পুবের নরম আলো পড়ছিল তার গায়ে। গা আবার কোথায় তার ? সে তো রোদ লাগবে বলে ঢাকা।আর ' 'তার' বলতে কার? কার আবার, আমাদের আদরের কন্যে দুর্গার গায়। দুর্গা স্নানে যাবে বলে কথা! সব্বোমটি মাড়িয়ে, ঢাক ঢোল পিটিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে, উলু দিয়ে, মেয়ে যাবে পাইক বরকন্দাজের কোলে চেপে। কেউ আবার পালকিতে নিয়ে যায়। কেউ আবার দোলায় । কেউ মাথার ওপর ছাতা ধরে তার। পাছে মেয়েটার কষ্ট হয়। পরিপাটি করে লাল পাড় কোরা শাড়িতে মেয়ের উথলে ওঠা রূপলাবণ্য ঢেকে দিয়েছে বাড়ির বড়োরা। লজ্জা মেয়ের ভূষণ কিনা । লাজে অবনত মেয়ে ঘোমটার আড়ালে মুচকি হাসে।
ভাবে, এইদিনটা পুরুষগুলোর খুব উত্সাহ। সারাটা বছর দানাপানি দেয়না কেউ। মহাসপ্তমীর ভোরে মেয়ের মহাস্নানের জন্য সব পুরুষের দরদ যেন উথলে ওঠে।
অবগুন্ঠনা মেয়ে মনে মনে বলে ওঠে,
প্রকৃতি সতীরে সাজিয়ে দাও। বলি, ঘরের মেয়েটাকে যত্ন করো তোমরা? আমায় নিয়ে বছরে একটা দিন এমনি আদিখ্যেতা না করলেও তো পারো। আর প্রকৃতি সতী? যে সারাটা বছর তোমাদের ভালোয় মন্দে মাথায় ছাতা ধরে রয়েছে? তোমাদের অসুখ থেকে মুক্তি দিচ্ছে সেই ওষধিরা? তাদেরো হেলাফেলা কোরোনি বাপু! ওরাও মানুষের জীবনদায়ী। আযুর্বেদের ঐতিহ্যবাহী ভারতবর্ষে মানুষের এত রোগভোগ । আমাদের এ দেশটায় আবার চাষাবাদ সর্বস্বতা! কৃষিকাজ তাদের রুজি রোজগার। তাই মহাসপ্তমীর ভোরে এই সবুজের অভিযান। সবুজের স্নান। আমি থাকি সবকিছুর অলখ্যে, সকলের আড়ালে। নেপথ্যের নায়িকা হয়ে।
ছোটবেলায় জ্ঞান হবার পর থেকে আমরা সকলেই দুর্গাপুজোর সপ্তমীর ভোরে মহা সমারোহে ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে গঙ্গায় বা নদীতে “কলা-বৌ” স্নান করানোর আয়োজন দেখি । স্নান করিয়ে সেই কলাবৌটিকে নতুন লালপাড় শাড়ি পরিয়ে মাদুর্গার পাশে রাখা হয় এবং পুজোর পাঁচটাদিন পুজো করা হয় ঐ কলাবৌটিকে । মা দুর্গাকেই ঐ রূপে পুজো করা হয় ।
মায়ের সেই মহাস্নানের মাহেন্দ্রক্ষণ। আশ্বিনের নরম রোদ গরম হতে থাকে বেলা বাড়ার সঙ্গে। কন্যে তখন ঘেমে নেয়ে একসা। ততক্ষণে তার ত্বকের প্রতিটি রোমকূপ উন্মুক্ত। এবার তার সৌন্দর্য্য চর্চায় ব্রতী হবার পালা। ইদানীং রূপসজ্জার জন্য আমরা অনেকেই ভেষজ উপাদানে ভরসা রাখি।মা দুর্গা সেই আদিকাল থেকেই স্কিন ফ্রেন্ডলি এইসব প্রাকৃতিক উপাদানেই রূপচর্চা করতে অভ্যস্ত। তাঁর পুজোয় সবই ভেষজ। দুর্গাপুজোর বিধিতে আট আঙুল পরিমাণ সরু বেলকাঠ দিয়ে দেবীর দন্তমার্জনা থেকে শুরু করে কুলকুচির জন্য কবোষ্ণ জল এমনকি স্নানের আগে গায়ে মাখার জন্য সরষের তেল ও কাঁচা হলুদ বাটা রাখতে হয়।
গঙ্গার জল ছাড়াও দেবী স্নান করেন শঙ্খ অর্থাৎ শামুকের দেহে যে জল থাকে সেই পরিশ্রুত জলে। এ ছাড়াও ঝর্না ও তীর্থের জলও লাগে দেবীর মহাস্নানে। পঞ্চগব্য বা দুধ, দই, ঘিয়ের সঙ্গে সনাতন বিশ্বাসে পবিত্র এবং রোগ বিনাশক গোময়, গোমূত্রও লাগে। আর লাগে পঞ্চ কষায় বা জাম, শিমূল, বেড়েলা, বকুল ও টোপাকুল গাছের ছাল ভেজানো জল। আর দেবীর মুখ পরিষ্কারের জন্য চাই হাতির দাঁতে করে উপড়ে তোলা মাটি। এ ছাড়াও বেশ্যাদ্বার, রাজদ্বার-সহ নানা স্থানের মাটিও দরকার হয়। নিয়ম অনুসারে লাগে উইয়ের ঢিবির মাটিও। মধু তো থাকেই সেই সঙ্গে দেবীর শরীরের ময়লা তুলতে লাগে চিনি।
এ যেন আমাদের আধুনিকার সনা বাথ নিয়ে গায়ে বেশ করে সরষের তেল, কাঁচাহলুদ বাটা মাখা হল। তারপর সুবাসিত তিলতেল মেখে আরো কিছুক্ষণ রোদ লাগানো। পরের পর্যায়ে তাঁর ফেসপ্যাক এবং বডিপ্যাক । এখন বিউটিশিয়ানরা মুলতানি মাটি, গঙ্গামাটি মাখতে বলেন! মা সেই কবে থেকে মেখে আসছেন তা! গজদন্ত মৃত্তিকা বা হাতির গজদাঁত লেগেছে এমন মৃত্তিকা, বৃষশৃঙ্গ মৃত্তিকা বা ষাঁড়ের শিঙের স্পর্শে ধন্য মাটি, নদীর উভয়কুলের মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারের মাটি, রাজদ্বারের মাটি, উইঢিপির মাটি, চতুষ্পথ মৃত্তিকা অর্থাত চৌরাস্তার মোড়ের মাটি আর সর্বতীর্থের মাটি মেখে মা বসে থাকবেন নদীপারে কিছুসময়। নদীতীরের দৃশ্য দেখতে দেখতে এবার তিনি দন্ত মার্জনা করবেন বেলকাঠের দাঁতন দিয়ে।
এবার আসল স্নানের পালা। পঞ্চগব্য বা গোমূত্র, গোময়, দধি, ঘৃত এবং দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, মধু, পুষ্পোদক, ত্রিফলা বা হরিতকী, আমলকী ও বহেড়া ভেজানো জল, পঞ্চকষায় যুক্ত জল দিয়ে স্নানের পর নদীর জল, সাত সাগরের জল, শিশিরের জল, শুদ্ধজল, পাণিশঙ্খের জল, কবোষ্ণ জল, গঙ্গোদক, সহস্রধারার জল, কুশ ঘাসের দ্বারা ছেটানো জল, নির্ঝরিণীর জল এবং তীর্থবারি এমন কত কত জল ঢেলে মেয়ের অবাক জলস্নান হল!
তারপর ফ্রুট ফেসিয়াল ফলোদক দিয়ে। পঞ্চরত্ন সমন্বিত জল দিয়ে গোল্ড ফেসিয়াল। তারপর অগরু চন্দন দিয়ে আ্যরোমা থেরাপি হল। সবশেষে আবার গাত্রমার্জণার পর ম্যাসাজ হল তিলতেল, বিষ্ণুতেল, সর্বোষধি আর মহৌষধির জল দিয়ে। সব শেষে অষ্টকলসের পূর্ত জল দিয়ে একে একে বিশেষ স্নান হল। পবিত্র হল সে। কিন্তু প্রশ্ন হল যুগে যুগে কি কন্যেরা এমন অপবিত্র থাকে? তাকে কি পুজো করার জন্য আগে শুদ্ধিকরণ করে নিতে হবে? মহাস্নান কি তবে বিশেষ শুদ্ধিকরণ?
আটটি ঘটিতে বন্দী আটরকমের জল। গঙ্গারজল, বৃষ্টির জল, সরস্বতীর জল, সাগরের জল, পদ্মরেণুমিশ্রিত জল, নির্ঝরোদক, সর্বতীর্থম্বু, ও শুদ্ধজল নিয়ে পদ্ম পাপড়ি ছড়িয়ে স্নান করে সিন্দুর পরে নতুন শাড়ি জড়িয়ে চললেন তিনি মন্ডপে।
আর এই অষ্টকলসের জল আক্ষরিক অর্থেই আটটি কলসের মন্ত্রপূত জল। দেবগণ, মরুত্গণ্, লোকপালগণ, নাগগণ, পর্বতসকল, সপ্তঋষিগণ, অষ্টবসুগণ সকলেই মহা উত্সাহে দেবীকে বাদ্য সমারোহে স্নান করানোয় ব্রতী হয়েছেন। তাই এই মহাস্নান রাজকীয় যজ্ঞ স্বরূপ।
আর এই অষ্টকলসের স্নানের সময় যে মন্ত্র পাঠ হয় তা সঙ্গীতশাস্ত্রসম্মত স্বরলিপি অনুসারে রচিত আটটি রাগ সঙ্গীত। প্রত্যেকটি একটি রাগরাগিণীর আশ্রয়ে রচিত। অষ্টকলসের মন্ত্রপূত জল দিয়ে দেবীর স্নানাভিষেকের সময় এই গানগুলি সেযুগেও ব্যাবহৃত হত এবং এখনো হয়। কালিকাপুরাণেই এর উল্লেখ রয়েছে।
প্রথমে "মালবরাগং বিজয়বাদ্যং কৃত্বা গঙ্গাজলপূরিতঘটেন " এই মন্ত্র বলে গঙ্গাজল পূর্ণ ঘট দ্বারা অভিষেক হয়। তখন বিজয়বাদ্য বা কাঁসা-পিতল দ্বারা নির্মিত বাদ্য যন্ত্র অর্থাত কাঁসরঘন্টা সহযোগে গাওয়া হয় মালব রাগে এবং চৌতালে ।|
এরপর "ললিতরাগং দুন্দুভিবাদ্যং কৃত্বা বৃষ্টিজলপূরিতঘটেন " এই মন্ত্র বলে বৃষ্টির জল পূর্ণ ঘট দিয়ে অভিষেক কালে দুন্দুভির সঙ্গে গাওয়া হয় ললিত রাগে এবং চৌতালে ।
এবার "বিভাসরাগং দুন্দুভিবাদ্যং কৃত্ব সরস্বতী-জলপূরিতঘটেন" এই মন্ত্র বলে সরস্বতী নদীর জলপূর্ণ ঘট দিয়ে স্নানাভিষেক হয় বিভাস রাগে এবং চৌতালে গীত হয় সংগীতের মধ্য দিয়ে আর দামামা জাতীয় রণ দুন্দুভি বাজে।
এরপর "ভৈরবরাগং ভীমবাদ্যং কৃত্বা সাগরোদকেন" এই মন্ত্র বলে ভীম বাদ্য বা ভেরী বা চামড়ার তৈরী ঢাকের আওয়াজের সাথে সাগরের জল দ্বারা স্নানের সময় ভৈরবী রাগে চৌতালে গান গাওয়া হয় ।
এবার "কেদাররাগং ইন্দ্রাভিষেকং বাদ্যং কৃত্বা পদ্মরজমিশ্রিতজলেন" এই মন্ত্র বলে পদ্মরজ বা পদ্মফুলের রেণু মিশ্রিত জল দিয়ে, বীণার সাহায্যে উৎপন্ন ধ্বনিতে কেদাররাগে চৌতালে স্নানাভিষেকের সঙ্গীত গাওয়া হয়।
তারপর "বরাড়ীরাগং শঙ্খবাদ্যং কৃত্বা নির্ঝরোদকপূরিতঘটেন" এই মন্ত্র বলে, শঙ্খধ্বনি, তূর্য, বাঁশী, সানাই ইত্যাদির সাথে ঝর্ণার জল দিয়ে স্নান এবং সঙ্গীত বৈরাটি রাগে ও চৌতালে ।
এবার "বসন্তরাগং পঞ্চশব্দবাদ্যং কৃত্বা সর্বতীর্থাম্বুপূর্ণেন ঘটেন" এই মন্ত্র বলে পাঁচ রকমের ধ্বনি, মানুষের সম্মিলিত ঐক্যতানের সঙ্গে সর্বতীর্থের জল দিয়ে স্নান হয় বসন্তরাগে ও চৌতালে ।
সবশেষে "ধানশ্রীরাগং বিজয়বাদ্যং কৃত্বা শুদ্ধ জলপূরিত ঘটেন" এই মন্ত্র বলে শীতল ও শুদ্ধ জল পূর্ণ ঘটের জল দিয়ে স্নানের সময় গান হয় ধানশ্রী রাগে ও চৌতালে আর বাজানো হয় বিজয়বাদ্য।
অর্থাৎ কাঁসরঘণ্টা দিয়ে শুরু ও শেষ হয় এই মহাস্নান।
কিন্তু কেন এত মাটি আর কেনই বা এতস্থানের জল দিয়ে তাঁর স্নানের আয়োজন? এ যেমন তেমন স্নান নয়। এ হল মহাস্নান যার অর্থ হল মহত বা বিরাট স্নান। স্নানের নানাবিধ বিপুল আয়োজন, দ্রব্যাদির অনুষঙ্গ, ষোড়শ উপাচার স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর মহত্বকে। স্মরণ করায় সৃষ্টির আদিমতম রহস্যকে । যখন ধরিত্রীতে এসে মিশেছিল সর্বপ্রকার বারিধারা। সব স্থানের মৃত্তিকা। প্রথম আদি তব শক্তি। তোমার জন্যেই আমাদের পায়ের নীচে আজ শক্ত মাটি। তোমার জন্যই আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় এই জল। তাই তোমার মহাস্নানেই সেই জল আর মাটি আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে যোগাড় করে তোমাকেই নিবেদন করি। অতএব গঙ্গাজলেই গঙ্গাপুজো করে বলি "তদীয় বস্তু তুভ্যমেব সমর্পয়ে" !
প্রান্তিকে ইরিগেশন ক্যানেলে নবপত্রিকার স্নান |
1 টি মন্তব্য:
অসাধারণ লাগলো ! সবচেয়ে সুন্দর এক একটি রাগের সঙ্গে এক একরকম বাধ্য সহযোগে এক এক স্থানের জল দিয়ে স্নান !
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন