১৯ ডিসে, ২০১২

১৯শে ডিসেম্বর


১৯শে ডিসেম্বর সকাল সকাল ফেসবুকের ইনবক্সে উড়ে আসা একরাশ জন্মদিনের শুভেচ্ছা মনে করিয়ে দেয় আজকের দিনটার কথা । আজ আবার ৪র্থ বাংলা ব্লগ দিবস ও । এতটা বছর পার করতে করতে এই দিনটাতে নানারকমের অভিজ্ঞতা কুড়িয়ে নিলাম আঁচল ভরে ।
একবার ছোটবেলায় বাবা হাতে তুলে দিয়েছিলেন  "ছোটদের বুক অফ নলেজ" ।ব‌ইখানা আমার থেকে বড় ও ভারী ছিল তাই সে ব‌ই যখন হাতে করে পড়তে শিখলাম তখন আরো অনেকগুলো জন্মদিন পেরিয়ে গেছে ।  

 ১৯৮৫ সাল  ; তখন বেথুন কলেজের থার্ড ইয়ার । পার্ট-টু পরীক্ষা দিয়ে ছুটিতে রয়েছি বাড়িতে ।  রেজাল্ট বেরুনোর অপেক্ষায় । গান শিখতে গেছি ঐ দিন বিকেলে । বাড়ি ফিরে দেখি একপাল বন্ধুরা বাড়ীতে অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার জন্মদিনের সারপ্রাইজ পার্টি দিতে হাজির । আমার কুড়ি বছর পূর্ণ হওয়ায় একুশটা রসোমালাই ভর্তি হাঁড়ি আর একুশটা হলদে গোলাপ নিয়ে সেদিনের সন্ধ্যেবেলায় আমার বাড়ির ড্র‌ইংরুম জমজমাট হল । বিয়ের ঠিক হল ১৯৮৮ সালে । পৃথ্বীশ তখন ডালাসে পিএইচডি স্টুডেন্ট । জন্মদিনের প্রথম লাভলেটার এল নীলখামে বন্দী হয়ে বিদেশ থেকে । সাথে গ্রিটিংস কার্ড ও একটা ছোট্ট উপহারের বাক্সে ছোট্ট ছোট্ট রকমারি পারফিউমের  সুদৃশ্য বোতল ।   সে এক অনুভূতি । জীবনের প্রথম প্রেমিক বন্ধু, হবু স্বামীর কাছ থেকে উপহার ! আবিষ্কার করেছিলাম নতুন করে নিজেকে । আবিষ্ট হয়েছিলাম অন্য রকম এক ভালোলাগায় । এরপর বিয়ে । তারপর ছেলে ও একে একে সংসারের ঝুট-ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া ।  
বিয়ের পর জন্মদিনের কোনো সুখস্মৃতি আমার মনের কোণায় থিতিয়ে পড়ে নেই । আমি কে, আমি কেন আর আমি কি জন্যে জন্মে এই বাড়িটায় এসে হাজির হয়েছিলাম বিয়ের পরে প্রথম কয়েক বছর তা আমাকে কেবলি তাড়া করে বেড়াত । সে সময় চাইলেও আমাকে ওর মত করে পেত না আর আমাকে ওর ইচ্ছেমত ভরিয়েও দিতে পারত না । আমার জন্য কিছু নিয়ে আসা মানেই বাড়িতে তুফানি ঝড় বয়ে যেত আর আমাকে ঘিরে এক অশান্তির বাতাবরণ তৈরী হয়ে যেত নিমেষের মধ্যে । তাই ভুলে যেতে বাধ্য হতাম ঐ বিশেষ দিনটাকে । একবারের ঘটনা খুব মনে পড়ে । আমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে  জেমস বন্ডের সিনেমা "টুমরো নেভার ডাইসের" নাইট শোয়ের টিকিট কাটিয়ে রেখেছিল আমাদের ড্রাইভারকে দিয়ে । রাতে বাড়ি এসে ডিনার খেয়ে আমাকে তৈরী হয়ে নিতে বলল " প্রিয়ায় টিকিট কাটা আছে, এই বলে "  চলেও গেলাম অপ্রত্যাশিত একরাশ আনন্দ সঙ্গে করে । রাতে বাড়ি ফিরে দরজা খুলে দিতে হল বলে মুখ ভার দেখলাম তাঁর আর পরদিন চায়ের টেবিলে আমার জন্য অপেক্ষা করে র‌ইল সেই কাল মাঝরাতে না বলা বকুনির কথা । " বৌ কে নিয়ে আদিখ্যেতা !!! যত্তসব ! " ভুলে গেলাম জন্মদিনের স্মৃতি ।  এভাবেই পেরিয়ে গেছে বাইশটা বছর এই বাড়িটায় । কিন্তু আমার জন্যে মায়ের মত পায়েস রেঁধে বা ছোট্ট কোনো উপহার নিয়ে কখনো সারপ্রাইস দেয়নি জন্মদিন; যে মানুষটা ভালোবেসে কিছু দিতে চেয়েছে আমাকে তার জন্য তাকে শুনতে হয়েছে অনেক কিছু, স‌ইতে হয়েছে শতেক । কারণ আমি যে অন্য বাড়ির মেয়ে তাদের বাড়ির উত্তরসুরীর জন্মদাত্রী! আজ তারিখটা এলেই মনে পড়ে সেই সব দুঃখের স্মৃতিগুলো । শিউরে উঠি আর বলি,  জন্মদিন, তুমি অন্যের হও, কিন্তু এসো না তুমি আমার হয়ে ।
 ২০১০ এ ভাইয়ের বাড়িতে  পুণায় ছিলাম এইদিনটিতে ।   আগের দিন  দুপুরের খাওয়াদাওয়া, যত্নাআত্তির কোনো ত্রুটি ছিলনা । বিকেল হল । সন্ধ্যে হল । আমরা হৈ হৈ করে বেরুলাম.. মন্দিরে গেলাম । ক্রসওয়ার্ড এ গেলাম । সেখান থেকে পিতজা হাট । খুব খাওয়া হল ।  ফেরার পথে গ্রিন আপেলের ভদকা হল সঙ্গের সাথী । ফিরে এসে রাত বারোটা ছুঁইছুঁই । আমার জন্মদিনের ঘন্টা বাজবে এই বুঝি । টলোমলো পায়ে সে এল গিফট হাতে  ।  ভাইয়ের ছেলে গুগ্‌লের কাছ থেকে "হ্যাপি বার্থ ডে পিসিমণি ( খুতুন)" শুনে আমার ভরে গেছিল মন ।   এত আনন্দ বুঝি কোনো জন্মদিনে হয় নি আমার !
 গতবছর ২০১১ তে জন্মদিন পালন হয়েছিল ট্রেনের মধ্যে । আমরা অমরকন্টক যাচ্ছিলাম । সেও এক অন্যরকমের অনুভূতি ।   এবছর ২০১২ তে আমার ছেলে তার পকেটমানি দিয়ে  আমার জন্য একটা কাঠের কাজ করা   সুন্দর রাজস্থানী মশাল এনেছে । ও জানে মা ঘর সাজাতে ভালোবাসে । তাই এই সারপ্রাইজ । প্রতিবছর আমার জন্মদিন আসতে না আসতেই ৩৬৫দিনের পুরোণো একটা বছরের পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবার তোড়জোড় ।  

জীবনের আলপথগুলো গুলো চলতে চলতে অনেক বন্ধু এল চারপাশে । একঘেয়েমি কাটল ফেসবুকের একচিলতে ব্যালকনিতে । কেউ ভালোবেসে ছুঁড়ে দিল একরাশ জুঁইভেজা বৃষ্টিকবিতা । কেউ দিল একগোছা শুকনো রজনীগন্ধা । কেউ আবার শিশিরসিক্ত শিউলির গন্ধ নিয়ে সামনাসামনি এসে দাঁড়ালো। আলতো করে ধরে আছি বন্ধুত্বের হাত । ভয় হয়, পাছে দুঃখ পেয়ে বসি । আলগোছে পছন্দ করি বন্ধুর ছবি ।  ভয় হয়, যদি আঘাত পাই।  বন্ধুকে প্রতিদানে হয়ত ফিরিয়েও দি একমুঠো সত্যি শিউলি কিম্বা জুঁইভেজা সন্ধ্যেটা ।

চলতে থাকে জীবন। আলগোছে, আলতো পায়ে । মনের কার্ণিশ বেয়ে নিঃশব্দে উঁকি দেয়  এসেমেস। বেজে ওঠে মুঠোফোন ঝন্‌ঝন্‌ । আমার মনোবীণায় সে ঝঙ্কারে হয়ত সামিল হয় অচেনা কোনো পাখি । সে শুধু বলে তুমি একা নও ।  ইনবক্সে উড়ে আসে অচেনা মেল, হঠাত মেল ।
চলতেই থাকে জীবন ছেঁড়া ছেঁড়া কবিতার ঘ্রাণ নিয়ে, অলস সময় পেরিয়ে যায় বৃষ্টিপথ, ভাবনার গদ্যেরা ভেসে যায় আপন খেয়ালিপথে, আলগোছে, আলতো পায়ে...

কখনো খেয়ালপোকা কিলবিল করে ওঠে । বলে "চল্‌, কোথাও ঘুরে আসি"
কখনো টেষ্টবাড গুলো লক্‌লক্‌ করে ওঠে "বলে চল্‌ ! ভালো কিছু খাই"
এদের নিয়েই  আমার ভালোমন্দ । এদের সাথে ওঠাবসা ।  আর রয়ে গেলে তোমরা । পুরোণো সেই আমির সাথে । চেনা চেনা রোদ্দুরে, অচেনা রাস্তায়, ভালোবাসার ফুটপাথে.......
একমুঠো কুচোনো কবিতার কলি দিয়ে জীবনপাত্রটি ভরে চলেছি । দুফোঁটা গান নিয়েছি সাথে। তিন-চার চামচ বৃষ্টি আর ছড়ানো ছেটানো শিশির ফেলেছি সেই জীবনপাত্রে । কথামালার টুকরো আখরগুলো দিয়ে  উথলে উঠি উঠি পূর্ণপাত্র । সবশেষে গার্ণিশ করলাম ভালোলাগার ঝর্ণাকলমের ফোঁটা দিয়ে । আর ভালোবাসার ঢাকনি দিয়ে বন্ধ করলাম আজকের রেসিপি ।
ভাগ্যি ব্লগ লিখতে শুরু করেছিলাম । তাই আজকের এই বিশেষ দিনে মন খুলে কটা কথা লিখতে পেরে ধন্য হলাম । এটাই এবারের  জন্মদিনের সবচেয়ে বড় পাওয়া !  


কোন মন্তব্য নেই: