২ অক্টো, ২০১৭

কুমারীপুজো এবং



এইসময় ২৫শে সেপ্টেম্বর ২০১৭
বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দির তিনশো বছরেরও পুরোনো এক তীর্থস্থান। এটি অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবরত্ন মন্দির। এখানে দেবী মূর্তি কষ্ঠি পাথরের অষ্টাদশভুজা সিংহবাহিনী, মহিষমর্দিনী, মহালক্ষী রূপিণী । মায়ের ঘট প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে এখানে শারদোতসবের সূচনা হয়। মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদে কৃষ্ণসায়র থেকে রূপোর ঘটে জল ভরে শোভাযাত্রা বের হয় মন্দিরের উদ্দেশ্যে।ঘোড়ায় টানা রথে বাদ্যযন্ত্র, ঢাক সহকারে বিশাল শোভাযাত্রায় অংশ নেন শহরবাসীরা। শহরের রাজপথের দুই ধারে মানুষের ভিড় উপচে পড়ে । অবশেষে শোভাযাত্রা এসে সর্বমঙ্গলা মন্দিরে শেষ হয় এবং ঘট প্রতিষ্ঠা হয়।

সারাবছর এখানে দেবীর নিত্যপুজো ছাড়াও মহাষষ্ঠীতে বিল্ববৃক্ষে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস, মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা পূজা, মহা অষ্টমীতে কুষ্মান্ড বলিদান, আরতি ও সন্ধিপূজা হয় । মহানবমীতে হয় কুমারী পুজো, হোমযজ্ঞ। মহা দশমীতে বিহিত পুজোর পর অপারাজিতা পূজা ও ঘট বিসর্জন হয় ।
বর্ধমানের কোথাও আবার পালকি চেপে কুমারীকে ঘোরানো হয় সারা শহর। সেখানেও ঐতিহ্য মেনে নবমীর দিন কুমারী পুজো হয়।
বর্ধমানের সাবেকী বাড়ির পুজোগুলি খুব প্রাচীন। কোনোটি বা পাঁচশো বছরেরো পুরোনো। বুদবুদের মানকরের বড় কবিরাজ বাড়ির পুজো প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের। বর্ধমান রাজার কাছে জমিদারি পাওয়ার পরে এখানে বাস শুরু করেন পূর্বপুরুষেরা। তখন থেকেই এই পুজো চলছে।
কাঁকসার ত্রিলোকচন্দ্রপুরের মণ্ডলবাড়ির পুজো প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। নবমীর দিন গ্রামের বাইরে তিলুইচণ্ডী তলায় পুজো হয়। এই তিলুইচণ্ডী নাকি লক্ষ্মণ সেনের আমলের। এখানে নবমীর দিন কুমারীপুজো হয় দেখবার মত। এছাড়া আসানসোল রামকৃষ্ণ মিশন ও কাটোয়ার রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমে ধুম করে হয় কুমারী পুজো।

কুমারী কন্যার শুদ্ধ আত্মাতেই নাকি ভগবতী দেবী দুর্গার প্রকাশ সবচেয়ে বেশী। তন্ত্রসার মতে ১ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত অরজঃস্বলা বালিকারা কুমারী পূজার উপযুক্ত । যে কোনো জাতের কন্যাকেই মাতৃজ্ঞানে দুর্গাপুজোর অষ্টমী কিম্বা নবমী তিথিতে পুজো করা হয়। বেদ পুরাণের যুগে মুনি ঋষিরা প্রকৃতিকে কুমারী জ্ঞানে পুজো করতেন।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০১ সালে বেলুড়মঠে দুর্গাষ্টমীতে পুনরায় কুমারীপুজো চালু করেছিলেন। ভারতবর্ষের দুটি স্থানে, মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী মন্দিরে এবং কন্যাকুমারীতে দেবীশক্তিকে কুমারী জ্ঞানে পুজো করা হয়।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত যে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া অনবরত চলছে সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপিত করে দেবীরূপে তার সাধনাই হল কুমারী পূজা । এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে । তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা।দুর্গাপুজো কে কলিকালের অশ্বমেধ যজ্ঞ বলা হয়। আর রামায়ণ্-মহাভারতে আমরা যত যজ্ঞের কথা শুনি কুমারীপুজো হল দুর্গাপুজোর মধ্যে আরো একটি বিশেষ যজ্ঞ।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। তখন শরৎকাল, দক্ষিণায়ণ। দেবতাদের নিদ্রার সময়। তাই, ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগরিত করলেন। দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বললেন, বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে। দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখলেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার রাশির মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি তপ্তকাঞ্চন বর্ণা বালিকা। ব্রহ্মা বুঝলেন, এই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা। তিনি বোধন-স্তবে তাঁকে জাগরিত করলেন। ব্রহ্মার স্তবে জাগরিতা দেবী বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চণ্ডিকামূর্তি ধারন করলেন।

মনু সংহিতা অনুসারে
যত্র নার্যন্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ
যত্রৈতান্তু ন পূজ্যতে সর্বান্তুত্রাফলাঃ ক্রিয়া’।।

এর অর্থ হল, যেখানে নারীরা পূজিত হন সেখানে দেবতারা প্রসন্ন। যেখানে নারীরা সম্মান পান না, সেখানে সব কাজই নিষ্ফল। আর তাই তো নারীর সম্মান প্রদানে ব্রতী হয়ে স্বামীজি এই কুমারী পুজো চালু করেন।

আবার মহাদেব যোগিনী শাস্ত্রে বলেছেন,
কুমারী পূজনং ফলং বক্তু নার্হামি সুন্দরী।
জিহ্বাকোটি সহস্রৈস্তু বস্তুকোটি শতৈরপি’।

এর অর্থ শতকোটি জিহ্বায় কুমারী পূজার ফল ব্যক্ত করতে পারব না। কুমারীরা শুদ্ধতার প্রতীক হওয়ায় মাতৃরূপে ঈশ্বরের আরাধনার জন্য কুমারী কন্যাকে নির্বাচন করা হয়।

তবে অরজ:স্বলা কুমারীদেরই কেন পুজো করা হবে সেই নিয়ে আধুনিক ভাবনাচিন্তায় দ্বিমত। কন্যা ঋতুমতী হলেই কি অশুদ্ধ হয়ে যায় ? আর অরজস্বঃলা কন্যাই কি অপাপবিদ্ধ? তাহলে অম্বুবাচীর দিনে কামাখ্যা মন্দিরে এত ভীড় কিসের হয়?

যোগিনীতন্ত্রে বলে ব্রহ্মার শাপে বিষ্ণুর দেহে পাপ সঞ্চার হলে সেই পাপ থেকে মুক্ত হতে হিমাচলে মহাকালীর তপস্যা শুরু করেন। বিষ্ণুর তপস্যায় মহাকালী খুশি হন। দেবীর সন্তোষ মাত্রেই বিষ্ণুর হৃদ পদ্ম হতে সহসা ‘কোলা’ নামক মহাসুরের আবির্ভাব হয়। সেই কোলাসুর ইন্দ্রাদি দেবগণকে পরাজিত করে অখিল ভূমণ্ডল, বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠ এবং ব্রহ্মার কমলাসন প্রভৃতি দখল করে নেয়। তখন পরাজিত বিষ্ণু ও দেবগণ ‘রক্ষ’ ‘রক্ষ’ বাক্যে ভক্তিবিনম্রচিত্তে দেবীর স্তব শুরু করেন। দেবতাদের স্তবে প্রসন্ন হয়ে দেবী চণ্ডিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে দেখা দিয়েছিলেন।সন্তুষ্টা দেবী বলেন, ‘হে বিষ্ণু! আমি কুমারীরূপে কোলানগরী গমন করে কোলাসুরকে সবান্ধবে হত্যা করব।’ দেবী কথামতো কাজ করেন। সেই থেকে দেব-গন্ধর্ব, কিন্নর-কিন্নরী, দেবপত্নীগণ সকলে সমবেত হয়ে কুসুম-চন্দন-ভারে কুমারীর অর্চনা করে আসছেন।
আজকের সমাজের নারী নির্যাতনের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কন্যাভ্রূণ হত্যা, ধর্ষণ, ইভটিজিং ইত্যাদির মত নৃশংস ঘটনায় মনে হয় প্রতিদিন যদি এভাবেই মন্দিরে মন্দিরে এক একজন জ্যান্ত কুমারীকে পুজো করা হয় তবে বুঝি কিছুটা হলেও এই কদর্য এবং বিকৃত রুচির কাজগুলির হাত থেকে মেয়েরা মুক্তি পেত। যে কুমারী কন্যাশ্রীদের দেবীজ্ঞানে পুজো করা হচ্ছে ধর্ম ভীরু সেইসব পুরুষরা পথেঘাটে তাদের স্পর্শ করতে অন্ততঃ একবার ভাববে।

কোন মন্তব্য নেই: