২৯ আগ, ২০১০

"নয়নভোলানো নিউ অর্লিন্স"

২৯শে আগস্ট ২০১০,  দৈনিক স্টেটসম্যান (বাংলা) র রবিবাররের ক্রোড়পত্র বিচিত্রায় প্রকাশিত "নয়নভোলানো নিউ অর্লিন্স"

আমেরিকার অনেক নাম করা শহর যেমন নিউইয়র্ক ,ফ্লোরিডা, নিউজার্সি,  বস্টন, ক্যালিফোর্নিয়া, লস এন্জেলেস নিয়ে আমরা পত্র-পত্রিকায় অনেক গল্প, ভ্রমণকাহিনী, পড়ে থাকি । এই শহর গুলি আমাদের না ঘোরা হলেও নামগুলির সাথে আমরা অত্যন্ত পরিচিত । কেউ আমেরিকা যাচ্ছে শুনলেই আমাদের এই সব চিরাচরিত  শহর গুলির কথা প্রথমেই মাথায় আসে ।  কিন্তু আজ আমি এমন একটি শহরের নাম করব তা হয়ত অনেকের চেনা আবার অনেকের কাছেই অচেনা  । বহু পুরোনো শহর এটি । আমেরিকার একটি গুরুত্ব পূর্ণ পোর্ট আর পাঁচমিশেলি ঐতিহ্যবাহী এই শহরটির নাম নিউ-অর্লিন্স । লুইসিয়ানা স্টেটের বন্দর শহর ।  মিসিসিপি নদীর ধারে  অবস্থিত এই শহরে আমার যাবার অভিজ্ঞতা এবং সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৮৯ সালে । ডালাস শহর থেকে গাড়ি করে এক ভোরে আমরা পাড়ি দিয়েছিলাম নিউ-অর্লিন্সের দিকে ।   টেক্সাস স্টেট আর লুইসিয়ানা স্টেটের  মধ্যবর্তী ইন্টারস্টেট হাইওয়ে ধরে মাজদা ৬২৬ গাড়ি নিয়ে আমাদের যাত্রা হল শুরু । সাথে এক থার্মোস কফি, ইন্স্ট্যান্ট কেক মিক্স  দিয়ে বানানো কেক , কুচো নিমকি আর আইসবক্সে "কোল্ড-কার্ট" (স্যান্ডুইচ এর মাংসের স্লাইস ) , স্যান্ডুইচ ব্রেড আর কয়েকটা কোক ক্যান । ডালাস থেকে নিউঅর্লিন্স প্রায় ৮০০ কিলোমিটার । রাস্তাঘাট ভাল, পথে ছোট বড় ফুড জয়েন্টেরও অভাব নেই   কিন্তু স্টুডেন্টের পকেটমানিতে কথায় কথায় রেস্তোরাঁয় থামতে হলে নিউঅর্লিন্সে পৌঁছে মেমেন্টো কেনার সামর্থ্য হবে না তাই খাবার দাবার খানিকটা নিয়ে যাওয়া এই আর কি ।
গাড়ি করে লংড্রাইভে যেতে যেতে দেখেছি আমেরিকার রাস্তাঘাটের  বৈচিত্র্য । নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে বিধাতা পুরুষ ছপ্পর ফুঁড়ে দিয়েছেন এদের, দু হাত তুলে সর্বক্ষণ আশীর্বাদ করে চলেছেন আর দেশের মানুষগুলিও সর্বদা প্রাণ দিয়ে  নিজের দেশ কে আরো সজীব, আরো সুন্দর করার ব্রতে ব্রতী  ।  এত পরিচ্ছন্নতা, এত পর্রিকল্পনাময় পরিকাঠামো দেখে বারবার মনে হয়েছে ভগবানের নিজের দেশ বোধ হয় এটি । তাই বোধ হয় এত সুন্দর । তাই নিউঅর্লিন্স যাবার সময় ও বারেবারে মনে হয়েছে "তোমার গান গাওয়া শেষে রেখে যেও তব হাতের কোমল স্পর্শ , আমি আবার ফিরে এসেছি হেথায় পেরিয়ে আলোকবর্ষ"  টেক্সাসের সবুজ আর লুইসিয়ানার নীল নিয়ে চললাম । গাড়ি ছুটে চলল হাইওয়ের ওপর দিয়ে, গাড়ির অডিওতে বাজতে লাগল রাবিঠাকুরের গান "পথ দিয়ে কে যায় গো চলে " যত এগোই তত মনে হয় সবুজে-নীলে মিশে প্রকৃতি একাকার । এখানকার আকাশ বোধ হয় আরো নীল আর ধানক্ষেতের সবুজ যেন আরো বেশি সবুজ ।  গ্রাম, ভুট্টার ক্ষেত, গম ও ধানের ক্ষেত, ছোট ছোট খাল-বিল আর বক, সারস তো চললই আমাদের সাথে । ঘন্টা দুয়েক চলার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে কফি আর কেক খেয়ে আবার চলা ।হাতে একটা ম্যাপ নিয়ে পাশের ড্রাইভার ভদ্রলোকটিকে ন্যাভিগেট করতে করতে চললাম |তখন মার্চ মাস, গরম একদম নেই । বাতাসে হালকা ঠান্ডার রেশ । শেষ বসন্তের  একটুকু ছোঁয়া ।   রাস্তার ধারে বড় বড় গাছেদের পাতা ঝরে গিয়ে নতুন কচি পাতা । কোনো গাছে পাতা নেই ফুল সর্বস্ব । কত রঙ তাদের... কখনো হলুদ, কখনো বেগুনী  । বাদাম গাছের মত কোনো একটা গাছ কমলা রঙের কচি পাতাদের উদ্ধত গ্রীবা মেলে ধরেছে আকাশের সীমায়,  কখনো পেরোলাম গাছেদের সুশীতল ছায়াময় এভিনিউ ।   আমেরিকার বসন্ত বোধ করি সব জায়গায় একই রকম । আরো নীল, ঘন নীল, কচি কলাপাতা সবুজ, গাঢ় সবুজ  ।  মনে হল দোল খেললাম প্রকৃতির সাথে ।
বেলা গড়িয়ে দুপুর সূর্য যখন মাথার ওপর তখন একটা ছায়ায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে স্যান্ডুইচ বানালাম গাড়ির মধ্যে বসেই । কোক আর স্যান্ডুইচ দিয়ে সারলাম দুপুরের খাওয়া । পাশের একটা গ্যাস স্টেশনে তেল ভরে ফ্রেশ হয়ে আবার  শুরু করলাম যাওয়া । ইতিমধ্যে টেক্সাস কে ফেলে লুইসিয়ানা ঢুকে পড়েছি । প্রকৃতিগত দিক থেকে বৈচিত্র কিছু চোখে না পড়লেও ছোট,  বড় সব নদীর দেশে এসেছি মনে হল । নদীর পাড়, সেতু সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণ দেখে নিজের দেশের জন্য বড় মায়া হতে লাগল ।  সবশুদ্ধ প্রায় ন' ঘন্টা লাগল  নিউঅর্লিন্স পৌঁছতে । বিকেল প্রায় তিনটে তখন ।
পৌঁছলাম সাউথ-ইস্টার্ন লুইসিয়ানার অন্যতম শহর নিউ অর্লিন্সে । ভারতবর্ষে গ্রেটব্রিটেনের ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি যেমন রাজত্ব করতে এসে কোলকাতায় গড়েছিল তাদের রাজধানী ঠিক তেমনি ৭ই মে, ১৭১৮ সালে ফ্রেন্চ মিসিসিপি কোম্পানি আমেরিকায় এসে নিউঅর্লিন্স শহরের গোড়াপত্তন করেছিল । তারপর নেপোলিয়ান    এই শহরের আশপাশের এলাকা লুইসিয়ানা স্টেটকে বিক্রি করেন ১৮০৩ সালে । আমেরিকার  দক্ষিণে অবস্থিত বলে ক্রীতদাস প্রথা বহু যুগ ধরে চালু ছিল এখানে তাই জনসংখ্যার বেশিরভাগ ই কৃষ্ণাঙ্গ । তবে শহরে পা দিয়ে ই মনে হল প্রাচীন ঐতিহ্যের ছোঁয়া এখানে, পুরোণো বাড়িদের, পুরোণো ট্রামেদের সারি ,ফুটপাথ ঘেঁষা গথিক স্টাইলের স্থাপত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা স্বমহিমায় ।  কেমন একটা মন কেমন করা পুরোণো পুরোণো গন্ধ পেলাম । পরে আমেরিকার অন্য শহর গুলিতে গিয়ে যা পায়নি । ঠিক আমাদের নিউমার্কেট, এস্প্ল্যানেডের গলি আর কলেজ স্ট্রীট কফি হাউসের মাদকতার স্পর্শ অনুভব করলাম ।   তবে মেন্ট্যানেন্স আর পরিচ্ছন্নতা দেখে আবার কেঁদে উঠল প্রাণ  পুরোণো কলকাতার জন্যে ।
ডিউক অফ অর্লিন্স, ফিলিপ-ডি-অরলিন্সের  এর নামে এই শহরের নাম হয় নিউ অর্লিন্স ।    মিসিসিপি নদীর বদ্বীপে অবস্থিত এই শহরের পুব আর পশ্চিম জুড়ে শুধু তরঙ্গায়িত মিসিসিপির নীল জলরাশি আর দক্ষিণে রাজকীয় হ্রদ লেক পনচার্ট্রেন ।  অমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ বন্দর এটি আর অফশোর এবং অনশোর পেট্রোল এবং ন্যাচারাল গ্যাস উতপাদনে পঞ্চম বৃহত বন্দর এই নিউ অর্লিন্স ।   ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে আমাদের কোলকাতায় যেমন এক সময় ফরাসী, ওলন্দাজ সহ বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল নিউ অর্লিন্সে এসে ঠিক তেমন মনে হল । এই শহরটি আমেরিকার এক অনন্য শহর যেখানে নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের  মাঝে এক মাল্টিলিঙ্গুয়াল এবং ক্রস কাল্চারাল হেরিটেজের সংমিশ্রণ ঘটেছে  । আর বহুমুখী ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হয়ে নিউঅর্লিন্স বাকী আমেরিকা থেকে যেন বিছিন্ন । নতুন আমেরিকার শপিংমলের গন্ধ নেই এখানে , নেই মোড়ে মোড়ে পিত্জা জয়েন্ট বা বার্গার পয়েন্ট, নেই এক্সপ্রেস ওয়ের চাকচিক্য। বরং ইওরোপীয় সংস্কৃতির অনন্দাধারা ব‌ইছে সেখানে ।    
একটি মোটেলে গিয়ে উঠলাম আমরা । মালপত্র রেখে স্নান করে বাকি কফিটুকুর সদ্ব্যবহার করে বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে ।প্রথমে ই দেখলাম লাল রঙয়ের ঝকঝকে ট্রাম একখানা । ফুটপাথথেকে নেমে ট্রামস্টপেজে গিয়ে উঠে পড়লাম ট্রামে । ওখানে বলে স্ট্রীটকার ।  পাঁচমিনিটের মধ্যে ট্রাম আমাদের নিয়ে গেল নিউ অর্লিন্সের সেন্ট্রাল বিজনেস পয়েন্ট জ্যাকসন স্কোয়ারে । উইকের মাঝামাঝি ; যথারীতি ডালহৌসি স্কোয়ারের মত ব্যস্ত রাজপথ  । অফিস পাড়া বা ডাউনটাউন নিউঅর্লিন্স । সন্ধ্যে হয়ে এসেছে তখন । নিরাপত্তাহীনতার ভয় হয়ত নেই নিউইয়র্কের মত কিন্তু  পথের ক্লান্তি রয়েছে সাথে তাই সেখানে বেশিক্ষণ না থেকে ফিরে এলাম আবার ট্রামে করে । রাতে হোটেলে ফিরে ডিনার খেয়ে ঘুমোলাম । পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে প্রথমেই গেলাম  "vieux carre" নিউ অর্লিন্সের প্রাণ কেন্দ্র, পুরোণো নিউঅর্লিন্সের ফ্রেঞ্চকোয়ার্টার ছিল এককালে, তাই ফরাসী ঐতিহ্য বহমান এখনো রাস্তার মাঝে |এই শহরই নাকি জ্যাজ মিউজিকের পীঠস্থান বলে জনপ্রিয় । বিখ্যাত জ্যাজ শিল্পী লুই আমস্ট্রং এখানকার ই লোক জানলাম । পথে ঘাটে অণুরণিত হচ্ছে জ্যাজ টিউন ।    রাস্তার ধারে ধারে বাদ্যশিল্পীর জ্যাজ অনুশীলনবিশালকার স্যাক্সোফোন নিয়ে সঙ্গীত চর্চা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম । এ শহরের আকাশে বাতাসে জ্যাজ; আমি জ্যাজের কিছুই বুঝি না কিন্তু   নিষ্ঠাবান কৃষ্ণকায় এই মানুষ গুলির সঙ্গীতচর্চায় ডেডিকেশন দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হলাম ।
চোখে পড়ল ক্ষুদে চিত্রশিল্পীদের শিল্পকলা রাস্তার ফুটপাথে ছবি আঁকার ,রঙ, তুলি নিয়ে বিছিয়ে বসেছে । যেমন   আমাদের কলকাতা ব‌ইমেলা বসে ছবি এঁকে কত বিক্রি হয় সুন্দর সুন্দর ছবি ।  দাড়িওয়ালা এক বড় শিল্পী কিছু দূরে তার ইজেল নিয়ে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে ছবি এঁকে চলেছে । ফ্রান্সের পথে পথে এমন হয় জানতাম কিন্তু এ শহরে দেখে বড় ভাল লাগল ।ফুটপাথের ধারে প্রাসাদোপম অট্টালিকার আধুনিক বুটিকে রূপান্তকরণ যেন অধুনা অমুক নং বালিগঞ্জ প্লেস অথবা তমুক নং ল্যান্সডাউন টেরেসে নামজাদা ডিজাইনার বুটিক!  ঐতিহ্যময় বাড়ি গুলির এত সুন্দর রক্ষণাবেক্ষণ দেখে মনে হল এরা সত্যি গড়তে জানে বেশি ভাঙতে জানে কম ।  নয়নভোলানো সব আর্টগ্যালারি দেখলাম  । এ শহর যে শিল্প-গীত-বাদ্য-কলার সনতন পীঠস্থান সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই ।   মজার শহর নিউঅর্লিন্স সকলে নিজের খেয়ালখুশিতে চলে । কোনো সময়ের অভাব নেই, নেই কোনো একঘেয়েমি । কোনোবাড়ির পোর্টিকোতে গীটারে জ্যাজ বাজায় তরুণ, কোথায় আবার বিউগল বাজিয়ে ভিক্ষা চাইছে যুবক, কোথাও আবার একর্ডিয়ানে সুর তুলতে ব্যস্ত কোনো শিল্পী । মনে হল  ল্যাটিন কোয়ার্টার "Vieux Carre" আজও ফরাসীয়ানায় অমলিন।
সুন্দর বাঁধানো ফুটপাথ,  রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি, সাবেকি স্ট্রীটল্যাম্প আর টুকটুকে লাল ট্রামগাড়ি সব মিলিয়ে এ শহর বারেবারে  মনে করিয়ে দিল আমাদের তিলোত্তমার কথা.... একদা ভারতের রাজধানী পুরোণো কলকাতার কথা  । গেলাম সেন্টপিটার্স স্কোয়ারে ।  সেন্ট পিটার্স ক্যাথিড্রাল দেখলাম । বাকি আমেরিকার মত প্রোটেস্ট্যান্ট বাইবেল বেল্ট নেই এখানে । প্রধানত ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী এ শহরের মানুষ । একটা ছোট্ট বুকলেট কিনলাম শহর সম্বন্ধে জানার জন্য । এই শহর বিখ্যাত তার প্রাচীন ঐতিহ্যময়তায় । ফ্রেন্চ আর স্প্যানিশ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বলে বিখ্যাত "mardi gras"ফেস্টিভাল এখানে হয় জানলাম ।  সেন্টপিটার্স স্কোয়ারেও নামা-অনামা কত শিল্পীর চিত্র প্রদর্শনী চলছে, যেন  ফ্রান্স শহরের পুরোনো সাবেকিয়ানা  ব‌ইছে  নিউঅর্লিন্সের কোণায় কোণায় |
গেলাম সাহেবি পাড়া ব্যস্তময় বুরবন স্ট্রীটে ।   বর্ণময় রাস্তার ধারের একটা পাবে ঢুকে এখানকার বিশেষ পানীয় "টেকিলা উইথ মার্গারিটা" খেলাম । লাঞ্চ সারলাম বুর্বন স্ট্রীটের এক পুরোণো হোটেলে ।   সেদিন প্লেটে সুসজ্জিত কেজুন রাইস আর ক্রফিস কারি নিয়ে পৌঁছে গেছিলাম পার্কস্ট্রীটের চাইনিস রেস্তোরাঁয়, এক নস্টালজিয়ায়....     লুইসিয়ানার খাবারে ক্রেওল এবং কেজুন এই দুই অভিনব ঘরানার সংমিশ্রণ ঘটেছে। স্থানীয় রেডাইন্ডিয়ানদের কুইসিন কে বলে ক্রেওল আর কেজুন হল গাল্ফ অয়েষ্টার, স্টীমড বা বয়েল্ড ক্রফিশ রেড বিনস আর স্মোকড রাইস হল এই দুই   মিশ্র খাবারের প্রধান অঙ্গ । ক্রফিশ আমাদের বাগদা চিংড়ির মত কিন্তু লবস্টার  বা কাঁকড়ার মত দাঁড়া আছে  । ট্রাইবাল কুইজিন তো কি সার্ভ করার ধরণ ধারণে সাহেবিয়ানার স্পর্শ । একটা প্লেটে স্মোকড রাইসের মাঝখানে বড় গর্ত করে ক্রফিশ কারি ঢালা রয়েছে । সে ভাবেই সকলে খাচ্ছে মাছভাত মেখে চামচ আর কাঁটা দিয়ে । সবশেষে খেলাম এখানকার অথেন্টিক সুইটডিশ "প্রালিন"| এটি এক প্রকার মিষ্টি, ক্যান্ডি জাতীয় যা তৈরী হয়  ব্রাউনসুগার, পাউডার্ড হোয়াইট সুগার, ক্রিম, মাখন আর "পেকন" বা আখরোটের মত একটি শুকনো ফল দিয়ে ।  
গেলাম নিউঅর্লিন্সের কলেজ পাড়ায় । সেন্ট চার্লস এভিনিউতে দুটি বিখ্যাত কলেজ দেখলাম । লয়োলা এবং টিউলেন ইউনিভার্সিটি । রাস্তায় একটা আর্ট এন্ড কিউরিও শপে গিয়ে কিনলাম বিখ্যাত নিউঅর্লিন্স শহরের মুখোশ , পোর্সেলিনের তৈরি এই মাস্ক । সব প্রাচীন শহরেই থাকে এমন কোনো না কোনো কিউরিও । যেমন ভুটানের ড্রাগন মাস্ক, পুরুলিয়ার ছৌ নাচের মুখোশ বাঁকুড়ার টেরাকোটার ঘোড়া আর শান্তিনিকেতনের ডোকরা ।
এবার গেলাম মিসিসিপি নদী দেখতে । ভূগোল পড়ার  সাক্ষী হয়ে চিরকাল যে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে তাকে স্বচক্ষে দেখে আত্মহারা হয়ে গেলাম । নদীর ওপর রিভার ক্রুজের ব্যবস্থা রয়েছে । খুব একটা ব্যয় বহুল ও নয় । আম-আদমী সকলেই যাচ্ছে । আমরাও চড়লাম এক মস্ত জাহাজে ।  মিসিসিপি বক্ষে ভেসেছিলাম সেদিন দুজনে.. আমার ভূগোল ব‌ইয়ের ইতিহাস সামনে দিয়ে বয়ে চলল ।
স্রোতের সুর তুলে নীলঘাগরার কুঁচি লুটিয়ে, মিসিসিপির ডেকে বসে দেখেছিলাম সূর্যাস্তের লাল রঙ ওপারের সেন্ট পিটার্স ক্যাথিড্রালও সাক্ষী হয়ে দেখেছিল সে বিকেলের সূর্যাস্তের লাল-কমলার কত খেলা!
মিসিসিপিকে বিদায় জানাতে বড় কষ্ট হয়েছিল মনে মনে বলেছিলাম "ঠিক এমন করেই থেকো তুমি যেমন আজ আছো,তোমার আকাশ আমার আকাশের চেয়েও নীল দেখে যাচ্ছি তোমার জলের রং আমার চোখের তারায় ধরে নিয়েছি তোমার আকাশে সেদিন দেখেছি পড়ন্ত সূর্য়ের লাল-কমলার খেলা
জলের ওপরে সেই ছায়া আর তার ওপরে আমাদের ছবি তা তুমিও কিন্তু রেখো ধরে সুন্দর করে.. শহর নিউঅর্লিন্সকে বলেছিলাম যদি তুমি হারিয়ে যাও একদিন যদি কোনো বিধ্বংসী ঝড় এসে তোমায় গ্রাস করে নেয় তোমার ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না, তুমি হয়ত তলিয়ে যাবে
কিন্তু আমার মনের ক্যানভাসে তুমি বেঁচে থাকবে চিরসুন্দর হয়ে"
২৯শে আগস্ট ২০০৫ এর এক বিধ্বংসি সাইক্লোন,  গাল্ফ অফ মেক্সিকো থেকে উড়ে এসে  আছড়ে পড়ে | কুখ্যাত এই সাইক্লোন  এখানে "হারিকেন ক্যাটরিনা" নামে পরিচিত। এর আঘাতে  মিসিসিপি নদীর বাঁধ ভেঙে  যায় এবং সমুদ্রের জলের উচ্ছ্বাসে সারা নিউ অর্লিন্স শহর গভীর জলে নিমগ্ন হয় । ১০০০ এরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায় অসংখ্য বাড়িঘর ভেঙে পড়ে এবং ব্যাবসা বাণিজ্যের বিপুল ক্ষতি হয় । পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব এখনো মুছে যায়নি নিউ অর্লিন্স থেকে, তার অর্থনীতি থেকে ও শহরের মানুষের মন থেকে  । "vieu carre" তে হয়ত এখনো বাজছে সেই জ্যাজ টিউনের সুর কিন্তু এ এক করুণ বিরহের সুর কারণ এখানকার দুটি ফর্চুন ৫০০ কোম্পানির মধ্যে একটির আজ কোনো অস্তিত্ব নেই |ঝড়ের ধাক্কায় কাবু হয়ে সে নিজেকে বেচে দিয়েছে দূর দেশের অন্য কোম্পানির মালিককে|
 
 

২টি মন্তব্য:

সুশান্ত কর বলেছেন...

এতো পুরোনো কথার খুটি নাটি মনে আছে! বাক করলেনতো!

Indira Mukhopadhyay বলেছেন...

Sushanta, NewOrleans ghure ese album e anek kichhu likhe rekhechhilam 1989 e... Doinik Statesman jakhon kyatrina jhor er tathyo niye NewOrleans ke likhte bollo takhon edit kore pathiyechhilam ...
Bhalo laglo porechhen bole...apnar mone achhe hoito anek din age chhoto ekta kabita ei sahortike niye likhechhilam blog e...