১৪ এপ্রি, ২০১১

আপনমনে আমায় থাকতে দে : রমা চৌধুরী



চৈত্রের সকাল শান্ত। উদাসীন। রং-এর রসাতলে বসেও তার কোনো সর্বনাশ নেই। সে বৈরাগীটি আপনমনে ধুলোর ঘূর্ণি ওঠা পথে ঘুরে বেড়ায় । পলাশের বনে ছমছমে আগুন। দহনে বিষাদে বুক পুড়ে যায়। বুক ভেসে যায় ভালবাসায়। এর-ই নাম চৈত্র। 



আঁকড়ে ধরে বেয়াদবের মত। ছড়িয়ে ফেলে খামখেয়ালে। তার কি-ই বা যায় আসেসে প্রেমিক শিল্পীরং-এর পসরা নিয়ে তার কারবার। বিকোবার দায় নেই। সঞ্চয়ের স্বপ্ন নেই। কেবল ছড়িয়ে যাওয়া। বিলিয়ে দেওয়া। পথ ভোলা পথিককে কতজন ডাক দেয় রং-এর তাপ ছড়িয়ে। সুগন্ধী আঁচল মেলে। সে আলোর শরীর কামনায় জ্বেলে চলে যায় বেভুল। দিগন্তরের আলপথ ধরে সন্ধ্যের দিকে তার একলা হাঁটা। গোধূলি তখন লাল হলুদের উদ্দাম শংখ লাগিয়ে খেলা ভাঙ্গার খেলায় মেতে উঠেছে। একটু পরেই দীর্ঘ অন্ধকারের হাত মেলে আলো মুছতে মুছতে ফিরে যাবে আঁধার ঘরে। জ্বেলে দেবে সন্ধ্যেতারার আলো। ঘরে ফিরছে তখন যারাতাদের জন্য অন্ধকার আকাশে শান্তি ছড়িয়ে নিকষ আঁচল জ্বলজ্বল করবে তার। জুঁই ফুলের মত স্বাতী অরুন্ধতী দূর থেকে স্নিগ্ধ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকবে তোমার দিকে। তোমার একলা কুটিরে জোৎস্নার কাম নিয়ে শুয়ে থাকবে স্মিত চাঁদ। কালপুরুষ দৃপ্ত ভালোবাসা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে একা। সে কারও নয়। তবু তুমি চাইবে তাকে তুমুল প্রেমে। উদার শরীরে তার ঝলকে উঠবে তোমার মিনতি। আজ রাতে তাকে চাইতে পারো তুমি যে কোনো অভীপ্সায়।
এ বসত তোমার একার। পড়শি নেই। ঠিকানা নেই। জনহীন জানলায় তোমার চোখের দিগন্ত। ওপারে এসে দাঁড়িয়েছে অনন্ত রাত্রি। অকুণ্ঠ তার শরীর। বাদাম গাছে নতুন তামাটে পাতারা থরথর করছে হাওয়ায়। সে না কি মলয় বাতাস। এমনি এসে ভেসে যায়। কাঁপিয়ে দিয়েজাগিয়ে দিয়ে। তাসের দেশের রাজপুত্রের মত। ইচ্ছের খেয়াল তার অভিসার। তুমিও তো ইচ্ছেমতী। যখন তখন ঝাঁপ দাও আকাশ থেকে পাতালে। জলস্রোত বহে যায় পাগলের মত। কোনদিকে যে যাও তুমিকাকে যে চাই তোমারকি হবে তা জেনেভাসতে চাই তো ভাসতে চাই। ডুবলেই বা ক্ষতি কিকোথাও তো নির্ঘাত আছেই সে সমুদ্র। তার উত্তাল শরীর নিয়ে। একদিন তো দেখা হবেই। আর না-ই যদি হয়তাতেই বা কি। এই যে সে ডাকছে আমায়আর আমি চলছি তার দিকেএই তো বেশ। যাত্রাই যে আসলঠিকানা নয়এ আর তুমি বুঝবে কবে প্রেমিকযেতে যেতে এই ছুঁয়ে যাওয়াকেড়ে নেওয়ার দস্যুতাফিরে চাওয়ার আকুতিছড়িয়ে ফেলার বাদশাহী মেজাজএকেই বলে বেঁচে থাকা। এর-ই নাম জীবন। বুনো পায়রার মত একেবারে নিঃসীমে হারানো। কামুক পুরুষের মত দমবন্ধ আঁকড়ে ধরা। বেদুইন সুরের পিছু পিছু ঘূর্ণি ঝড়ের মত ছোটা। ভোরের ভৈরবী হয়ে বাজলেও দুপুরের বৃন্দাবনী সারং-এর কাছে নতজানু হওয়া কামনায়। বেলা-শেষ যখন কোমল মুখ তুলে ধরে সন্ধ্যের দিকেতখন পূরবীর তান শুরু হোক। সন্ধ্যের ইমন তীব্র মধ্যমের ইশারায় আদর করুক। রাত্রির বেহাগ বাজুক শরীরে। তারপর নামবে অতল অন্ধকার। গহনে নির্জনে তুমি দেখা পাবে তার। সে যে তোমার এত কাছে ছিল কে জানতহিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকলে জানব-ই বা কি করেডুব-তল অন্ধকারে তার দরজা খোলা দু হাট করে। শুয়ে আছে সে একা। তার শরীরের গেরুয়া চাদরে বৈরাগের ঐশ্বর্য। যখন ফুল ফুটেছিলকিছুই জানিনি। সে যে দূরে নেই কে জানতসে যে শুধু আমার তাই বা জানা হল কবেএ মাধুরী যে আমার হৃদয় উপবনে লুকিয়ে থেকে এমনি করে পাগল করবে আমায় বোঝা যায়নি তা-ও।
এখন আর যাওয়ার নেই কোথাও। অতন্দ্র অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকি আমার কামনায়। আমার বিশ্বাসে। আমার পরিত্রাণে। সামনে ধু-ধু মাঠ জ্যোৎস্নায় বানভাসি। অপার। অসীম। আমি একা। তাই আমি তার। আমি একা। তাই সে আমার। পথে চলে যেতে যেতে পরশ পাবার এই মুহূর্তে আমি থাকি আমার মতন। আমায় থাকতে দাও আপনমনে।


আমি রিনি । কাগজে কলমে রমা চৌধুরী ।  ছন্নছাড়া, খামখেয়ালি। প্রকৃতি আমার প্রাণ।  আমার প্রেমিক আমার ভগবান ।  আমি লিখি, গান গাই ।  মানুষের জগতের বদলে পশুপাখী, পোকামাকড়ের জগত আমার বেশি প্রিয় । আর কিছু বলার নেই । বাকি কথা বলবে আমার লেখা । 

৫টি মন্তব্য:

kalyanbandhu বলেছেন...

ঈর্ষা জাগছে লেখিকার অসাধারণ গদ্য-তুলির এমন অনায়াস সঞ্চরণ দেখে।আপন পরিচয়টিও দিয়েছেন বড়ো সুন্দর ভঙ্গিমায়।প্রশ্ন জাগে,ইনি কোথায় ছিলেন এতোদিন?

মেঘ বলেছেন...

খুব সুন্দর।
মেঘ

madhumita বলেছেন...

bhari bhalo laglo poRe. Lekhikar janye shubhechha roilo.....

সংঘমিত্রা বলেছেন...

Osadharon ekti gadya rachana.sandhyar Imon er kori ma r moto tibra o bisonno.

Indira Mukhopadhyay বলেছেন...

যা বলেছ সঙ্ঘমিত্রা । লেখিকা যে গান আর সাহিত্যে সমান পারদর্শী তা বোঝা যায় আর সেই সাথে ডিজিটাল ছবি আঁকাতেও ।