১৬ জুল, ২০১৩

বেথুন-জার্নাল -১

-->

মরা একপাল মেয়ে জড়ো হয়েছিলাম ১৯৮২ সালে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা পাসের পর কোলকাতার এক ঐতিহ্যবাহী মেয়েদের রক্ষণশীল কলেজে । সকলের মধ্যে দুটি বিষয় অন্ততঃপক্ষে কমন ছিল । এক হল সকলের কেমিস্ট্রি অনার্স আর দুই সকলেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বেশ কনফিডেন্ট পড়াশুনোর ব্যাপারে । আমাদের অনেকের আবার আরো একটা জিনিস কমন ছিল সেটা হল কেমিস্ট্রি অনার্সের সাথে ম্যাথস আর ফিজিক্স । 
 

সেই ছাব্বিশ নম্বর ঘরটা ! কাঁচের সার্শি সরিয়ে, পুরোণো গন্ধ বুকে নিয়ে, খড়খড়ির দরজা ঠেলে অন্ধকার ঘরে ঢুকেছিলাম হুড়মুড় করে । কিছুটা উচ্চাশা নিয়ে আর কিছুটা দুরুদুরু বুকে । ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই পচাডিমের হাইড্রোজেন সালফাইডের সেই চেনা উচ্চমাধ্যমিক গন্ধটা অবশ করে দিল সুষুম্না স্নায়ুগুলোকে ।

ব্যাক্তিত্ত্বময়ী জ্যোত্স্নাদি এসেছিলেন । অনেকটা সেই মূর্তিমতী করুণায় শ্রদ্ধা উপছে উঠেছিল । তারপর রেডক্স ইক্যুয়েশান ব্যালেন্সিংয়ের দাপটে কেমন যেন সব ওলটপালট ! আবার হাতীবাগানের ড্রেসের ঝুলে সব যেন উথালপাথাল... কিছুটা অনাস্বাদিত মুক্তির আস্বাদে, কিছুটা শেষ ঊণিশ-কুড়ির ভালোলাগায়, ফুচকার তেঁতুলগোলা জলে ...

কিন্তু মনের মধ্যে একটু আধটু খচখচানি সেই ছাব্বিশ নম্বরের । আমি অ-পাঙক্তেয় ন‌ই তো সেখানে ? আমার জীবন রসায়নের সাথে রসায়নের দোস্তি সত্যি হবে তো?
বরানগর থেকে প্রথম একা বেরুলাম বেথুন কলেজে ভর্তি হয়ে । বাবা কলেজে ভর্তি করে চেনালেন পথঘাট, দোকানপাট । ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বর । ১৭ বছরের আমি । মফস্বলী শহর আলমবাজার থেকে নিয়মিত শুরু হল আমার কলকাতা অভিযান । ছোটবেলায় শ্যামবাজার যেতে হবে শুনলেই বাবা বলতেন "কোলকাতা" যেতে হবে । আমি ভাবতাম অনেক দূর বুঝি! কোলকাতা যাওয়া মনেই এটা ওটা সেটা । শ্যামবাজার থেকে ড্রাই ফ্রুটস, ফড়িয়াপুকুরের অর্ফ্যানের চা পাতা, অমৃত'র লাল দৈ, জলোযোগের প্যাটিস আরো কত বলব ! ঠাকুমার জাফরাণী জর্দা, ঘোষকাজিনে চোখ দেখিয়ে চশমা করতে দেওয়া কিম্বা কুমার্স কনসার্ণ থেকে আঁকার স্কুলের রঙ-তুলি ! বাবা চেনাতেন পথঘাট । পাঁচমাথার মোড়ে পাঁচটা বড় রাস্তা কোন্‌টির কি নাম ও তারা সব শেষে কোথায় গিয়ে পড়েছে । পঞ্চমুন্ডির আসনে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে নেতাজী সুভাষের ইতিবৃত্ত ! কিছুটা অজানা আনন্দ আর সাথে কিছুটা অচেনা ভয় নিয়ে শুরু হল কলেজ জীবন । এতদিন ছিল মা-বাবার হাত ধরে শখের বাজার । এখন সেটা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হল ।
কলেজ কেটে রূপবাণী সিনেমায় দু একবার সিনেমা ও হাতীবাগানের স্টার থিয়েটারে মায়ের সাথে সুপ্রিয়া দেবীর "বালুচরী" দেখেছি । ফেরার পথে সিলভার ভ্যালী রেস্তোরাঁয় কবিরাজী কাটলেট ভুলতে পারিনি এখনো । হাতীবাগানে একটা পেন সারানোর দোকান ছিল । নাম "পেন কেবিন্" । আমরা ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতাম । তাই ভালো মন্দ নানা পেনের নিব বদলানো লেগেই থাকত । এখনকার মত "ইউস এন্ড থ্রো" এর বাতাবরণ ছিলনা । কলেজ বান্ধবী মল্লিকা তখন টেনে নিয়ে যেত ওর বাড়ি । রসোগোল্লা আবিষ্কারক নবীন চন্দ্র দাসের বাগবাজারের বাড়িতে । বহুবার গেছি আর কে সি দাসের লোভনীয় সব মিষ্টিতে উদরপূর্তি করে বাড়ি ফিরেছি । কি আতিথেয়তা তাঁদের !
বিবেকানন্দের সিমলে স্ট্রীটের পাশে বিডন স্ট্রীটের ওপর জন ডিঙ্কওয়াটার বেথুন সাহেবের কলেজে।উল্টোদিকে হেদুয়ার সরোবর আর স্কটিশচার্চ কলেজ । বৈকুন্ঠ বুক হাউসে অনার্সের প্রথম ব‌ইট‌ই কেনা ; কলেজ ফেরত স্বাস্থ্যকর সুখাদ্যের হ্যাবিট ধরানোর জন্য সিমলেপাড়ার বিখ্যাত আইসক্রিম সন্দেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন অভিভাবক । দক্ষিণেশ্বর-বাবুঘাট, মিনিবাস রুট নং ১৫৮ তে চড়ে রোজ কলেজ যেতাম । কোনোদিন আবার আড়িয়াদহ-বাবুঘাট, মিনিবাস রুট নাম্বার ১৮১তে চড়ে শ্যামবাজারে নেমে বিধান সরণীর ট্রামে করে । বিধান সরণীর নাম ছিল একসময় কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীট । তখন আলমবাজার থেকে বিডন স্ট্রীট যেতে মিনিবাসে লাগত ১টাকা ৫ পয়সা । সেই ৫ পয়সা আজ অবলুপ্ত আর মিনিবাসের সেই চেহারাও বদলেছে । প্রায়শ‌ই বাসে উঠত বরানগর বাজার থেকে কাশীপুরের সুমিত্রা অথবা বাসবী ।
কোলকাতার পথঘাট চিনেছি কলেজবেলায় । প্রায়শই পাঁচমাথার মোড়ে জ্যাম থাকার দরুণ আরজিকর রোড দিয়ে বাস ঘুরে দীনেন্দ্র স্ট্রীট দিয়ে বেরিয়ে বিধানসরণী ধরত । বুক ধড়পড় করত অচেনা জায়গা দিয়ে যখন বাস যেত কিন্তু ঐ ভাবে এঁকে বেঁকে বাস যখন আমাকে বেথুন কলেজের সামনে নামিয়ে দিত তখন এই শহরটার ওপর বেশ অদ্ভূত ভালোলাগায় আবিষ্ট হতাম ।
ভরতবর্ষের প্রথম মহিলা কলেজ বেথুন কলেজ । প্রতিষ্ঠাতা জন ইলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন । সেযুগে আমাদের দেশে নারীশিক্ষা প্রসারে যাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য । ১৮৪৯ এ তিনি স্থাপন করেন বেথুনস্কুল ও পরে ১৮৭৯ এ বেথুন কলেজ নির্মিত হয় । আমাদের সময় বেথুন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন শ্রীমতী দীপ্তি ত্রিপাঠী । কলেজে ভর্তির পর শুনেছিলাম আরো অনেক মহিয়সীর নাম যাঁরা এখান থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন ।এঁদের মধ্যে সুখলতা রাও অন্যতম । আমাদের বাংলাভাষায় হাতেখড়ি হবার সাথে সাথে যাঁর অ, আ ক, 'র ছড়ার ব‌ই পড়ে আমাদের স্কুল যাবার ভিত তৈরী হয়েছিল । বেথুনে পড়েছিলেন মহিলা কবি কামিনী রায় যাঁর কবিতা আমাদের একাধিকবার সিলেবাসের মধ্যে ছিল । এছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রীতিলতা ওয়াদেদার পড়েছিলেন এই কলেজে । নেতাজী সুভাষচন্দ্রের খুব কাছের বন্ধু, সে যুগের রাজনৈতিক এবং সমাজসংস্কারক লীলা রায় (আগে নাগ ছিলেন ) সে যুগে বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজীতে প্রথম হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোল্ড-মেডেল পেয়ে ছিলেন । এছাড়াও রয়েছেন পদ্মাবতী স্মর্ণপদক প্রাপ্তা সরলা দেবীচৌধুরাণী , শ্রীমতী সীতাদেবী, ডাঃ দীপ্তি ত্রিপাঠী, বৈজ্ঞানিক ডাঃ অসীমা চট্টোপাধ্যায়, থিয়েটার ও ছায়াছবি ব্যাক্তিত্ত্ব শোভা সেন, সঙ্গীতজ্ঞা পূরবী মুখোপাধ্যায়, নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রী চাকী, বাচিকশিল্পী ব্রততী বন্দোপাধ্যায় যাঁরা এই বেথুন কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশান করেছিলেন । বেথুন কলেজের দুজন প্রথম গ্র্যাজুয়েট হলেন ডাঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং শিক্ষাবিদ চন্দ্রমুখী বসু । ১৮৮৩ সালে এঁরা বেথুন কলেজ থেকে পাশ করেন । গ্র্যাজুয়েশানের পর কাদম্বিনী দেবী কলকাতা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়েন । আর চন্দ্রমুখীদেবী বেথুন কলেজে লেকচারার পদে যোগ দেন । আমার ১৯৮৩ সালে বেথুন কলেজে সেকেন্ড ইয়ার । সেবছর এই প্রথম দু'জন মহিলার গ্র্যাজুয়েশানের শতবছর উদ্‌যাপন মহা আড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল । নানারকম বর্ণময় অনুষ্ঠান এবং খাওয়াদাওয়ার মধ্যে দিয়ে পালিত হয়েছিল সেই সেন্টিনারি । বেথুন কলেজের গ্র্যাজুয়েট হবার সুবাদে আর ঠিক ঐ বছরেই স্টুডেন্ট হিসেবে উপস্থিত থাকার সুবাদে আমিও খুব গর্বিত ।

1 টি মন্তব্য:

D K Mitra বলেছেন...

Khub valo laglo ... Jhorjhore anobadyo lekha ...