৩ জুল, ২০১৭

সর্বমঙ্গলা বিপদতারিণী মা দুর্গা


Ei Samay Burdwan Suppliment 3rd July 2017


বর্ধমানের মানুষজনের বিশ্বাস দেবী বিপত্তারিণী হলেন মা দুর্গার অনেকগুলি অবতারের মধ্যে একটি। আষাঢ়মাসে শনি-মঙ্গলবারে মহা ধুম করে এখানে মেয়েরা বিপদতারিণীর পুজো করেন। অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবরত্ন রীতিতে এ নির্মিত মন্দির হল বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দির । ১৭০২ খ্রীষ্টাব্দে বর্ধমানের মহারাজ কীর্ত্তিচাঁদ হলেন এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠিতা  । 
এখানে দেবী কষ্টি পাথরে অষ্টাদশভুজা সিংহবাহিনী মহিষমর্দ্দিনী। এই সেই মন্দির যেখানে দুর্গাপুজোর সন্ধিপুজোয় কামান দাগার ক্ষণটিতে সারা জেলা জুড়ে একযোগে অষ্টমী-নবমী সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম বর্ধমানের কবি রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল কাব্যেও উল্লেখ আছে এই সর্বমঙ্গলা দেবীর । 

স্থানীয় মানুষদের কিংবদন্তী  বলে বর্ধমানের উত্তরে সর্বমঙ্গলা পল্লীতে ছিল বাগদী সম্প্রদায়ের বাস। সেখানেই নাকি ছিল এই কষ্টিপাথরের বিগ্রহটি। তারা না জেনে বুঝে এই পাথরটির ওপরে তাদের খাবার জন্য গেঁড়ি, গুগলি, শামুক, ঝিনুক রেখে ভাঙত প্রতিদিন। আর চুনোলী মানে যারা চুন তৈরী করে তারা এসে খোলাগুলি পরিষ্কার করে নিয়ে যেত। একদিন তারা খোলার সাথে সেই পাথরটিও নিয়ে যায় আর চুনভাটির মধ্যে পাথরটিকেও পুড়তে দেয়। কিন্তু পাথরটি পোড়ে না। পরে তারা দামোদর নদে পাথরটি ফেলে আসে। দামোদর নদের  বিছানায় পাথরটি পড়ে থাকতে দেখে এক ব্রাহ্মণ সেটিকে ধুয়ে মুছে এনে সেটির গায়ে দেবীমূর্তির সকল চিহ্ন দেখতে পান ও তক্ষুনি তাকে গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠা করেন ।  
প্রতিবছর এখানকার মেয়েরা নিজেদের বিশ্বাসে হাজির হয় এই জাগ্রত মন্দিরে। কেউ কেউ নদীতে স্নান করে দন্ডী কাটে বিপদ কেটে যাবার আশায়।  ভাবলে অবাক হতে হয়, এই বাংলায় দেবী দুর্গা তবে শুধুই আশ্বিন মাসে পূজিতা হন না । প্রতিমাসেই তাঁর আরাধনা নিয়ে থাকে বাঙালী, সংসারের মঙ্গলকামার্থে, বিপদের হাত থেকে বাঁচবে বলে।
বিপত্তারিণী পুজোর ব্রতকথাটি ঘাঁটলে দেখতে পাই তেমনি এক গল্প যেখানে ধর্মশীল বৈদর্ভ রাজ্যের রাজার রাণী সুরূপা অগাধ বিশ্বাসে মা বিপদতারিণীর ব্রত করেছিলেন । রাজা অনেক দান-ধ্যান,  যাগ-যজ্ঞ করতেন এবং প্রজাপালক রূপে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন । তাঁর রাণী  সুরূপাও ছিলেন ধর্মপরায়ণা। তিনি জাতপাঁতের বিচার না করে সমাজের আপামর স্ত্রীলোকের সাথে সমানভাবে  মিশতেন । এক নিম্ন শ্রেণীর চামার বৌয়ের সাথে তিনি স‌ই পাতিয়েছিলেন । ফলে রাজবাড়িতে এই চামার বৌটির খুব যাতায়াত ছিল । রাণী সুরূপা ভালোভালো খাদ্যদ্রব্য তাকে দিতেন এবং তার বিনিময়ে সেই চামার বৌ রাণীকে নানাবিধ ফলমূল এনে দিত । এইভাবে বেশ চলছিল উভয়ের বন্ধুতা ।

একদিন সুরূপার সাধ হ'ল গোমাংস কেমন হয় তা চাক্ষুষ দেখতে । চামার বৌ তাকে বারবার নিষেধ করল কিন্তু রাণী তাঁর জেদ ধরে বসে র‌ইলেন। অতঃপর চামার বৌ পরদিন একটি থালায় করে চাপা দিয়ে কিছুটা গোমাংস নিয়ে যেমনি রাজবাড়িতে প্রবেশ করবেন তখুনি দ্বারীর তা নজর পড়ল । রাজাকে গিয়ে তত্ক্ষণাত সে নালিশ করলে । প্রহরীকে বেঁধে রেখে রাজা স্বয়ং রাজ অন্দরমহলে গেলেন সত্যতা  যাচাই করতে। রাণী সেই সময় তাঁর স‌ই কে আদেশ দিচ্ছিলেন, সেই গোমাংস পূর্ণ থালাটি  খাটের নীচে লুকিয়ে রাখার জন্য ।
রাজা এসে রাণীকে জিজ্ঞাসা করলেন "তোমার স‌ই তোমার জন্য কি উপহার এনেছে আমাকে দেখাও"
রাণী তো রাজাকে দেখে ভয়ে চোখে অন্ধকার দেখলেন এবং বিপদগ্রস্ত হয়ে মা বিপদতারিণীকে স্মরণ করলেন । কারণ বাড়ীতে গোমাংস ঢুকেছে  জানলে রাজা  রাণীর গর্দান নেবেন।
মাদুর্গার আসন রাণী সুরূপার আর্তিতে টলে উঠল । তিনি রাণীকে যেন কানেকানে বললেন ঐ চাপা দেওয়া থালাটির মধ্যে তার স‌ইয়ের দেওয়া চৌদ্দটি ফল  রাজাকে দেখিয়ে দিতে এবং স্নান সেরে রাজাকে সেই ফলগুলি ব্রাহ্মণকে দান করতে ।  রাণী সুরূপা তো অবাক! থালার চাপা সরিয়ে রাজাকে দেখালেন সেই চৌদ্দটি ফল । মাদুর্গার কৃপায় গোমাংসের চৌদ্দটি ফলে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনা দেখে রাজা এবং  রাণী সুরূপা নিজে তো বিস্ময়ে হতবাক । মাদুর্গা রাণীকে আরো বললেন যে তিনি স্বয়ং বিপদতারিণী মা । যে তাঁকে স্মরণ করবে তার কোনো বিপদ আপদ হবেনা ।
রাণীকে যাবজ্জীবন এই ব্রত পালন করতে বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন। রাণী এভাবে বিপদ থেকে মুক্তি পেলেন।
রাজা স্নান সেরে এসে সেই ফলগুলি ব্রাহ্মণসেবায় দিলেন । মা বিপদতারিণীর অলৌকিক ক্ষমতায় সেদিন সুরূপা প্রাণে বেঁচে গেছিলেন।   
সেই থেকে বর্ধমান তথা সারা বাংলার এয়োতিরা এই বিপদতারিণী পুজোয় সামিল হয়ে নিষ্ঠাভরে দেবী দুর্গার পুজো করেন।  শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া থেকে দশমী অবধি যে যে শনি ও মঙ্গলবার পড়ে সেগুলিতে এই ব্রত পালনের নিয়ম। একটি চুপড়িতে তেরো রকমের ফল (দুটি খণ্ড করা), তেরো গাছা লাল সুতো, তেরো রকমের ফুল, তেরোটি মিষ্টি, পান, সুপারী হল এই পুজোর উপাচার। পুজো শেষে ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দিয়ে তেরোটি গাঁট দেওয়া লাল সুতো বা তাগা  মেয়েদের বাঁহাতে আর ছেলেদের ডান হাতে বেঁধে দেবার  নিয়ম।
আর পুজো শেষে যেনতেনপ্রকারেণ তেরোটি নুন না দেওয়া লুচি খেতেই হবে উপোসী ব্রতীকে। তাই দেখেছি এই পুজোর দিনে ছোট্ট ছোট্ট লুচি বানাতে, পেট ভরে গেলেও যাতে শেষ করা যায় তেরোটি।  আর সারাদিনে পুজো করে ঐ একবারই খেতে পারবে সে। কোনও তরকারী খাওয়া চলবে না ঐদিন।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। এভাবেই মা বিপত্তারিণী একাধারে সংকট হারিণী আবার বাংলায় অবশ্য কর্তব্য আষাঢ় মাসের দুর্গা পুজোও বটে।

কোন মন্তব্য নেই: