যম, সংযম, যমুনা, যমজ... আগে কখনো ভাবিনি এই শব্দগুলোর সঙ্গে ভাইফোঁটার কত গভীর সংযোগ। সূর্যপত্নী সংজ্ঞা সূর্যের সঙ্গে সহবাসকালে তাঁর পতির তেজোদৃপ্ত শরীরের ছটা, উত্তাপ, তেজময় বিকিরণ সহ্য করতে না পারায় চোখ বুঁজে রইলেন। ক্রুদ্ধ সূর্যের সংজ্ঞার এহেন সংযম অপছন্দ হল। গালিগালাজ করলেন পত্নীকে! "কোথায় আমার মত পুরুষের সঙ্গে রতিলিপ্ত হয়ে শীত্কারে, আনন্দে চূড়ান্ত সম্ভোগময়ী হবে তা নয় চোখ বুঁজে রয়েছো! সংযম পালন হচ্ছে? ঠিক আছে, আমার ঔরসে তোমার গর্ভের সন্তান হবে আলোকবিহীন অর্থাত ঘোর আঁধারের মত কালো।'
সাহিত্যের ধারাপাতে সংযোজিত হল নতুন শব্দ যার নাম সংযম। আর সূর্যের অভিশাপে সংজ্ঞার একজোড়া কালো পুত্রকন্যা জন্ম নিল যাদের নাম হল যম এবং যমী। ।
সূর্যপত্নী সংজ্ঞা সূর্যের দাপট সহ্য করতে না পেরে পৃথিবীতে ফিরলেন । সেইসঙ্গে তার বিকল্প হিসেবে তার ছায়াকে রেখে এলেন সূর্যের কাছে, দেবলোকে।ব্যাস! সূর্য ছায়ার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হলেন। ছায়ার গর্ভে যখন সূর্যের সন্তান এল তখন সংজ্ঞার পুত্রকন্যা যম-যমীর সঙ্গে ছায়া বৈমাত্রেয় সুলভ ব্যবহার করতে থাকলেন । ছায়ার কুমন্ত্রণায় সূর্য নিজপুত্র যমকে নরকে এবং কন্যা যমীকে মর্ত্যে পাঠিয়ে দিলেন ।
সাহিত্যের অভিধানে একজোড়া সহজাত সন্তানের নাম একত্রে যমজ। সূর্যতনয়া, রবিনন্দিনী, সূর্যজা যমুনার অপর নাম কালিন্দী বা যমুনাও প্রবাহিত হল কালীয় নামক সর্পের বিষোদগারে কালো বর্ণের নদীরূপে । যম হলেন কালদন্ড হাতে নরকে মৃত্যুর দেবতা রূপে।
বহুদিন অতিবাহিত হলে যম এবং যমী উভয়ে একে অপরের বিচ্ছেদে কাতর হলেন। যম দেখা করতে গেলেন যমীর সঙ্গে । আর সেদিনটি ছিল কালীপুজোর দু-দিন পর কার্তিক অমাবস্যার শুক্লাদ্বিতীয়া তিথি যা আজো ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা যমদ্বিতীয়া নামে খ্যাত। ভাইয়ের জন্য যমী নানাবিধ খাদ্যদ্রব্যের আয়োজন করে, উপহার সাজিয়ে নাকি বসেছিলেন তাই ঐদিনে বোনেরা ভাইদের জন্য এভাবেই পালন করে থাকে। কারণ একটাই। ভাইয়ের মঙ্গলকামনায়, ভাইয়ের পরমায়ু কামনায়।
ঋগ্বেদ বলে যম আর যমী মায়ের শরীরের বাইরে এসেও নাকি মাতৃজঠরের একত্র অবস্থানকে ভুলতে পারেনা। তাই যমী যমকে কামনা করে বসেন। বলেন, আমাকে তোমার সন্তান দাও। যম কিন্তু নিরুত্তর। প্রত্যাখ্যান করেন আপন সহোদরা যমীকে।
অথর্ববেদে বলে যমুনা নাকি যমকে বলেছিলেন মায়ের পেটে তো তাঁরা একত্রে দশমাস পাশে শুয়ে ছিলেন অতএব এখনো তিনি সেভাবেই যমকে শয্যাসঙ্গিনী রূপে কামনা করেন কিন্তু যম বোনের মুখে এমনটি শুনে যেন তড়িতাহত হলেন। বলেন, জন্মসূত্রে এক পরিবারের হলে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করা গর্হিত কর্ম।
যদিও প্রাকবৈদিক যুগে ভাই-বোন বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছে তাই যমীর এরূপ ধারণা অমূলক নয়। কিন্তু যম সেই ধারণাকে এক্কেবারে আমল না দিয়ে চলে যান। আজ আমাদের শরীরবিজ্ঞান বলছে ভাই-বোনে বিবাহ হওয়াটা সত্যি সত্যি যুক্তিযুক্ত নয় । ভারত সহ পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে এই বিবাহ চালু ছিল কিন্তু জিনগত সমস্যা এই বিবাহকে নিরাপদ করেনা অনেকাংশেই। সুস্থ মাতৃত্ব আসেনা। এলেও জিনগত ত্রুটি নিয়ে সন্তান আসে তাদের যা পরবর্তী জীবনে দুর্বিষহ। ভয়ানক সব রোগের স্বীকার হয় ভাইবোনের মিলনের ফলস্বরূপ সন্তানটি। সে যুগে এত বিজ্ঞান ছিলনা। ছিলনা হেমাটোলজির পরীক্ষানিরিক্ষা। মানুষ বুঝতনা জিনতত্ত্ব ও জৈবরহস্য। সেই বিয়ের ফলশ্রুতি মোটেই সুখকর হয়নি তাই বুঝি ধীরে ধীরে বিদায় নিয়েছে সহোদর-সহোদরার বিবাহ। সেই প্রাচীন যুগে এক পরিবারের, একই পিতামাতার দুই পুত্রকন্যার বিবাহ হলে হয়ত নিজেদের রক্তের শুদ্ধতা বাঁচিয়ে রাখাটা হত একটিই কারণে। পিতার সম্পত্তি যাতে নিজের পরিবারের মধ্যেই সযত্নে রক্ষিত হয়। কারণ বিবাহ নামক সামাজিক বন্ধন হল সম্পত্তি রক্ষার্থে উত্তরসুরীর উৎপাদন।
কিন্তু রক্তের রসায়ন দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ । এ জটিল তত্ত্ব গবেষণায় উঠে এসেছে। রক্তের শুদ্ধতার পরিবর্তে রক্ত দূষণ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা জানিয়েছে বিজ্ঞান। কিন্তু এ তত্ত্ব জানতেন না যমরাজ। ডারউইনের থিয়োরি অফ ইভোলিউশানে সারভাইভ্যাল অফ দ্যা ফিটেষ্ট বা যে সমর্থ সেই বাঁচবে সেই অনুসারে কালক্রমে ভাই-বোনের এই বিবাহে ভাটা পড়ে গেছে। পরে এসেছে আরো থিয়োরি। রক্তসূত্র ধরে যেমন এসেছে আমাদের বংশগোত্র। এখনো আধুনিক সমাজেও আমরা স্বগোত্রে তাই বিবাহ দিতে কেউ কেউ নারাজ হই। আর তাই বুঝি যমীর ভাইকে বিবাহের আবেদন ও বোনকে বিবাহে যমের এই প্রত্যাখানের লোকায়ত কাহিনীটি প্রচার করে ধীরে ধীরে মর্যাদার আসনে বসানো হয়েছে ভাইফোঁটাকে আর সমাদর করা হয়েছে ভাইবোনের মধুর সম্পর্কটিকে।
যা হয়েছে তা সমাজের ভালোর জন্যেই। যম-যমীর সুস্থতার জন্যেই। আর ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়েছে ভাইবোনের বিয়ে। তাই বুঝি যমী মনকে বুঝিয়ে বলে, যমের অখন্ড পরমায়ু আশা করে। তাকে পেট পুরে তার মনের মত পদ রেঁধেবেড়ে খাওয়াও, তাকে উপহার দাও..শুধু এই বিয়ে থেকে শতহস্ত দূরে থাকো।
কালের স্রোতে ধুয়েমুছে সাফ হল ভাইবোনের যৌনতার গন্ধ মাখা সম্পর্ক। আর ঠাঁই পেল স্বর্গীয় সুন্দর এক অমলিন, পবিত্র সম্পর্ক। যম যমীর ফোঁটা নিয়ে পরম তৃপ্তি পেলেন। আর সমাজ স্বীকৃতি দিল ভাই-ফোঁটা, ভাই-দুজ, ভাই-বীজ, ভাই-টীকা বা ভাই-তিলকের মত পবিত্র উত্সবকে।
পুরাণ এই উত্সবের অন্য ব্যাখ্যা দেয়। কার্তিকমাসের শুক্লা দ্বিতীয়ার দিনে শ্রীকৃষ্ণ দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ নরকাসুর বধ করে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর বিজয়-সম্বর্ধনায় ভগিনী সুভদ্রা যে উত্সবের আয়োজন করেন তার নামই ভাইফোঁটা।
*তাই আবহমান কাল ধরে বোনেরা ভাইদের মঙ্গল কামনা করে ফোঁটা দেয় ভাইয়ের শত পরমায়ু, উন্নতি কামনা করে।
কিন্তু কখনো কি শুনেছি আমরা এর উল্টোটা? অর্থাৎ ভাই তার বোনকে ফোঁটা দিয়ে বোনের সুস্থতা, সুরক্ষা এবং সার্বিক উন্নতি চাইছে? সকালে ধোপদুরস্ত হয়ে মাঞ্জা দিয়ে, ধুতির কোঁচা দুলিয়ে ভাইরা যুগে যুগে বলে এল, "ভাইফোঁটা নিতে যাচ্ছি"। কিন্তু "বোনফোঁটা দিতে যাচ্ছি" ও তো বলতে পারত তারা।
তাই এস আমরা চালু করি সামগ্রিক "ভাইবোনফোঁটা"। দু-তরফের পক্ষ থেকেই ফোঁটা চালু হোক!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ভাইফোঁটা...
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ভাইফোঁটা' অনুষ্ঠানের উষ্ণতা ও আন্তরিকতা খুবই পছন্দ করতেন। তিনি তাঁর ভগিনীদের কাছ থেকে ভাইফোঁটা নেবার সুযোগ থেকে কখনও বঞ্চিত হতে চাইতেন না। সৌদামিনী, শরৎকুমারী, সুকুমারী, স্বর্ণকুমারীর ও বর্ণকুমারী দেবীরা নানা সময়েই দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, সৌমেন্দ্রনাথ প্রমুখ দাদা-দের ভাইফোঁটার দিন ফোঁটা দিতেন এবং সেই পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন রবীন্দ্রনাথও।
স্বর্ণকুমারী দেবী রবীন্দ্রনাথ-কে খুবই স্নেহ করতেন এবং ভালোবাসতেন ও তাঁর আদরের ভাই-কে ফোঁটা দিয়েছেন। স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'গাথা' তাঁর আদরের ভাই 'রবি'কে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন -
"ছোট ভাই'টি আমার
যতনের গাঁথা হার কাহারে পড়াব আর?
স্নেহের রবিটি, তোরে আয়রে পড়াই,
যেন রে খেলার ভুলে ছিঁড়িয়া ফেল না খুলে,
দুরন্ত ভাইটি তুই, তাইতে ডরাই।"
কবি'র জীবনের শেষ ভাইফোঁটার আবেগঘন অনুষ্ঠানের অসাধারণ বর্ননা আছে রাণী চন্দ'র "গুরুদেব" বইটিতে।
"ভ্রাতৃদ্বিতীয়া এল। গুরুদেবের এক দিদিই জীবিত তখন - বর্ণকুমারী দেবী। তিনি এলেন আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিতে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আজও ভাসে ছবি চোখের সামনে - গৌরবরন একখানি শীর্ণহাতের শীর্ণতর আঙুলে চন্দন নিয়ে গুরুদেবের কপালে কাঁপতে কাঁপতে ফোঁটা কেটে দিলেন। দুজন দুপাশ হতে ধরে রেখেছি বর্ণকুমারী দেবীকে। ফোঁটা কেটে তিনি বসলেন বিছানার পাশে চেয়ারে। ভাইয়ের বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। খুব রাগ হয়েছে দিদির ভাইয়ের উপরে। কালিম্পঙে গিয়েই তো ভাই অসুস্থ হয়ে এলেন, নয়তো হতেন না - এই ভাব দিদির। ভাইকে বকলেন, বললেন, দেখো রবি, তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনো। বুঝলে?
গুরুদেব আমাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, বললেন, না, কক্ষনো আর ছুটে ছুটে যাব না; বসে বসে যাব এবার থেকে।
সকলের খিলখিল হাসিতে ঘর ভরে উঠল।"
মেয়েদের উপলক্ষ্য করে কোনো অনুষ্ঠানই নেই। একটি মাত্র অনুষ্ঠান সাধভক্ষণ তাও সে কোনো গৌরবের নয় সবাই জানি ।বেশ কয়েক বছর আগে তসলিমা নাসরিন তাঁর কোলকাতার বাড়িতে বোনফোঁটার অনুষ্ঠান শুরু করেন।গতবছর দেখলাম এই ফেসবুক পাতায় বেশ কয়েক জোড়া বোনের বোনাফোঁটার ছবি।বেশ লাগলো কিন্তু। মেয়েরা যদি এইভাবেই আরো কাছাকাছি এসে যায় পরস্পরের প্রতি আরো সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে।
যাইহোক আমাদের সিস্টারহুড জারি থাকুক।সব বোনেদের পক্ষ থেকে আমার পরম বন্ধু কবি তৃষ্ণা বসাক এর বোনফোঁটা মন্ত্রটি পড়ছি
বোনফোঁটার মন্ত্র
তৃষ্ণা বসাক
(অমৃত আর গরল মথিয়া
এসে গেছে আজ ভগিনীদ্বিতীয়া)
নতুন যুগের নতুন সুর।
বোন না যেও দূর।।
বোনের কপালে দিলাম ফোঁটা ।
ভায়েরা প্লিজ দিও না খোঁটা।।
যমুনাকেও দিলাম ফোঁটা ।
যম দেখে ভয়ে কাঁটা!
তুমি আমার বোন হয়ো।
বছর বছর ফোঁটা নিও।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন