আশ্বিনের শুক্লপক্ষ । শুক্লাষ্টমীর জ্বলজ্বলে বাঁকাচাঁদ আকাশের গায়ে । অষ্টমীর সকালের পুষ্পাঞ্জলি, আরতি, ভোগরাগ সন্ধ্যার শীতল, সন্ধ্যারতি, সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে নিষ্ঠায় পালন হয়েছে । রাত বাড়ে । নিশাচরী খেচরদের কূজনে অষ্টমী তখন যাই যাই । মেঘমুক্ত আকাশে ফুটফুটে তারা । মাদুর্গার মৃন্ময়ীমূর্তি চিন্ময়ী হয়ে উঠছে ক্রমশঃ । এগিয়ে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ । রাত বারোটার পর থেকেই তোড়জোড় শুরু । একশো আট লাল পদ্ম ফোটাতে শুরু করেছে সকলে মিলে । একশো আট প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের তত্পরতায় রাত্রি দেবীও অবগুন্ঠন খুলে এগিয়ে এসেছেন । একশো আট প্রদীপের সলতে, ঘৃত, কর্পূর সহকারে স্থাপন করা হল পিতলের প্রদীপদানে । সময় তখন রাত বারোটা বেজে একান্ন মিনিট ; সন্ধিপূজা শুরু হল । অস্টমী আর নবমী তিথির শুভ সন্ধিক্ষণ রাত একটা বেজে পনেরো মিনিটে । মন্ত্রের অণুরণনে মুখরিত রাতের হিমেল বাতাস । কাশ্মীর থেকে কণ্যাকুমারিকা, কামরূপ থেকে কাঠিয়াবাড় সবস্থানই একযোগে আলোড়িত হল । পটকা, দামামা, শঙ্খধ্বনি, ঢাকের বাদ্যি, উলুধ্বনি, ঘন্টা সব মিলিয়ে একটা শব্দের স্রোত ভারতের আসমুদ্র হিমাচলের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিল । গড়িয়ে চলল সেই শব্দ । মায়ের ঘামতেলযুক্ত মুখমন্ডল উদ্ভাসিত সেই শব্দে । অষ্টমীতিথির বিদায় আর নবমীর আগমনে চিত্রনেত্রা অদ্রিজার সন্ধিপূজা চলতে লাগল ।
দেবী দুর্গা নাকি এই দুইতিথির মিলনক্ষণেই আবির্ভূতা হন দেবী চামুন্ডারূপে । চন্ড এবং মুন্ড এই দুই উগ্রমূর্ত্তি ভয়ানক অসুরকে বধ করেছিলেন এই সন্ধিক্ষণে । আশ্বিনমাসে রামচন্দ্রের অকালবোধন এবং অপ্রতিরোধ্য রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করার জন্য যে দুর্গাপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসের রামায়ণে সেখানেও দেখি রামচন্দ্র সন্ধিপূজা সমাপন কালে দেবীর চরণে একশো আট পদ্ম নিবেদন করার আশায় হনুমানকে দেবীদহ থেকে একশো আটটি পদ্মফুল তুলে আনতে বলেন । হনুমান একশোসাতটি পদ্ম পেলেন । দেবীদহে আর পদ্ম ছিলনা । এবার প্রশ্ন কেন দেবীদহে একটি পদ্ম কম ছিল । তার কারণ স্বরূপ কথিত আছে , দীর্ঘদিন অসুর নিধন যজ্ঞে মাদুর্গার ক্ষত বিক্ষত দেহের অসহ্য জ্বালা দেখে মহাদেব কাতর হলেন । মায়ের সারা শরীরে একশো আটটি স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল । মহাদেব তাঁকে দেবীদহে স্নান করতে বললেন সেই জ্বালা জুড়ানোর জন্য । দেবীদহে মায়ের অবতরণে একশো সাতটি ক্ষত থেকে সৃষ্টি হয়েছিল একশো সাতটি পদ্মের । মহাদেব দুর্গার এই জ্বালা সহ্য করতে না পারায় তাঁর চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু নিক্ষিপ্ত হল মায়ের একশো আটতম ক্ষতের ওপর । দেবীদহে স্নানকালে সেই অশ্রুসিক্ত ক্ষতটির থেকে যে পদ্মটি জন্ম নিয়েছিল সেটি মা নিজে হরণ করেছিলেন । কারণ স্বামীর অশ্রুসিক্ত পদ্মফুলটি কেমন করে তিনি চরণে নেবেন । আবার কৃত্তিবাসের রামায়নে পাই রাবণ নিধন যজ্ঞের প্রাক্কালে রামচন্দ্র বলছেন
" যুগল নয়ন মোর ফুল্ল নীলোত্পল
সংকল্প করিব পূর্ণ বুঝিয়ে সকল ।।
একচক্ষু দিব আমি দেবীর চরণে "
রাম ধনুর্বাণ নিয়ে যখন নিজের নীলোত্পল সদৃশ একটি চক্ষু উত্পাটন করতে উদ্যত তখন দেবী রামচন্দ্রের হাত ধরে তাঁকে নিবৃত্ত করে বলেন
"অকালবোধনে পূজা কৈলে তুমি, দশভুজা বিধিমতে করিলা বিন্যাস।
লোকে জানাবার জন্য আমারে করিতে ধন্য অবনীতে করিলে প্রকাশ ।।
রাবণে ছাড়িনু আমি, বিনাশ করহ তুমি এত বলি হৈলা অন্তর্ধান "
সন্ধিপূজার এই মাহেন্দ্রক্ষণে কেউ বলি দেন । কেউ সিঁদুর সিক্ত একমুঠো মাসকলাই বলি দেন । সবকিছুই প্রতিকী । সর্বকালের সর্বক্ষণের দুষ্টের দমন হয় দেবীর দ্বারা । রক্ত বীজের ঝাড় অসুর কুল যেন বিনষ্ট হয় । ঢাকের বাদ্যি বেজে ওঠে যুদ্ধজয়ের ভেরীর মত । একশো আট প্রদীপের আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয় ভারতবর্ষের আনাচকানাচ । উত্তিষ্ঠত ভারতবাসীর জাগ্রত মননে দুষ্কৃতের বিনাশিনী এবং সাধুদের পরিত্রাণ কারী মা দুর্গা কান্ডারী হয়ে প্রতিবছর অবতীর্ণ হন মর্ত্যলোকে ।
২টি মন্তব্য:
বাহঃ কি সুন্দর লিখেছেন ইন্দিরাদি। এত ঘটনার সব কিছু আমি জানতাম না। আপনার পুজো ভাল কাটল আশাকরি।
hyan go Mahasweta, Prantiker pujote darun enjoy korchhi protibarer moto.... asha kori tumio bhalo achho...
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন