চিত্ত। উত্তর দেখে চমকিত আমি ও তুমি। আর মাঝখান থেকে ওদের ডেটা কালেকশান আর তারপর মাইনিং বা হান্টিং যাই বল।
মেঘের কোলে বসে ভাবছিলাম আবারো। তবে কে আমি ? বা আমার মত নগন্যের এহেন ডেটাবেস? হাতে স্মার্ট ফোন, কোলে ল্যাপটপ, ব্লগ লিখছি আমি। হাত নিশপিশ ক্লিকের জন্য। কিন্তু আর নয়। ক্লাউডে ভাসছে সব ডেটা। ওরা খুঁড়ে ফেলছে ডেটার খনি। ফেসবুকের নীল স্ক্রীনে আমার চোখ। মেঘের আড়াল থেকে বিভীষণ যুদ্ধ করেছিলেন না? আমিও তাই করি? নক্ষত্রপুঞ্জ ধেয়ে আসছে আমার দিকে। মহাস্থবির গ্রহেরা হাঁ করে গিলছে আমাকে।  সতর্কবাণী তাদেরঃ বুঝেসুঝে চলো হে! কেয়ারফুল্! তাই বলে কেয়ারলেস নয় কিন্তু'
 আমি কি তবে চুরি হয়ে গেলাম? ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে দেখি ধুস্! আমার মত নগন্য পাবলিকের গোলাপ না পলাশ কি প্রিয় জানতে চেয়ে প্রশ্নবাণ আবারো ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আমি এড়িয়ে যাই এবার। কারণ কয়েক বছর আগেই  নীল রং না লাল রং সেটা সাধারণ লোকেদের কাছে জানতে চেয়েই ক্ষুদ্রতর স্বার্থ বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিপন্ন হয়েছিল। সে ডেটা হান্টিং ছিল নীল পার্টি না লাল পার্টির পক্ষে না বিপক্ষে জানার কৌশল। আর তলে তলে আমেরিকার ভোটযুদ্ধে ফেসবুক ইউজারদের রাজনৈতিক প্রেম কোন দলে সেই তথ্যটুকুনি ওরা কাজে লাগিয়ে নিল সুকৌশলে। অর্থাত ভোটদাতারা প্রভাবিত হল এভাবেই। বিজ্ঞাপনের দ্বারা। এবার বুঝুন আপনি। কি করবেন। 
যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

কোন মন্তব্য নেই: