২৩ মার্চ, ২০২৩

ইটান্ডা

 






বর্গি এল দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে? 


এই বর্গি কারা ছিল? তাদের এত ভয় পাওয়ারই বা কী কারণ? 


অষ্টাদশ শতাব্দীর কুখ্যাত এবং দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী মারাঠা হানাদার এই বর্গি। ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত দশ বছর ধরে বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে নিয়মিতভাবে লুঠতরাজ চালাত এরা। বীরভূম জেলাও বাদ পড়েনি এদের বীভৎস অত্যাচার থেকে।  

তখন বাংলায় আলিবর্দি খাঁর যুগ। হঠাৎ একদিন বাংলার আকাশে দুর্যোগ ঘনিয়ে এসেছিল। 


আচমকা একদল লুটেরার উৎপাত শুরু হল এ গ্রামেও । রাতের অন্ধকারে একদল লোক টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে হানা দিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে, লোকজনকে মেরে-ধরে তাদের সবকিছু কেড়ে নিল। ভাঙচুর করল।  তাদের অত্যাচারে স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হল। মানুষজন ভয়ে ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ করে দিল।গ্রামবাসীর কাছ থেকে জোরজুলুম করে খাজনা বা কর আদায় করত বলেই সেই ছড়া "বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে" র প্রাসঙ্গিকতা।  


এই দুবৃ‌র্ত্তরাই আমাদের পরিচিত ছড়ার সেই বর্গি। বর্গি শব্দটা এসেছে ফারসি ‘বারগিস’ থেকে, যার অর্থ ‘প্রাচীন মারাঠা যোদ্ধা’। জাতে মারাঠি। হাতে তীক্ষ্ণফলার বর্শা। আসল নিবাস ভারতের মহারাষ্ট্র হলেও দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত জুড়েই ছড়িয়ে তখন তারা। বাংলার সিংহাসনে আলিবর্দি খাঁ আর দিল্লির মসনদে মোগলরা। মারাঠাদের যোদ্ধা হিসেবে বেশ নামডাক তখন। ইতিমধ্যে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মোগলদের সঙ্গে মারাঠাদের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল। কিছু দলছুট বিপথগামী মারাঠা সেনাই একসময় বাংলা জুড়ে শুরু করে দোর্দণ্ড তাণ্ডব।


তাদের আক্রমণ আর যেন কমেই না। তারা বাংলায় এসে পড়লে আলিবর্দি খাঁ সৈন্যসামন্ত বাড়িয়ে তাদের দেশছাড়া করতে আসেন। কিন্তু বর্গিরা সহজে পিছু হটার পাত্র নয়। একের পর এক তারা নতুন আস্তানা গেড়ে একসময় পালিয়ে যায় দক্ষিণে হুগলিতে। 


ব্যবসাবাণিজ্য তখন লাটে ওঠার জোগাড়, মানুষ না খেতে পেয়ে মরার পথে। বর্গিদের দস্যুবৃত্তি কে ন্যায়দম  খাওয়াতে নবাব হিমশিম। অতঃপর দেনাপাওনার চক্করে একপ্রকার কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করেই কিন্তু বাংলা থেকে ওদের দূর করতে হয়েছিল। প্রায় এক যুগের ত্রাসের অবসান ঘটেছিল তারপর। 


জেলা আমাদেরই বীরভূমি। মহকুমার নাম বলিপুর যার থেকে হয়েছে বোলপুর আর তার অনতিদূরেই প্রত্যন্ত ইটান্ডা গ্রাম। ইটান্ডার করুণ ইতিহাস রয়েছে। প্রায় চারশো বছর আগে বর্গী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই গ্রাম।  গ্রামের বেশীটাই বাজারপাড়ায় মানে বহুকাল আগে একটা বাজার ছিল হয়তবা। এখন আর নেই। আমরা পৌঁছে গেলাম প্রান্তিক থেকে পালিতপুরের রাস্তায়। গুগল ম্যাপই সেখানে ভরসা। স্থানীয় মানুষজন কে জিগেস করলে সদুত্তর মেলে না। অথচ ম্যাপ দেখাচ্ছে পঞ্চরত্ন শিব মন্দির, বিষ্ণু মন্দির, কালী মন্দির। তাই যেনতেনপ্রকারেণ পৌঁছতেই হবে। অতটা পথ এসে তো আর ফিরে যাব না বিফল মনোরথ হয়ে। অকস্মাৎ লাল তাগা পরিহিতা এক বঙ্গললনার আবির্ভাব। তিনি সধবা না বিধবা না হতবান্ধবা তা জানিনা। খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুক্ষুসুক্ষু মহিলা  জানালেন, আরেকটু এগিয়ে গেলেই একটা পেরাইমারি ইশকুল পড়বে। তার পাশ দিয়ে গেলেই দেখতে পেতে পারেন। মানে তিনিও বেশ কনফিডেন্ট নন। আশ্চর্য! সেখানকার বাসিন্দা বলেই তো মনে হল তাঁকে। একটু গাইড করতেও আপত্তি? মানে বুঝলাম আপনার ঈশ্বরে তেমন বিশ্বাস নেই। তাই মন্দির টন্দিরের ব্যাপারে আগ্রহ খুব কম। আরে আপনি যে বসতবাড়ি থেকে বেরুলেন তখন তার সদরের মাথায় তো দেখলাম জ্বলজ্বল করছে প্রাচীন রাধাকৃষ্ণের খোদাই করা বিগ্রহ। তার মানে ভগবান হয়ত আপনাকে বিট্রে করেছে তাই আস্থা হারিয়েছেন। এনি ওয়ে। আমি এই ইটান্ডার কথা পড়েছিলাম একটি ভ্রমণ গাইডে। পরশপাথর প্রকাশনার  "পায়ে পায়ে বীরভূম" সিরিজের বইটিতে। তা থেকেই আগ্রহ বাড়ে। তারপর সেই ইশকুল ও তার পাশ দিয়ে, ধানের গোলা, খড়ের গাদা, বড় পুকুর পেরিয়ে সোজা মন্দিরময় সেই ইটান্ডায় হাজির হতেই স্থানীয় এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে নমস্কার জানালেন। তাঁর পূর্বসুরী রাষানন্দ সাধু খাঁর তৈরী একের পর এক মন্দির।  পঞ্চরত্ন  শিব মন্দির, দোতলা শ্রীধর মন্দির, বাংলার চালার আদতে বিশাল কালী মন্দির দেখে আমার অবস্থা সেই গুহার  মধ্যে এলাহি ধনসম্পদ দেখে আলিবাবার যেমন হয়েছিল আর কী ! এত সুন্দর টেরাকোটার কাজ! এত অপূর্ব পরিবেশ! হে ঈশ্বর! পঞ্চরত্ন শিবমন্দিরের পাশেই  সম্প্রতি সংস্কার হয়েছে আরেকটি দক্ষিণ মুখী রেখদেউল। প্রবেশ দ্বারের মাথায় খোদাই করা ইন্সক্রিপশনে লেখা ১২২২ বঙ্গাব্দ  বা ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ। সেটির প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় পাইন পরিবার। খিলানের ওপর কৃষ্ণলীলা ও খিলানের ওপর সিংহাসনে উপবিষ্ট রাম সীতা জ্বল জ্বল করছে। নতুন সংস্কার করেছে বটে তবে রঙ চঙ মোটেও ভালো মানায় নি এত সুন্দর টেরাকোটা মন্দিরে। কুলুঙ্গীর মধ্যে অসাধারণ সব মূর্তি এখনো পড়ে আছে কিছু। 

পঞ্চরত্ন মন্দিরটি তার তুলনায় বিশাল। তা সারানোর লোক পাওয়া যাচ্ছেনা জানালেন সেই সাধু খাঁ পরিবারের ভদ্রলোক। এটিও দক্ষিণমুখী আর গায়ে টেরাকোটার কাজ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। গর্ভগৃহে প্রবেশের একটিই দ্বার। নিত্য পুজো হয়। রাষানন্দ সাধু খাঁ প্রতিষ্ঠা করেন ১২৩৫ বঙ্গাব্দে বা ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে। টেরাকোটার নিখুঁত স্থাপত্যে  ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ থেকে মনসা, ত্রিপুরাসুন্দরী থেকে  রাম সীতা, কালী, গরুড়ের পিঠে চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি দেখলে হতবাক হতে হয়। দশাবতারের কূর্ম, বামন বা মৎস্য অবতার এখনো নজর কাড়ে। পোড়া মটির এত সূক্ষ্ম শৈলী সে যুগেও? কিছু কিছু নষ্ট হয়েছে তবে এখনো অনেকটাই অক্ষত। মন্দিরের বাইরের চাতালে একটি বিশাল পালকি নজর কেড়ে নিল। পাশে দোতলা শ্রীধর নারায়ণের মন্দিরটিও দারুণ। তবে রক্ষণাবেক্ষণ না করলে কালের স্রোতে মিশে যাওয়াটা অসম্ভব নয়। পায়ে হেঁটে কিছুদূর এগুতেই দেখি সব মন্দির কে টেক্কা দেওয়া জোড়বাংলা কালী মন্দির। মূল মূর্তির বদলে নতুন মূর্তি কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির মন্দিরের গন্ধ পেলাম যেন। মন্দিরের নিলয় অলিন্দে, কুলুঙ্গি, স্তম্ভে আবারো অসামান্য সব টেরাকোটার কাজ। ঘোড়ায়  চড়ে মানুষের শিকার তো ঘোড়সওয়ার, যুদ্ধযাত্রায় রণতরীর সজ্জা অসাধারণ। কৃষ্ণ বলরাম থেকে শুম্ভ নিশুম্ভ দলনী দেবী, সেনাবাহিনীর কুচ কাওয়াজ, বগলামুখী কালী... এমন কত বলব?  এখন অবিশ্যি এ গ্রামে গোলা ভরা ধান রয়েছে বোঝাই। দেখে চোখ জুড়োয়। মানুষ কে অযথা খাজনার চাপে বুলবুলির ঘাড়ে দোষ দিতে হয়না। তবুও দারিদ্র্য আছে। পুকুর আছে। গোরু আছে। ভেড়াও আছে। আবার কাছেই নার্সিং স্কুলও  হয়েছে বিশাল। 






একদা এ গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যেত অজয় নদ। নৌকো ভাসিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যও হত । মশলাপাতির আড়তদার ছিলেন এই সাধু খাঁ পরিবার। তাই বুঝি এত রমরমা ছিল ইটান্ডা গ্রামে। এত মন্দির টন্দির... খিলান ওয়ালা প্রকান্ড দোতলা বাড়ির ছাদে ছিল সেই শ্রীধর মন্দির। পরে যা নামিয়ে আনা হয় একতলায়। সব ঘটনার জলজ্যান্ত সাক্ষী অজয় নদ। দুর্ভাগ্য হল নদের নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় আজ স্থানীয় লোকেরা বলে কেবলি 'অজয়ের খাত' । যার পাশ দিয়ে বাইক হাঁকিয়ে, স্মার্ট ফোন হাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলে যায় বীরভূমির যুবক। এ গাঁয়ের পথিপার্শ্বে পড়ে থাকে ম্যাগির হলদে প্যাকেট, স্প্রাইটের সবুজ বোতল। মেয়েরা এখনো আদুড় গায়ে পুকুরে নাইতে নামে। 

সাধু খাঁ বাবু জানালেন এই কালীর নাম ছিল এক কালে হাড়কাটা কালী। কারণ এখানে ঘরে ঘরে কারিগরেরা একসময়  হাড় ( সম্ভবত তন্ত্রসাধনা হত কালীমন্দিরে ) দিয়ে নানা রকম গয়নাগাটি ও শিল্পদ্রব্য বানাতেন। 

এ বসন্ত ফুরায়। তার আগেই... ক্রমশই শেষ হয়ে আসছে বীরভূম জেলার সব প্রাচীন দর্শনীয় স্থানগুলি। এখনো বাকী আছে অবিশ্যি কয়েকটা প্রাচীন শিব মন্দির দেখা ও তা নিয়ে লেখা। 

কোন মন্তব্য নেই: