১৪ এপ্রি, ২০১১

আমাকে আমার মতো : কল্যাণবন্ধু মিত্র


আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমি কারোর সাতে-পাঁচে থাকি না। আশেপাশে কার ঘরে কি ঘটছে না ঘটছে সে নিয়ে মাথা ঘামাই না।বাজারদোকান,অফিস,ছেলে, মেয়ে, কুকুর, বউ, সিরিয়াল...ব্যস্‌ ,এর বাইরে আর কিছু জানিনা। কারণ আমি আমার মতো থাকতে চাই’। এই হলো আজকের গড়পড়তা মানুষের মনের ভেতরকার ছবি।
আধুনিক কাল আমাদের ‘স্বার্থের জমিটাকে’ এইভাবে ক্রমশঃ ‘ঊর্বর’ করে তুলছে।সেই ঊর্বর জমিতে ‘সবুজ ফসল ফলানো’র ধান্দাবাজি চাপা দেওয়ার ধামা হিসেবে এমন ধাপ্পাবাক্যের কোন জবাব নেই।“আমাকে আমার মতো থাকতে দাও”!
আমার বাবা প্রতিদিনই বাজার যাবার সময় একগোছা পোস্টকার্ড নিয়ে বেরোতেন ডাকবাক্সে ফেলবেন বলে। সে-সব পত্রপ্রাপকদের মধ্যে হাতে গোনা ক’জনের  উত্তর আসতো।যারা  চিঠির প্রাপ্তিস্বীকারটুকুও করে না,পয়সা খরচ করে বারবার কুশলবার্তা জানতে চেয়ে তাদের চিঠি লিখে কি হবে ? কী আশ্চর্য,অতোদিন আগে এই কথার জবাবে বাবা বলেছিলেন , ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’।
মাঝেমাঝে ভাবি, এই মানুষটা সত্যিই যদি  নিজের মতো থাকতেন,তাহলে কী বিপুল সম্পদ-ই না তিনি অর্জন করতে পারতেন!মধ্যবয়সে তার সামনে এসেছিলো এক সুবর্ণ সুযোগ।যে সুযোগ জীবনে একবারই আসে।কিন্তু সুযোগকে “হ্যাঁ” বলার বদলে তিনি সরাসরি “না” বললেন ।কারণ ঠাকুমা তখন পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছেন। বাড়িতে যদিও ঠাকুমা দৃষ্টিহীন চোখেই স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেন সর্বত্র,নিকটজনেরা আসেন তাঁর সাথে গল্প করতে, কিন্তু অচেনা পরিবেশে নির্বান্ধব অবস্থায় তিনি সারাটা দিন কাটাবেন কি করে ?শুধু এই কারণেই সুযোগপ্রাপ্তদের মধ্যে একমাত্র বাবা-ই রয়ে গেলেন কলকাতায়।বাকি জীবনটা কাটালেন পুরানো পদে-ই,অনেক কম বেতন ও সুযোগসুবিধাকে হাসিমুখে শিরোধার্য করে।
নিজের অপরিনামদর্শী ঋণজর্জর ভাইকে পাওনাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে কী পরম মমতায় সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি ,সে তো বারবার-ই দেখেছি।একবার এইরকম পরিস্থিতিতে বাবার নিজেরই টাকার ভাঁড়ার শূন্য,তা-ও তিনি ভাইকে বিমুখ করেন নি,কিভাবে যেন সব সামাল দিলেন।নিজের কষ্টার্জিত অর্থের বিরাট অঙ্ক জলাঞ্জলি দিয়ে ভাইকে সম্মানহানি থেকে বাঁচালেন।তখন এমনটাই হতো।শুধু ভাই কেন,প্রতিবেশীর বিপদেও মানুষ নিজেকে আড়ালে রাখার অভিনব সব কায়দায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে নি।তখনকার যুগের মুখে “আমাকে আমার মতো থাকতে দাও” ধরণের নির্লজ্জ আত্মকেন্দ্রিক-বার্তাময় সঙ্গীত সত্যিই অকল্পনীয় ছিল।স্বার্থপর মানুষ কি তখন ছিল না ? সংখ্যায় কম হলেও তারা সেযুগেও জন্মগ্রহণ করতো।কিন্তু আপন-আপন স্বভাবের জন্য তারা প্রকাশ্যেই নিন্দিত হতো।অমানবিক কাজ অর্থকৌলীন্য দিয়ে ঢাকা যেতো না।   
আমার পারিবারিক গণ্ডিতে দীর্ঘদিন আমিই ছিলাম সবার স্নেহের একচ্ছত্র অধিরাজ। কিন্তু সেই সময় আমাকে আমার মতো করে থাকার শিক্ষা দেওয়া হয় নি। যে কোনো সুখাদ্য অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে খেতে শেখানো হয়েছিলো আমাকে।আজ প্রায় সব ছেলেমেয়ের কানে তার-তার নিজের মতো করে জীবনযাপনের মন্তর দেয়া হচ্ছে ঘরে বাইরে । সেই মন্তর প্রথমে ঘর ভরিয়ে দেয়,ধাঁধা লাগায় প্রাপ্তির চমকে-ঠমকে।তারপর  আসে এক মর্মান্তিক আবিষ্কারের লগ্ন।এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে চলচ্ছক্তিহীন একা নিজেকে দেখার পালা। অন্যরা সবাই,এমনকী আপনজনেরাও তখন যে যার নিজের মতো করে থাকছে ! তাদের আর অন্যদিকে তাকাবার সময় কোথায় ?

কল্যাণবন্ধু মিত্র
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের  বিধি নির্দেশক দফতরের বিশেষ দায়িত্ত্বপ্রাপ্ত অফিসার











[ ১ম পাতায় ফেরত ]

1 টি মন্তব্য:

সংঘমিত্রা বলেছেন...

Kalyanda, apnar lekhata aj abar porlam, ageo porechhi..khub bhalo legechhe amar.