২৪ মার্চ, ২০২৩

মুলুক শ্রীপাট / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 


প্রাচীন শিব মন্দির 


শ্রীপাট বলতে বোঝায় বৈষ্ণব মহাপুরুষদের জন্মভূমি বা ভজনস্থান বা লীলাক্ষেত্র।গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক ঘটনার তীর্থক্ষেত্র হল এই শ্রীপাট। সারা বাংলার বিভিন্ন জেলা জুড়ে রয়েছে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর স্মৃতি বিজড়িত এমন তীর্থক্ষেত্র। শ্রী চৈতন্য ভাগবত রচয়িতা বৃন্দাবন দাসের শ্রীপাট রয়েছে বর্ধমান জেলার দিনেশ্বর বা দেনুড় গ্রামে। তেমনি রয়েছে এই জেলায়  মহাপ্রভুর পদধূলি ধন্য বৈষ্ণব তীর্থ অম্বিকা কালনা শ্রীপাট। রয়েছে এই জেলার কন্টকনগর বা কাটোয়ার ঘাটকুড়ি শ্রীপাট। যেখানে নীলাচল যাবার পথে মহাপ্রভু কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে সপার্ষদ এই ঘাটকুড়ির ন'পাড়া গ্রামে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এখন সেটি কেতুগ্রামের  ঘাটকুড়ি বিশ্রামতলা শ্রীপাট নামে পরিচিত। ঠিক তেমনি বীরভূমের অন্যতম বৈষ্ণব তীর্থ ক্ষেত্র হল শ্রীপাট মুলুক।  

এবার আসি মুলুক প্রসঙ্গে।পদকর্তা  বৃন্দাবন দাস তাঁর চৈতন্য ভাগবতে অম্বিকা কালনাকে উল্লেখ করে এভাবে বলেছেন... 

‘এই মতে সপ্তগ্রামে অম্বয়া মুলুকে।/ বিহরেন নিত্যানন্দ পরম কৌতুকে।’ অর্থাৎ মুলুক মানে গ্রাম বা স্থান বোঝায়। 




তমাল গাছ 


সেই মন্দির যেখানে রয়েছে মহাপ্রভুর বিগ্রহ 


বোলপুর থেকে মাত্র  চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে বোলপুর-পালিতপুর রাস্তার ধারেই এই ছোট্ট গ্রাম মুলুক শ্রীপাট।  সবুজ এই গ্রামখানি তমাল গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায় গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর পদধূলি ধন্য। সম্ভবত বীরভূমের প্রথম শ্রীপাট। প্রচুর অলৌকিক কাহিনী শোনালেন স্থানীয় মানুষ, অধ্যাপক, গবেষক। রামকানাই ঠাকুরের বংশধর। এই রামকানাই ঠাকুরই মন্দির গড়ে মুলুক গ্রাম টিকে প্রতিষ্ঠা করেন। ভর ভরন্ত তমালগাছ বসন্তের ফুলে, কচি পাতায় টইটুম্বুর। সেগাছে কখনো ফল ধরে না। অর্থাৎ কর্মফলের কথা মাথায় রেখে বুঝি গাছ বিস্তার লাভ করেনি এখানে। আশ্চর্যের কথা হল বেদির নীচে তমালের ডালপালা লুটিয়ে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে কিন্তু গরু ছাগল ভুলেও সেই পাতা খেতে আসছে না। তমাল গাছের এমন সুশীতল ছায়া আছে বৃন্দাবনে। তাই বীরভূমের মানুষ এই মুলুক শ্রীপাট কে গুপ্ত বৃন্দাবন বলে আঁকড়ে পড়ে থাকেন। তো এই রামকানাই ঠাকুর এখানে বৈষ্ণব মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। মাটি খোঁড়া শুরু হল। মাটির নীচে পাওয়া গেল এক চতুর্ভুজা দেবী মূর্তি। রামকানাই মাথায় করে তাঁকে অপরাজিতা দেবী রূপে প্রতিষ্ঠা করলেন তমাল গাছের পাশেই। অর্থাৎ বৈষ্ণব মন্দিরে ঢোকার আগেই  শক্তির আরাধ্যা কে প্রণাম জানিয়ে প্রবেশ করতে হবে ভক্তি অঙ্গনে। কুলুঙ্গীতে রাখা সেই মূর্তি। দর্শন হল না। তিনি মহা জাগ্রত। ঘেরাটোপের মধ্যে তালা বন্ধ সেই কুলুঙ্গী। যতবার চুরি করে পালিয়েছে কেউ ততবারই এসে আবারো পরিত্যাগ করে সেখানেই ফেলে রেখে গেছে তাঁকে। তিনি যে অপরাজিতা। কেউ জিততে পারবে না তাঁকে। ব্যাবসায়িক কাজেও মন্দির গড়ে নিত্য পুজো পাঠেও ভয় পান বুঝি মানুষ। 

আরো আছে এমন গল্প। তমাল গাছের পাশে বিশাল বৃক্ষের নীচে লেখা থেকে জানলাম তা। সেকালে ভোগ রান্নার হাতা খুন্তি ছিল না। গাছের ডাল দিয়েই উনুনের রান্না ঘেঁটে দেওয়ার চল ছিল। রান্নার পর সেই ডাল পুঁতে দেওয়া হত মাটিতে আর সেই সব ডাল থেকে গাছ বেরিয়ে প্রকান্ড রূপ আজ। ভাতকাঠি বলা হয় এই গাছের ডাল কে। 

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পরে এই কৃষ্ণাঙ্গন এক অন্য মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে ছিল। বাংলার ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র হিসেবেও মুলুকের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তবে শ্রীপাট মুলুকের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে ‘জলন্দার গড়’-এর কাহিনি। যা আজ জলুন্দি গ্রাম নামে পরিচিত।


বৈষ্ণবদের কৃষ্ণলীলার রস আস্বাদনের কেন্দ্র হিসাবে উন্মোচিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে। জলন্দার গড় বা জলুন্দি ছিল তেমনি স্থান ।চৈতন্যদেবের অন্যতম প্রিয় পার্ষদ ধনঞ্জয় ঠাকুরের বাসভূমি। এই জলুন্দিতেই শ্রীপাট প্রতিষ্ঠা করেন ধনঞ্জয় ঠাকুর। সেটিই জলন্দার গড়ের অনতিদূরেই মুলুক গ্রামের অবস্থান। তবে মুলুকের ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ধনঞ্জয় পণ্ডিতের কনিষ্ঠ ভ্রাতা তথা শিষ্য সঞ্জয় পণ্ডিতের বংশধর রামকানাই ঠাকুর। রামকানাই ঠাকুরের পিতা যদুচৈতন্য আদিকাল থেকেই ছিলেন পরম বৈষ্ণব। মুলুক গ্রামে শ্রীপাটের প্রতিষ্ঠাতাও রামকানাই। 


লেখাপড়ায় মন নেই বালক রামকানাইয়ের। পিতার কাছে  কেবলি জোটে তিরস্কার । তিরস্কারের ভয়ে গৃহত্যাগ করলেন  এবং বৃন্দাবন যাত্রা করবেন ঠিক করলেন। সন্ধ্যাসমাগমে মুলুক প্রান্তরে এসে উপস্থিত হলেন । পথশ্রমের  ক্লান্তিতে  এক বটগাছের নীচে আশ্রয় নেন তিনি । সেখানে অস্তগামী সূর্যালোকে গরুর পাল ও রাখাল বালকের দল দেখে ও তাদের মুরলীর ধ্বনিতে বিভোর হয়ে যান এবং তাঁর অন্তরের মধ্যে জাগ্রত হয়ে ওঠে বৃন্দাবনের কৃষ্ণলীলার স্মৃতি। উপলব্ধি করেন কৃষ্ণপ্রেমের মাহাত্ম্য এবং তারই ফলশ্রুতিতে শ্রীপাট মুলুক আখ্যাত হয় গুপ্তবৃন্দাবন নামে।

রামকানাই ঠাকুর মুলুকে বসবাস করবেন ঠিক করলেন। তাঁর নিজের বাস্তুবাড়ি তৈরি করার উদ্দেশ্যে মাটির সন্ধান করতে করতে পৌঁছে গেলেন  জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে তিনি মাটি খুঁড়তে শুরু করলে বেরিয়ে এল এক দেবীমূর্তি। এই দেবীমূর্তি ছিল চতুর্ভুজা মহিষমর্দিনীর। রামকানাই ঠাকুর সেই দেবী চতুর্ভুজার নাম দেন ‘অপরাজিতা দেবী’ এবং তাকে তিনি নিজ গৃহে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সময় থেকেই শারদ শুক্লপক্ষে সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত দেবীর বিহিত পূজাব্যবস্থা আজও অনুসৃত হয়ে আসছে। এই মহাশক্তির প্রতিষ্ঠার পরেই রামকানাই নিজ নামে এক মহাদেব প্রতিষ্ঠা করলেন । এই মহাদেবই পরে রামেশ্বর রূপে পূজিত হন রামকানাই প্রতিষ্ঠিত দেবী অপরাজিতার এবং রামকানাইদেবের পুজো রাঢ়বঙ্গের বীরভূমিতে বৈষ্ণব ও শক্তিসাধনার বিস্ময়কর সম্মিলনের নিদর্শনরূপে গণ্য হয়ে থাকে।


ইতিহাস বলছে এই মুলুক গ্রামের পূর্ব নাম মল্লিকপুর। পরে সুলতান গিয়াউদ্দিন ইয়ুজের সেনাপতি মুলুক খান তাঁর নিজের নাম অনুসারে মল্লিকপুরের নামকরণ করেন মুলুক। তবে জনশ্রুতি আছে, কোনও এক সময়ে রামকানাই ঠাকুর সুলতান জুম্মা খান কে  ‘মুলুক খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সেই সূত্র ধরেই তাঁর সম্মানে গ্রামটি মুলুক নামে পরিচিত হয়। 

এখানে জনশ্রুতি আছে যে নবাব জুম্মা খাঁ একবার  এসে পড়লেন হঠাত করেই। সঙ্গে তাঁর ৩০০ অনুগামী। তখন অন্নভোগ বিতরণ চলছে। কিন্তু সেই বিশাল অতিথি সমাবেশেও এক গামলা ভাত ফুরোয় নি। সবার কুলিয়ে গেছিল। বিস্মিত নবাব তা দেখে দেবসেবার জন্য প্রায় ৩৬০ বিঘা নিস্কর জমি দিতে চাইলে রামকানাই তা নামমাত্র খাজনায় গ্রহণ করেন। এক স্থানে দাঁড়িয়ে এক মুঠো ভাত তিনি ছড়াতে থাকেন নিজের  এলাকা চিহ্নিত করার জন্য। সেই ভাত যতদূর ছড়িয়ে পড়ে ততদূর অবধি 'ভাতুরার মাঠ' নামে খ্যাত হয়। মুলুক শ্রীপাট থেকে ৩ মেইল পূর্বে এই মাঠ। 

রামকানাই ঠাকুরের মুলুকে আগমন, বসবাস এবং গোষ্ঠযাত্রার স্মৃতি স্মরণে প্রতি বছর গোষ্ঠাষ্টমীতে মুলুককে কেন্দ্র করে রামকানাইদেবের বিশেষ পূজানুষ্ঠান এবং প্রধান মেলা উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই উৎসবে হরিনাম সংকীর্তন, বাউল, নানা ধরনের মন্ত্রপাঠ হয়ে থাকে। প্রভু রামকানাই নবরূপে সুসজ্জিত হয়ে ওঠেন। অষ্টমী থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত মেলার স্থায়িত্ব কাল। সেখানে উৎসব উপলক্ষে নানা ধর্মের, সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম ঘটে। জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসবে মুলুকের রামকানাই মন্দির প্রাঙ্গণে এক বিশেষ ধরনের নারকোল খেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। তা ছাড়াও জ্যৈষ্ঠ মাসে অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন, ঝুলনযাত্রা, রথযাত্রা ইত্যাদি উৎসবগুলিও বিশেষ সমারোহের সঙ্গে পালিত হয়।

রামকানাই মন্দিরের মধ্যে প্রাচীন দালানরীতি লক্ষ্য করা যায়। ছোট ছোট খিলানে সাজানো বারান্দা এবং গর্ভগৃহের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি ছাড়াও গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মূর্তি, নবগোপালের কষ্টিপাথরের অসংখ্য শালগ্রাম শিলা এবং গণেশের মূর্তিও রয়েছেয। মুলুকের মন্দির চত্বরের পাশাপাশি অন্যান্য দর্শনীয় স্থানও স্বমহিমায় চিরজ্জ্বল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অপরাজিতা দেবীর মন্দির, শিবমন্দির সমূহ, ভাতুরার মাঠ প্রভৃতি।

সচ্চিদানন্দন ঠাকুরের সঙ্গে 




কোন মন্তব্য নেই: