স্থান- কৈলাশ, কাল- প্রত্যুষ, পাত্র- দেবাদিদেব মহাদেব.
এটুকু বললেই যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হল ভোলেনাথ মহাদেব তাঁর অতি প্রিয় ব্যাঘ্রচর্ম আসনে বসে ধ্যান মগ্ন, নাগরাজ তাঁর গলায় ডিজাইনার গয়নার মত দোদুল্যমান, নন্দী-ভৃঙ্গী মাতোয়ারা হয়ে ব্যোম..ব্যোম.. শব্দে চারিদিক মাতিয়ে তুলেছে এবং বলাই বাহুল্য যে গঞ্জিকা ধূমের প্রতিক্রিয়ায় সকলেই আমোদিত। ভোলেনাথের গঞ্জিকা না হলে দিন ভালো যায়না, তাই ভোর বেলাতেই দু-এক ছিলিমের সেবা হয়ে গেলে পোয়াবারো। সারাদিন বুঁদ হয়ে থাকা যায় জাগতিক সুখসুবিধা আশা-নিরাশার পরোয়া না করেই। এমনিতেই কৈলাশের এই বরফ ঢাকা পাহাড়ি প্রান্তরে এন্টারটেইনমেন্ট এর কোনো ব্যবস্থা নেই, অপ্সরারাও কেবল দেবরাজ ইন্দ্রের সভাঘরে নৃত্যগীতের পারদর্শিতা দেখাবার জন্যে চুক্তিবদ্ধ ।এই ঠান্ডায় এবড়োখেবড়ো পাহাড়ে নাচা-গানা করার জন্যে তাদের ভারী বয়ে গেছে! তাই নন্দী ভৃঙ্গীর গালবাদ্যের যুগলবন্দী আর ভোলানাথের ডমরুধ্বনীই ভরসা। মহাদেব অসাধারণ নৃত্যপটু কিন্তু তাঁর নৃত্যের অর্থ সমূহ বিপদ। প্রলয় নাচন শুরু হলে আর রক্ষা নেই। পৃথিবী যাবে রসাতলে। যতক্ষন তিনি গঞ্জিকাচ্ছ্ন্ন হয়ে নিমীলিত নেত্রে ইষ্টনাম জপে মগ্ন থাকেন ততক্ষনই সবার পক্ষে মঙ্গল। মা দুর্গাও বারবার বলে দিয়েছেন কোনমতেই যেন মহাদেবের রক্তচাপ বৃদ্ধি না হয়। যদি হয়, তবে মা জননীর ত্রিশুলের খোঁচায় অথবা খড়্গাঘাতে নন্দী ভৃঙ্গীর মুন্ড কাটা পরবে। সে রিস্ক নিয়ে যে লাভ নেই, তাই এভাবেই দিন কাটানো শ্রেয়ঃ ।
কাল পয়লা বৈশাখ, ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো কোনো রাজ্যের মানুষ খুব ধুমধাম করে এই দিনটি পালন করেন। তাদের মধ্যে বঙ্গপ্রদেশ অন্যতম। তবে সমস্যা সেটি নয়, সমস্যার কারণ আজ নীল পূজা। বাঙালি জাতির ধর্মপ্রাণা মহিলাকূল খুবই নিষ্ঠাভরে দিনটি পালন করেন শিবার্চনা করে। কিন্তু এবারের মুশকিলটা একটু অন্যরকম। বাবার মেজাজও তিরিক্ষি। দুচার দিন হল থানা পুলিশের চক্করে মনের শান্তি যার-পর-নাই ভ্রষ্ট।আজকালকার পুলিশ পেয়াদাগুলো লজ্জা-শরমের মাথা খেয়েছে।ঘুষ খেয়ে খেয়ে এতই অভ্যস্ত যে মহাদেব কেও রেহাই দেয়নি। ভোলানাথ ট্যাঁকে ক্যাশ টাকা রাখেন না, তাই ওরা তাঁর শখের ছিলিমটি জব্দ করেছে। গন্ডারের সিং দিয়ে বানানো, খাস অসমের কাজিরাঙ্গা থেকে এনে এক ভক্ত উত্সর্গ করেছিল বছর কয়েক আগে।
তা মোদ্দা কথায় আসা যাক। ওই যে বললাম আজ নীল পুজো, বাবার না হলেও, নন্দী ভৃঙ্গীর মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে চাল, কলা, ডাব, দুধ, গাঁজা, ভাঙ্গ ...ইত্যাদির নতুন সাপ্লাই আসবে ভেবে। কিন্তু আসল মানুষ, থুড়ি, দেবতার মেজাজ চটে আছে ওই পুলিশের চক্করে। ভোলেনাথ মুক্তপুরুষ, সোনাদানার ধার ধারেন না কস্মিনকালেও । রুদ্রাক্ষের গয়না, সাপের মালা...এই তাঁর সিগনেচার সাজ। পরনেও কেবলমাত্র বাঘছালের কটিবন্ধ। কৈলাশের এই ঠান্ডায় গায়ে একটি জামা পর্যন্ত দেন না। মা জননী এ নিয়ে কতই না গঞ্জনা করেছেন! রাগেদুঃখে সজল চোখে সারাদিন গোঁসাঘরে কাটিয়েও দেখেছেন, কা কস্য পরিবেদনা!...কোনো লাভ হয়নি।
শুধু ছিলিম নয়, পুলিশের নজর বাবার বাঘছাল এবং গঞ্জিকার ওপরেও। এই দুটি জিনিসই বাবার সারাক্ষণের সঙ্গী, দেখতে সাধারণ মনে হলেও এদের কর্ম অসাধারণ।কটিবন্ধের বাঘছালটি বাবার লাজ রাখনেওয়ালা এবং মনমোহক গঞ্জিকার পুরিয়াটি দিব্যদৃষ্টি দেনেওয়ালা।তাও সে ব্যাটাদের প্রাণে সয়না! একদিকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নিয়মকানুন অন্যদিকে নেশাদ্রব্য ব্যবহারের জন্যে আবগারী আইন...যাকে বলে সাঁড়াশি আক্রমণ। জেরবার করে দিচ্ছে নানারকম কমিশন টমিশন বসিয়ে এতেও রক্ষা নেই, পুজো উপলক্ষ্যে ঘটি ঘটি জল, দুধ আর ডাবের জলে স্নান করিয়ে সর্দিজ্বরের উপক্রম করেছে।সেগুলো পৃথিবীর নানা প্রান্তে যে জায়গাতেই ঢালুক, এফেক্ট তো সোজা কৈলাশেই এসে হয়, তাও এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায়! মন মেজাজ ভালো থাকবে কি করে? তাই আজ বাবার কপালে ভাঁজ, তৃতীয় নয়নে রোষের আভাস, আলুথালু জটাজাল, মস্তিষ্কে আগ্নেয়গিরি…।
সন্ধ্যা অতিক্রান্ত, মহাদেব ধ্যান ভাঙতেই হুহুঙ্কার দিলেন..."সব তফাত যাও... (রেগে গেলে বাবা ভোলানাথ দেবভাষা ছেড়ে বাংলা ও দেবনাগরীর ককটেল বলেন) সবকো ভস্ম কর দুঙ্গা...ঠান্ডায় মেরা জান নিকাল রহা হ্যায় আউর তুমলোগ সারাদিন ধরকে পানী আউর দুধ ঢেলে আমাকে চান করাতা হ্যায়! এদিকে তেষ্টায় মেরা ছাতি ফাটতা হ্যায়, ও নেহি দেখতা! যতসব মর্কটকা দল...খতম কর দুঙ্গা সবকো....!... (এবার কিঞ্চিত নরম সুরে..) দে ভাই, শান্তিসে একটু ব্যায়ঠনে!...আরে বাপ আমার, দেনা বাপু আমাকে থোড়া নিজের মত থাকতে,…ভাগো সব হিঁয়াসে...খালি যাবার আগে ছিলিমটা দিয়ে যাস…!!!
৫টি মন্তব্য:
মধুমিতা প্রমাণ করেছে " আমাকে আমার মত থাকতে দাও " টপিকে এত সুন্দর রম্য রচনা লেখা যায় ! হ্যাপি ব্লগিং মধুমিতা !
বেশ মজা লাগল পড়ে। নববর্ষের শুভেচ্ছা নেবেন।
হা ! হা! হা! সত্যিত্যো নিজের মঙ্গল চাইতে চাইতে ভক্তেরা বেচারার শ্বাস নেবার সুযোগটুকুও কেড়ে নেয়! দারুণ ! হাসালেন বটে!
Madhumita tomar lekhata khub upabhogya hoyechhe.subhechhe roilo.
ইন্দিরাদি, যে পত্রিকার জন্যে আপনার কবিতা নিলাম, সেই একই পত্রিকার জন্যে মধুমিতা ভট্টাচার্যের এই রম্যরচনাটা নিলে উনার আপত্তি থাকবে না তো? উনাকে জিজ্ঞেস করে জানাবেন তো?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন