ফুটপাতের ধারে প্রায়ই দেখা যেত কুকুরটাকে।ব্যস্ত নগরের ব্যস্ত পয়েন্ট।সবসময় মানুষের আনাগোনা।যানবাহনের হর্ণ এবং যানযট লেগেই আছে।এই ব্যস্ত পয়েন্টের ফুটপাতের পাশে কুকুরটাকে দেখা যেত।কখনো নিরব নিস্তেজভাবে হাটছে,কখনো লেজমুড়ি দিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শোয়ে আছে,কখনো দৌড়ে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক।গায়ের হলদেটে লোম রাস্তার ধুলা ময়লার আস্তরণের নিচে পড়ে বিবর্ণ হয়ে পড়েছে কিছুটা।তবে কুকুরটার আশ্চর্য সুন্দর দুটি চোখ ছিল।কখনো মনে হত গাঢ় নীল,কখনো বাদামী,কখনো বা ধূষর।চোখের দিকে তাকালে বোঝা যেত অপূর্ব প্রানের স্বতস্ফুর্ত স্পন্দন খেলা করছে কুকুরটির দু চোখে।
সম্ভবত এই অনিন্দ্যসুন্দর নীল চোখদুটো দেখেই সদ্য বিদেশ ফেরত ভদ্রলোক কুকুরটাকে তার নিজ বাড়িতে নিয়ে গেলেন।ভদ্রলোকের কুকুর পোষার শখ ছিল অথবা কুকুরের প্রতি একটা দরদ ছিল তা বলা যায়।তারওপর এই কুকুরটির চোখের সৌন্দর্যে তিনি নিশ্চয়ই বিমোহিত হয়েছিলেন।ভদ্রলোকের কুকুর পোষার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না।বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভাবলেন প্রথমে এর গায়ের নোংরা দূর করতে হবে।তিনি অনেক ভেবেচিন্তে একটি স্বণামধন্য কুকুর প্রসাধনী প্রস্তুতকারক কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করলেন।কুকুরটির আশ্চর্য সুন্দর চোখের কথা বলার পর স্বণামধন্য কুকুর প্রসাধনী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ডগস বিউটি সোপ এন্ড টয়লেট্টিজ লিমিটেড কুকুরটির জন্য বিনামূল্যে সাবান সরবরাহ করতে রাজি হল।কিন্তু এর জন্য কুকুরটির পশ্চাতদেশে ডগস বিউটি সোপ এন্ড টয়লেট্রিজ লিমিটেড এর লেবেল লাগাতে হবে।
বিদেশ ফেরত ভদ্রলোক এতে রাজি হলেন।উন্নতমানের সুগন্ধী সাবানের মাধ্যমে কুকুরটিকে উত্তমরূপে ধৌত করা হল।অতঃপর কুকুরটির পশ্চাতদেশে লিখে দেয়া হল ডগস বিউটি সোপ এন্ড টয়লেট্টিজ লিমিটেড।
ধৌত করার সমস্যার সমাধানের পর দেখা দিল কুকুরের খাবারের সমস্যা।এক্ষেত্রে কুকুরের বর্তমান মালিক অর্থাৎ সেই বিদেশ ফেরত ভদ্রলোক তার এক পরিচিত কুকুরের খাবারের কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করলেন।তারাও কুকুরটির জন্য যাবতীয় খাবার সরবরাহ করতে রাজি হল।তবে এজন্য কুকুরের পেটে তাদের কোম্পানীর লোগো “ডগস হেলথি ফুড লিমিটেড” লাগাতে হবে।
কুকুরের মালিক ভদ্রলোক এতেও সানন্দে রাজি হলেন।কুকুরটিকে পর্যাপ্ত পুষ্ঠিকর খাবার খাওয়ানো হল।তারপর তার পেটে “ডগস ফুড লিমিটেড” এর লোগো সেটে দেয়া হল।
এরপর কুকুরের মালিক বিদেশ ফেরত ভদ্রলোক কুকুরটির স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টি দিলেন।ডগস হেলথ ইন্সটিটিউট তাদের লেবেল কুকুরটির পিঠে লাগিয়ে বিনামূল্যে মেডিকেল চেক আপ করে দিল।
“ডগস আই কেয়ার” নামের কুকুরের চক্ষু বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ঘটিত একটি প্রতিষ্ঠান কুকুরটির চোখের রঙ বদলানো কে একটি মারাত্বক রোগ বলে অবিহিত করলেন।কুকুরের মালিক ভদ্রলোক ঘাবড়ে গিয়ে তাদের কাছে এ রোগমুক্তির উপায় জানতে চাইলে তারা জানাল, তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রস্তুতকৃত জিরো পাওয়ারের সানগ্লাস ব্যবহার করলে কুকুরটি ভাল থাকবে।অতঃপর ডগস আই কেয়ারের লেবেল সাটা জিরো পাওয়ারের সানগ্লাস কুকুরটির অনিন্দ্য সুন্দর চোখজোড়া ঢেকে দিল।
এরপর মাসখানেক ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে কুকুরটির কোন খোজখবর নিতে পারি নি।একমাস পরে ওই বিদেশ ফেরত ভদ্রলোকের বাসায় গেলাম।ভদ্রলোক আয়েশ করে বসে পান করছিলেন।আমাকে দেখেই বললেন,কুকুরটাকে দেখতে আসছেন তো? আসেন। ভদ্রলোক আয়েশী অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে তার বাসার সামনে লম্বা উঠানের মত জায়গাটায় নিয়ে গেলেন।
প্রথমে দেখে আমি কুকুরটাকে চিনতেই পারি নি।এটা যে কোন প্রাণী তা ই ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল।পুরো শরীর জুড়ে বিভিন্ন কোম্পানীর লেভেলিং।মাথায় ডগস ক্যাপের লেভেল লাগানো ক্যাপ,পায়ে ডগস ফুটওয়্যারের লেভেল লাগানো জুতা,পিটে ডগস ওয়েল,পেটে ডগস ফুড,নাকে,মুখে,চোখে প্রায় সবখানেই এরকম ছোট বড় লেভেল লাগানো। বিচিত্র রঙের লাল নীল সবুজ হলুদ রঙের লেভেলের চাপে কুকুরটি জীবিত কি মৃত তা বোঝা যাচ্ছিল না। কুকুরটির আশ্চর্য সুন্দর চোখদুটিও ঢাকা পড়ে ছিল জিরো পাওয়ারের চশমার আড়ালে।
এককালের স্বাধীন এবং দু চোখে প্রাণ প্রাচূর্যে ভরপুর কুকুরটি এভাবেই একটি জীবন্মৃত লেভেলের স্তুপে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
মুরাদুল ইসলাম
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র
[ ১ম পাতায় ফেরত ]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন