১২ ফেব, ২০১১

"তখন ২৩"..আমার চোখে




দৈনিক স্ট্যেটসম্যান ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০১১ তে প্রকাশিত এই আলোচনা  



"তখন ২৩" একটি সময়োপযোগী বাংলাছবি । বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে যা ঘটে চলেছে  তাকে সঙ্গে নিয়ে অত্যন্ত নিপুণ ভাবে ছবির কাহিনীকার এবং পরিচালক অতনু ঘোষ চরিত্রগুলিকে এঁকেছেন  । 
বয়সন্ধির সমস্যা প্রকটভাবে না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে স্থান পেয়েছে । স্থান পেয়েছে একটি একমাত্র সদ্য টিন পেরোনো ছেলের মায়ের অতি অধিকারবোধ । মূল চরিত্র তমোদীপ । যে কি না বাবা-মায়ের আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা পূরণ করেছে, ডাক্তার হয়ে  । যে তমোদীপের জীবনে তার মা ছিল সবচেয়ে বড় বন্ধু তিনি ধীরে ধীরে সরে গেছেন তার কাছ থেকে যখন তার জীবন ঘিরে তার বায়োলজি টিচার মেঘনার  প্রতি   ইনফ্যাটুয়েশান । মেঘনার সাথে ঘনিষ্ঠতায় মা হয়েছেন বিরক্ত ।  মেঘনাকে তমোদীপের মা অনুরোধ করলেন তার ছেলের জীবন থেকে দূরে চলে যেতে । আবার পরক্ষণেই তিনি ভাবেন যে মেঘনাকে দূরে সরিয়ে দিয়েই বুঝি তার ছেলের সাথে  দূরত্ব তৈরী হল । তাই আবার মেঘনাকে অনুরোধ করেণ ফিরে যেতে যাতে তাঁর ছেলের সাথে সম্পর্ক সহজ হয় ।   
সোশ্যালনেটওয়ার্কে  তমোদীপের আলাপ হয়েছে শ্রীপর্ণার সাথে যে আবার চিনে ফেলে মেঘনাকে যিনিও উপস্থিত ফেসবুক নামক সোশ্যালনেট ওয়ার্কিং সাইটে ।  এমন সময় তমোদীপ আসক্ত হয়েছে পর্ণোগ্রাফিক ছবিতে । যেখানে পর্ণস্টার মোহিনী ওরফে শম্পা দাশগুপ্তার  লাস্যময়তার রঙীন ফ্যান্টাসিতে ডুবে গেছে তমোদীপ । এই তিন বাইরের জগতের নারীর আকর্ষণে দূরে সরে গেছে একসময়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু অন্দরমহলের "মা" নারীটি । তিনি বুঝতে পারেন না নিজের সেই ছোট্টটিকে । তমোদীপ  বুঝতে পারছে যে তার মায়ের কাছ থেকে সে দূরে সরে গেছে । তার বায়োলজি টিচার মেঘনার সঙ্গ তার ভালো লাগে কারণ তার মনের বয়স সেই ভালোলাগাকে  প্রাধান্য দিয়েছে । তার মা তাতে ভয় পেয়েছেন আর পাঁচটা মায়ের মত । কিন্তু মেঘনা নিজে একজন ডিভোর্সি এবং জীবনকে তমোদীপের থেকে বেশিদিন দেখেছে তাই মেঘনা কিন্তু আদ্যোপ্রান্ত শিক্ষিকার ভূমিকা পালন করেছে এবং সেই চরিত্রটির জন্য ইন্দ্রাণী হালদারকে নির্বাচন যথাযথ বলে আমার মনে হয়েছে ।  তমোদীপের জীবনে এসেছে চ্যাট ফ্রেন্ড শ্রীপর্ণা যার জীবনে সোশ্যালনেট ওয়ার্কিং শেষ কথা এবং নিজের জীবনকে ভালো করে উপলব্ধি করার জন্য সে সব চ্যাট ফ্রেন্ডকে মিট করে । ডিজিটাল সম্পর্ককে রিয়েলিটির মুখোশ পরিয়ে দেখবে বলে হয়ত । কিন্তু যখন সে চ্যাট-বন্ধু রজতাভ দত্তের সংস্পর্শে আসে তখন রজতাভ নিপুণ হস্তে তাকে বুঝিয়ে দেন যে এই বয়সে যখন তখন চ্যাট ফ্রেন্ডকে চর্মচক্ষে আলাপ করে তার সঙ্গে সময় কাটানোটা কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে ।   আবার মন ছুঁয়ে যায় রজতাভর চরিত্রটির অপূর্ব চিত্রায়ণ । এই দুটো দিক বিচার করে আমার মনে হয়েছে ছবিটি শিক্ষামূলক । আজকের যুগের সোশ্যালনেটওয়ার্কে চিটে গুড়ের মত আটকে থাকা স্কুল-কলেজ পড়ুয়াগুলির দেখা দরকার ছবিটি আবার দেখা দরকার তাদের মায়েদেরও যারা বুঝতে পারছেন না বয়ঃসন্ধির সমস্যাটি কোথায়  ?  ঠিক এমন সময় তমোদীপের ফ্যান্টাসির জগতের নায়িকা পর্ণস্টার মোহিনীর আবির্ভাব হয়  বাইপাসে রোড এক্সিডেন্ট হয়ে সরাসরি তমোদীপের পেশেন্ট রূপে ; মোহিনী হয়ে নয় " শম্পা দাশগুপ্তা " যার আসল পরিচয় ; হসপিটালে কয়েকটাদিন কাছের থেকে মোহিনীকে দেখার সুযোগ করে দেন তমোদীপের ভাগ্যলক্ষী ।   উঠে আসে শম্পার মোহিনী হবার গল্প । এবার শুরু হয় তমোদীপের টানাপোড়েন । পরিচালক অতনু ঘোষ ঠিক সেই সময় মেঘনা চরিত্রটিকে সঠিক ভাবে রূপায়িত করেন একজন " মনের কথা মন খুলে " বলার মত কাউন্সিলারকে যিনি অল্পবয়সীদের মনের ছবি দেখেন  তার এফএম চ্যানেলের লাইভ টক-শো তে । ধীরে ধীরে কাউন্সেলিং করেন তমোদীপকে আর সেই সাথে তমোদীপের মা'টিকে  । তমোদীপের মনের টানাপোড়েনের পরত গুলি একটি একটি করে খুলে যায় । সে শক্ত করে ধরে থাকে জীবনের সম্পর্ক-যুদ্ধের স্টিয়ারিংটি । ধীরে ধীরে এগুতে থাকে পজিটিভিটির দিকে । দেখতে পায় আলো । ঝকঝকে রাস্তায় তার নিজের  কেনা  প্রথম লাল রঙের গাড়ির চাবি মায়ের হাতে দিয়ে প্রমাণ করে যে সে বদলায় নি একটুও । এখানে গাড়িটিও সিম্বলিক কারণ জীবনের গতিময়তার প্রতীক রূপে, নতুন রাস্তায় জীবন মোড় নেবে বলে  । আর পাওলি দামের অভিনয়ে মোহিনী চরিত্রটি আমার চোখ দিয়ে দেখে মনে হল শম্পার আর পাঁচটা পতিতার মত  অতীত ছিল ; শম্পার  শিল্পীসুলভ গায়নশৈলী ছিল আর ছিল কবিতাকে উপলব্ধি করার মন । কিন্তু  তমোদীপ, মেঘনা আর শ্রীপর্ণার বন্ধুত্বের স্পর্শে সে ফিরে এল আলোর জগতে । ভালোবাসার ছোঁয়ায় উন্মোচিত হ'ল তার হৃদয়ের কোমল মনোবৃত্তি । তাই সে  হলুদফুল রাখল তমোদীপের গাড়ির ওপর   । এখানে হলুদ ফুল আবারো " গোল্ডেন হার্টে"র প্রতীক গল্পের শুরুতে আমরা দেখি আমাদের দেশের তথাকথিত হিপোক্রেসীর শিক্ষা ব্যাবস্থায় গালভরা "সেক্স এডুকেশন"  কেমন সুন্দর ভাবে  তুলে ধরেছেন পরিচালক । আর যেহেতু তমোদীপ, মেঘনা, শ্রীপর্ণা এরা ফেসবুক ও অর্কুটের মাধ্যমে সোশ্যালাইট করে তাই প্রতিনিয়ত অতনু বুঝিয়ে দিয়েছেন রিয়েল আর ভারচুয়াল চরিত্র সব সময় এক হতেও পারে আবার না হতেও পারে । তাই এসেছে ডাঃ রূপক সেনের জীবন সঙ্গিনী পিঙ্কি প্রসঙ্গ । আবার ফেসবুকে রজতাভর ছবি দেখে শ্রীপর্ণার বিস্ময় ! আর মোহিনী চরিত্রটি ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে না ঘুরলেও রিয়েল লাইফে তার দুটো আইডেন্টিটি । একটি মোহিনী অন্যটি শম্পা ।    সেখানে রিয়েল লাইফের সাথে ভার্চুয়াল লাইফ মিলে মিশে এক ! সব শেষে বলি " তখন ২৩" একটি মনের সমুদ্রে সাতাঁর কেটে চলা " ইনফ্যাটুয়েশানের্" ছবি যেখানে যৌবনে পদার্পণ হওয়া তমোদীপের ফ্যান্টাসিগুলো একসময় ফিরিয়ে দেয় তাকে নিজের একান্ত আপন জীবনে ।  জীবন চতুষ্কোণে চার নারীর  সম্পর্কের টানাপোড়েনে বিদ্ধস্ত তমোদীপ নিজের চোখ দিয়ে মনের ভেতরকে দেখে  উপলব্ধি করে মনের কোণে থিতিয়ে পড়ে থাকা জীবনদর্শন |
সব মিলিয়ে বলা যায় এই জেনারেশানের ছবি, পরিচ্ছন্ন ছবি যেখানে অহেতুক নাচ-গান নেই । আর সব শেষে বলি তমোদীপের ভূমিকায় যীশু সেনগুপ্ত, মোহিনীর ভূমিকায় পাওলি দাম, শ্রীপর্নার ভূমিকায় অপরাজিতা ঘোষদাস,    মেঘনার ভূমিকায় ইন্দ্রাণী হালদার এবং তমোদীপের মায়ের ভূমিকায় তনুশ্রী শঙ্কর এক্কেবারে সঠিক নির্বাচন । কেবল লকেট   চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রটির তাতপর্য আমার কাছে একটু প্রশ্ন জাগিয়েছে । আর অতুলপ্রসাদের গান " তুমি গাও" এ জয়তী চক্রবর্ত্তির গায়কী আরো একবার মন ছুঁয়ে গেল । এ যাবত কাল পরিচালক অতনু ঘোষের কাছ থেকে ঊনিশটি টেলিছবি আমরা দেখেছি তারা মিউজিকের পর্দায় । বড়পর্দায়  অতনু ঘোষের ২য় ছবি " তখন ২৩" এ ও তিনি সার্থক তা আবার প্রমাণ করে দিয়েছে ।   তারা ফিল্মস বড়পর্দায় প্রথমেই সফলতা প্রমাণ করেছে 

 

কোন মন্তব্য নেই: