৮ জানু, ২০১৮

মহাপ্রভু জিন্দা হ্যায়




শীতের ভোর। পুবের মিঠে রোদ গায়ে মেখেই বেরিয়ে পড়া নবদ্বীপের দিকে। কলকাতা থেকে কোনা এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে ডানকুনি, বৈদ্যবাটি হয়ে নবদ্বীপের পথ। প্রথম পিটস্টপ রাস্তার ধারে এক পথ রেস্তোঁরায়।  ছোট্টছেলে তার দাদুর মিষ্টির দোকানে নিয়ে গেল। নিতান্ত‌ই ছোট সে। তার নাম জিগেস করলে বলল, প্রীতম শিকদার রোবট। আমি বললাম রোবট কেন? সে দর্পের সঙ্গে জানাল, ভিনগ্রহ থেকে আসা এক এলিয়েন সে। পৃথিবীর সবকিছু দেখেশুনে আবার নিজের গ্রহে ফিরে যাবে। তার বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়েই নাকি অন্যগ্রহে যাওয়ার পথ। বিশ্বায়নের কি মাহাত্ম্য! কেবল টিভি এবং ইন্টারনেটের যুগে গ্রামের এই সপ্রতিভ বালকটিও কত পরিণত আজকের যুগে। স্টেট হাইওয়ের ধারে তার দাদুর হোটেলে বসতে দিল। কিছুপরেই টেবিলে এল গরম ছেঁড়া পরোটা আর ধূমায়িত আলুর সবজী। শেষপাতে গুড়ের রসগোল্লা। অমৃতকমলার পৌষের সকাল জমে গেল সেই মূহুর্তে। 
আমরা চললাম সদ্য ধান ওঠা খেতের পাশে একরের পর একর জমিতে সর্ষেফুলে ছয়লাপ হলুদকে সঙ্গী করে। আমন্ত্রণে চলেছি কীর্তণ পরিবেশনের। কলকাতার এক আশ্রম নবদ্বীপে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে আমাদের। পথে বেরিয়েই মনে পড়ল নানান ব্যস্ততায় আমন্ত্রণপত্রটি বাড়িতে ফেলে এসেছি। অতএব নবদ্বীপের কোন্‌ ঠিকানায় যাচ্ছি তা অজানা। শুধু আছে দুটি ফোন নাম্বার। অতএব সে যাত্রায় নিশ্চিন্ত।

এদিকে স্টেশন পৌঁছতেই হাতের মুঠোয় খোলা গুগল ম্যাপ জানাতে থাকল এখুনি সেই স্টেশনে কোন্‌ কোন্‌ ট্রেনের আগমন এবং প্রস্থানের খবর। ধ্যুত্‌ তেরি! এই এক জ্বালা কৃত্তিম বুদ্ধিমতার। আমার গুগল সব জানে। আমি এযাবত আমার এন্ড্রয়েড ফোন থেকে যত মেসেজ করেছি সেখানে নবদ্বীপ কথাটি সে পড়ে বুঝে ফেলেছে ইতিমধ্যে। আর আসার পথে পথ নির্দেশিকা গুগলম্যাপের অ্যাপটিতে গন্তব্য নবদ্বীপ তাও জানা তার। অতএব অংক কষে ফেলেছে তার কৃত্রিম মস্তিষ্ক । একেই বলে এ আই মাহাত্ম্যম্‌ । আমাকে হেল্প করতে চায় সে।

 কিন্তু বিধি বুঝি হল বাম! নবদ্বীপ স্টেশনের কাছে আসতেই ফোন ঘোরালাম আশ্রমের একজনকে। যথারীতি মোবাইল উপলব্ধ নেই সেখানে। আরেকটি নাম্বারেও সংযোগ হলনা কিছুতেই। আর স্টেশনের দুধারে শুধু চোখে পড়ছে "টাইগার জিন্দা হ্যায়" এর বিজ্ঞাপন। নিকুচি করেছে। আমি কোথায় হাতড়ে মরছি ঐ ঠান্ডায় রাতে কোথায় গিয়ে উঠব তা জানিনা আর কেবলি চক্ষুশূল হচ্ছে সলমন খানের বাইসেপস আর ক্যাটরিনার ভ্যাঙচানো শ্রীমুখ।   সঙ্গে আমার অশীতিপর বৃদ্ধা। অতরাতে প্রোগ্রাম সেরে তিনিই বা কোথায় থাকবেন? আর প্রোগ্রামটাই বা কোন্‌ মঞ্চে কিছুই জানিনা।  অবশেষে পুছতাছ শুরু করি।এক ব্যক্তি জানাল জন্মস্থানের দিকে আজ রাতে অনুষ্ঠান আছে।গাড়ি থেকে মুখ বের করে স্থানীয় মানুষকে জিগেস করতেই  তারা বলে, এ পাড়ায় কিস্যুটি হয় না। প্রাচীন মায়াপুর অর্থাত গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর খোদ জন্মস্থান যেতে হবে । সেখানেই যা কিছু। স্বাভাবিক। আজ যাঁর জন্য সেই একদা সংস্কৃতচর্চার অন্যতম পীঠস্থান এই নবদ্বীপ "ধাম" হয়ে উঠেছে সেখানেই সব মাতামাতি হওয়াটাই উচিত। একটি কলেজ পড়ল। স্থানীয় স্মার্ট সব ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে জটলা করছে। জিগেস করলাম, মহাপ্রভুর জন্মস্থানটি কোন্‌ দিকে? তারা ঠোঁট উল্টিয়ে বলল "জানিনা' । চোখমুখের ভাবও বলল মহাপ্রভুর নাম শোনেনি তারা। আবার অলিগলি চলি রাম।  "আচ্ছা দাদা জন্মস্থান?" "কার জন্মস্থান?'  রেগে গিয়ে একহাত নিয়ে ফেলি। আরে মশাই কার আবার? আমার, আপনার নয় নিশ্চয়‌ই। এখানে এসে মানুষ কার জন্মস্থানে যায়? অতএব আবার চলি কানাগলি, পোড়া গলি। এবার এসে পড়ল বুড়োশিব তলা। বেশ প্রাচীন মন্দির। নেমে পুরোহিতকে জিগেস করলাম। তিনিও সেই এক কথা মহাপ্রভুর জন্মস্থানের খোদ পাড়া প্রাচীন মায়াপুরেই সব। অতএব আর কোনোদিকে নয়। পুরী গিয়ে জগন্নাথ, কলকাতা পৌঁছে কালীঘাট আর নবদ্বীপ পৌঁছে জন্মস্থানে না হাজিরা দিলে কোনোকিছুই হবেনা। এদিকে গাড়ির সকলে মিলে অনুষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ফোন ঘুরিয়ে, মেসেজ পাঠিয়েই চলেছি। নো পাত্তা। অবশেষে হাজির হলাম সেই প্রাচীন মায়াপুরে। পরে নির্মিত বিশাল গেট, মন্দিরের আভিজাত্যের মধ্যে অলঙ্কৃত করে রেখেছে সেই সাড়ে পাঁচশো বছরের পুরোনো প্রকাণ্ড নিমগাছ আর তার কোল ঘেঁষে এক ঘর। সেই ঘরে "জনমিলা গোরাচাঁদ শচীর উদরে'। 
সেই নিমগাছে এখন মানুষ লাল সুতো বেঁধে মানত করে। কিন্তু আমার তেমন কোনো ইচ্ছে নেই তখন। দূর থেকে নিমগাছকে প্রণাম জানিয়ে বললাম "আমার ফোনে আজকের অনুষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যেন যোগাযোগ করতে পারি"  প্রণাম জানিয়ে ফিরে আসছি । মন্দিরের বাইরেও পা দি‌ই নি তখন। আমার মোবাইলে কর্মকর্তাদের বহু প্রতীক্ষিত সেই ফোনটি এল। "দিদি আপনি পৌঁসেসেন? আমরাও আসতেসি" 
তারা জানাল আমাদের জন্য  দুদিনের আশ্রমের ঘর, প্রোগ্রামের আয়োজন এই জন্মস্থানের পাশেই। নরহরি আশ্রমে।

আমি বুঝলাম সত্যি সত্যি "টাইগার জিন্দা হ্যায়' ।


কোন মন্তব্য নেই: