কোলকাতায় আমার ছেলেবেলার পুজোর স্মৃতি আনন্দবাজার ইন্টারনেট সংস্করণে কলeকাতা বিভাগে পুজো ২০১২ তে প্রকাশিত "আমার শহর" কলমে ।
আমার ছোটবেলা কেটেছে বরাহনগরের আলমবাজারে। পুজোর মাস দুয়েক আগে কোনও একটা সপ্তাহান্তে বাবা আমাদের কলকাতায় নিয়ে যেতেন পুজোর বাজার করতে। সে ছিল আমাদের সব চাইতে বড় উত্তেজনার দিন— সারাদিনের ‘প্রোগ্রাম’। সকালবেলা ভারী জলখাবার খেয়ে বেরোনো হত আর ফেরা হত সেই রাতে। বাড়ির সামনে থেকে সরকারি স্পেশাল বাস ‘এস ১৭’য় চেপে বসতাম আমরা চার জন। তার পর গিয়ে নামা হত লিন্ডসে স্ট্রিট। প্রথমেই ঠান্ডা পানীয়— ক্যাম্পাকোলা। তার পর সোজা হেঁটে বেন্টিঙ্কট স্ট্রিটে গিয়ে চিনে বাজারের জুতো কেনা হত। চিনেপাড়ার উস্তাদদের হাতে বানানো জুতোতে নাকি পা ভাল থাকে, তাই এত কষ্ট করা! সেই জুতোর বাক্স বয়ে যাওয়া হত নিউমার্কেটে। আমার ফ্রক কেনা হত স্টাইল টেক্স থেকে। মা প্রতিটি ফ্রকের ঝুল আর ডিজাইন খুঁটিয়ে দেখতেন যাতে পোশাকে শালীনতার মাত্রা বজায় থাকে। ভাইয়েরটা কেনা হত রহমান স্টোর্স থেকে। গঙ্গাদীন গুপ্তার অর্গ্যান্ডি আর কোটা শাড়ি, জয়সওয়াল স্টোর্স থেকে মায়ের তাঁতের শাড়ি, ঠাম্মার দুধ সাদা ফাইন থান, দিদিমার ইঞ্চিপাড়ের সাদা শাড়ি, মা দুর্গার লালপেড়ে শাড়ি, জ্যাঠামশাইদের জন্য ফাইন ধুতি— সব কিনে যাওয়া হত নাহুম’স-এ। নিউমার্কেটের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নাহুম’স-এর চিজ প্যাটি আর ডি গামার কেক। কেক, প্যাটি খাওয়ার পর বাড়ির জন্যও কিছু নিয়ে নেওয়া হত। তার পর যাওয়া হত লিন্ডসে স্ট্রিটের হ্যান্ডলুম হাউসে। এখানে তখন তো আর আনাচে কানাচে এত বুটিক ছিল না! তাই এক্সক্লুসিভ পিওর সিল্ক শাড়ি কিনতে মা ওখানেই যেতেন। আর সেখানে এক ঢিলে দুই পাখি! পর্দার কাপড়, বেডশিট সব কিছুই মিলত ন্যায্য দামে। বাবার জন্য প্রায় জোর করে মহাদেবী এন্ড মেহতা থেকে শার্ট প্যান্টের পিস কিনতেন মা।
তখন শহর কলকাতায় হাতে গোনা খাবারের দোকান ছিল। কিন্তু এ পাড়ায় সঠিক দামের ছোট বড় রেস্তোরাঁ ছিল বেশ কিছু। ছোলা বাটুরে আর স্পেশাল কুলফি মালাই খেতাম ইন্দ্রমহলে। র্যালি’স-এর সিরাপ আর সিমাইয়ের পায়েস সহযোগে এমন সুন্দর কুলফি মালাই বোধহয় আর কোথাও তখন পাওয়া যেত না। এর পর সিম্ফনিতে আমাদের অভিযান। নতুন পুজোর গানের এলপি রেকর্ড। আর তখন এইচএমভি থেকে শিল্পীদের গানের রেকর্ড কিনলে একটা গানের লিরিকসের বই দিত। মায়ের নজর থাকত ওই বইয়ের দিকেই। তত ক্ষণে ফুটপাতের দোকান থেকে ভাই মায়ের আঁচলে গেরো দিয়ে একটা গাড়ি বা মোটরসাইকেল বা একটা ক্যাডবেরি বাগিয়ে বসে আছে। আমার একটা হেয়ারব্যান্ড, জামার সঙ্গে ম্যাচ করে দু’টো ক্লিপ আর রিবনও কেনা হয়ে গিয়েছে। বাবা রেগেমেগে বলছেন ‘‘এ বছরই শেষ। তোমাদের নিয়ে আর আসা যাবে না এখানে। এত বায়না!” কথাগুলো বাবা যে এমনিই বলতেন সেটা আমি বুঝতাম। কিন্তু ভাই বেচারা খুব ভয় পেয়ে যেত।
বিকেলের চায়ের জন্য ঢোকা হত অনাদি কেবিনে। সঙ্গে অবশ্যই অনাদির স্পেশাল মোগলাই পরোটা। এই একটা দিন বাবা বাইরের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমাদের লাগাম ছেড়ে দিতেন। আর তখন কলকাতা এত পরিচ্ছন্ন ছিল যে বাইরের খাবার খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ভয় কম ছিল। এখন বাইরে খেতে গেলেই ভাবি ভাল জায়গায় যেতে হবে, এসি থাকতে হবে, ভাজাভুজি মোটেই না— হেলথ রুল মেনে খেতে হবে। খোলা জিনিস খাওয়া চলবে না ইত্যাদি।
এক বার বাবা আমাদের চাইনিজ রেস্তোরাঁ কারকো-য় নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন কলকাতায় চিনে খাবারের চল সবে হচ্ছে। চাংওয়া, জিমিস কিচেন, পিপিং আর কারকো— এই ক’টি রেস্তোরাঁতেই সাবেকি চিনে খাবার মিলত। আর চাইনিজ খাবারে ইন্ডিয়ানত্বের ছোঁয়াও ছিল অল্প, তাই আমাদের বরং অসুবিধেই হত। কেবল গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রন ছাড়া আর কোনও পদই ভাল লাগত না। বাবা বলতেন, চাইনিজ খাবারের অভ্যেস করতে— সহজ পাচ্য, তেল মশলাও কম। আর সস্ ভিত্তিক রান্না, তাই মুখ বদলানোর পক্ষে আদর্শ। কিন্তু আমরা তিন জন সে কথা মানতাম না। শুধুই গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রনের দিকে হাত বাড়াতাম।
আমাদের স্কুল ছুটি পড়ে যেত পঞ্চমীর দিন। আর খুলত ভাইফোঁটার পর। পুজোর ক’দিন বইপত্র শিকেয় তোলা থাকত।
পুজোর প্রতি দিন সকালে বাবা নিয়ম করে চালাতেন গ্রামাফোন চেঞ্জার। আর একে একে সানাই, শরদ, সেতার, নতুন গানের এলপি রেকর্ড— কলের গান বাজত। বছরের এই সময়টা নিয়ম করে বাবা সেই শব্দ যন্ত্রটির পরিচর্যা করতেন পুজোর কয়েক দিন আগে থেকেই। আজও সেই পুরনো আধুনিক গানগুলো রেডিওতে শুনলে মনটা যেন কেঁদে ওঠে। শিউলির গন্ধ, পুজোর ঢাকের আওয়াজ, শিশির ভেজা শরত্কাল ছুট্টে এসে মনের দরজায় কড়া নাড়ে। এক বার কেনা হয়েছিল হেমন্ত, মান্না, আরতি, প্রতিমা, শ্যামল, সন্ধ্যা, অনুপ ঘোষালের সাতটা ছোট ৪৫ আরপিএম-এর রেকর্ড, এইচএমভি থেকে বেরিয়েছিল। আর সবচেয়ে মজা হল দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সাতটা ছোট রেকর্ড এক সঙ্গে ওই চেঞ্জারে বসিয়ে সেট করে ঘুমিয়ে পড়লে নিজের থেকেই একটা একটা করে বাজতে থাকবে। খুব মজা হত— নতুন গান যা প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজছে তা আবার আমাদের বাড়িতেও বাজছে। অনুপ ঘোষালের ‘বিয়ে করবই না’, আরতি মুখোপাধ্যায়ের ‘বন্য বন্য এ অরণ্য ভাল’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাব’, মান্না দের “ক’ ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ”, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘গহন রাতি ঘনায়’— এই গানগুলো আমাকে তখন ছুঁয়ে গিয়েছিল, তাই বোধ হয় আজও মনের কোটরে পড়ে রয়েছে। সে বার এই গানগুলোই কিন্তু বেরিয়েছিল পুজোর গান হিসেবে, সালটা বোধ হয় ১৯৭৩ কি ১৯৭৪ হবে, ঠিক মনে নেই। এখনকার ছোটরা দেখি পুজোর সময়েও কম্পিউটার গেম খেলছে নয়তো টিভি খুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কার্টুন দেখছে। তাদের ঠেলেঠুলে প্যান্ডেলে পাঠাতে হয় আরতি দেখতে আর অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ খেয়ে আসার জন্য।
সপ্তমীর দিন সকাল থেকেই সব প্যান্ডেলে পড়ে যেত নবপত্রিকার স্নান করানোর ধুম। আলমবাজার গঙ্গার ঘাট খুব কাছে বলে সকাল থেকেই শোনা যেত ঢাকের আওয়াজ। প্রত্যেক বার মা বলতেন নবপত্রিকার পুজো মানে আসলে মা দুর্গার পুজোই। অত বড় মৃন্ময়ী মূর্তি তো আর গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে স্নান করানো যায় না, তাই নব পত্রিকা বা কলাবউকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ভাই কেবল বলত, ওটা তো গণেশের পাশে থাকে তাই গণেশের বৌ। মা দুর্গা কেমন করে গাছ হবে? মা তখন আবার ব্যাখ্যা করে দিতেন যে ন’রকমের উদ্ভিদ, যেমন, বেল, ডালিম, কচু, মান কচু, হরিদ্রা, অশোক, ধান, কদলী, আর জয়ন্তী গাছের চারাকে শ্বেত অপরাজিতা গাছ দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকা বানানো হয়। শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার প্রতীক রূপে চার দিন ধরে মা পূজিত হন।
সপ্তমীর দিন বিশেষ আমিষ পদ রান্না হত— মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছ, চিংড়ির মালাইকারি, আরও কত কি! সে দিন বিকেলে আড়িয়াদহে আর দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর দেখতে যেতাম রিকশা ভাড়া করে। বিরাট বিরাট পুজো হয় ওই দু’টি অঞ্চলে। মাঝে মাঝে ‘হল্ট’ দেওয়া হত মামারবাড়িতে আর জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে। জল যোগ এবং বিয়োগ করে ঠাকুর দেখার পর্ব চলত।
অষ্টমীর দিন ভোর থেকেই চলত অঞ্জলির প্রস্তুতি। একে একে স্নান সেরে সবচেয়ে ভাল আর দামি জামাটি পরে অঞ্জলি দিতে যেতাম। বিয়ের আগে পর্যন্ত এ ভাবেই কাটত ষষ্ঠী, সপ্তমী আর অষ্টমী।
বিয়ের পর প্রথম বছর কেটেছিল দক্ষিণ কলকাতার পুজো দেখে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজমের বাসে চেপে দেখতে গিয়েছিলাম কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো। আধুনিক থিমের দুর্গাপুজোর চেয়ে অনেক মন কাড়ে এই পুজোগুলি। সে বার সপ্তমীর দিন ধর্মতলা থেকে বাসে চড়ে দেখেছিলাম বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজো, জানবাজারে রানি রাসমণির বাড়ির পুজো, শোভা বাজারের রাজবাড়ির পুজো, উত্তর কলকাতার বিখ্যাত লাটুবাবু-ছাতুবাবুদের পুজো। ডাকের সাজের প্রতিমা, চণ্ডীমণ্ডপে সুদৃশ্য চালচিত্রে বিশাল আয়োজন, বাড়ির মহিলাদের সাবেকি গয়না ও বেনারসি শাড়ি পরে মায়ের পুজো গোছানো— সব কিছুতেই ঐতিহ্যের ছাপ।
আর এক বার আমরা একটা গাড়ি নিয়ে বেলুড় মঠে কুমারী পুজো দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানেও খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো হয়। তবে আজকাল ধর্মের নামে যে হুজুগের স্রোতে আপামর বাঙালি মেতে উঠেছে তা বেলুড় মঠের ভিড় দেখলেও বোঝা যায়।
পুজো এখন ফ্যাশানেবল হয়ে উঠেছে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আলোর রোশনাইয়ের সঙ্গে অনুরণিত হয় এক দিকে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্র আর ডিজিট্যাল এলসিডি স্ক্রিনে রংচঙে বিজ্ঞাপন। আর সেই সঙ্গে থরে থরে সাজানো ফাস্টফুডের গরমাগরম হাতছানি। এক একটি বারোয়ারি পুজো এখন ‘স্পনসর্ড’ পুজো— কোনও এক কোম্পানির সম্পত্তি, কোনও একটি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের কিনে নিয়েছে ওই পাঁচটি দিনের জন্য। প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে মা আসেন একটা প্যাকেজে! সেরা প্যান্ডেল, সেরা প্রতিমা, সেরা দর্শক শ্রীমতি, সেরা আরও কত কিছুর ভিড়ে কিন্তু আসল পুজো একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। সরে যাচ্ছে পুজোর মূল, অনাদি আবেদন।
আমার ছোটবেলা কেটেছে বরাহনগরের আলমবাজারে। পুজোর মাস দুয়েক আগে কোনও একটা সপ্তাহান্তে বাবা আমাদের কলকাতায় নিয়ে যেতেন পুজোর বাজার করতে। সে ছিল আমাদের সব চাইতে বড় উত্তেজনার দিন— সারাদিনের ‘প্রোগ্রাম’। সকালবেলা ভারী জলখাবার খেয়ে বেরোনো হত আর ফেরা হত সেই রাতে। বাড়ির সামনে থেকে সরকারি স্পেশাল বাস ‘এস ১৭’য় চেপে বসতাম আমরা চার জন। তার পর গিয়ে নামা হত লিন্ডসে স্ট্রিট। প্রথমেই ঠান্ডা পানীয়— ক্যাম্পাকোলা। তার পর সোজা হেঁটে বেন্টিঙ্কট স্ট্রিটে গিয়ে চিনে বাজারের জুতো কেনা হত। চিনেপাড়ার উস্তাদদের হাতে বানানো জুতোতে নাকি পা ভাল থাকে, তাই এত কষ্ট করা! সেই জুতোর বাক্স বয়ে যাওয়া হত নিউমার্কেটে। আমার ফ্রক কেনা হত স্টাইল টেক্স থেকে। মা প্রতিটি ফ্রকের ঝুল আর ডিজাইন খুঁটিয়ে দেখতেন যাতে পোশাকে শালীনতার মাত্রা বজায় থাকে। ভাইয়েরটা কেনা হত রহমান স্টোর্স থেকে। গঙ্গাদীন গুপ্তার অর্গ্যান্ডি আর কোটা শাড়ি, জয়সওয়াল স্টোর্স থেকে মায়ের তাঁতের শাড়ি, ঠাম্মার দুধ সাদা ফাইন থান, দিদিমার ইঞ্চিপাড়ের সাদা শাড়ি, মা দুর্গার লালপেড়ে শাড়ি, জ্যাঠামশাইদের জন্য ফাইন ধুতি— সব কিনে যাওয়া হত নাহুম’স-এ। নিউমার্কেটের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নাহুম’স-এর চিজ প্যাটি আর ডি গামার কেক। কেক, প্যাটি খাওয়ার পর বাড়ির জন্যও কিছু নিয়ে নেওয়া হত। তার পর যাওয়া হত লিন্ডসে স্ট্রিটের হ্যান্ডলুম হাউসে। এখানে তখন তো আর আনাচে কানাচে এত বুটিক ছিল না! তাই এক্সক্লুসিভ পিওর সিল্ক শাড়ি কিনতে মা ওখানেই যেতেন। আর সেখানে এক ঢিলে দুই পাখি! পর্দার কাপড়, বেডশিট সব কিছুই মিলত ন্যায্য দামে। বাবার জন্য প্রায় জোর করে মহাদেবী এন্ড মেহতা থেকে শার্ট প্যান্টের পিস কিনতেন মা।
তখন শহর কলকাতায় হাতে গোনা খাবারের দোকান ছিল। কিন্তু এ পাড়ায় সঠিক দামের ছোট বড় রেস্তোরাঁ ছিল বেশ কিছু। ছোলা বাটুরে আর স্পেশাল কুলফি মালাই খেতাম ইন্দ্রমহলে। র্যালি’স-এর সিরাপ আর সিমাইয়ের পায়েস সহযোগে এমন সুন্দর কুলফি মালাই বোধহয় আর কোথাও তখন পাওয়া যেত না। এর পর সিম্ফনিতে আমাদের অভিযান। নতুন পুজোর গানের এলপি রেকর্ড। আর তখন এইচএমভি থেকে শিল্পীদের গানের রেকর্ড কিনলে একটা গানের লিরিকসের বই দিত। মায়ের নজর থাকত ওই বইয়ের দিকেই। তত ক্ষণে ফুটপাতের দোকান থেকে ভাই মায়ের আঁচলে গেরো দিয়ে একটা গাড়ি বা মোটরসাইকেল বা একটা ক্যাডবেরি বাগিয়ে বসে আছে। আমার একটা হেয়ারব্যান্ড, জামার সঙ্গে ম্যাচ করে দু’টো ক্লিপ আর রিবনও কেনা হয়ে গিয়েছে। বাবা রেগেমেগে বলছেন ‘‘এ বছরই শেষ। তোমাদের নিয়ে আর আসা যাবে না এখানে। এত বায়না!” কথাগুলো বাবা যে এমনিই বলতেন সেটা আমি বুঝতাম। কিন্তু ভাই বেচারা খুব ভয় পেয়ে যেত।
বিকেলের চায়ের জন্য ঢোকা হত অনাদি কেবিনে। সঙ্গে অবশ্যই অনাদির স্পেশাল মোগলাই পরোটা। এই একটা দিন বাবা বাইরের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমাদের লাগাম ছেড়ে দিতেন। আর তখন কলকাতা এত পরিচ্ছন্ন ছিল যে বাইরের খাবার খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ভয় কম ছিল। এখন বাইরে খেতে গেলেই ভাবি ভাল জায়গায় যেতে হবে, এসি থাকতে হবে, ভাজাভুজি মোটেই না— হেলথ রুল মেনে খেতে হবে। খোলা জিনিস খাওয়া চলবে না ইত্যাদি।
এক বার বাবা আমাদের চাইনিজ রেস্তোরাঁ কারকো-য় নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন কলকাতায় চিনে খাবারের চল সবে হচ্ছে। চাংওয়া, জিমিস কিচেন, পিপিং আর কারকো— এই ক’টি রেস্তোরাঁতেই সাবেকি চিনে খাবার মিলত। আর চাইনিজ খাবারে ইন্ডিয়ানত্বের ছোঁয়াও ছিল অল্প, তাই আমাদের বরং অসুবিধেই হত। কেবল গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রন ছাড়া আর কোনও পদই ভাল লাগত না। বাবা বলতেন, চাইনিজ খাবারের অভ্যেস করতে— সহজ পাচ্য, তেল মশলাও কম। আর সস্ ভিত্তিক রান্না, তাই মুখ বদলানোর পক্ষে আদর্শ। কিন্তু আমরা তিন জন সে কথা মানতাম না। শুধুই গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রনের দিকে হাত বাড়াতাম।
আমাদের স্কুল ছুটি পড়ে যেত পঞ্চমীর দিন। আর খুলত ভাইফোঁটার পর। পুজোর ক’দিন বইপত্র শিকেয় তোলা থাকত।
পুজোর প্রতি দিন সকালে বাবা নিয়ম করে চালাতেন গ্রামাফোন চেঞ্জার। আর একে একে সানাই, শরদ, সেতার, নতুন গানের এলপি রেকর্ড— কলের গান বাজত। বছরের এই সময়টা নিয়ম করে বাবা সেই শব্দ যন্ত্রটির পরিচর্যা করতেন পুজোর কয়েক দিন আগে থেকেই। আজও সেই পুরনো আধুনিক গানগুলো রেডিওতে শুনলে মনটা যেন কেঁদে ওঠে। শিউলির গন্ধ, পুজোর ঢাকের আওয়াজ, শিশির ভেজা শরত্কাল ছুট্টে এসে মনের দরজায় কড়া নাড়ে। এক বার কেনা হয়েছিল হেমন্ত, মান্না, আরতি, প্রতিমা, শ্যামল, সন্ধ্যা, অনুপ ঘোষালের সাতটা ছোট ৪৫ আরপিএম-এর রেকর্ড, এইচএমভি থেকে বেরিয়েছিল। আর সবচেয়ে মজা হল দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সাতটা ছোট রেকর্ড এক সঙ্গে ওই চেঞ্জারে বসিয়ে সেট করে ঘুমিয়ে পড়লে নিজের থেকেই একটা একটা করে বাজতে থাকবে। খুব মজা হত— নতুন গান যা প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজছে তা আবার আমাদের বাড়িতেও বাজছে। অনুপ ঘোষালের ‘বিয়ে করবই না’, আরতি মুখোপাধ্যায়ের ‘বন্য বন্য এ অরণ্য ভাল’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাব’, মান্না দের “ক’ ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ”, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘গহন রাতি ঘনায়’— এই গানগুলো আমাকে তখন ছুঁয়ে গিয়েছিল, তাই বোধ হয় আজও মনের কোটরে পড়ে রয়েছে। সে বার এই গানগুলোই কিন্তু বেরিয়েছিল পুজোর গান হিসেবে, সালটা বোধ হয় ১৯৭৩ কি ১৯৭৪ হবে, ঠিক মনে নেই। এখনকার ছোটরা দেখি পুজোর সময়েও কম্পিউটার গেম খেলছে নয়তো টিভি খুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কার্টুন দেখছে। তাদের ঠেলেঠুলে প্যান্ডেলে পাঠাতে হয় আরতি দেখতে আর অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ খেয়ে আসার জন্য।
সপ্তমীর দিন সকাল থেকেই সব প্যান্ডেলে পড়ে যেত নবপত্রিকার স্নান করানোর ধুম। আলমবাজার গঙ্গার ঘাট খুব কাছে বলে সকাল থেকেই শোনা যেত ঢাকের আওয়াজ। প্রত্যেক বার মা বলতেন নবপত্রিকার পুজো মানে আসলে মা দুর্গার পুজোই। অত বড় মৃন্ময়ী মূর্তি তো আর গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে স্নান করানো যায় না, তাই নব পত্রিকা বা কলাবউকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ভাই কেবল বলত, ওটা তো গণেশের পাশে থাকে তাই গণেশের বৌ। মা দুর্গা কেমন করে গাছ হবে? মা তখন আবার ব্যাখ্যা করে দিতেন যে ন’রকমের উদ্ভিদ, যেমন, বেল, ডালিম, কচু, মান কচু, হরিদ্রা, অশোক, ধান, কদলী, আর জয়ন্তী গাছের চারাকে শ্বেত অপরাজিতা গাছ দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকা বানানো হয়। শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার প্রতীক রূপে চার দিন ধরে মা পূজিত হন।
সপ্তমীর দিন বিশেষ আমিষ পদ রান্না হত— মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছ, চিংড়ির মালাইকারি, আরও কত কি! সে দিন বিকেলে আড়িয়াদহে আর দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর দেখতে যেতাম রিকশা ভাড়া করে। বিরাট বিরাট পুজো হয় ওই দু’টি অঞ্চলে। মাঝে মাঝে ‘হল্ট’ দেওয়া হত মামারবাড়িতে আর জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে। জল যোগ এবং বিয়োগ করে ঠাকুর দেখার পর্ব চলত।
অষ্টমীর দিন ভোর থেকেই চলত অঞ্জলির প্রস্তুতি। একে একে স্নান সেরে সবচেয়ে ভাল আর দামি জামাটি পরে অঞ্জলি দিতে যেতাম। বিয়ের আগে পর্যন্ত এ ভাবেই কাটত ষষ্ঠী, সপ্তমী আর অষ্টমী।
বিয়ের পর প্রথম বছর কেটেছিল দক্ষিণ কলকাতার পুজো দেখে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজমের বাসে চেপে দেখতে গিয়েছিলাম কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো। আধুনিক থিমের দুর্গাপুজোর চেয়ে অনেক মন কাড়ে এই পুজোগুলি। সে বার সপ্তমীর দিন ধর্মতলা থেকে বাসে চড়ে দেখেছিলাম বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজো, জানবাজারে রানি রাসমণির বাড়ির পুজো, শোভা বাজারের রাজবাড়ির পুজো, উত্তর কলকাতার বিখ্যাত লাটুবাবু-ছাতুবাবুদের পুজো। ডাকের সাজের প্রতিমা, চণ্ডীমণ্ডপে সুদৃশ্য চালচিত্রে বিশাল আয়োজন, বাড়ির মহিলাদের সাবেকি গয়না ও বেনারসি শাড়ি পরে মায়ের পুজো গোছানো— সব কিছুতেই ঐতিহ্যের ছাপ।
আর এক বার আমরা একটা গাড়ি নিয়ে বেলুড় মঠে কুমারী পুজো দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানেও খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো হয়। তবে আজকাল ধর্মের নামে যে হুজুগের স্রোতে আপামর বাঙালি মেতে উঠেছে তা বেলুড় মঠের ভিড় দেখলেও বোঝা যায়।
পুজো এখন ফ্যাশানেবল হয়ে উঠেছে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আলোর রোশনাইয়ের সঙ্গে অনুরণিত হয় এক দিকে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্র আর ডিজিট্যাল এলসিডি স্ক্রিনে রংচঙে বিজ্ঞাপন। আর সেই সঙ্গে থরে থরে সাজানো ফাস্টফুডের গরমাগরম হাতছানি। এক একটি বারোয়ারি পুজো এখন ‘স্পনসর্ড’ পুজো— কোনও এক কোম্পানির সম্পত্তি, কোনও একটি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের কিনে নিয়েছে ওই পাঁচটি দিনের জন্য। প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে মা আসেন একটা প্যাকেজে! সেরা প্যান্ডেল, সেরা প্রতিমা, সেরা দর্শক শ্রীমতি, সেরা আরও কত কিছুর ভিড়ে কিন্তু আসল পুজো একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। সরে যাচ্ছে পুজোর মূল, অনাদি আবেদন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন