৩ এপ্রি, ২০২০

লকডাউন মোনোলোগ

ভিশপ্ত বসন্ত পেরিয়ে চৈত্রের প্রখর রৌদ্রে আমাদের নিভৃতবাস গালভরা ইংরেজী নাম কোয়ারেন্টিন। সীতার বন্দীদশা বা যক্ষের রামগিরি পর্বতের অভিশপ্ত নির্বাসনের মতোই এ এক ভয়ংকর জীবন দুনিয়া জুড়ে। তফাত শুধু একটাই সীতা বা যক্ষের ছিল একাকী নিভৃতযাপন আর আমাদের পারিবারিক গৃহবন্দী দশা। তাঁদের ছিলনা সোশ্যালমিডিয়া আর আমাদের বন্দীদশায় সেই খুপরিটুকুনি এক পশলা সুবাতাস। শারীরিক দূরত্বে আমরা  একটু বেশীই সামাজিক হয়ে পড়ছি বরং। পৃথিবী তথা দেশ তথা রাজ্য জুড়ে করোনার জন্য আমাদের সমবেত অশৌচপালন এই লকডাউন। এবছর চৈত্রে চড়কে ঢাকে কাঠি পড়লনা আর। হাম-বসন্তের জন্য শীতলার জন্য মানতের পুজো তুলে রাখতে হল কারোর। যারা চলে গেলেন তাদের শ্মশানযাত্রায় কেউ সামিল হলেন না। এমন কি ফুলের একটি পাপড়িও জুটলনা তাঁদের। একটা সর্বগ্রাসী চিন্তা সারাক্ষণ কুরেকুরে খেল মানুষকে। তার মধ্যেও শিক্ষিত মানুষদের আচরণ অবাক করে দিল আমাদের। ততক্ষণে মহামারী অতিমারীতে পরিণত হল। সীমিত শস্য, সীমিত খাদ্যদ্রব্য তবুও আমাদের ঘরভর্তি করার এক অদম্য তাড়না তৈরী হল। আর যারা পেলনা? তাদের কথা ভুলে গেলাম না তো আমরা? স্বার্থপর মানুষ এর এই বাজারেও পঞ্চব্যঞ্জন চাই‌ই চাই। ভাতের পরে রুটি, রুটির পরে দুধ, দুধের পরে আবার ভাত, এভাবেই চলবে তবে? আসুন যে যার সাধ্যমত ত্রাণ নিয়ে জমা করি তাদের জন্য।
শরীরে, মনে খুব ক্লান্তি রয়েছে। অ-সুখ এমন অবস্থাকেও বলে বুঝি। আক্ষরিক অর্থে ব্যাধি নেই তবে আধি আছে যা ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক। সংবাদের স্রোত নজরে আসতেই দুপুরের সোহাগী বিশ্রাম আপাত নিদ্রা কেড়ে নিচ্ছে। রাতে তাড়াতাড়ি বিছানায় গেলেও তন্দ্রা ও নিদ্রার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হাত-পা আপাত জিরেন নিচ্ছে বটে কিন্তু স্বপ্নের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে দোদুল্যমান জীবনের অজানা ঘূর্ণিপাকে। 
আমরা স্বার্থসর্বস্ব মানুষ যাদের সরকারী নির্দেশিকা মেনে বিধিসম্মতভাবে হোম আইসোলেশনে থাকার কথা তারাও কি ঠিকঠাক পালন করলাম? যাদের বিদেশ থেকে ফিরে ঘরবন্দী থাকার কথা ছিল তারা? যারা এর মধ্যেই বিয়েবাড়ি গিয়ে সংক্রমিত হয়ে আবারো দূর থেকে দূরে, ছড়িয়ে দিলেন সংক্রমণ, ধর্মীয় সম্মেলনে একে অপরকে দূর থেকে দূরান্তের মানুষকে আক্রান্ত করলেন। কেউ কেউ প্রাণ‌ও দিলেন এই মারণ ভাইরাসের প্রকোপে তাঁদের দেখেও সচেতন হবনা? রোগ চেপে রাখব? আড়াল করব নিজেকে? তারপর এক্সপোজড হলে সেই মুখ দেখাতে পারবো তো সমাজে? কেউ দেখলাম খুব নোংরা রাজনীতি করছেন। এটা কি সেই সময়?  একেই তো এখন আমরা সবাই আমাদের গৃহ পরিচারিকাদের অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য ছুটি দিয়েছি। নিজেদের কাজ নিজের হাতে করার অভ্যেস শহরের মানুষদের নেই তার মধ্যেও অনেকে কাজের লোক ছাড়া বাঁচতে পারছেন না। এবার ভাবুন সেই কাজের লোকটি রোজ তার ঘরে ফিরে যাচ্ছে। সে কার স্অঙ্গে মিশছে কোথায় যাচ্ছে আমাদের তা অজানা। এবার সেই এসে আমাদের দিতেই পারে সেই রোগ। আমরা হয়ত বুঝলাম না। সে ছিল নীরব এক বাহক। যাকে দেখে বোঝা যাবেনা। নিজের চাহিদা, ইচ্ছেগুলো সীমিত রাখা এই মূহুর্তে খুব জরুরী। সে খাবারদাবারেই হোক আর কাজের লোকের ব্যাপারেই হোক। আরো কত ঘটনা দেখছি। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে সারাক্ষণের কাজের লোকের শরীরখারাপ হলে তাকে বাড়ির বাইরে বের করে দেবার মত অমানবিক ঘটনা। সে কোথায়  যাবে? পরিবহন নেই। তাকে ডাক্তার দেখিয়ে ব্যাবস্থা করুন তবে। করোনা অনেক কিছু শেখাচ্ছে প্রতিমূহুর্তে। আমরা একদিকে অমানবিক আচরণ করে ফেলছি আবার চূড়ান্তভাবে মানবিক হয়ে গৃহ পরিচারিকার খোঁজ নিচ্ছি। সে ত্রাণ পাচ্ছে কিনা। সে ঠিক আছে কিনা। নিজেদের একাহাতে সব  কাজকর্ম করতে হচ্ছে বলে হাড়েহাড়ে বুঝছি তাদের কদর। কথায় বলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না। ঠিক তেমনি ব্যাপার । আমরা সামান্য ডাল ভাত, সেদ্ধ ভাত, খিচুড়ি, ডিম ভাতে দিনের পর দিন অভ্যস্ত হচ্ছি। ঘরের বাচ্ছারাও সোনা হেন মুখ করে খেয়ে নিচ্ছে তা। মা ঠাকুমার পুরনো, অত সাদামাটা কেজো রান্নাবান্না কে মান্যতা দিয়ে ঝালিয়ে নেবার সুযোগ দিল এই লকডাউন। এই ফাস্টফুডের্, ট্রান্সফ্যাটের রমরমায় সেটাও কম কথা নয়। হঠাত করেই প্রকৃতি দেখছি। ঘর থেকে দু' পা না ফেলেই চোখ রাখছি নীল আকাশে,পাখীর ডাকে, সবুজে, ফুলের রঙে। পরিবেশের দূষণমাত্রা ঝাঁ করে একধাক্কায় নেমে গেছে অনেকটাই। সারা বিশ্বজুড়েই। আমরা শিখলাম যে ধর্মের কল‌ও বাতাসে নড়ে। আমরা শিখলাম when resources are limited unlimited creativity দিয়ে সংসার করতে হয়। পরিবারের সবার জন্য খাদ্যবন্টন করতে হয়।  

কোন মন্তব্য নেই: