দুর্গা
পুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই
ধুমধাম করে আশ্বিনমাসের
পূর্ণিমাতে কোজাগরী লক্ষ্মী
পুজোর রীতি মূলত পূর্ববাংলার
মানুষদের। তবে এখনো বর্ধমানের
ঘরে ঘরে এই পুজো লক্ষ্য করা
যায়। কারণ দেশভাগের পর বহু
মানুষ বর্ধমান জেলাতেও এসে
ঘর বেঁধেছিলেন।এঁরা কেউ মাটীর
সরায় রঙীন লক্ষ্মী মূর্তি
এঁকে অথবা কেউ মাটীর প্রতিমা
এনে পুজো করেন ঘরেই। অবনীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের বাংলার ব্রত বইতে
আছে,
দেবীর
কাছে খেতের ভাল ফলনের আশায়
মানুষ পুজো দেয়। বর্ধমান
জেলাটি আমাদের রাজ্যের
শস্যভান্ডার। তাই কোজাগরী
পুজোর উপাচার হিসেবে ফলমিষ্টি
ছাড়াও ধানজাত দ্রব্যাদি অর্থাত
খই,
চিঁড়ে,
মুড়কি,
মুড়ি
ইত্যাদির মোয়া অবশ্যই নিবেদিত
হয়। তাই কোজগরী লক্ষ্মী পুজো
বর্ধমনের এই লৌকিক কৃষি উত্সবও
বটে। আকাশে পূর্ণচাঁদের রূপোলী
জ্যোত্স্নায় ঘরে ঘরে সোনার
ধানের গোলা। তাই সম্বচ্ছর
যেন ধনের ফলন নিয়ে গৃহস্থ কে
চিন্তা করতে না হয়,
তাদের
পরিবার যেন থাকে দুধেভাতে।
আউস ধানে পরিপূর্ণ মাঠঘাট।
লক্ষ্মী তাদের ধান্য তথা
ধনদেবী।
মানুষের
বিশ্বাস কোজাগরীর রাতে ঘুমোনো
চলবেনা। তাহলেই লক্ষ্মী তাকে
ছেড়ে চলে যাবে। মা লক্ষ্মীর
হাতে ধানের শীষের গুচ্ছ।
চৌকাঠে পিটুলিগোলার আলপনা,
সারা
বাড়ীময় লক্ষ্মীর পদচিহ্ন এই
বিশ্বাসে...তিনি
ঠিক আসবেন প্রত্যেক ব্রতীর
ঘরে। পুরাণে বলে সমুদ্রমন্থনের
সময় ক্ষীরসাগর থেকে পদ্মফুল
হাতে লক্ষ্মীদেবীই উঠে
এসেছিলেন হাতে রাশিরাশি
সোনাদানা,
মণিমাণিক্য
নিয়ে।
সমুদ্রমন্থনের
সময় উঠে এসেছিলেন বলে লক্ষ্মীর
অপর নাম সমুদ্রকন্যা। কেউ
আবার ডাকে ভূদেবী অর্থাত সারা
পৃথিবীর,
সমগ্র
প্রকৃতির পালনকর্ত্রীরূপে।
শারদপূর্ণিমা
তাঁর যে ভীষণ প্রিয়। আশ্বিনের
এই পূর্ণিমার সময় বর্ষা ঋতু
ফিরে যায় একবছরের মত। মৌসুমীবায়ু
বিদায় নেয়। শস্যশ্যামলা মাটি
থেকে সোনা রঙের নতুন আউস ধানের
গন্ধ ওঠে। ভক্তের ঘরে পরব আর
লক্ষ্মী তখন কোজাগরী। এটি
তাঁর কৌমুদী-উত্সব।
চাঁদের আলোয় তখন রাত পরিক্রমার
শুরু। কোজাগরী হয়ে তিনি নজর
রাখেন কে তাঁকে চায়। কে তাঁর
পালন করে। কে তাঁকে বেঁধে রাখে
আজীবন।
অবনীন্দ্রনাথের
মতে কোজাগরী লক্ষ্মী হলেন
আদিম অনার্য লক্ষ্মী। আর
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর ব্রত
কথাটিও সেই অনার্যা কন্যা কে
ঘিরেই।
উজ্জয়িনীর
এক ধার্মিক রাজা তাঁর প্রজাপালনের
জন্য খুব সুখে কাল যাপন করতেন।
একবার তিনি ঢেঁড়া পিটিয়ে
জানিয়ে দিলেন যে তাঁর রাজ্যের
হাটে কোনো অবিক্রিত জিনিষ
যেন না পাড়ে থাকে। দিনের শেষে
তিনিই সেই জিনিষটি কিনে
নেবেন দোকানীর কাছ থেকে। রটে
গেল খবর। জানা গেল এক কামারের
কাছে এক ভয়ানক চেহারার বিশ্রী
নারীমূর্তি পড়ে রয়েছে। কামারকে
জিগেস করতেই সে বলল,
মহারাজ
এটি নাকি অলক্ষ্মী মূর্তি
তাই কেউ কিনতে চাইছেনা। মহারাজ
বললেন,
তিনি
যখন কথা দিয়েছেন তখন সেটি কিনে
নিয়েই বাড়ি ফিরবেন। নয়ত অধার্মিক
রাজা হিসেবে তাঁকে রাজ্যের
মানুষ চিনে যাবে। রাজা অগত্যা
সেই লোহার মূর্তিটি কিনে এনে
নিজের ঠাকুরবাড়িতে তাকে আশ্রয়
দিলেন। মাঝরাতে নিজের রাজপুরীর
মধ্যে মেয়েলি কান্নার কন্ঠস্বর
শুনে রাজা দেখতে পেলেন এক
ক্রন্দনরতা নারীমূর্তিকে।
রাজা
তাকে জিগেস করলেন "তুমি
কাঁদছো কেন মা?'
সেই
নারী বললে,"
মহারাজ,
আমি
আপনার রাজলক্ষ্মী,
আজ
আপনার বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি'
রাজা
বললেন,
কেন
মা?
আমি
কি অন্যায় করেছি?
জানতে
পারি?'
সেই
নারীমূর্তি বললে,"
আপনি
রাজবাড়িতে অলক্ষ্মীকে ঠাঁই
দিয়েছেন। অতএব আমি আর এখানে
থাকতে পারবনা।'
এই
বলে তিনি অন্তর্হিতা হলেন।
আবার কিছুপরে রাজা দেখলেন
আরেক সুন্দরী,
সুশীলা
নারী প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে
যাচ্ছে। সে হল ভাগ্যলক্ষ্মী।
তার কিছুপরেই যশোলক্ষ্মী,
কুললক্ষ্মী,
সকলেই
একে একে রাজপুরী থেকে বিদায়
নিল। রাজার সেরাতে ঘুম এলনা।
এবং সকলেরি বিদায় নেবার কারণ
হল সেই অলক্ষ্মীমূর্তিটি
যেটি রাজা কিনে এনেছিলেন।
এভাবেই
তাঁর দিন কাটে।
তবুও
শিল্পীর হাতে বানানো সেই
অলক্ষ্মীমূর্তিটি ফেলে দিতে
রাজার মন চায়না। শিল্পী তো
আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরী
করেছে তাকে।
শিল্পীর
শিল্পীসত্তায় আঘাত করতে মন
চায়না রাজার। তাই প্রাসাদ
থেকে একটু দূরেই সরিয়ে রাখেন
তাঁকে কিন্তু ফেলতে পারেন
না। ক্রমে তিনি দরিদ্র হতে
থাকলেন। ধন,
মান,
যশ,
সাফল্য
ভাগ্য তাঁকে ছেড়ে চলে যায়।
একদিন রাজা দেখতে পেলেন ধর্মরাজ
তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রাজা
তখন নিরূপায় হয়ে ভাবলেন এটা
মেনে নেওয়া যায়না। ধর্ম তাঁকে
ত্যাগ করলে তিনিতো অধার্মিক
রাজা রূপে পরিগণিত হবেন। রাজা
তখন ধর্মকে পুরো ব্যাপারটা
বুঝিয়ে বললেন।
ধর্মরাজা
রাজার যুক্তি শুনে খুব খুশি
হলেন। ধর্মরজের কথায় আশ্বিনমাসের
পূর্ণিমায় রাণীকে কোজাগরী
ব্রত পালন করতে বললেন । রাণী
সারারাত জেগে বসে রইলেন।
আর নিষ্ঠাভরে লক্ষ্মীর পুজো
করে রাজা সব ফিরে পেলেন। আবার
আগের মত তাঁর রাজবাড়ি ভরে উঠল
জাঁকজমকে,
ধনসম্পত্তিতে।
আর
ঠিক সেখানেই যেন মানব সংসারে
ভাল এবং মন্দ মেয়ের টানাপোড়েনের
গল্পটি উঠে আসে। লক্ষ্মী এবং
অলক্ষ্মীর পুজোর তাই বুঝি
চল। কারোকে ফেল না। সব মেয়েই
পূজ্য। দোষে গুণে গড়া মানুষ।
লক্ষ্মীকে বরণ করলেও অলক্ষ্মীকেও
ফেলে দেওয়া চলবেনা...ইহজগতের
মানুষের জন্য সেই শিক্ষামূলক
বার্তা আজো পাই এই পুজোর থেকে।
লক্ষ্মী সুরূপা আর অলক্ষ্মী
কুরূপা। লক্ষ্মী শান্ত আর
অলক্ষ্মী চঞ্চলা। তারা তো
আমাদের ঘরের আর পাঁচটা মেয়েরি
মতন। তাই অলক্ষ্মীর পুজো করে
নিয়েই লক্ষ্মী পুজোর রীতি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন