১ জানু, ২০১৮

ইতুপুজোর কথা

এইসময় ডিসেম্বর ১১ ২০১৭
অঘ্রাণমাসের প্রতি রবিবার ভোরে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের দেখা যায় ইতুপূজা বা মিত্র পুজো করতে। মিত্র > মিতু > ইতু এই হল মূল শব্দের বিবর্তন। ইতু শস্যের দেবী। কেউ বলে এটি সূর্য পুজো। কেউ বলেন লক্ষ্মী বা কৃষি দেবী।  একটি মাটির সরায় মাটি দিয়ে ভর্তি করে মাটির ঘট বসিয়ে  ঘটটি পূর্ণ করা হয় দুধ বা জল দিয়ে।সরার উপর পুঁতে দেওয়া ছড়ানো হয় পঞ্চশস্যের দানা, কলমি, কচু ইত্যাদি।
ইতু পুজোর উদ্দেশ্য হলো সংসারের সুখ ও ঐশ্বর্য কামনা।
কোথাও কোথাও পাড়া-প্রতিবেশীরা একত্র হয়ে বসে একজন ইতুর ব্রত কথা বলে, আর ব্রতীরা হাতে ফুল নিয়ে বসে বসে শুনে যায় ব্রত কথা।

অষ্টচাল, অষ্টদূর্বা কলসপাত্রে থুয়ে
শুন একমনে ইতুর কথা সবে প্রাণ ভরে ।
ইতু দেন বর !
ধনধান্যে পুত্র-পৌত্রে ভরে উঠুক ঘর ।

আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে ইতুদেবীর পুজো বোধহয় দুর্গাপুজোর নবপত্রিকার মত । কৃষির জন্য সূর্যদেবতার অবদান অনস্বীকার্য তাই বুঝি "ইদম্‌ অর্ঘ্যম্‌ নমো শ্রী সূর্যায় নমঃ" বলে অর্ঘ্য দেওয়া হয় ইতুর ঘটে।  সূর্যদেবতা এবং ইতুদেবী উভয়কেই তুষ্ট রাখা হয়।
গোটা মাস এইভাবে ব্রতকথা শুনে সংক্রান্তির দিন সেই সরায় বসানো ঘট আর তার মধ্যে অঙ্কুরোদগম হয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠা সজীব ও সবুজ উদ্ভিদ পরিবার নিয়ে মেয়েরা দল বেঁধে যায় নদীর ঘাটে কিংবা পুকুর পাড়ে। ভাসিয়ে দেয় ইতুর ঘট ও সরা।

গরীব বামুন-বামনীর দুই মেয়ে উমনো আর ঝুমনো । শীতকালে একদিন বামুনের পিঠে খাবার সাধ হল । বামনীকে ডেকে বললে পিঠে করতে । পিঠের সব যোগাড় যন্ত্র করে সে বললে একটি পিঠেও যেন তার ঐ মেয়েদুটিকে না দেওয়া হয় । বামনী পিঠে ভেজে ভেজে উনুনের পিঠে রাখে আর রান্নাঘরের পেছনে বসে বামুন একটি করে তেঁতুল বিচি রাখে নিজের কাছে । হঠাত বামনীর কি মনে হল। পেটের দুই সন্তান দুই মেয়ে। তাদের কি করে সে পিঠের থেকে বঞ্চিত করে? চুপিচুপি  উমনো-ঝুমনোকে দুটো পিঠে খাইয়ে দিয়ে মুখ পুঁছে শুয়ে পড়তে বলল । বামুন পিঠে খেতে গিয়ে দুটো পিঠে কম দেখে বামনীকে জবাবদিহি করতে বললে।  কেন সে এই মহার্ঘ পিঠে তার মেয়েদুটোকে দিয়েছে । বামনী বললে আর হবেনা অমন, ভুল হয়ে গেছে তার  । বামুন শুনলোনা বামনীর কথা ।
মেয়েদের বুঝিয়েসুঝিয়ে পিসির বাড়ি নিয়ে যাবার নাম করে  রেখে এল ঘন জঙ্গলের মধ্যে। আর ফিরে এসে আনন্দ করে বলতে লাগল আজ সব পিঠে সে একা খাবে। সে আরো বলল যে  মেয়েদুটোর বিয়েথা ও ঐ আত্মীয়ের বাড়ি থেকেই যেন হয়ে যায় তেমনটি বলে কয়ে এসেছে তাদের ।
এদিকে মেয়েদুটোকে পিসির বাড়ি যাবার নাম করে বনের মধ্যে জল আনার ছুতো করে সে ফেলে রেখে এল । রাতে মেয়েদুটো ভয় পেয়ে  কাঁদতে কাঁদতে জোড়হাত করে দুই বোনে বলল, বটবৃক্ষ তুমি যদি সত্য হও তবে তোমার কোটরে আজ রাতের মত আমাদের স্থান দাও। তাই বলে বটগাছের কোটরে আশ্রয় নিল । পরদিন ভোরে উঠে তারা দেখে নদীর ধারে মেয়েরা কি সব পুজো করছে । উমনো-ঝুমনো তাদের কাছে  গিয়ে শুনলো যে মেয়েরা ইতুপুজো করলে নাকি সংসারের সব দুঃখ ঘুচে যায় তাই তারা ইতুপুজো করছে । 
উমনোঝুমনো তাদের কথামত নদীতে নেয়ে এসে ইতুপুজোয় সামিল হল।  পুজোর পরে তারা ওদের বলল ইতুঠাকুরাণীর কাছ থেকে মনের মত বর চেয়ে নিতে। মেয়েদুটো তাদের বাবা-মায়ের দুঃখ ঘোচানোর বর চাইলো। এদিকে সেই বরে বামুন-বামনীর ঐশ্বর্য্য ফিরে তারা খুব ধনী হয়ে গেল। বামুনটা ভেবেছিল জঙ্গলের মধ্যে মেয়েদুটোকে নির্ঘাত বাঘে খেয়েছে। কিন্তু ইতুদেবীর বরে মেয়েদুটো পথ চিনে একদিন যখন ঘরে ফিরে এল তখন তাদের বাবা-মা তো অবাক। এর কিছুদিন পরে সেই রাজ্যের রাজা যখন পাকেচক্রে তাদের বাড়ি এসে মেয়েদুটিকে রাজপুত্রের বৌ করে নিয়ে গেলেন তখন বামুন বামনী সত্যিই অবাক হল।  উমনোর সঙ্গে যুবরাজের আর কোটাল-পুত্রের সঙ্গে ঝুমনোর বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পরের দিন ছিল অঘ্রাণমাসের রবিবার। উমনো বেমালুম ভুলে গেল ইতুপুজোর কথা। সে দিব্যি মাছ-ভাত খেল। আর ঝুমনো নিষ্ঠাভরে ইতুপুজোর ব্রত পালন করল। ইতুর ঘট মাথায় করে সে হাতীর পিঠে চড়ল। উমনো পান চিবুতে চিবুতে সোনার পালকীতে গিয়ে উঠল। উমনো যে পথে গেল সে পথে খালি মড়া যায়। পথঘাট শুকিয়ে রুক্ষ হয়। ঝুমনো যে পথে যায় সে পথে কেবল মরাই ভরা সোনার ধান, শস্যশ্যামলা প্রান্তর দেখে। এভাবে দুজনে শ্বশুর ঘরে গিয়ে উঠল। 

শ্বশুরঘরে গিয়ে ইতুর বরে ঝুমনো সত্যি হল রাজরাণী। তার আগমনে কোটালের বাড়ি যেন ভরে উঠল সুখ সমৃদ্ধিতে, ঐশ্বর্য্যে আর খ্যাতিতে। আর ওদিকে উমনোর আগমনে রাজবাড়িতে যেন মড়ক, গৃহযুদ্ধ, অশান্তি, ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকল। 
ঝুমনো রাজরাণী হয়েও ইতুপুজো করতে ভোলেনা। উমনো কিন্তু ভুলেই গেল ইতুর ব্রত। দুইবোনের দেখা হতে ঝুমনো সব জানতে পেরে বলল, দিদি তুই ইতু পুজো ছেড়েচিস বলে তোদের এমন দুর্দশা আজ। সেই শুনে উমনো আবার ইতু পুজো করতে থাকে। আর ধীরে ধীরে তাদের সংসারের অভাব অনটন ঘুচে যায়।  
এভাবেই সরল বিশ্বাসে বর্ধমান তথা পশ্চিমবঙ্গের অনেক জেলায় এখনো সৌভাগ্যপ্রদায়িনী ইতুদেবীর ব্রত পালন খুব পরিচিত একটি পার্বণ। 

এখনো অঘ্রাণমাসের রবিবারে নদীর তীরে গেলে শোনা যায় বাংলার মেয়ে বৌদের মুখে ইতুর পাঁচালিঃ

কাঠিমুঠি কুড়োতে গেলাম, ইতুর কথা শুনে এলাম
এ কথা শুনলে কি হয়, নির্ধনের ধন হয়
অপুত্রের পুত্র হয়, অশরণের শরণ হয়
অন্ধের চক্ষু হয়, আইবুড়োর বিয়ে হয়,
অন্তকালে স্বর্গে যায় ।

কোন মন্তব্য নেই: