৭ আগ, ২০২০

বাইশের সবুজায়ন



ঠাকুরের মৃত্যু হয়না। তিনি চির সবুজ উদ্ভিদের মত। বেঁচে থাকেন আমাদের মধ্যে, আমাদের জীবনে, যাপনে, জন্মে, মরণে। বেঁচে ওঠেন তাঁর লেখায়, গানে, কবিতায় বারেবারে।  

আজ অরণ্যমেধ যজ্ঞের সামিল হয়ে মানুষ যখন পরিবেশ সচেতনতার বাণী আওড়ায় তখন মনে পড়ে বাইশে শ্রাবণের কথা। মরণশীল রবিঠাকুরের মৃত্যুদিন বাইশে শ্রাবণকে তার আশ্রমের বৃক্ষরোপণের দিন হিসেবে ধার্য করেছে বিশ্বভারতী। যেন তিনি ঐ উত্সবের মধ্যে দিয়ে নবজীবন লাভ করেন প্রতিবছর। ১৯৪২ সাল থেকে এমনটি হয়ে আসছে অথচ বিষয়টির ওপর বিশেষ আলোকপাত দেখিনা।  

শ্রাবণের ধারায় সিক্ত মাটিতে উদ্ভিদ তার সঞ্জিবনী শক্তি পায় ও ধীরে ধীরে  মহীরুহে রূপান্তরিত হয়। তাই তার নবীন জীবন বরণের এই উত্সবে কবির গতজীবন স্মরণ-মননের এবং বৃক্ষের নবজীবন বরণের। শান্তিনিকেতনে বিগত এই এতগুলি বছর ধরে কত নামী মানুষের হাতে পোঁতা বৃক্ষের তালিকাসূচি পাওয়া যায় । শ্রাবণ যেন দিনের শেষে যেতে গিয়েও যেতে পারেনা। বাইশেও তাকে নতুন করে ফিরে পাওয়া আমাদের। প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর ছিন্নপত্রে তার উল্লেখ পাই আমরা। 


কবির  কথায় "এই পৃথিবীটি আমার অনেক দিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালোবাসার লোকের মত আমার কাছে চিরকাল নতুন। আমি বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ পূর্বে তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে যখন মাথাতুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করছেন তখন আমি এই পৃথিবীর  নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাস গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলেম।"

বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের সূচনা কবি প্রথম করেছিলেন তাঁর জন্মদিনে। আর কেন এই উত্সব সেই কারণ হিসেবে কবি বলেন" পৃথিবীর দান গ্রহণ করবার সময় মানুষের লোভ বেড়ে উঠল। অরণ্যের হাত থেকে কৃষিক্ষেত্রকে সে জয় করে নিলে, অবশেষে কৃষিক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে হটিয়ে দিতে লাগল। নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্র হরণ করে তাকে নগ্ন করে দিতে লাগল। তার বাতাস হল উত্তপ্ত, মাটির ঊর্বরতার ভান্ডার নিঃস্ব হল।"


এই কথা মাথায় রেখেই বৃক্ষরোপণ বা বনমহোত্সব্ বা তাঁর ভাষায় "অপব্যায়ী সন্তান কতৃক মাতৃভান্ডার পূরণের কল্যাণ উত্সব"।   

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। কবির পরিবেশ বান্ধব মনের কোণে জেগে থাকা কত ইচ্ছে পূরণ হয়নি। তাঁর ইচ্ছেগুলোর সুবিচার হয়েও হয় নি। বিচারের বাণীগুলি নীরবে, নিভৃতে কেঁদেছে। সোনাঝুরির খালপাড়ে কত চাঁদ-সূয্যি উঠে অস্ত গেছে। আশ্রমের আম্রকুঞ্জ থেকে ছাতিমতলা অবধি কত গৃহবাসী দ্বার খুলেছে। কত বসন্ত, কত পৌষ দেখেছে। গোয়ালপাড়া থেকে তালতোড়, ফুলডাঙা থেকে শ্যামবাটিতে কত জনসমাগম হয়েছে। খোয়াইহাটে কত কত কাঁথা বাটিকের পসরা সেজেছে। ভুবনডাঙায় কত টেরাকোটার ঢোলক, নোলক নাড়াচাড়া হয়েছে । কত আউল বাউল উজাড় করে গেয়ে উঠেছেন মন প্রাণ ঢেলে। হৃদমাঝারে তবুও ধরে রাখতে পারলনা তাদের কবিগুরুকে । একরত্তি কোপাইয়ে যে জল সেই জলই রয়ে গেল যেন। আজ তিনিও পণ্য। বসন্ত উৎসবে, পৌষ মেলায় তাঁকে বেশী করে স্মরণ, মনন, তাও নিজেদের স্বার্থে। বৃক্ষরোপণ আজও হয় বাইশে শ্রাবণে তবু আরও সবুজায়ন হয়েছে কি? শান্তিনিকেতনের চারিপাশে আবর্জনার দূষণ কমেছে কি? গুরুকুলে শিক্ষার মান বেড়েছে কি? বিশ্বভারতী তেমন করে কবির ঠাটঠমক আর ধরে রাখতে পারল কই? 



তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও মানুষ ছিলেন, আবদুস শাকুর ( দীপ প্রকাশন্ )