৪ ফেব, ২০১১

"থট-শপ"


সে এক ছিল মজার দোকান । দোকানের নাম "থট-শপ" ;সেই দোকান সাধারণ মানুষ খুঁজে পেত না, যার যাবার ইচ্ছে হত সে ঠিক পৌঁছে যেত সেই দোকানে । মালিক এক থুড়থুড়ে, দাড়ি ওলা বুড়ো যার নাম চিন্তামণি, অনেক বয়স তাঁর ।  এক সময় ছিলেন রসায়নবিদ । ক্রিস্টালের ওপরে রিসার্চ করেছিলেন বহু বছর ।  সে দোকানে কত রকমের  সব জিনিষ বিক্রি হত । থরে থরে সব সাজানো থাকতো কাঁচের বয়ামের মধ্যে  । ঠিক যেন লজেন্স ! লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা.... কত রঙের বাহার।  কত ধরণের গড়ন সেই সব রঙীন লজেন্স-ক্রিস্টালের; কোনোটা ছুঁচের মত, কোনোটা রম্বসের মত, কোনোটা আবার চোঙাকৃতির, কোনটে বা আয়তঘনাকার ।প্রত্যেক বয়ামের গায়ে স্ফটিকের নাম, দাম আর গুণাবলী লেখা থাকত।  বুড়ো চিন্তামণি দোকানের মধ্যে  টেষ্টটিউব, বানসেন বার্নার, বিকার, ফিল্টারপেপার, ফানেল  আর আইসবক্স নিয়ে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা নাওয়া-খাওয়া ভুলে । ছোট ছোট বাক্সের মধ্যে রাখা রঙবেরঙয়ের নুন-চিনির মত দানা  বের করে তাদের জলে দ্রবীভূত করে , ফুটিয়ে ধীরে ধীরে ঠান্ডা করে বরফে কিম্বা ঠান্ডা জলের মধ্যে রেখে রাতে  বাড়ি চলে যেত; পরদিন এসে দেখত কেমন সব রঙ বেরঙয়ের স্ফটিকের উত্পত্তি ।বুড়োর ছিল এক গ্লাসরড যা প্রত্যেক ক্রিস্টালে ছোঁয়ালেই একটা করে চিন্তা বা "থট" ঢুকে যেত তার মধ্যে । আর যে সেই ক্রিস্টাল বুড়োর কাছ থেকে কিনে নিয়ে বাড়ি গিয়ে বয়ামে লেখা নিয়ম মাফিক গ্লাসে জল নিয়ে এক এক করে যেই ফেলত অমনি চিন্তার বুদবুদেরা গ্লাসের জলের মধ্যে থেকে সেই মানুষটির মাথায় যেত চলে । আর ঠিক তক্ষুণি সেই মানুষটি পাড়ি দিত চিন্তার কল্পলোকে ।     "কিউবিক"
ছোট্ট অপু একদিন সেই দোকানের খোঁজ পেল । তার অনেক দিনের সাধ পাখি হয়ে উড়ে মেঘেদের কাছে যাবার; নীলচে সবুজ "স্ফটিক"নামের    লজেন্স-ক্রিস্টালের পাউচ কিনে নাচতে নাচতে বাড়ি এল । বুড়োর কথামত এক গ্লাস জল নিয়ে যেই একদানা ক্রিস্টাল জলে ফেলা অমনি অপু পাড়ি দিল পাখির বেশ ধরে  স্বপ্নের কল্পনায় । মাছরাঙার নীলটুকু ,কাঠঠোকরার হলদে টুকু, টিয়ার ঠোঁটের লালটুকু নিয়ে অপু হল ছোট্ট পাখি  টুনিয়া । শিস দিয়ে গান গাইতে গাইতে টুনিয়া উড়ে গেল মেঘের বাড়ি। অনেক দিন ধরেই অপুর মা বলছিল বৃষ্টিহীনতা আর খরার কথা । মেঘের কাছে গিয়ে টুনিয়া গান শুনিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে মেঘকে নিয়ে এল নিজের বাড়ির ছাদের মাথায় আর শুরু হল ঝমাঝম বৃষ্টি ।

ছোট্ট মেয়ে তাথৈ সমুদ্রের নীচে  দ্বীপে পাড়ি দিতে চায় ।  তাথৈ সেই দোকানে গিয়ে  কমলা রঙয়ের "রম্বিক"নামের ক্রিস্টাল কিনে নিয়ে এল আর জলে ফেলতেই চিন্তার বুদবুদেরা তাথৈকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সমুদ্রের নীচে । ছোট ছোট সি এনিমন, কোরাল, হাইড্রা আর এলগিদের সাথে তার বন্ধুত্ব হল। মায়ের কাছে গল্প শুনেছিল ঝিনুকের পেটে মুক্তোর কথা । কিন্তু কোনোদিন তা চোখে দেখেনি সে। খুব ইচ্ছে হত হাতে করে দেখার । নীচে গিয়ে দেখে কত কত ঝিনুক । ঢাকনা খুলে পেটে করে পেল্লায় মুক্তো নিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে । দুচোখ ভরে তা দেখতে দেখতে হঠাত্‌ তাথৈ ভাবল "আমি যদি এমন একটা মুক্তো হতে পারতাম"  । যেমনি ভাবা অমনি একটা বিরাট গোলাপী ঝিনুক তার দিকে ছুটে এসে বলল "আজ থেকে তুমি হলে এই জলমন্ডলের রাণী । তোমার নাম আমি দিলাম মুক্তা, এস আমার কোলে"  আহ্লাদে আটখানা হয়ে মুক্তারাণী ঝিনুকের কোলে বসে পড়ল । আর তখুনি আর সব জলদেশের বন্ধুরা তাকে ঘিরে হৈচৈ করতে লাগল, নাচতে লাগল, গাইতে লাগল । মুক্তা তাদের বলল যাবে তোমরা আমার বাড়ির বাগানে? একটা ছোট্ট লিলিপুলে থাকবে । আমার সাথে রোজ খেলবে এই ভাবে । রাণীর কথা কি আর অমান্য করা যায় সব ছোট বড় ঝিনুকেরা, মস-ফার্ণ, শাঁখেরা  অমনি রাজী হয়ে গেল । তাথৈ তাদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ির বাগানের লিলিপুলে ছেড়ে দিল । অনেকদিনের শখ তার পূর্ণ হল ।
অপু, তাথৈ স্কুলে গিয়ে সব বন্ধুদের তাদের নতুন অভিজ্ঞতার কথা বলল ।  স্কুলের টিচারদেরও বলল সব । একজন টিচার দোকানের নাম জিগেস করল । তার অনেকদিনের সাধ চাঁদে যাবার ।  তা তিনি রাস্তা চিনে সেই "থট-শপে" গেলেন । সেখানে গিয়ে চিন্তামণির কাছ থেকে বেগণি রঙের "কিউবিক"  নামের   ক্রিস্টালটি পছন্দ করে কিনে ফেললেন । বুড়োকে টিচার এবার প্রশ্ন শুরু করলেন । আচ্ছা আমি তাহলে সত্যি সত্যিই আমার শখ পূরণ করতে পারবতো এই লজেন্স-ক্রিস্টালের সাহায্যে? যদি না হয় আমার কিন্তু পয়সা ফেরত চাইই-চাই । আমার কোনো বিপদ হবে নাতো?"আরো বললেন " আচ্ছা জলে দিলেই হবে ? এতো মনে হচ্চে গ্যাঁজাখুরির গল্পের মত ।  আমি আবার ফিরতে পারবো তো এই পৃথিবীতে ? ইত্যাদি ইত্যাদি ..."বুড়ো চিন্তামণি বিরক্ত হয়ে বললেন " আচ্ছা বাপু, তোমার যখন এতই চিন্তা তখন কেন আমার দোকানে আসা ? আমি কি আর তোমার মত খদ্দেরের জন্যে সে কোন সূদুর থেকে এই সব লজেন্স নিয়ে এসে বিক্রি করি ?  অপু, তাথৈ এদের মত শিশুরা যাদের আমার কথার ওপর অগাধ আস্থা আর যারা শুধু বিশ্বাস করে আমাকে তাদের জন্যই আমি বেচি । তাই তারা ফলও পায়  । তুমি চাইলে তাই বিক্রি করলাম ঐ বেগণি লজেন্স-ক্রিস্টাল গুলো । এই নাও তোমার পয়সা ফেরত, আমার জিনিস দিয়ে দাও আমাকে"

এমনি করে চিন্তামণির রঙিন দিন গুলো কাটতে থাকে একে একে । হঠাত সে ভাবল আচ্ছা আমিও তো এমন করে পৌঁছে যেতে পারি আমার ড্রিমল্যান্ড স্বর্গপুরের দরজায় । আমার তো কেউ কোত্থাও নেই; আমার জন্যে তো ভাববার ও কেউ নেই; আমি মরে গেলে কাঁদবার ও কেউ নেই; তাহলে দেখি না আমি যদি যেতে পারি চিরকালের মত সেখানে । আর শুনেছি সেখানে গেলে আর জন্ম হয় না । আর যুগযুগ ধরে মানুষের বিশ্বাস এই যে যারা ভাল কাজ করে তারা নাকি স্বর্গে যায় । আর চিন্তামণি জ্ঞানত: কোনো খারাপ কাজ করেনি কোনোদিন । মিথ্যে বলেনি, লোক ঠকায়নি, মানুষকে হিংসে করেনি । তাহলে সেও তো পৌঁছে যেতে পারে সেই স্বর্গদ্বারে ।  ব্যাস, যেই ভাবা অমনি খুলে গেল একটা বয়ামের ঢাকনা । বয়ামের লেবেলে লেখা "কসমিক",  রঙ টুকটুকে লাল  । বয়ামের মুখ থেকে উঠে আসছে একটা স্টিক আর তার থেকে ছোট ছোট লাল ফুল স্বচ্ছ পাপড়ি মেলে চিন্তামণির দিকে চাইছে, ঘরের  মধ্যে জোছনার  আলো চুঁইয়ে পড়েছে সেই পাপড়িতে আর ফুল গুলো ঝলমল করে উঠছে, যেন বলছে "এস, চল আমার সাথে, তোমার এবার যাবার সময়" চিন্তামণি উঠে ফুলের কাছে গেল| হাতে করে একটা ফুল নিল আর এক গ্লাস জলে ফেলল সেই লজেন্স-ক্রিস্টালের লাল ফুলটিকে ; সঙ্গে সঙ্গে চিন্তার বুদবুদেরা চিন্তামণিকে নিয়ে চলল স্বর্গের দিকে ।  যেতে যেতে সে ছুঁয়ে দেখল আকাশের নীল রঙ, পাহাড়ের গাছেদের সবুজ রঙ , সূর্যের হলুদ-কমলা রঙ মেখে নিল বেশ করে । একটা বিশাল গুহার মধ্যে পৌঁছাল সে । যেখানে একধারে ঝরণার জল ওপরে সাদা কিন্তু ঝরে পড়ার মুখে নীল । কোথাও বা ফোয়ারা উঠছে মাটি থেকে লাল রঙের, লাল নীল ফুলেরা ফুটছে সবেমাত্র তাদের কুঁড়ি থেকে । ফুলের পাপড়ি যে এই ভাবে চোখের সামনে খোলে তা দেখে চিন্তামণির আনন্দ আর ধরে না ।  এইবার সে দেখতে পেল বিশালাকার ঝুলন্ত স্ট্যালাকটাইটের পাহাড়। মনে পড়ে গেল কেমিস্ট্রি ব‌ইতে ছবি দেখেছিল । কিছুদূর গিয়েই চোখে পড়ল স্ট্যালাগমাইটের প্রোথিত স্তম্ভ । ক্রিস্টাল নিয়ে গবেষণা করতে করতে , পড়াশুনো করতে করতে অনেক দিনের ইচ্ছে  ক্যালসিয়াম কার্বনেটের ক্রিস্টালাইজেশনের কারসাজিতে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরী স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইটের দেশে যাবার । এই বুঝি তার স্বর্গের ঠিকানা । সে সত্যি আজ পৌঁছে গেল স্বর্গের আঙিনায় ।

ছোটদের ম্যাগাজিন "ইচ্ছামতী" তে প্রকাশিত

কোন মন্তব্য নেই: