৫ মে, ২০২৩

"হীরের আংটি আবার বেঁকা" / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 "হীরের আংটি আবার বেঁকা"

এ প্রবাদের জন্ম যেন সত্যিই  আমাদের প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মাথাদের দ্বারা। ছেলেরা ভুল করতে পারেনা। তাদের সাত খুন মাপ। তারা রাত করে বাড়ি ফিরতে পারে। উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে পারে। তারা নিস্কম্মা, অলস হয়ে দিন যাপন করতে পারে। এখনও গ্রামে গঞ্জে এমনি তো দেখি। স্বামী দিনের পর দিন ঘরে বসে বসে খাচ্ছে আর বউটি  উদয়াস্ত খেটে দুটো পয়সা আনছে সংসারের জন্য।এমনকি সে মদ্যপান করে বউকে পেটাতেও পারে।  কারণ তার স্বামী হল পুরুষ মানুষ। সে বাড়ির কর্তা। তার কোনো দোষ থাকতে পারেনা। সে জন্মেই হীরের আংটির মত মহার্ঘ। তাই তা টেরাবাঁকা হোক কিম্বা ভাঙা। ধর্ষণেও তাদের পূর্ণ অধিকার। নারী পুরুষ একসঙ্গে কোনো দোষ করলে সমাজের চোখে মেয়েটিরই দোষ হয়। শ্লীলতাহানির  পরেও সমাজ মেয়েটিকে দোষারোপ করে তার খুল্লামখুল্লা সাজ পোষাকের জন্য। কারণ ছেলেদের দোষ থাকতে পারেনা। মেয়েদের কলঙ্কের ভয় আছে কিন্তু। বিয়ের বাজারে পাত্রের রূপ গুণ না থাকলেও সে সর্বগুণসম্পন্ন পাত্রী অপেক্ষা কম যায় না কারণ সে পুরুষ। সে হীরক খচিত সেটাই আসল কথা। মানে তার লিঙ্গই তার সামাজিক অবস্থান নির্দেশ করছে। 

এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে আরো একটি প্রবাদের কথা। "ছেলের মুতে কড়ি, মেয়েদের গলায় দড়ি" 

তাই বুঝি সে যুগে সংসারে পুত্র সন্তানের কামনায় তার বাবা মা প্রাণ পাত করতেন। তাই বুঝি একের পর এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে দিতে বিধ্বস্ত বাবা মা মন্দিরে ছুটতেন কাকভোরে সশীষ ডাব নিয়ে কিম্বা দরগায় গিয়ে হত্যে দিতেন অথবা চিস্তিতে গিয়ে লাল সুতো বেঁধে আসতেন। ছেলে আসবে মায়ের কোল আলো করে। তার প্রস্রাবটিও ফেলার নয়। তার মধ্যে মহার্ঘ কড়ি আছে যে। সে জন্মালে বাড়িতে শাঁখ বাজবে। তার অন্নপ্রাশন হবে ঘটা করে। তার জন্য মা বছরের পর বছর ষষ্ঠী পালন করবে। তার মঙ্গলের আশায়। আর মেয়ে হলে? এসব কিছুর প্রয়োজন নেই। পারলে মুখে নুন পুরে হত্যা তো আর করা যায় না বরং তার জন্য সবকিছু অন্যরকম নিয়ম হোক। কন্যা সন্তানের  জন্য অত গদ্গদ হবার কিছু নেই। এই  বৈষম্যই তো তাকে সেই ছেলের থেকে আলাদা করে রাখবে। সে জন্মালে শাঁখ বাজবে না। তার জন্মদিনে পায়েসের বাটি, মাছের মুড়ো কিছুই আয়োজন হবে না। 

আজ মেয়েরা সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে আমরাও পারি। তাদের সময় হয়েছে পুরো আকাশের সবটাই ছেলেদের সঙ্গে ভাগ করে নেবার। বরং তাদের জন্যই এই প্রবাদের বদলের সময় এসেছে। কালো মেয়ের রঙের জন্য শুনতে হয় কত কিছু। কালো মেয়ের বিয়ে নিয়েও ভাবতে হয় বিস্তর। সেই কালো মেয়ে যখন রাষ্ট্রের মধ্যমণি কিম্বা মহাকাশের পথে পাড়ি দেয় অথবা মারণ রোগের ওষুধ আবিষ্কার করে ছেলেদের সঙ্গে পঙক্তিভোজে সেরা বিজ্ঞানীর আসনে বসে আর তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হয়ে বিদেশ দাপিয়ে বেড়ায় তখন বলতেই হয় কয়লার কালোতেই কিন্তু হীরে লুকিয়ে থাকে। 

কোন মন্তব্য নেই: