৮ অক্টো, ২০২১

চালচিত্র কেন থাকে? / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

চালচিত্রের ছবি- কুমারটুলি, কলকাতা 


মাদুর্গার চালচিত্র যেন দুর্গাপূজার অন্যতম অঙ্গ। বহু দেবতার সমাবেশ লক্ষ্য করা যায় এই চালচিত্রে। পটশিল্পীর রং তুলির টানে এই চালচিত্রের সুষমা যেন মায়ের মূর্তিকে আরো সম্পূর্ণ এবং উজ্জ্বল করে তোলে। আমরা কেবল দেবী দুর্গাকে সপরিবারে পূজা হতে দেখি কিন্তু আসলে হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল দেবদেবীরাই কিন্তু উপস্থিত থাকেন ঐ চালচিত্রতে। সব দেবদেবীরাই যেন দুর্গা কে পিছন থেকে অহোরাত্র আশীর্বাদ বর্ষণ করে অভয় দেন। বলেন, তুমি লড়াই করে জয় লাভ কর। আমরা সঙ্গে আছি। আমাদের ত্রেত্রিশ কোটি দেবদেবীর অসংখ্য নাম কিন্তু আসলে এরা সবাই প্রতীকী। 

শিব

দুর্গাপূজা যেন কলিকালের অশ্বমেধ যজ্ঞ । শিব ছাড়া যেমন সকল যজ্ঞ অসম্পূর্ণ তাই মায়ের চালচিত্রের মধ্যমণি হলেন মহাদেব । তিনি যেন এলাহী বৈচিত্রের মাঝে নির্বিকার স্বামীরূপে বিরাজমান । মহামায়া মা দুর্গাকে যেন তিনি সৃষ্টি ও প্রলয়ের ভার দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে আছেন তাঁর মাথার ওপর । মা অসুর বিনাশ করলে শিবপ্রদত্ত আশীর্বাদে আর তাই আমরা শিবকে বন্দনা করি আর মা এর কারণে প্রসন্ন হন । শিব ও শক্তির সম্মিলিত সত্তায় প্রকৃতির সর্বক্ষণের ভাঙাগড়া অব্যাহত থাকে ।

রাইরাজা

চালচিত্রে শিবের ডানদিকে উপবিষ্টা শ্রীরাধা । শক্তিবাদী আরাধনার সাথে সেখানে বৈষ্ণববাদের মেলবন্ধন । বিষ্ণুর শক্তি লক্ষ্মী । শ্রীরামের অবতারে তিনি সীতা আর শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গীনী শ্রীরাধিকা। দেবী-ভাগবতে বলা আছে  যে জগতের উত্পত্তিকালে বিশুদ্ধ শক্তিরূপিণী রাধিকা এবং বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা আবির্ভূতা হন তাই একত্রে এই দুই শক্তিযুগলের আরাধনা একান্ত কর্তব্য ।

নারসিংহী

রাইরাজার ডানদিকে নারসিংহী থাকেন ।  অষ্টশক্তির অন্যতম হলেন নারসিংহী । ভগবান শ্রীহরি দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য  নৃসিংহ রূপে অবতীর্ণ হয়ে হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন । সেই কারণে অসুরগণের বিনাশ ও দেবতাদের কল্যাণার্থে দেবগণের মহাবল শক্তিসমূহ তাদের শরীর থেকে বহির্ভূতা হয়ে নারসিংহী নামক দেবীমূর্তিতে প্রবেশ করে ।  এই দেবীমূর্তি শ্রীচন্ডীর সমীপে উপস্থিত হন । এবং মাদুর্গার সঙ্গে অসুরের যুদ্ধের সময় এই নারসিংহী দুর্গার শরীরে লীন হয়ে যান ও মা’কে  অসুর নিধনের জন্য  আরো শক্তি দান করেন ।

রক্তবীজ

নারসিংহীর ডানদিকে আছেন রক্তবীজ । রম্ভাসুরের মৃত্য্র পর তার চিতার আগুণ থেকে এক বিশালাকায় দৈত্য নির্গত হয় যার নাম রক্তবীজ । চন্ডও মুন্ড বধের পর দানবরাজ শুম্ভ মহাসুর রক্তবীজকে বলে মাদুর্গাকে সংহার করতে । রথে আরোহণ করে রক্তবীজ শৈলশিখরে মাদুর্গার কাছাকাছি পৌঁছতেই দেবীদুর্গা শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন । সেই শঙ্খধ্বনিতে রক্তবীজ বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে দেবীর নিকট গিয়ে দেবীকে শুম্ভ অথবা নিশুম্ভকে বিবাহ করতে বলে । দেবী উগ্র থেকে উগ্রতর হয়ে ওঠেন । প্রচ্ন্ড যুদ্ধ হয় দুজনের মধ্যে । পাপমতি রক্তবীজ দেবীর বাণে বিদ্ধ হয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়ে । মূর্ছা ভঙ্গ হলে তার শরীরের প্রতিটি ফোঁটা রক্ত থেকে সেই দানবের অনুরূপ বলশালী দৈত্য উত্পত্তি হয় । শত সহস্র অসুরে ধরিত্রী ছেয়ে যায় । দেবগণ তখন বিপদ দেখে চন্ডিকা রূপিণিদেবীকে বলেন রক্তবীজের দেহনিঃসৃত প্রতিটিরক্তের ফোঁটাকে পান করতে তাহলে দৈত্যের উত্পত্তি রোধ হবে । চামুন্ডারূপিণিদেবী তাই করতে লাগলেন এবং অতঃপর সেই রক্তহীন রক্তবীজকে অস্ত্রাঘাতে নিহত করলেন ।

চামুন্ডা

রক্তবীজের ডানদিকে আছেন দেবী চামুন্ডা ধূম্রলোচন বধের পর শুম্ভের আদেশে চন্ড ও মুন্ড পদাতিক, অশ্ব, হস্ত ও রথ এই চতুরঙ্গ সৈন্য সহ দেবীর উদ্দেশ্যে ধাবিত হয় । দেবী ক্রোধে অতিশয় কৃষ্ণবর্ণ হলে তাঁর ললাট থেকে করালবদনা, লোলজিহ্বা কালী নির্গত হন । দেবী কালী চন্ডের মস্তক ছিন্ন করেন এবং পরে মুন্ডকেও অসির আঘাতে বধ করেন । সেই দেখে চন্ডিকাদেবী কালীকে চামুন্ডা রূপে অভিহিত করেন ।  তাই দুর্গার চালচিত্রে চামুন্ডার অবস্থান যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ।

মাহেশ্বরী

চামুন্ডার ডানদিকে আছেন দেবী মাহেশ্বরী ।  অষ্টশক্তির অন্যতমা এই দেবী চতুর্ভুজা, ত্রিনেত্রা, বৃষভারূঢ়া ।

ইন্দ্রাণী

মাহেশ্বরীর ডানদিকে আছেন ইন্দ্রাণী ।  তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের পত্নী, ইন্দ্রের শক্তি । গজবাহনা, চতুর্ভুজা, বজ্রধারিণী  ।

রামচন্দ্র

চালচিত্রে মহাদেবের বাঁদিকে আছেন রামচন্দ্র ।

সীতাহরণের পর রামচন্দ্র বানরসেনাদের সাহায্যে সেতুবন্ধ্ন করে লঙ্কায় হাজির হলেন । ব্রহ্মা তখন রামকে আদেশ করলেন অপরাজিতা দুর্গার পুজো করে জগতের উদ্ধারে নেমে পড়তে । সমগ্র রাক্ষসকুলকে ধ্বংস না করতে পারলে যে ধরিত্রীর নিস্তার নেই । তাই কৃষ্ণপক্ষেই নিদ্রিতা দেবীকে অকালে জাগ্রত করে অকালে অর্থাত শরতকালে (পূর্বে বসন্তকালে শুক্লপক্ষে দেবলোক জাগ্রত অবস্থায় পুজো হত) কাজে নেমে পড়েছিলেন রামচন্দ্র স্বয়ং । তাই তো অকাল বোধন । ব্রহ্মার পরামর্শে দেবী দুর্গার দশভুজা মূর্তি মাটি দিয়ে গড়ে সিংহবাহিনী সেই দেবীর বোধন করেছিলেন ব্রহ্মা স্বয়ং বিল্ব বৃক্ষমূলে । সেই দিনটিই ছিল মহাষষ্ঠী । শুক্লাসপ্তমী থেকে মহানবমী অবধি বিশেষ পুজো চলতে লাগল । সপ্তমীর দিন দেবী স্বয়ং রামের ধনুঃশ্বরে প্রবেশ করলেন । অষ্টমীতে রামের বাণে আশ্রয় নিলেন । অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে দশানন রাবণের মস্তক পুনঃ পুনঃ ছেদন করলেন রামচন্দ্র । নবমীর দিন সীতা উদ্ধার করলেন রাম । আর দশমীর দিন প্রাতে যুদ্ধে জয়লাভের পর দেবীমূর্তি নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে বিসর্জন মন্ত্র পাঠ হল । সেদিন পালিত হল বিজয়া দশমীর বিজয়োত্সব ।

জগদ্ধাত্রী

শ্রীরামচন্দ্রের বঁদিকে আছেন দেবী জগদ্ধাত্রী । তিনি মাদুর্গার অন্যতম রূপ । দেবী চতুর্ভুজা এবং কবীন্দ্রাসুর নিসূদিনী । দেবীর সাথে যুদ্ধের সময় মহিষাসুরের ছদ্মরূপ হল কবীন্দ্রাসুর । মা দুর্গা অঘটন পটীয়সী মায়ার বলে মহিষাসুরের আবরণ উন্মোচন করে কবীন্দ্রাসুরের শিরশ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

নিশুম্ভ-শুম্ভ

চালচিত্রে জগদ্ধাত্রীর বাঁদিকে থাকে নিশুম্ভ আর নিশুম্ভের বাঁদিকে থাকে শুম্ভ ।  রক্তবীজ নিহত হবার পর নিশুম্ভ সসৈন্যে দেবীর দিকে তেড়ে যায় ।দেবীর সঙ্গে শুম্ভ ও নিশুম্ভের ভয়ানক যুদ্ধ হয় । দেবী নিশুম্ভকে বাণ দিয়ে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেন । সেই দেখে শুম্ভ কুপিত হয় । তখন দেবী শুম্ভকে শূলের দ্বারা আঘাত করেন । ইতিমধ্যে নিশুম্ভ জ্ঞান ফিরলে বাণ দিয়ে দেবীকে ও বাহন সিংহকে আঘাত করে । তারপর চলে গদাযুদ্ধ । শেষে দেবী চন্ডিকা শূলের দ্বারা নিশুম্ভের হৃদয় বিদীর্ণ করেন ।

শুম্ভকে বধ করতে দেবীর সময় লেগেছিল ।  একসময় শুম্ভ দেবতীর্থ পুষ্করে তপস্যা করে । ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দান করেন যে কোনো পুরুষের হাতে তোমার মরণ হবেনা । চন্ডিকার সঙ্গে যুদ্ধের সময় শুম্ভ দেবীকে বলেহে উদ্ধত দেবী দুর্গা, তুমি গর্ব কোরোনা । তুমি অন্যান্য দেবীর সাহায্যেই তো যুদ্ধ করছ । সেই শুনে দেবী বলেন,    সমস্ত দেবীর প্রকাশ তাঁর শরীরেই । এরপরেই তিনি যেইমাত্র শুম্ভকে শূল দিয়ে বক্ষে আঘাত করেন সাথে সাথেই শুম্ভর মৃত্যু হয় ।

বারাহী

দৈত্যরাজ শুম্ভের বাঁদিকে থাকেন বারাহী । ইনি বরাহ অবতারের শক্তি । বরাহবদনা, কৃষ্ণা, পীতাম্বরী, সালঙ্কারা, বরাভয়, হল ও মুষলধারিণী । ইনিও অষ্টশক্তির এক শক্তি যিনি দাঁত দিয়ে ধরণীকে ধরে রেখে উদ্ধার করেছিলেন ।

ব্রহ্মাণী

ইনি ব্রহ্মার সৃষ্টিশক্তি । কমন্ডলুর  মন্ত্রপূত জল কুশ দিয়ে ছিটিয়ে দৈত্যদের হীনবীর্য করেছিলেন । ইনি রক্তবর্ণা, বিশালনয়না, বর ও অভয় মুদ্রাধারিণী, হংসারূঢা ।

কাত্যায়নী

দেবী ব্রহ্মাণীর বাঁদিকে আছেন দেবী কাত্যায়নী । তিনি অপরূপা, শান্ত । কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে আশ্বিনমাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে আবির্ভূতা ও পালিতা এই কন্যা দেবতাদের তেজে প্রকাশিত হন ।  তাঁর ত্রিনয়ন থেকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর সৃষ্টি হয়েছিল । তাই সকল প্রকার জাগতিক ও পারমার্থিক বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য দেবতারা কাত্যায়নীর সাহায্য নেন ।

এছাড়াও চালচিত্রে রয়েছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, গণেশ, কার্তিক, সূর্য, চন্দ্র, পবন, ইন্দ্রাদি দেবতারা । নারীশক্তির মধ্যে অন্যতমা কালী, অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী সরস্বতীও আছেন সেই সাথে । সুতরাং চালচিত্রে আঁকা মূর্তিগুলি  যথেষ্ট ইঙ্গিত বহন করে এবং এই মূর্তিগুলির মধ্যে দিয়েই মায়ের সার্বিক শক্তির প্রকাশ ঘটে ।