হেমন্তে কোন্ বসন্তেরই বাণী শুনছ কি? অমি কিন্তু শুনছি দিব্যি। ভোরের গোলাপী কুয়াশায় আর সন্ধ্যের হিমঝরা নেশায় আমি শুনতে পাচ্ছি অঘ্রাণের পদধ্বনি। আমার অঘ্রাণের অনুভূতিমালা কখনো বেশ মায়ামাখানো কখনো আবার করুণ। ঠিক যেন তার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার মত। তাই তার পাতাঝরার টুপটাপ শব্দ পেলেই সদা ভয় হয়, তারে হারাই হারাই । এখন ঠান্ডা তো আর পড়েইনা আর এসেই যাই যাই করে। শীতফুলগুলো চোখ মেলে চাইতে না চাইতেই শীত ফুড়ুত। রবীন্দ্রসরোবরের বিদেশী পাখীগুলোর মত শীতও এখন পরিযায়ী আমাদের শহরে। তাইতো তাকে হারিয়ে ফেলি চকিতে। আর যেটুকুনি পাই সেটুকুনি চেটেপুটে নি আহ্লাদে। এ আমাদের সোনার গৌর। একবার চলে গেলে আর তো পাবনা। তাই অঘ্রাণে রাজ্যের বাইরে নৈব নৈব চ। বরং চোখ ফেলে যেটুকুনি দেখা বাকী সেটুকুনি চেঁচেপুঁছে নিয়ে নি।
ওরে ওরে! কলকাতার এত কাছেই সাগরদ্বীপ, বকখালি। যাবি নাকি সুন্দরবন কিম্বা শান্তিনিকেতন? কিম্বা চল বাংলাদেশের সীমানা অবধি, বিভূতিভূষণের স্মৃতিবিজড়িত টাকীতে? আহা! ইছামতীর কি রূপ! নৌকাবিলাসে কি আনন্দ! আর তার টাটকা তাজা মাছের ব্যাঞ্জন? ছেড়ে আসতে মন চায়না। তবুও ফিরে আসতে হয় নিজের ডেরায় । টাকী থেকে আসার পথে পাটালী কেনা হয়েছে বলে কথা! এ পাটালী নাকি বিখ্যাত। মাঘ পড়লেই পিঠেপুলির রসনায় মত্ত হওয়া আমবাঙালীর অবশ্য কর্তব্য। অঘ্রাণে খেঁজুরগাছ ছুলে দিয়ে মাটীর হাঁড়ি বেঁধে দেয় গ্রামের মানুষ। তারপরেই খেজুরগুড়, পাটালী, তক্তি, মোয়ার গন্ধে পাগল আমরা।
অতএব অঘ্রাণ জমে কুলফিমালাই । এ আমার দেশের বিদেশ যেন। কে বলে মকরসংক্রান্তিতেই যেতে হবে সাগরে? কে বলে পৌষমেলার ভীড়েই পৌঁছতে হবে শান্তিনিকেতনে? শীতের আমেজ পাবি, বেড়ানোর আনন্দে যাবি। টেষ্টবাডগুলো লকলক করে বলে ওঠে, তাজা মাছ, কাঁকড়া খাবি সুন্দরবনের? তবে রাতারাতি প্ল্যান। চলো লেটস গো!
যদি ভেসে যায় আদরের শীত?
এই তো কেমন দিন ছোট তার, রাতটা বড়োই বড়।
তবে কি এবার শীত পড়ল, না কি লোকদেখানোয় দড়ো?
শীতের কলকাতার জন্য সারাটা বছর ধরে ঠিক যেন হাপিত্যেশ করে বসে থাকা আমাদের।
কুয়াশার পরত ছিঁড়ে খুঁড়ে আমাদের ঘুম ভাঙে কোলকাতায় । আমি কান পেতে রই । উশখুশ প্রাণ । খবরের কাগজ ছিনিয়ে শীতের কলকাতার কোথায় কি! আজ নন্দনে ছায়াছবি উৎসব তো কাল আইসিসিআর এ চিত্র প্রদর্শনী । একাডেমিতে নাটক কিম্বা মিলনমেলায় টেরাকোটা-ডোকরার সার্বজনীন আবেদনে । মেলায় মেলায় ছয়লাপ মহানগর! খবরের কাগজ হাতে তুললেই শয়ে শয়ে পিকনিক স্পট । এখন আর কেউ চড়ুইভাতি বলেনা । এখন গিয়ে মেয়েদের মাঠেঘাটে রান্নাবান্না করতে হয়না । জমিয়ে কেটারিং হয় পিকনিকে । শুধু চাই একফালি সোনালী রোদের সকাল, নীল আকাশ আর একচিলতে সবুজ খোলা মাঠ । অঘ্রাণে লংড্রাইভ জমে আইসক্রিম আবারো । অমৃত কমলার সকাল ।
পাড়ায় পাড়ায় ব্যাডমিনটন । শুরু এই আঘ্রাণেই । আবার কখনো রাস্তা ব্লক করে বারোয়ারি ক্রিকেট ।
ছোটবেলায় দক্ষিণের বারান্দায় মায়ের পিঠের ভেজা চুল রোদের দিকে মেলা আর সামনে দুহাতে উল কাঁটা ? শীতের এই মিঠে রোদ পিঠে নিয়ে কমলালেবুর দুপুরগুলো ছিল বেশ টেনশনের । কারণ স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার দিনগুলো, ক্লাসে ওঠাউঠির ক্ষণও ঠিক এই সময়েই । শীতের ভালো ও মন্দ, সার্কাস-মেলা কিম্বা চিড়িয়াখানা-চড়ুইভাতি সব নির্ভর করছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের ওপর ।
অঘ্রাণে উত্তরের হাওয়া বইতে শুরু করলেই মনে হয় নজর না লাগে। আমাদের শহরের শীত বড়ই ক্ষণস্থায়ী। তার মধ্যেই কাশ্মীরি শালওয়ালাদের বাড়িবাড়ি ঘুরে বেড়ানো আর ওয়েলিংটনে গোলগাল ভুটিয়ামাসীদের উলের শীতপোষাক নিয়ে পসরা সাজানোর কথা মনে পড়ে যায়। তবে এখন আমাদের তেমন একটা শীতপোষাকের চাহিদা নেই। হালকাপুলকা ট্রেন্ডি শীতবস্ত্র মিলে যায় হাতের কাছের শপিংমলে। তাই জমিয়ে আর কাশ্মিরী শাল, ফিরান অথবা জম্পেশ কার্ডিগান, পুলওভার কেনার সৌভাগ্য হয়না। আর দুটোমাস তো বই শীত। গরম কাপড়চোপড় আবার মথবল এর গন্ধে বাক্সবন্দী হয়ে যায়। তবে শীত যতটুকুনিই থাকুক, শীতের রকমারী সব্জি, উচ্চ হজমশীলতা আর মেলা, পার্টি ইত্যাদির দৌরাত্ম্যে আমাদের গ্যাস্ট্রোনমিক ফূর্তি কিন্তু জমিয়ে চলতে থাকে।
বাঙালীর শীতকাল মানেই একটা কমপ্লিট প্যাকেজ। অঘ্রাণের নতুন চাল, মটরশুঁটি, মূলো, কমলালেবু আর খেজুরের গুড়ের পাটালী দিয়ে মা ঠাকুরঘরে "নতুন" দিতেন। দুধের মধ্যে সব নতুন জিনিস দিয়ে পাথরের বাটিতে ঠাকুরকে নিবেদন করা আর কি! আর পুজোর পর সেই প্রসাদের কি অপূর্ব স্বাদ! তখন মনে হত,
আহা শীতকাল, থাক্না আমার ঘরে। বারেবারে ফিরে আসুক নবান্ন, ঠিক এমনি করে ।
অঘ্রাণের শুক্লপক্ষে "বড়িহাত" করতেন মা। নতুন বিউলির ডাল ভিজিয়ে রেখে শীলে বেটে নিয়ে তার মধ্যে চালকুমড়ো কুরে দিয়ে, হিং, মৌরী সব মিশিয়ে মা অঘ্রাণের রোদে পিঠ দিয়ে ভিজে এলো চুলে বড়ি দিতেন। একটি বড় কুলোর ওপরে পাতলা পরিষ্কার কাপড় বিছিয়ে সুচারু হস্তে এই বড়ি হাত অর্থাত বড়ি দেওয়ার রীতি অনেকেরি আছে। ঝোলে খাবার বড় বড়ি, ছোট্ট ছোট্ট ভাজাবড়ি এসব আজকাল স্মৃতি। আমরা দোকান থেকে কিনে খাই। আর ডালের সাথে পরিবেশিত হওয়া এই ভাজাবড়ির অন্যতম অঙ্গ ছিল কালোজিরে আর পোস্ত। কেনা বড়িতে পাইনা তেমন আর। এই বড়িহাতের দিন দুটি বড় বড়ি গড়ে তাদের বুড়ো বুড়ি করা হত। বুড়ি-বড়িটির মাথায় সিঁদুর আর দুজনের মাথাতেই ধানদুব্বো দিয়ে, পাঁচ এয়োস্ত্রীর হাতে পান, কপালে সিঁদুর ছুঁইয়ে, শাঁখ বাজিয়ে তাদের রোদে দেওয়া হত। একে বলে বড়ির বুড়োবুড়ির বিয়ে দেওয়া।
অঘ্রাণের প্রত্যেক রবিবারে মা-মেয়েরা মিলে করে ইতু ঠাকুরাণীর পুজো। ইতুপুজো হল মিত্র বা সূর্যের পুজো।
মাটি কিম্বা পেতলের সরায় মাটির ঘট পাতা হত। সরার মধ্যে মাটি ফেলে পঞ্চশস্য ছড়িয়ে দেওয়া হত। মন্ত্রবলে পুজো করে ঝি-বৌরা ইতুব্রতকথা পাঠ করত আর সেদিন নিরামিশ খেতে হত। সারাটা অঘ্রাণ মাস ধরে প্রত্যেক রবিবারে ইতুপুজো করে সংক্রান্তির দিনে ইতু ভাসানো হত গঙ্গায়। আর ততদিনে সেই সরার মধ্যে পঞ্চশস্যদানার অঙ্কুরোদগম হয়ে সেই মাটির সরা কি অপূর্ব এক সবুজ সজীবতা পেত । মায়ের সাথে
আমিও বলতাম মায়ের সাথে সাথে...
অষ্টচাল, অষ্টদূর্বা কলসপাত্রে থুয়ে
শোন সবে ইতুর কথা এক মন দিয়ে,
ইতু দেন বর,
ধনধান্যে পুত্রপৌত্রে ভরে উঠুক ঘর।
আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে ইতুদেবীর পুজো বোধহয় দুর্গাপুজোর নবপত্রিকার মত । কৃষির জন্য সূর্যদেবতার অবদান অনস্বীকার্য তাই বুঝি "ইদম্ অর্ঘ্যম্ নমো শ্রী সূর্যায় নমঃ" বলে অর্ঘ্য দেওয়া হয় ইতুর ঘটে। সূর্যদেবতা এবং ইতুদেবী উভয়কেই তুষ্ট রাখা হয়।
গ্রীষ্মের সময় যেমন মঙ্গলচন্ডীর ব্রত হয় অঘ্রাণে আমাদের আছে কুলুইমঙ্গলচন্ডীর ব্রত।
অঘ্রাণমাসের শুক্লাষষ্ঠীতে ব্রতকথা পড়ে জল খেতে হয় । অঘ্রাণ মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে কেন মেয়েরা কুলুই চন্ডীর ব্রত করে মা?
এমন প্রশ্ন জাগত ছোটবেলায় ।
মা শোনাতেন ব্রতকথা আর বলতেন " বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর "
ইতুপুজোর উমনো-ঝুমনো কিম্বা মঙ্গলচন্ডীর আকুলি-সুকুলি সেই চিরাচরিত মেয়েদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে আড়াল করে রাখার গল্প আবার মেয়েদের হাত ধরেই কখনো ইতুদেবী কখনো মঙ্গলচন্ডীকে স্মরণ করে সে যাত্রায় উদ্ধার।
প্রতিবছর অঘ্রাণের ভোরে যখন শীত দরজায় কড়া নাড়ে তখন মনে পড়ে এইসব। পাল্টায়না ব্রতকথার গল্পগুলো। শুধু পাল্টে যায় সমাজের চিত্রকল্পটা। বদলে যায় চরিত্রগুলো। ব্রতের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলে এ যুগেও । সমাজে মেয়েগুলো আজো ব্রাত্য । শীতপোষাকে জানু-ভানু-কৃশাণু তারা শীতের হাত থেকে রক্ষে পাবে বলে।
তবুও প্রকৃতির নির্ঘন্ট মেনে শীত আসে। পালংশাকের ঘন সবুজে, কমলালেবুর ঘ্রাণের মধ্যে দিয়ে। বাঁধাকপির হালকা সবুজের পরতে পরতে শীত খুলতেই থাকে। রঙীন বাজার সরগরম হয় শীতসবজীর রামধনুতে।
বাংলার মেয়েগুলো বাবা-ভাই-স্বামীর মঙ্গলের জন্য বছরের পর বছর ব্রতের উপবাসী হয়ে নতুন অঘ্রাণের ঠান্ডায় পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান করে পুজোর যোগাড় করে কিন্তু তাদের কথা কে মনে রাখে? যারা এই নতুন শীতকে ওয়েলকাম করতে পারেনা? তারাই বা কি করে এই অঘ্রাণে? যে বা যারা পারল না এই অঘ্রাণের অনুভূতিগুলো ভাগ করে নিতে? তাদের বাজারের থলি থেকেও উঁকি দেয় পিঁয়াজকলি কিম্বা হাতে ঝোলানো দিশী ফুলকপি। তাদেরো সাধ হয় একটা দুধের প্যাকেটে একটু সুজি ছড়িয়ে গুড় দিয়ে গরম পায়েস খাবার। কারণ শীত তো বারেবারে আসেনা বছরে।
এইসব অনুভূতিতে পার হয়ে যায় আমার অঘ্রহায়ণ । আমার শীতের সূচনা। শীত আসে, শীত যায়। আমাদের ঘুম ভাঙে কলকাতায়।
সবশেষে আবার রবিঠাকুরের শরণাপন্ন হয়ে বলি, "অঘ্রাণ তবে ফাগুন রহিত ব্যেপে"। অতএব, কিছুক্ষণ আরো নাহয় রহিতে কাছে।
কলকাতা ২৪x ৭ "রোববার"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন