৩০ মার্চ, ২০২৩

শান্তা

হে পিতা দশরথ! 

আজ আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামচন্দ্রের জন্মদিনে এই চিঠি। জানো পিতা? রামের দিদি শান্তা আজো  বিস্মৃত । রামায়ণ পাঠকের প্রিয় কথাকার বাল্মিকী  আমার কথা খুব সামান্য লিখেছেন । রাজশেখর বসুর রামায়ণে শান্তা অনুপস্থিত । অথচ শান্তা তার প্রিয় ভাই রামের দিদি। রামায়ণ পাঠকদের প্রিয় কবি কৃত্তিবাস সাফাই গাইলেন। নাকি লোমপাদ আর তাঁর স্ত্রী বর্ষিণী মানে আমার মা কৌশল্যার বোন নাকি আমাকে দত্তক নিয়েছিলেন। কিন্তু কেন পিতা? আমি কন্যা বলে? 

দেখো পিতা দশরথ, আমি তোমার ঔরসজাতা । কৌশল্যা আমার মাতা। কিন্তু তুমি  আর আমাকে মনে রাখলে কই? আমিই তো সেই ইক্ষাকু রাজপরিবারের প্রথম সন্তান, রাজতনয়া শান্তা। আমি যে মেয়ে তাই আমাকে বিলিয়ে দেওয়া যায়। কী বল? কারণ তোমার বংশের ধারক হবে তোমার পুত্র। কী ঠিক বলছি তো  আমি? আমার জন্মের পরে তাই অযোধ্যায় কোনো সাজো সাজো রব নেই। নেই কোনো আনন্দোৎসব, শঙ্খধ্বনি। সিংহাসনের দাবীদার তো মেয়ে হতে পারেনা। এমনি চলে আসছে। তাই আমি আসায় সন্তুষ্ট হলে না তুমি। তবুও আমি ভূমিষ্ঠ হলাম। রাজা-রাণীর মধুর দাম্পত্যের প্রথম প্রেমের ফসল এক সামান্য মেয়ের মূল্যায়ণ হলনা রাজবাড়িতে, নিজের পরিবারে। আমার পরিচয়, জন্মসূত্র যেন কিছুটা গোপন রইল। পায়েসের বাটি, চূড়াকরণ, অন্নপ্রাশন, আদিখ্যেতা সব শিকেয় তোলা রইল তোমাদের আগামী  উত্তরাধিকারের জন্য। তবুও জন্মপরিচয়ে দশরথ আমার বাবা, কৌশল্যা আমার মা।   

অথচ আমি হলাম গিয়ে বুদ্ধিমতী, বিদুষী, সুন্দরী শান্তা। ব্রাত্য, উপেক্ষিতা  রাজ পরিবারে। কারণ তোমার চাই পুত্র সন্তান। সিংহাসন রক্ষা করবে সে পুত্র। রাজ পরিবারে মন্ত্রী সান্ত্রী, দাস দাসী সবাই বুঝেছিল এই শান্তাকে। কতটা সর্বগুণসম্পন্না হতে পারে এই মেয়ে জানতেন তাঁরা। কিন্তু আমি যতই বিকশিত হতে থাকলাম ততই যেন অবসাদগ্রস্ত হতে থাকলে তুমি। মা কৌশল্যার কিছুটা স্নেহ পেলেও তুমি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলে আমার থেকে। মা এবং মায়ের বাকী তিন সপত্নী কেউই ছেলে দিতে পারছে না তোমায়। সেই চিন্তায় তোমার রাতের ঘুম গেল। তারপর? সবাই জানে সে ঘটনা। কোথা থেকে যেন খবর পেলে তুমি।

পিতা, সেদিন আমি ভগ্ন হৃদয়। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি। তোমার পরম বন্ধু লোমপাদের কাছে দান করে  দিয়েছিলে আমায়। সবার মুখে সেদিন কুলুপ। 

 বোধহয় লোমপাদই জানালেন তোমায়। ছেলে হবার কৌশল। ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির খবর । তিনি করবেন পুত্রেষ্টি যজ্ঞ। তা করলে আমার চার মায়েদের নাকি কোল আলো করে পুত্র সন্তান আসবে। কিন্তু তারপর? সেই মুনির নাকি যজ্ঞের আগে প্রয়োজন নারী সঙ্গের। সেখানে আমাকে দিব্য কাজে লাগালে তুমি আর আমার পালক পিতা লোমপাদ । বালিকা বয়সেই মুনির সঙ্গে বিয়ে দিলে তোমরা । মুনির সঙ্গে আমার সহবাস হল। তৃপ্ত হলেন মুনি। তোমার কন্যা শান্তার স্বামী ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিই সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে সপরিবারে শান্তাকে সঙ্গে নিয়ে অযোধ্যায় এসে প্রথমে অশ্বমেধ যজ্ঞ, তার পরে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন। যে যজ্ঞের প্রসাদ খেয়ে শান্তার ভাইদের জন্ম হল শান্তার পয়েই। 

 একটা নয়, চার চারটে ছেলে পেলে তুমি। রাজপ্রাসাদের জীবন চিরকালের মত ছেড়ে শান্তার শুরু হল আশ্রমিক জীবন। আমি হলাম গিয়ে মুনিপত্নী। আর পুত্রলাভের আনন্দে তখন বানভাসি অযোধ্যা। আমাকে কেউ আর মনে রাখেনি। রাজ পরিবারের চাহিদা মেটাতে আমি এসেছিলাম আবার হারিয়েও গেলাম অনাদরে, অবহেলায়। 

হ্যাঁ, পিতা, আমি তো দন্ডকারণ্যে ওদের বনবাসে গিয়ে তোমার পুত্র এবং পুত্রবধুর খোঁজখবর নিতে দেখা করে এসেছিলাম। আমার সুলক্ষ্মণা, সাধ্বী, সুন্দরী ভ্রাতৃবধূ সীতার সঙ্গে সভ্য ননদিনী সুলভ আচরণও  করে এসেছিলাম।আমিই তো ওদের অনসূয়া আর অত্রিমুনির আশ্রমে নিয়ে গেছিলাম।  

আজ খুব মনে পড়ছে ভাইকে। ভায়ের জন্মদিনের সেই শ্লোক? বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে বসে সেই যে রামায়ণী পাঠকদের তুলসীদাস লিখলেন? ভাইয়ের গুণগান করে। অথচ দেখ তিনিও আমায় ভুলে গেলেন। 

"নৌমী তিথি মধুমাস পুনীতা 

সুকল পচ্ছ অভিজিত হরিপ্রীতা 

মধ্য দিবস অতি সীত ন ঘামা 

পাবন কাল লোকবিস্রামা।।" 

চৈত্র মাস মধুমাস। তার শুক্লা নবমী তিথি। ঈশ্বরের প্রিয় অভিজিত মুহূর্তে দুপুরবেলায় নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায়,  মানুষের   আনন্দদায়ক এক পবিত্র সময়ে জন্মেছিল আমার ভাই, রামচন্দ্র। 

কোশল দেশের শোভা, তোমাদের পুত্র রামচন্দ্র। কী অপূর্ব রূপবান সে! সর্বাঙ্গে সুলক্ষণ চিহ্নিত। পেটে ত্রিবলী রেখা, গভীর নাভি, প্রশস্ত স্কন্ধ, উন্তত ললাট, আজানুলম্বিত দুই বাহু, শাঁখের মত গ্রীবা, নীল পদ্মের মত চোখ, কুঞ্চিত কেশরাজি আর? কত কত বলব আর ?  চাঁদের কিরণের মত ভায়ের দন্তরুচিকৌমুদী ছড়িয়ে পড়ে চারিদকে। ভায়ের নখ, আঙুল, চিবুক, পক্ক বিম্বের ন্যায় ওষ্ঠ দেখে রাজ জ্যোতিষী বলেছেন বীরের সমস্ত লক্ষণ ভায়ের দেহে।

মিটেছে তো পিতা ? তোমার মনে সেই পুত্রের হাহাকার চিরকালের মত মিটেছে আশাকরি। বশিষ্ঠদেব  ঠিকই আদেশ দিয়েছিলেন কী বল? পুত্রেষ্টি যজ্ঞ না করলে কী আর তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্রের জন্ম হত?  


ইতি 

তোমার পয়মন্তী  শান্তা    


কোন মন্তব্য নেই: