- কে এই মহিষাসুর? কিভাবেই বা তার জন্ম?
মহিষাসুরমর্দ্দিণি দুর্গা বৃত্তান্তের খলনায়ক হলেন অপরাজেয় দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ মহিষাসুর।
বরাহপুরাণের মতে বিপ্রচিত্তি নামক দৈত্যের মাহিষ্মতী নামে একটি মেয়ে ছিল। ছোট মেয়ে খেলার ছলে সিন্ধুদীপ নামে এক তপস্যারত ঋষির সামনে গিয়ে মহিষীর বেশে তাকে ভয় দেখাতে লাগল। ঋষির তপস্যাতো লাটে উঠল। ক্রুদ্ধ ঋষি ছোট মেয়েটিকে তখন “তাহলে মহিষীই হয়ে যাও” বলে অভিশাপ দিলেন। সেই মহিষীরূপী মাহিষ্মতীর গর্ভে যে পুত্রসন্তান হল তার নাম মহিষাসুর।
কালিকাপুরাণে বলে মহিষাসুর হল রম্ভাসুরের পুত্র। প্রবল ক্ষমতাশালী রম্ভাসুর মহানন্দে এক সুন্দর মহিষীকে বিবাহ করে। বিবাহ করে ফেরার পথে আর এক অসুরের দ্বারা রম্ভাসুর নিহত হয় আর তার নবপরিণীতা স্ত্রী কিছুদিন পর জন্ম দেয় মহিষাসুরের। যে কিনা মহাদেবের আরাধনা করে দেবীর সাযুজ্যলাভের বর লাভ করে। কঠোর তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মার কাছ থেকে অমরত্ব পায় । ব্রহ্মা যেমন মহিসাসুরকে অমরত্ব দিলেন তেমনি বললেন একমাত্র নারীশক্তির দ্বারাই এই মহিষাসুর বধ হবে।
একের পর এক বরলাভের পর এই মহিষাসুরের দাপট ক্রমশঃ বাড়তেই থাকে।
পুরাণ আর শাস্ত্রের পাতায় আমরা দেখি আবির্ভূতা হতে এক অসামান্যা নারীর যিনি একহাতে বরাভয় অন্যহাতে তুলে নেন অস্ত্র। দশপ্রহরেণ সেই দেবীশক্তির হাতে পরাজিত হন মহিষাসুর। এবার দেখা যাক এই দেবীশক্তির রহস্যের পেছনে কোন্ ঘটনা ছিল।
- মেধাঋষির মুখে মহামায়ার উত্পত্তি সমূহ আখ্যান : কিসের বলে মাদুর্গার এত শক্তি?
মহিষাসুর তখন অসুরগণের রাজা। দেবতাদের বলে অমরত্ব লাভ করে তার বিশাল প্রতিপত্তি। অত্যাচারী মহিষাসুর তখন দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ঠিক করেছে । স্বর্গ তার পাখির চোখ। যেনতেনপ্রকারেণ দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গরাজ্য তার দখলে আনতেই হবে। একশো বছর ধরে যুদ্ধ করে স্বর্গরাজ্য নিজের করায়ত্বে আনল সে। দেবসেনাবাহিনী পরাজিত হল আর মহিষাসুর হল স্বর্গের রাজা। দেবতাগণ একত্র হয়ে বিষ্ণু ও মহাদেবকে সঙ্গে নিয়ে প্রজাপিতা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হল। একজন অসুরের কাছে তাঁরা কি করে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন সব কাহিনী জানালেন ব্রহ্মাকে। দেবতাদের মুখে মহিষাসুরের দ্বারা এমন লাঞ্ছনার ঘটনা শুনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেব যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলেন। তাঁদের মুখমন্ডল থেকে এক মহাতেজ নির্গত হল। হিমালয় অঞ্চলে ঋষি কাত্যায়ণের আশ্রমে সেই মহাতেজ থেকে জন্ম নিল এক দেবী। আশ্বিনমাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে তাঁর আবির্ভাব হল আর ঋষি কাত্যায়ণের আশ্রমে জন্ম বলে তাঁর নাম হল কাত্যায়ণি। এই দেবীর শরীরের এক একটি অংশ এক একজন দেবতার তেজে তেজোপ্রাপ্ত হল।
শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশপাশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ, চন্দ্রের তেজে কুচযুগ, ইন্দ্রের তেজে শরীরের মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরুদ্বয়, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের অঙ্গুলিসমূহ, এবং কুবেরের তেজে তৈরী হল উন্নত নাসিকা। অষ্টাবসুর তেজে তার হাতের আঙুল তৈরী হল। দক্ষাদি প্রজাপতিগণের তেজে তাঁর দন্তসকল এবং বহ্নির তেজে দেবীর ত্রিনয়ন সৃষ্টি হল। সন্ধ্যাদেবীদ্বয়ের তেজে ভ্রূযুগল ও বায়ুর তেজে উত্পন্ন হল কর্ণদ্বয় । দেবী এরূপে তেজসম্ভূতা হলেন কিন্তু মহিষাসুরকে বধ করবার জন্য তো তেজই যথেষ্ট নয়। তাই সকল দেবতারা এই দেবীকে অসুর বধের জন্য নানাবিধ দিব্যাস্ত্র যোগাতে লাগলেন।
- কোন্ কোন্ দেবতারা মাদুর্গাকে কি কি অস্ত্র দিয়ে মা'কে "সায়ুধা"(আয়ুধ-অস্ত্র) করলেন?
- মহাদেব তাঁর স্বীয় শূল থেকে সৃষ্ট একটি ত্রিশূল দিলেন ।
- বিষ্ণু তাঁর সুদর্শণ চক্র থেকে সৃষ্ট চক্র দিলেন।
- বরুণ দিলেন শঙ্খ ও নিজের পাশ থেকে তৈরী করে আর একটি পাশ।
- অগ্নিদেব দিলেন শক্তি।
- পবনদেবতা দিলেন একটি ধনুক ও দুটি বাণপূর্ণ তূণীর ।
- দেবরাজ ইন্দ্র দিলেন বজ্র ও ঐরাবত নামক স্বর্গের হাতির গলদেশের ঘন্টা থেকে ঘন্টা তৈরী করে দিলেন ঘন্টান্তর।
- মৃত্যুরাজ যম দিলেন কালদন্ড।
- প্রজাপতি ব্রহ্মা দিলেন একটি রুদ্রাক্ষের মালা ও কমন্ডলু।
- দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দিলেন কুঠার ও নানাপ্রকার অস্ত্র ও অভেদ্য কবচ।
- সূর্যদেব দেবীর লোমকূপে তাঁর তেজরাশি সমর্পণ করলেন।
- কালের দেবতা দিলেন একটি উজ্জ্বল ধাতব ঢালও প্রদীপ্ত খড়্গ।
- ক্ষীরসমুদ্র দিলেন পদ্মের মালা, হাতে দিলেন পদ্মফুল এবং নানাবিধ অলঙ্কার যেমন, মুক্তামালা, দিব্যচূড়ামণি, কর্ণকুন্ডল, হাতের বলয়, ললাটভূষণ, বাজু, নির্মল নূপুর, অত্যুত্তম কন্ঠহার ও সমস্ত অঙ্গুলিতে শ্রেষ্ঠ অঙ্গুরীয়।
- হিমালয় দিলেন দেবীর বাহন সিংহকে।
- কুবের দিলেন একটি সুরাপূর্ণ পানপাত্র।
- নাগরাজ বাসুকি দিলেন একটি মহামণিশোভিত নাগহার।
এইরূপে দিব্য আয়ুধে দশভুজা দেবীমূর্তি সজ্জিত হয়ে উঠলেন। এবং প্রস্তুত হলেন সেই মহাসংগ্রামের জন্য।
যেহেতু ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর দেবাসুর-দানবের অবধ্য হলেও স্ত্রীবদ্ধ হবে তাই বুঝি ঋষি কাত্যায়ণ সকল দেবতার তেজ এবং ক্রোধানলের শক্তি ও দিগন্তব্যাপী সংহত তেজ দিয়ে তৈরী করলেন এই কাত্যায়ণীকে।
গভীর গর্জণে আকাশবাতাস ধ্বনিত হল। দেবীর সিংহনাদে দশদিশি কম্পিত হল। পৃথিবী ও পর্বতসকল বিচলিত হল। দেবগণ সানন্দে সিংহবাহিনী দেবীর জয়ধ্বনি দিলেন। মুণিগণ দেবীর স্তব শুরু করলেন। অসুরগণ ত্রিলোকবাসী দেবতাদের উদ্দেশ্যে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ধেয়ে এল। যুদ্ধ শুরু হল প্রবল।
বিন্ধ্যপর্বতে এই তিলোত্তমা দেবী মহামায়া বা কাত্যায়ণি সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে অচিরেই বধ করলেন মহিষাসুর নামক দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ ঐ দৈত্যটিকে। আর এই মহিষাসুরকে বধ করে দেবীর অপর নাম হল মহিসাসুরমর্দ্দিণি ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন