২৮ মার্চ, ২০২০

করোনা পেয়িং ডিভিডেন্ড

(১) 
আলমবাজারে আমার বাবা মা দুদিন ধরে দুধ পাচ্ছিলেন না দেখে ফেসবুকে পোস্ট করতেই বান্ধবী অদিতি সেন চট্টোপাধ্যায় ফোন করে ব্যাবস্থা করতে গেলেন। ওদিকে আমার মা ততক্ষণে রিষড়ায় মাসীর ছেলেকে বলে রেখেছিল ওদিকে এলে দুধ ব্রেড নিয়ে আসতে কারণ রিষঢ়া পুরসভার কাউন্সিলর মাসীর পুত্রবধূ। এবার গতকাল প্রচুর দুধ এধার ওধার থেকে এসে পড়ায় আমার মা নিজেই এখন মাদার ডেয়ারী। অদিতি কে বারণ করলাম এত দূর থেকে লোক পাঠাতে। এবার যেটা হল তা আরো আনন্দের এবং প্রশংসার ও বটে। অদিতিকে মায়ের বাড়ির ঠিকানা ও মোবাইল দিয়েছিলাম। গতকাল থেকে বরানগর মিউনিসিপালিটির কাউন্সিলর নিজে ফোন করছেন। মাসীমা কিছু লাগবে এই বলে। আজ নিজে এসেছিলেন বাড়িতে। বলে গেলেন প্রয়োজন হলে জানাতে। চীন, ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি ভারতেও এমন পরিষেবা কে কে পেলেন বা পাচ্ছেন জানান। করোনার যুগে আবিষ্কার করছি এই দেশে জন্মানোর মাহাত্ম্য।
(২) 
প্রচুর পরিশ্রমের ফলে দেহের অবাঞ্ছিত, অনাকাঙ্ক্ষিত মধ্যপ্রদেশের স্ফীতি বুঝি একটু ন্যায়দম খাচ্ছে।মেপে খাওয়াদাওয়া আর সেই সঙ্গে পরিশ্রম দুয়ে মিলে বেশ চাপে রেখেছে তাকে।
(৩) 
অনেকদিন বাদে বেশ ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছে মা, দিদা, ঠাম্মার কেজো সব রান্না। কাজের লোকেদের হাতে সেসব রান্না বলে করিয়ে নেওয়া যায় না কারণ (১) তখন ফ্রিজে এত আমিষ মজুদ থাকে আর (২) নিজের মাথাতেও আসেনা সেসব
(৪) 
ঈশ্বরকে শুধাই মনে মনে, এভাবেই তবে ঘরবন্দী করে তুমি শেষমেশ দুনিয়ার সব উগ্রপন্থী, নরখাদক, ধর্ষক, জঙ্গি, খুনী, চোরডাকাত, ছিনতাইবাজ সব দুষ্টুদের শান্ত করার উপায় বের করলে? ইন্ডিয়ার ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরো অনুযায়ী অপরাধের মাত্রা এখন মাত্র ৭%। রেপ ভিক্টিম রিপোর্ট নেই !তাই বুঝি উপলব্ধি হয় ঈশ্বরই শাশ্বত এবং চরম সত্য।মানুষ যখন অপারগ তখন উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়া এই ক্রাইম রেটের লেখচিত্র কে তিনিই নিজের হাতে নিম্নমুখী করলেন। এর নাম ধর্মের কল বাতাসে নড়ে ওঠা। নাকি এভাবেই সমাজকে বাঁচানোর জন্য তিনি নিজেই গোকুলে বাড়াচ্ছিলেন এই মারণ ভাইরাসটিকে?
(৫) 
নাস্তিকেরা বিপদে পড়লে আমার মত আস্তিককে বলে তোমার ঠাকুরকে বোলো আমার কথা।
(৬)  
আমাদের বাড়িতে একটা কথা আছে "ঢেউচালানি" বলে মানে যারা আরকি সবসময়ই উঠল বাই তো কটক যাই টাইপ, ঘরে মন বসেনা মোটেও। সেই দলে মাঝেমাঝে আমিও পড়ি আর এখন শুধু ঠাম্মার কথা ভাবছি, মেয়েরা ঘরমুখো হলে সংসারের অনেক কাজ হয়, একথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে কিন্তু। ঘরের কোণে কোথায় ঝুল, বাগানে শুকনো গাছের ডালপালা, ফ্রিজটা অফ করে পরিষ্কার, রান্নাঘরের আনাচকানাচ, বাসনের র‍্যাক, মশলাপাতির শিশি ধোয়ামোছা, একটা করে বইয়ের তাক গোছানো, অবিন্যস্ত আলমারি গুলোর দিকে নজর দেওয়া, বাড়ির সব আয়নাগুলো একদিনে খবরের কাগজ ভিজিয়ে মুছে নেওয়া আর সেই সঙ্গে এখন সদর দরজা আর কলিংবেলে কলিন দিয়ে পরিষ্কার করা..... মানে বাড়িটাকে এই ফাঁকে একটু গুছিয়ে নেওয়া। সবকিছুর একটা ভালো দিক আছে কিন্তু।
(৭) 
এদ্দিন স্বার্থপর মানুষ শুধু দারা-পুত্র-পরিবারের অসুখে প্রার্থনা করত।এখন অপারগ হয়ে সারা বিশ্ববাসীর জন্য ভাবছে।মশাই এর নাম learning process!


(৮) 
প্রকৃতির দূষণ নিম্নমুখী। মানুষ হল পরিবেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই অবলা, সর্বংসহা পৃথিবী আজ মানুষ নামক জীব কে গৃহপালিত করে ঘর বন্দী করেই ফেলেছে। গাড়িঘোড়া না চলায় পরিবেশের দূষণ, ধুলো, ধোঁয়া থেকে মুক্তি। প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছাচারে বিরতি। জঙ্গলের অরণ্যমেধ যজ্ঞ থেকে যত্রতত্র প্ল্যাস্টিক পতন ইত্যাদির মত বিষয় গুলো বেশ ভালো দিক।
(৯) 
সব অনলাইন খাবার সরবরাহকারীরা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘরে বানানো খাবারেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে সারা বিশ্ববাসীকে। শরীরের আপাত ধৌতিকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত। সবাই স্বাস্থ্য সম্মত খাবার খাচ্ছে।পরিমাণে কম খাচ্ছে কাজেই জাঙ্ক ফুডের, ট্রান্স ফ্যাটের রমরমা আপাতত শিকেয় তোলা।
(১০) 
ঘরে বসে, গৃহবন্দী হয়ে মধ্যবয়সী হোমমেকারদের শারীরিক ব্যাথা বেদনা, আর্থ্রাইটিস, গাউট, গেঁটে বাত, কোমরে ব্যাথা, গোড়ালি ব্যাথা, সাইনাস, মাইগ্রেন অনেকটাই কম এ যাবত। তবে ইনসমনিয়া গ্রাস করছে যেটা আমাকেও বেশ কষ্ট দিচ্ছে। ঘুমের ওষুধ খাচ্ছি। রাতে কোকো / ড্রিংকিং চকোলেট দিয়ে দিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ আর বিকেলের দিকে চা কফি আর না খেলে ইনসম্নিয়ার উপশম হয় কিন্তু। তবে মনে পড়ছে আমাদের এক দুঁধে অভিজ্ঞ হাউজ ফিজিশিয়ানের কথা। মা, দিদিমারা বাড়িতে দেখতে এলে হাজার একটা রোগের কথা বলে ওষুধ দিতে বলতেন।ওপরে উল্লিখিত কোনো না কোনো ছোটোখাটো উপসর্গের কথা বলতেন তাঁরা। সেইসঙ্গে ছিল গায়ে হাতে পায়ে জ্বালা অথবা সামান্য চুলকুনি। সেই প্রাজ্ঞ ডাক্তারবাবু মুচকি হেসে বলতেন, এগুলি "হাউজওয়াইফস কমন সিনড্রোম" বলে গড়গড় করে একটা মাল্টিভিটামিন লিখে দিতেন। হোমিওপ্যাথির ডাক্তার দিতেন বিনা ওষুধের চিনির গুলি। এখনকার ডাক্তারবাবুরা বলেন প্রাণায়াম করতে। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে, সেলাইফোঁড়াই করতে, রান্না করতে, ব‌ই পড়তে, গান করতে, বাগান করতে, কবিতা লিখতে। তবেই নাকি মধ্য থেকে প্রৌঢ় হাউজ ওয়াইফরা এই প্রবলেম গুলি থেকে অনায়াসে মুক্তি পাবেন। এসবের কোনো দাওয়াই নেই। প্ল্যাসিবো এফেক্টের কারণে সাদা চিনির গুলিতেও এমন হত আগেকার দিনে। সবটাই ছিল মনের ব্যাপার। আমার একমাস ধরে খুব কষ্ট হচ্ছিল সাইনাসের। সেই সঙ্গে কোমরে ছিল বেদম ফিক ব্যাথা। বলতে নেই, এখন সব গায়েব!!! করোনা পেয়িং ডিভিডেন্ড!  

কোন মন্তব্য নেই: