২৮ ফেব, ২০২১

রেওয়া পত্রিকা, অভিজিৎ দত্ত গল্প পুরষ্কার ২০২০ "পাসপোর্ট"

 


 

পাসপোর্ট

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 

তদিন বাদে প্রণতি পিসি কে দেখে চমকে উঠেছিল রূপা। কি আশ্চর্য! মানুষটার বিয়েই হলনা কোনোদিন আর সে কি না বিধবার বেশে? দেখেই জিগেস করেছিল সে, কেন গো এমন সাদা শাড়ি পরে রয়েছ তুমি? আমার কিন্তু মোটেও ভালো লাগছে না তোমায় এমন দেখে।  

প্রণতি বলেছিলেন, বয়স তো ভালোই হল রে। তুই যখন বিদেশ চলে গেলি তখন তোর বয়স কত বল তো? 

কেন ? চার বছর। আর তোমার আঠেরো বছর বোধহয় । এই তো? দেখো দিব্যি মনে আছে আমার। তাই বলে বুড়োরা কেউ রঙ্গিন শাড়ি পরে না?  

প্রণতি বললেন, হ্যাঁ। আমি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিলাম সেবছরেই। 

রূপা বলল, আমায় কিন্তু চিঠে লিখে জানাওনি পাশের খবরটা। বাবা বলেছিল আমায়, দেখও আমার বোন লেটার নিয়ে পাশ করেছে । তখন তো কেমন রঙীন শাড়ি পরতে গো। এখন কেন এমনি পর? 

আরে চল্‌, চল্‌ দিকিনি। কত বছর পর এলি বলত? তোর দিকে চেয়ে দেখি, দাঁড়া তুই! চকচক করছে স্কিন একেবারে। সেদেশে জারাই থাকে তাদেরই এমন। 

তুমি থামবে? রূপা বলে 

হ্যাঁ রে, তোর বর কবে আসবে? 

আমি ঠিক একমাস থাকব পিসি । যাবার সাতদিন আগে তিনি আসবেন ছেলে কে নিয়ে। বাবার অফিস, ছেলের কলেজ । সেদেশে ছুটি অত সুলভ নয় পিসি। বুঝেছ? 

আচ্ছা, বেশ। নে, নে চল, চল এবার। জামা প্যান্ট ছাড়। কিছু মুখে দে। 

সত্যি কি গরম এখানে! 

রূপার কষ্ট দেখে প্রণতি বললেন, তবু তো শীতকালে এলি রে। এখন তো বেশ আরাম আমাদের। 

রূপা বলল, আচ্ছা মন্টু কাকা কোথায় ? দেখছি না যে। 

 

প্রণতি এড়িয়ে যান। তুই হাত মুখ ধুয়ে আয়। রাত হয়েছে। ডিনার খেতে খেতেই সব কথা হবে। তোরা ওখানে শুনেছি খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে নিস। 

হ্যাঁ, আর্লি ডিনার সেদেশে। বলে রূপা তার স্ট্রলি ব্যাগ টানতে টানতে বলে, এই ফ্ল্যাট টা কিন্তু বেশ ছোট যাই বল পিসি। আমাদের আগের বাড়িটা অনেক বড় ছিল। 

প্রণতি কিচেনের দিকে এগিয়ে যান। প্রশ্নগুলি কিছুটা এড়িয়ে। 

বাড়ির সঙ্গে কি ফ্ল্যাটের তুলনা চলে রে? বাড়ি হল বাড়ি আর ফ্ল্যাট হল ফ্ল্যাট। কোনও তুলনাই চলে না। 


রূপা যখন সেই ছোটবেলায় এ শহর ছেড়েছিল তখন তাদের সেই পুরনো বড় বাড়িটায় কত মানুষ একসঙ্গে, এক ছাদের নীচে বাস করতেন। রূপার ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, বাবা, মা, আরো এক পিসি আর মন্টুকাকা। বাবা সবার বড়। প্রণতি তারপরেই । সবচেয়ে সুন্দরী বাড়ির মধ্যে। মন্টু সকলের ছোট। মাঝে রূপার আরেক পিসি। রূপার বাবা পরিতোষ শিবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরী পেলেন কলকাতায়। তখন পাত্রী দেখে তাকে বিয়ে দেওয়া হল। বিদেশ থেকে আরো ভালো চাকরীর অফার এল। এর মধ্যে জন্মেছে রূপা। বছর চারেকের মেয়ে নিয়ে তারা বিদেশে সেটল করল।  দেশে থাকাকালীন প্রণতি পিসির সঙ্গেই ছিল রূপার যত দোস্তি, যত বায়না। বাবা, মায়ের সঙ্গে বিদেশে যাবার বেশ কিছুদিন পরে ছোট পিসি শম্পার  বিয়ে হল। রূপারা আসতে পারেনি বিয়েতে। শম্পা এম এ, বিএড করে ইস্কুলে পড়াতেন। তারপর পোষ্ট এন্ড টেলিগ্রাফে বেশ কিছুদিন চাকরি করার পর তার বিয়ে । রূপা এসব শুনেছে বাবার মুখে।  

প্রণতি টেবিল সাজালেন ভাইঝির জন্য। পিসির হাতে এতদিন পর গরম ভাত, আলুপোস্ত আর মাছের ঝোল খেয়ে তৃপ্তিতে সুখঢেকুর তুলতে তুলতে রূপা বলে, এবার তোমার জন্যে সেদেশ থেকে কি এনেছি দেখবে চল।  

প্রণতি বললেন, আমি কি ছাই বেরোই নাকি? রূপা তার ঢাউস ব্যাগ খুলে পিসির জন্যে একে একে সুগন্ধী সাবান, বডি লোশন, ঘরে পরার নরম চটি আর চকোলেট বের করে।   

প্রণতি বলেন, যাক! এগুলো সব কাজের জিনিষ। চকোলেটের মোড়ক খুলে পিসির মুখে আদরে একটা ডার্ক চকোলেট পুরে দেয় রূপা। অনেকদিন বাদে কেউ এমন আদর করে কিছু দিল প্রণতি কে। । পরিতৃপ্তিতে মন ভরে ওঠে তাঁর । আশীর্বাদ করেন রূপাকে। 

আজ রাতে তোমার কাছে শোব কিন্তু পিসি । সেই ছোটবেলাকার মত। রূপার আবদারে শুখোরুখো মনের ভেতরে অনেকদিন পর যেন নতুন করে বৃষ্টি ঝরে তাঁর। কি আনন্দ সেই ভেজায়।  

বলেন, সে আর বলতে! আমার কাছে শুবি না তো কার কাছে আর শুবি? এ বাড়িতে আর কে আছে? 

মন্টুকাকার খবর কি বললে না তো? 

প্রণতি বললেন, সব খবর এক্ষুণি চাই মেয়ের। আগে চল। এবার কোমর ফেটে যাচ্ছে আমার। শুয়ে শুয়ে সব বলব। রূপা বলল, তা ভাল। আমার তো এখন জেট ল্যাগ। ঘুম আসবে না।  

তবে চল শুয়ে শুয়েই দেদার আড্ডা দেব আজ।  

যা বলছিলাম,তোর  মন্টু কাক আর বিয়েই  করেনি রে। সে আমার কাছেই ছিল এতদিন। দুই ভাইবোনে থাকতাম সেই বড় বাড়িটায়। তারপর তোর দাদু যেমন উইল করে গেল । সেই অনুযায়ী সব ভাগ হল। তবে বাড়ি আর রাখা গেল না। যখন আমাদের বাড়ি প্রোমোটারকে দিয়ে দিলাম তখন মন্টুর আর আমার প্রাপ্য আলাদা ফ্ল্যাট বা টাকা। বাবা কি আর জানত যে মন্টু জীবনে বিয়েই করবে না? 

মন্টুকাকা গান শেখাত না? 

হ্যাঁ, এখনো শেখায় সেই ফ্ল্যাটবাড়িতেই। ওটাই তো তার একমাত্র রুজিরোজগার। তোর বাবা আর ছোট পিসি বাড়ির অংশ ছেড়ে দিয়ে টাকা নিয়ে নিল তখন। আর আমি এসে উঠলাম এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে। আমার প্রাপ্য বাকী টাকা ব্যাঙ্কে রেখেছি। বড় ফ্ল্যাট নিয়ে কি করব। শেষ বয়সে টাকা থাকলে সে আমাকে দেখবে। 

এই ফ্ল্যাট প্রণতি রূপাকে দিয়ে যাবেন। এবারে সেই সব কাগজেকলমে করতেই রূপার আসা। তার পিসির ইচ্ছে ।

তা বাবা, ছোটপিসিকে অত পড়াশুনো করালো আর তুমি হায়ার সেকেন্ডারির পর আর পড়লে না কেন পিসি? তুমি পড়াশোনায় অত ভাল ছিলে শুনেছি । 

কি আর করি বল? বাড়িতে পড়তে দিল না কেউ। তখন বাড়ি থেকে বেরুনো বারণ। 

তা তোমার বোন যে বেরুলো?  

আমার কপালটাই খারাপ রে। 

তোমার বিয়ে দিলেন না কেন ঠাম্মা, দাদু?  

সারাজীবন ধরে এত টানাপোড়েন সহ্য করে এতবছর পর এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ভাল না লাগলেও রূপা কে তিনি বলেই দেবেন সব। এই ভাবলেন।  

কি হল পিসি? চুপ করে র‌ইলে যে।  

আমাদের বাড়ি সে অর্থে কনসারভেটিভ ছিল না। নয়ত আমার বোন অতদূর পড়ে, চাকরী করে তারপর বিয়ের পিঁড়িতে বসে? 

তবে?  

তবে আর কি? এই যেমন তুই সেদেশে তোর বরকে ভালোবেসেছিলি, তোর বাবা মা বিয়েও দিয়ে দিলেন।  

রূপা বলল, সেটাই তো ন্যাচারাল।


জানিস? আমার জীবনটা অনেকের থেকে আলাদা রে। 

কেন পিসি? 

আর কেন? তাঁর জন্য আমিই দায়ী। 

তার মানে? 

আমাদের মস্ত সেই পুরোনো বাড়িটার পাশেই থাকত সুবিমলরা। দুই পরিবারে আসা যাওয়াও ছিল। তবে ঐ যেমন হয় সুবিমল আর আমি তখন ভেসে গেলাম। আমরা প্রেম করতাম ছাদে উঠে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এইরকম চলছিল। সে পড়ত কলেজে। আমি তখন ক্লাস টেন। 

তো ? কি হল তারপর? রূপা বলে 

তার পিসি বলল, মা একদিন মাসীদের সঙ্গে থিয়েটার দেখতে গেল রংমহলে। শম্পা কে সঙ্গে নিয়ে গেল।আর আমাকে রেখে দিয়ে গেল কারণ আমার সামনেই টেস্ট পরীক্ষা। বাবা অনেক রাতে ফিরতেন অফিস থেকে। তোর বাবা তখন শিবপুরের হষ্টেলে। 

রূপা বলল তারপর ? 

সুবিমল সেদিন আমাদের বাড়ির মধ্যেই সোজা চলে এসেছিল। তারপর যা হয়। এতদিনের দূর থেকে প্রেম হঠাত অত কাছাকাছি এসে আর বাঁধ মানেনি। আর কি বলি? সব তো বুঝিস । 

আই মিন গুড তো। ক্ষতি কি তাতে? রূপা বলল। 

তোরা বলবি কি আর হয়েছে এসবে? যাকে বিয়ে করবেই ঠিক করেছ তার সঙ্গে শোয়াই যায়। প্রণতি বললেন। 

ইয়েস। অফ কোর্স। নো  ঢাক ঢাক গুড়গুড় । 

আমি চুপচাপ ছিলাম। পরীক্ষার রেজাল্টও ভাল হল। কিন্তু আমার শরীরের হাবভাব দেখে মা বুঝে ফেলল মাস তিনেক পর। আমার পেটে তখন সুবিমলের সন্তান। মা চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে আমাকে বাবার কাছে নিয়ে গেল। আর তারপরেই সব খালাস হয়ে আমায় মুক্ত করল। তবে মা'কে সুবিমলের কথা আমি খুলে জানিয়েছিলাম সব। বাবা, মায়ের চরম আপত্তি। ভ্যাগাবন্ড ছেলে। পাড়ার লোক। পাশেই থাকে। তাদের সঙ্গে প্রবল অশান্তি, ঝগড়াঝাটি কিছুই বাকী র‌ইল না। তদ্দিনে সুবিমল চুপিচুপি বম্বে পাড়ি দিয়ে সিনেমা করতে গেছে। রাগে, ঘেন্নায় আমার তখন সুবিমলের প্রতি প্রেম উধাও। 


রূপার চোখে তখন জল টলটল করছে। ও তাই জন্যে এমন বৈধব্য বেশ তোমার? সেই কাপুরুষ লোকটার জন্যে? এত্ত মায়া? এটা আমি মেনে নিতে পারলাম না কিন্তু।  

প্রণতি বললেন, মোটেও না। আমার অভিমান অন্যখানে। এই ঘটনার পর অষ্টাদশীর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হল বাড়িতে। আর জারি করল কারা? তার বাবা আর মা। বাড়ির বড় মেয়ে, সুন্দরী বুদ্ধিমতী মেয়ে তাদের সব আশায় জল ঢেলে দিয়েছে তাই। বাবা আলমারী খুলে আমার রঙীন সব শাড়ি পুড়িয়ে দিল। আর সাদাশাড়িগুলো এনে আমাকে বলল, কাল থেকে বাইরে বেরুনো বন্ধ। পড়াশুনো আর চলবে না। এখন থেকে যেন বাড়ির সব রান্নাবান্না আমি‌ই দেখি। মা'কে সাহায্য করি। যেমন আগেকারদিনে হত। ভাইবোনদের পড়াশুনো দেখতে হবে। অনেক কষ্টে হায়ারসেকেন্ডারি পরীক্ষাটা দিলাম। ভাবলাম বাবা-মায়ের মন গলবে। আবারো পড়তে দেবে। কিন্তু নাহ্! পরীক্ষার পর থেকেই মা খুব অসুস্থ হয়ে বিছানায় শোয়া। তাও নাকি আমার দোষে। বাবা বলত প্রায়শঃই। মন ভেঙ্গে গিয়ে মা শয্যা নিয়েছে নাকি।  আর আমার দায়িত্ত্বে এই পুরো সংসার। দুটো ভাইবোনের ইস্কুল, পড়াশুনো, রান্নার মাসীর যোগাড়, ধোপা, নাপিত বাজারের হিসেব সবকিছু। ভাল রেজাল্ট করেও আর ভর্তি হওয়া হলনা কলেজে। আর সেইথেকেই এমনি আছে রে তোর প্রণতি পিসি।  


রূপা বলল

- হাউ স্যাড পিসি। জাষ্ট ভাবতে পারছিনা যে বাবা, মা কি করে এমন ক্রুয়েল হতে পারে। 

- আর কি হবে এসব ভেবে? রাখ তো।  

- আর সেই লোকটা? সে ই বা কি করে পারল এমন করতে? 

- কাপুরুষ একটা। ওকে একবার পেলে আমি বুঝিয়ে ছাড়তুম । লোকটা পালিয়ে বাঁচল। জানিস? সেদিন কেউ আমার পাশে দাঁড়ায় নি। এমন কি তোর বাবাও না। 

- এস্কেপিস্ট একজন। তোমার জীবনটা নষ্ট করল। রূপা বলে ওঠে। 

- নে, নে এবার বাদ দে ওসব কথা। এবার ছবি দেখা দিকিনি সেদেশের। তোর ঘর সংসার, ছেলে, বর সকলের। 

রূপা এবার তার হাতের সেলফোন খুলে নিজের শহরের ছবি দেখাতে শুরু করে দিল। সেদেশের ছবি কি সুন্দর। কোন্‌টা ছেড়ে কোন্‌টা দেখে? 

ওদেশের আকাশ বড্ড নীল রে। আর জলবায়ু কত ভাল বল্‌ তো! এখানকার মত এত গরম নেই। 

রূপা বলল, তুমি এবার আমার সঙ্গে চলে চলো প্লিজ। খুব আরামে থাকবে বাকী জীবনটা। 

এই মধ্য ষাটে নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাব? কি যে বলিস বাপু! 

তোমার নিজের দেশের পুরনো স্মৃতিগুলো কি খুব সুখের ? সেই বিশাল বাড়িও নেই। না আছে লোকজন। কিসের জন্য মায়া তোমার? 

প্রণতি চুপ করে থাকেন। সত্যিসত্যি তাঁর কোনোই পিছুটান নেই। কিন্তু এত বয়সে সেদেশের জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা কি মুখের কথা? কথায় বলে পর ভাতী হয়ো কিন্তু পর ঘরী হয়ো না। 


সেলফোনের ফোটো অ্যালবামের পাতা উল্টে যায় রূপা একে একে। দুজনের খুচরো, এলোমেলো সংলাপ চলতে থাকে। হঠাত একটি ছবিতে গিয়ে চোখ আটকে যায় প্রণতির। এ কি! এ ছবি কার? কোথায় পেলি তুই?  


রূপা বলে, কেন? তুমি চেনো নাকি এনাকে? আরে সেবার বঙ্গ সম্মেলনে আলাপ হল। মুম্বাই থেকে এসেছিলেন। ওখানে স্ক্রিন প্রেজেন্স ছিল ওনার। বাঙালী অভিনেতা বিমল দা। দারুণ দোস্তি হয়ে গেছে । আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড হয়ে গেছেন তারপর থেকে। উনি অ্যামেরিকায় আমাদের বাড়িতে এসে দুরাত ছিলেন। কি ভাল অভিনয় করেন গো পিসি। এখনো যোগাযোগ আছে। 


ঝটকা মেরে প্রণতি উঠে পড়েন বিছানা থেকে। আমি তোর সঙ্গে সেদেশে চলেই যাব রূপা। সেদেশেই গিয়ে থাকব তবে। চল তবে পাসপোর্ট, ভিসার সব ব্যবস্থা করে ফেলি। যদি সেই লোকটার সঙ্গে আরেকটি দেখা হয়! 

রূপা বলল কে? কার কথা বলছ তুমি?  

প্রণতি বললেন ঐ যে, সুবিমল থেকে এখন শুধু বিমল হয়েছে যে। মুম্বাই গিয়ে ভোল বদলেছে তার । এইবার এতদিন বাদে তার সঙ্গে বোঝাপড়াটা সেরে নেওয়া দরকার।     



৫ ফেব, ২০২১

ইমিউনিটি কারে কয়?

 

সেই যে লকডাউনে শেফ সঞ্জীব কাপুর লাখ কথার এক কথা কয়েছিলেন নাইন্ডিয়ান কিচেনে মশলার তাকটি হল ইমিউনিটি বুস্ট্যার এর জায়গা। খুব মনে ধরেছিল কথাগুলি। কথাগুলো কিয়দাংশে কিন্তু সত্যি প্রমাণিত হয়েছেও । তাইনাআমাদের ছেলেপুলেদের আমরা ছোটো থেকে অত হাত ধোয়াইওরা হামা দিতে শুরু করলেই খুঁটে খায়। তা সে আরশোলার পা হোক কিম্বা টিকটিকির গু। দু চারদিন নলিখলি যায় হেগে। তারপর ঠিক হয়ে যায় চিঁড়েকাঁচকলাআপেল সেদ্ধ খেয়ে। আমরা একটু বড় হলেই স্কুল কলেজে এক আকাশের নীচেখোলা হাওয়ায় হজমি,আলুকাবলিফুচকারোল খেয়ে অভ্যস্ত। এটা শুধু আমার রাজ্যেই নয়। আসমুদ্র হিমাচলেই এমন। তাই আমাদের এই HARD immunity কি HERD immunity তে গিয়ে ঠেকলএই অভিশাপ আজ আমাদের আশীর্বাদ। আমাদের ন্যাংটা খোকার শিঙনি ঝরা নাকথুতু মাড়িয়ে রাস্তা থেকে এসে জুতো না ধুয়েই গটমট করে ঘরে ঢুকে পড়াথুতু দিয়ে বড়বাজারের গদির ব্যাবসায়ীর নোট গোনা আর বাজারের চকচকে আপেল বা পেয়ারা না ধুয়েই নোংরা জিনসের প্যান্টে ডিউস বলের মত দুবার ঘষে নিয়ে কামড় দেওয়া... এসবের একটা মাহাত্ম্য আছে কি বল?

১ ফেব, ২০২১

"এবং রংপুর লাইম" পথের আলাপ পত্রিকার আয়োজনে সেরা দশে পুরস্কৃত গল্প

 



(১) 

নমস্কার! আমার নাম সুতনুকা রায়। আপনাদের নাম্বার পেলাম এক বন্ধুর কাছ থেকে । 

হাঁসের ডিম আছে তো এখনও? নাকি ফুরিয়ে গেছে? জানান তবে। 

আচ্ছা সোনারপুরে  ডেলিভারি করবেন? 


এতসব লিখেই খটখট নিজের ঠিকানা টাইপ করে ফেললেন। 

একতরফাই যেন বকে চলেছেন সুতনুকা। মনখারাপের মেঘ এক নিমেষে উড়িয়ে দেবার এ এক উপায় হল বেশ। কিন্তু ওদিকের প্রাপক কথা বলেনা কেন যে ? দুটো টিক নীল হয়ে গেল। 


অনেকক্ষণ হয়ে গেছে হোয়াটস্যাপের ওদিক থেকে কোনও উত্তর না আসায় সুতনুকা বিচলিত হলেন। মধ্যবয়সীর শরীর মনে খুব টানাপোড়েন। মায়ের সঙ্গে একা থাকেন। বাবার কেনা ফ্ল্যাট আর সঞ্চিত বেশ কিছু টাকাপয়সা আছে তাই এখনও দিব্য চলে যায়। সমস্যা একটাই। ঘরে কেউ নেই কথা বলার মত। অশীতিপর প্যারালিটিক মা দীর্ঘদিন বিছানায় শয্যাশায়ী। কথাবার্তাও জড়ানো। সুতনুকা কোভিডের লকডাউনে মায়ের দিনেরাতের কাজের লোকটিকেও কাছে পায়নি। সে রাতারাতি কানাঘুষো লকডাউনের কথা শুনেই পালিয়েছিল বাড়ি। ট্রেনে করে আসা যাওয়া করত। অগত্যা মা কেও দেখতেই হয়। ফেলে তো আর দেওয়া যায় না। একাই রাঁধে বাড়ে। ঘরের কাজ কোনোমতে সারে। টিভি দেখলে মন খারাপ লাগে। মনোবল কমে যায়। দু একজন আত্মীয় বন্ধু থাকলেও কোভিডের কালে কেউ আগ বাড়িয়ে কিছু জিগ্যেস করেনা সুতনুকা কে, এমনি স্বার্থপর মানুষ এখন। যদি রাতবিরেতে মায়ের জন্য তাদের কোনও দরকার পড়ে । তাই হয়ত। দিন দিন আত্মীয়, পরিজন সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে সুতনুকা একদিন খুব একা হয়ে পড়লেন এই মারণ কোভিডের রাজত্বকালে। এবছরটায় শুধু নিজেকে বাঁচতে হবে আর মা কে নিয়ে বন্দী হয়ে ঘরে থাকতে হবে। এ আর এমন কি? বন্দীই তো ছিলেন তিনি । তবে কোভিডের আগে কাজের মেয়েটা আসত যেত দিনে দু বার। বিকেলে সে চা করতে এসে। টিভি দেখতে দেখতে গল্পগাছা করত। এখন কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে সুতনুকার সেইসব ভাবলে। 


আবার টাইপ করলেন... 

আর কি কি আইটেম আছে আপনাদের? জানালে ভালো হয়। অবিশ্যি ডেলিভারি না করলে আলাদা কথা... 

অতঃপর উত্তর আসে ও প্রান্ত থেকে। সুতনুকা উৎফুল্ল হোয়াটস্যাপে "টাইপিং" দেখে।  

নমস্কার। আপনি কি ফেসবুকে আছেন ম্যাম? তাহলে আমাদের পেজটি লাইক করলে জানতে পারবেন। 


 না আমি ফেসবুকে নেই। "হাটেবাজারে" র  সুন্দরবনের ভালো হাঁসের ডিমের কথা জেনে মনে হল। 

আপনি আমায় এখানেই জানাতে পারেন কি কি জিনিষ আছে হাটেবাজারে তে । আপনাদের প্রডাক্ট রেঞ্জ জানলে আমার অর্ডার দিতে সুবিধা হয় একটু। 


ওদিকে হাটেবাজারে আবারো টাইপিং... 

আপনার কি লাগবে ম্যাম? চাল থেকে চালতা, ডাল থেকে ডালডা, আম থেকে আমড়া সব রাখি আমরা। 

বাহ! কি সুন্দর কথা বলেন আপনি! 

হাসির ইমোটিকন আসে ওপ্রান্ত থেকে। 

খুশি হন সুতনুকা। লিখে ফেলেন ঝপাঝপ... 

তার মানে দুধ থেকে দুধেরসর চাল, গাছপাঁঠা থেকে কচি পাঁঠা সব? 

ইয়েস ম্যাম। এভরিথিং । আপনার কি লাগবে শুধু বলুন। হাজার টাকার ওপরে ফ্রি হোম ডেলিভারি। প্রথম কাস্টমার হিসেবে আপনি অ্যাডিশানাল টেন পারসেন্ট ডিসকাউন্টও পাবেন। 

আরও খুশি সুতনুকা। তড়িঘড়ি বলেন 

সুন্দরবন থেকে সোনারপুর কাছেই হবে আপনাদের  

আবারো হাটেবাজারে টাইপিং ... 

আমরা দক্ষিণ থেকে উত্তর সর্বত্র ডেলিভারি করে থাকি ম্যাম। 

"বেশ"  

শব্দটা লেখার পরেই মায়ের গোঙানিতে সুতনুকার মেসেজিংয়ে ভাটা পড়ে। 

মায়ের ঘরে যেতেই সুতনুকার চোখে পড়ে মা অনেকক্ষণ বিছানা ভিজিয়ে পড়ে আছে তেমনি। বোধহয় শীত করছিল তাই চেঁচিয়ে মেয়েকে জানান দিয়েছেন। মা কে হাগিস পরিয়ে রাখেনা সে। এক হল তার দাম আর দুই মায়ের অ্যালারজি। খুব র‍্যাশ বেরুতো আগে আগে। তাই মা কে উঠিয়ে সে নিজেই বেড প্যান দেয় নিয়মিত। 

ওদিকে হাটেবাজারে তাদের প্রডাক্ট প্রোমোশানের খবরাখবর দিয়েই চলে... 

আমাদের সব প্রডাক্ট আমাদের নিজস্ব ফার্মের। কয়েকটা ফলের ছবি, মাছের ছবি। ম্যাম, ইফ ইউ আর ইন্টারেস্টেড প্লিজ ভিজিট আওয়ার ফার্ম ওয়েবসাইট। লিংক দিয়েই সে যাত্রায় কথোপকথনে ইতি টানে হাটেবাজারে। 

এসেই তাকে অফলাইন দেখে মন খারাপ হয় সুতনুকার। ডাউনলোড করে ছবিতে চোখ রাখেন। 

কাঁঠালিকলাও? কাগচি লেবু, ছড়া তেঁতুল, রংপুরের লেবুর ছবি দেখে মোহিত হন সুতনুকা। তার মানে লকডাউনে মামাবাড়ির সেই স্পেশ্যাল হাতঅম্বল অ্যাসিওরড। কি ভালো রাঁধত তাঁর মা। হাতায় করে তেলের মধ্যে সর্ষে লংকা ফোড়ন দিয়েই ঢেলে দিত তেঁতুলগোলা, নুন, মিষ্টি । লেবুর রস আর লেবুপাতা দিয়েই ফুটে উঠলে নামিয়ে ঢেলে দিত সুতনুকার  কাঁঠালিকলা চটকানো ঠাণ্ডা ভাতের মধ্যে।গরমকালে ইশকুল থেকে ফিরে এই হাত অম্বল খেতে খুব ভালো লাগত তাঁর। তাই কাঁঠালিকলা আর রংপুর লেবু একসঙ্গে দেখে চোখ চকচক করে উঠল সুতনুকার।  

হাটেবাজারের নিজস্ব ফার্মের ওয়েবসাইটের লিংকে ক্লিক করেই নিমেষের মধ্যে হাজির হলেন তিনি খোলা আকাশের নীচে । যেখানে রঙিন, ঝলমলে সব টাটকা আনাজপাতি, মুদিখানা, মাছমাংস, ডিমের পসরা থরেথরে সাজানো । 

মনের আনন্দে ওপারে  ছুঁড়ে দিলেন একগুচ্ছ প্রশ্ন  । 


পায়েসের গোবিন্দভোগ খুঁজে পেলাম না। আচ্ছা মুরগীর ডিম দিশী? তাহলে হাঁসের ডিমের সঙ্গে এটাও দবেন । মানে হাঁস, মুরগী মিলিয়ে ছ' টি করে মোট এক ডজন। 

ছড়া তেঁতুল দেখেই লোভ লাগছে। বাজারে তো পাইই না আর । ওটা দেবেন আড়াইশো গ্রাম। 

গন্ধরাজ লেবুর পাশে রংপুর লাইমস দেখলাম । কতদিন পর নাম শুনেই জিভে জল এল! বাংলাদেশের রংপুরের লেবু? আমার মামারবাড়ি জানেন? দু দুটো লেবুগাছও ছিল সেখানে। সব কেমন ছেড়ে আসতে হয়েছিল দাদুদের। নাম শুনেছি মায়ের মুখে । খুব টক অথচ ভীষণ রস ঐ লেবুর। বাইরেটা ঘন সবুজ, ভেতরটা মুসাম্বীর মত হলুদ। তাইতো ছবি দেখেই চিনতে পেরেছি। ওটার বড্ড দাম। তবুও দেবেন দুটো। বাপের বাড়ির লেবু শুনলে মা একটু খুশি হবেন। 


ওপ্রান্তে  কেউ আর তখন অনলাইন হয়না দেখে বিফল মনোরথ সুতনুকা মনের দুঃখে হোয়াটস্যাপের ঝাঁপি বন্ধ করে দেন। সেরাতের মত । 

ভোরে উঠেই দেখেন উত্তর এসেছে। 

আমাদের সব নিজস্ব ফার্মের প্রোডাক্ট ম্যাম। গোবিন্দভোগ চালের মত আমাদের নিজস্ব একটা সুগন্ধি চাল আছে। নাম গোপালভোগ। ওটা নিয়ে দেখুন। এক কেজি দিচ্ছি তবে। 

সুতনুকা ঝটিতি টাইপ করতে শুরু করে দেন... 

তাহলে মুরগীর ডিম, হাঁসের ডিম মিলিয়ে একডজন, পাঁচ কেজি দুধের সর চাল, এক কেজি গোপালভোগ। ও হ্যাঁ, সোনামুগ ডাল দেবেন এক কিলো। আড়াইশো তেঁতুল, দুটো গন্ধরাজ লেবু আর দুটো রংপুর লাইমস। মোট কত হয় জানাবেন। আমি কিন্তু ক্যাশে পেমেন্ট করব। আমার দ্বারা ওসব নতুন ডিজিটাল ওয়ালেট হবেনা।  

ফোন রেখেই এবার মনে হল কোভিডের যুগে খুচরো নেওয়া যাবে না। অতএব রাউন্ড ফিগারে দুহাজার টাকার মত জিনিষ নিতে হবে। তাই আবার ঢুকে দেখতে হবে সাইটে। 

কিন্তু ও প্রান্তে নীরব। কোনও উত্তর আসেনা। 

ধুস! সকাল সকাল অনেক কাজ। মায়ের কাজ, নিজের কাজ। রাঁধাবাড়া। টবের গাছ থেকে তুলসী পাতা তুলে এনে মধুর শিশি হাঁটকাতে গিয়ে দেখেন  তলানিতে ঠেকেছে। মনে পড়ে গেল। 

আচ্ছা ওদের মধুও তো দেখলাম মনে হল। সুন্দরবনের চাক ভাঙা খাঁটি মধু। তাহলে তো দু' হাজার হয়েই যাবে। এবার সোজা ফোন করেই ফেললেন তিনি। কেউ ধরল না ফোন। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল... 

স্যরি! দিস ইজ হোয়াটস্যাপ নং। শ্যাল কন্ট্যাক্ট ইউ সুন... 

কি যন্ত্রণা রে বাবা! আবার টাইপ করতে বসলেন সুতনুকা। এক কেজি মধু দেবেন। আচ্ছা এই মধু চিনির রসে ক্যারামেলাইজড নয় তো? তাহলে নেব না। 

খটখট উত্তর এল ওদিক থেকে। 

কি যে বলেন ম্যাম! সুন্দরবনের খাঁটি মধুর নাম সারা বিশ্বে। আমাদের মধু এক্সপোর্ট হয়। 

সুতনুকার মনে পড়ে, রংপুরের মামাবাড়ির লোকজনের মুখে সুন্দরবনের মধুর নাম শুনেছে। বাংলাদেশে সুন্দরবনের যে অংশটা ঢুকে আছে সেখানেও এই মধু পাওয়া যেত। 

আবার লিখলেন... 

দেখুন যা যা জিনিষ অর্ডার করলাম সব মিলিয়ে ২০০০ পুরো হয় যেন। আমি খুচরো নেব না কিন্তু। 

ওকে ম্যাম। শ্যাল রাউন্ড আপ উইথ লেবু কিম্বা তেঁতুল। 

(২) 

সেদিন মা মেয়ের চা-টোস্ট পর্ব শেষে ভাত রেঁধে বসে রইলেন সুতনুকা। এমন প্রায়ই হয় আজকাল তাঁর। কোনদিন ডালটা প্রেসারে সেদ্ধ করে গ্যাস নিভিয়ে দিয়ে টিভি খোলেন। কোনদিন আনাজপাতি কেটে নিয়ে হাঁফিয়ে মরেন। কোনদিন মিক্সারে পোস্তটা কাঁচালঙ্কা দিয়ে দুবার ঘুরিয়ে ক্ষান্ত দেন। ভাবেন আর কদ্দিন এভাবে? মায়ের জীবনটাও তেমনি। কোভিডও তেমনি। এই দুয়ের টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত হতে হতে আজ ক্লান্ত এই অবিবাহিতা। আর কদ্দিন নিজের জন্য রান্না করে চলবেন তিনি? মা তো নামমাত্র বেঁচে আছেন। তাঁর খাওয়াদাওয়া শুধু বাঁচার জন্য। তিনি কি খান, কেন খান তাও সবসময় বোঝেন না। সর্বগ্রাসী এক মনখারাপ ঘিরে ধরে কুয়াশার মতন। এসে দাঁড়ান মায়ের বিয়ের ড্রেসিং মিররের সামনে ।  পুবের রোদ এসে আছড়ে পড়েছে  পুরনো পলকাটা আয়নার কাচে । সুতনুকার সিঁথির পাশের আরও আরও চুলগুলিতে রঙ ধরে গেছে এই কোভিডের কালে। অর্থাৎ আরেকটু বয়স বেড়ে গেল বুঝি। আগে শখের নেল পালিশ লাগানো সব ঘুচে গেছে । বেরুনোর সময় লিপস্টিক, ম্যাচিং ব্লাউজ, শখের শাড়ি সব শিকেয় তোলা রইল। কিসের জন্য তবে এই বেঁচে থাকা? দিনের পর দিন। 

এখন আবার আরেকটা ভয় কুরেকুরে খায় তাঁকে। তাঁকে  যদি কোভিড ধরে? তিনি যদি মায়ের আগে চলে যান এই দুনিয়া থেকে? মায়ের কি হবে তবে? এর নাম ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশনের আরেক নাম মনখারাপ। কেউ যেন বলে ওঠে নেপথ্যে। 


একটা ফোন এসে সেই চিন্তায় ভাটা পড়ে তখনকার মত। অচেনা নম্বর। 

হাটেবাজারে থেকে বলছি। আপনার টোটাল বিল অ্যামাউন্ট ২০১০ টাকা। এক্সপেক্টেড ডেলিভারি টাইম, কাল সকাল ১০টা। 

কথাগুলো বলেই ফোন কেটে যায় না কেউ কেটে দেয় বুঝতে পারেন না । পরেই মনে হল ভয়েস মেসেজ ছিল সেটি। 

মানুষের সঙ্গে আর ইন্টারঅ্যাক্ট করা যাবেনা তবে? কি মারাত্মক অতি যান্ত্রিক হয়ে উঠল জীবন! তবে বাবা একটা কথা বলতেন বটে। "প্ল্যানেট  আর্থ ইজ সিক। অ্যান্ড দ্যা ডিজিজ ইজ ম্যান"  মানুষের থেকে দূরে থাকতে শেখ । ভালো থাকবি। 

সেদিন অনেক তর্ক হয়েছিল বাবার সঙ্গে।  কি যে বল তুমি! মানুষ কি জন্তু জানোয়ার? মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। 

বাবা বলেছিলেন পশুপাখিদের অতীত নেই, ভবিষ্যতের চিন্তা নেই। আছে কেবল বর্তমান। যত মানুষের সঙ্গে মিশবি তত বুঝবি। আনন্দ যেমন পাবি তেমনি ততটাই আঘাত পাবি, দুঃখ পাবি।

 

ভূপেনবাবুর বিখ্যাত গান "মানুষ মানুষের জন্যে" মিথ্যে তবে? সুতনুকা বলেছিল। 


আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধব সবার থেকে বাবা ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন একদিন। তখন ইন্টারনেট আসছে সবেমাত্র। সোশ্যাল মিডিয়াও ছিলনা। বাবা একা হয়ে পড়লেন অবসর নেওয়ার পরেই। প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে বয়স্ক ছেলেরা অনেকেই  এমন অবসাদগ্রস্ত  হয়ে পড়ছে আজকাল। এর নাম মেল মেনোপজ। কাগজে পড়েছেন তিনি। গুমরে গুমরে নিজের খোলসের মধ্যেই গুটিয়ে রাখতে রাখতে একদিন দুম করে বাবা চলে গেলেন। সুতনুকার তখন কলেজ জীবন। তারপর এম এ ক্লাসে ঢুকেই মায়ের স্ট্রোক হল। পড়া শেষ হল তারমাঝেই কিন্তু সুতনুকার জন্য জীবনের আর কিছু নতুন ইশারা রইল না। নাথিং টু লুক ফরোয়ার্ড। কেউ তার বিয়ের চেষ্টাও করেনি কোনোদিন । আর প্রেমে পড়তেও শেখেননি সুতনুকা। ঐ যে বাবার কথাই মাথায় গেঁথে ছিল বোধহয়। মানুষের থেকে দূরেই থেকে গেলেন তিনি। নতুন করে নিজের জীবনে বিপদ ডেকে আনার কোনও ইচ্ছেই মাথায় আর আসেনি।  

ফোন হাতে নিয়েই দেখতে পেলেন হোয়াটস্যাপে মেসেজ এসেছে আবারো। যে কথাগুলি তখন ফোনে শোনালো সেটাই আরও একবার। তিনি শুধু থ্যাংক্স জানালেন তখনকার মত। 

মনে মনে বলে উঠলেন, উফ! কি নিরুত্তাপ সারা দুনিয়া!

(৩) 

এভাবেই চলছিল বেশ। কাঁঠালি কলায়, থোড়-বড়ি-মোচায়।  দুধেরসর থেকে দুধকচু সবের মধ্যেও ঐ অচেনার সঙ্গে কথোপকথন সুতনুকাকে এক পশলা সুবাতাস দিয়ে যায়। গলার স্বর শুনে অভ্যস্ত ও প্রান্তের মানুষটিকে খুব দেখতে, জানতে ইচ্ছে করলেও উপায় নেই তার। আরও কথা বলারও ইচ্ছে থেকেই যায়। 

হঠাত একদিন গ্রসারী আইটেমের অর্ডার দিয়ে সুতনুকা ঝাঁঝের সঙ্গে লিখেই ফেলেন, এত এত জিনিষ কিনছি কিছু ফ্রি দেন না তো?  


সঙ্গেসঙ্গে ওদিক থেকে উত্তর আসে। 

আপনার কি চাই বলুন? নেক্ট টাইম ফর শিওর। 

সুতনুকা কি বলবেন ভেবে পান না। 

ওদিক থেকে আবারো প্রশ্ন আসে... 

বলবেন ম্যাম। কি দিতে পারি ফ্রি হিসেবে। 

সুতনুকা স্মাইলি পাঠান খুশি হয়ে

প্রত্যুত্তরে হাটেবাজারের করজোড়ে নমস্কারের ইমোজি ফুটে ওঠে স্ক্রিনে।  

থেমে যায় বার্তালাপ। 


(৪) 

ইলিশমাছ বড্ড দাম। তার চেয়ে চিংড়ি দিন। মাছের ডিম আছে? এইসব আদুরে খুচরো সংলাপে বানভাসি হয় সুতনুকার হোয়াটস্যাপ। তবে আগে যেমন বেশীটাই কেজো কথা হত এখন আরেকটু আবেগ মাখানো সেই সংলাপের ভাষা। হাটেবাজারের ভাষাতেও  বেশ আত্যিশ্যের ছোঁয়া।  

বিজনেস ডিল বাদ দিয়ে সুপ্রভাত, শুভরাত্রির সঙ্গে দিব্য জায়গা করে নিল সুন্দরবনের আমফানের ক্ষয়ক্ষতি । সুতনুকা একদিন লিখেই ফেললেন, 

আপনাদের ফার্মের ঘরবাড়ির কোনও ক্ষতি হয় নি তো? জানাবেন। যদি সাধ্যমত কিছু সাহায্য করতে পারি। 

ওদিক থেকে উত্তর আসে বিনয়ের সঙ্গে, 

সো নাইস অফ ইউ ম্যাম।

উদ্বেল হয়ে পড়েন সুতনুকা। 

এসব কথা ছাড়াও "কি টাটকা মাছ ছিল" অথবা "খুব মিষ্টি ছিল পেয়ারা” ...এসব শুনে  হাটেবাজারেও তাদের ব্যাবসায়ী  মনোবৃত্তি, নিক্তিতে ওজন মাপা ছেড়ে সুতনুকা ম্যামের জন্য স্পেশ্যাল ডিল দিতে শুরু করল অচিরেই। 

দু কিলো আলুর সঙ্গে কাঁচা হলুদ ফ্রি, এক কিলো সোনামুগ ডালের সঙ্গে একশো হলুদ গুঁড়ো ফ্রি আবার কোনদিন একডজন কলা দিল দশটার দামে। 

সুতনুকা ছেড়েই দিয়েছেন প্রায় পাড়ার দোকান থেকে বাজার আনা। এই বেশ ভালো ব্যাবস্থা। আজকাল প্রতিদিন ভোরে উঠেই তিনি হাটেবাজারের মেসেজ পান। নতুন কি ফল এল, কি শাক এল, কোন মাছ এল ... মন ভালো হয়ে যায় তাঁর। ইচ্ছে হয় সামনাসামনি মানুষটির সঙ্গে একটিবার আলাপ করার। 

(৪) 

ম্যাম ইউ উইল লাভ দিজ গুডি ব্যাগ ফর্ম আওয়ার ফার্ম! শ্যাল ডেলিভার ইউ টুডে। 

সুতনুকা হতবাক। কিছু তো অর্ডার করেন নি তবু কেন? হয়ত ভ্যালিউড ক্লায়েন্ট ভেবে কিছু দিচ্ছে। 

সেদিন গুডি ব্যাগ খুলতেই চোখে পড়ল রংপুর লাইমস, কাঁচা হলুদ, তুলসীপাতা, আদা, ছোট্ট মধুর শিশি আর গোলমরিচের প্যাকেট। বেশ অবাক হলেন খুলে। বেশ দামী সব জিনিষ। আর সঙ্গে একটা চিরকুটে লেখা "স্টে হেলদি, স্টে সেফ" 

হাটেবাজারে তার মানে তাদের ক্লায়েন্টের কোভিড কেয়ারের জন্য বেশ সচেতন। ফার্ম ফ্রেশ গুডিজ পাঠিয়েছে তাই। 

হোয়াটস্যাপ খুলে সুতনুকা লেখেন খুব ভালো লাগছে এইসময় এত কিছু দরকারি জিনিষ হাতে পেয়ে। নিশ্চয়ই পাঁচন বানিয়ে খাব। থ্রোট কেয়ার হবে আমাদের। মনে করার জন্য থ্যাংকস। বাই দ্যা ওয়ে জ্যান্ত কাতলার কি স্টেট্যাস? ল্যাজা মুড়ো বাদ দিয়ে সলিড মাছ দেবেন এবার এক কেজি । ঘাড়ের বা নীচের দিকের মাছ নেব না অ্যাজ ইউজ্যুয়াল। মা কে কাঁটা বেছে দিতে হয় আমার।  

ওপাশ থেকে উত্তর আসে জানি তো ম্যাম। তবে এবার আরেকটা সারপ্রাইজ দি? 

প্লিজ... 

ইয়োর ফেবারিট মালাবার স্পিনাচ ফাইনালি অ্যারাইভড। কাতলা মাছের সঙ্গে ওটা ফ্রি যাবে, সঙ্গে আড়াইশো হরিণা চিংড়ি ফ্রি। অসুবিধে নেই তো ? বাই দ্যা ওয়ে, একফালি কুমড়ো দেব কি তবে? উইকেন্ডে পুঁইশাক দিয়ে চিংড়ি চচ্চড়ি জমে যাবে ম্যাম। 

সুতনুকা ভাবেন, আমার আবার উইকেন্ড! আমি কি চাকরী করি ছাই? তবে কি করে জানলো ওরা? দিন কয়েক ধরে পুঁইশাকের জন্য বড্ড মনকেমন করছিল তার। মা ও খুব ভালো রাঁধতেন একসময়। 

হাটেবাজারের সঙ্গে কেনাকাটিতে মন ভালো করতে করতে একসময় ডিপ্রেশন একটু একটু করে মুক্তি দিয়েছিল সুতনুকা কে। ফেসবুকে ঢুকে নিজেই একটা অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেছিলেন তিনি। প্রোফাইলের ছবিও একই আছে মানে যেটি হোয়াটস্যাপে লাগানো। মানুষ কে হঠাত করেই ভালো লাগতে শুরু করেছে তাঁর। বাবা ভুল বলতেন। বাবার কপাল সেটা। খুঁজে পেয়েছেন  ইশকুল, কলেজ, ইউনিভারসিটির কয়েকজন বন্ধু বান্ধব কে। 

বেশ কাটছিল দিন। অসুস্থ মা ঘরে। তবুও অভ্যেসে সব সয়ে গেছে। কোভিড ও বশে আছে এখনও অবধি। 

হঠাত করেই একদিন রাতে মায়ের শ্বাস উঠল। পাশে শুয়েই টের পেলেন সুতনুকা। মায়ের নাড়ী ছেড়ে দিচ্ছে। ভোর রাতে মা চলে গেলেন। পাড়ার ছেলেদের খবর দিলেন। মা কে তারা নিয়ে গেল।  সুতনুকার গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল বেরিয়ে এল। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নতজানু হয়ে জানালেন ধন্যবাদ। মা কে মুক্তি দিলেন তিনি। কোভিডও ধরতে পারেনি তাই  মায়ের শেষ যাত্রায় তিনিই সঙ্গী হলেন। মুখাগ্নি করলেন। 


বাড়ি ফিরে দেখেন হাটেবাজারের ডেলিভারি পড়ে আছে তাঁর দরজার সামনে। একমধ্যে কিছু অর্ডার দিয়েছেন বলে  তো মনে পড়ছে না। তাহলে? 

প্যাকেট খুলে দেখতে পেলেন একটি চিরকুটে লেখা শোকবার্তা ..মে ইওর মাদার'স সোল বি অ্যাট পিস! ওম শান্তি! ফ্রম টিম  হাটেবাজারে। 

চিরকুটের সঙ্গে এসব আবার কি? হবিষ্যির আয়োজন? সুতনুকার জন্য? আতপ চাল, মটর ডাল, সৈন্ধব লবণ, ঘিয়ের শিশি আর কাঁচকলা। ওরা জানলো কি করে? তিনি তো এখনও মায়ের মৃত্যুর কথা বলেন নি ওদের সঙ্গে। 


কোভিডের যুগে সংক্রমণের "ট্রেস দ্য পাথ" এ অভ্যস্ত শিক্ষিত মানুষজন। হঠাত মাথায় এল তাঁর। মা চলে যাবার পরেই ভোর রাতে ফেসবুকে স্টেট্যাস দিয়েছিলেন বটে। বন্ধুদের জানাতে । হাটেবাজারেও সেখানে সুতনুকার প্রকৃত বন্ধু কিনা!  











 




১৫ নভে, ২০২০

ভাইফোঁটার পুরাণকথা এবং বিজ্ঞান / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

যম, সংযম, যমুনা, যমজ... আগে কখনো ভাবিনি এই শব্দগুলোর সঙ্গে ভাইফোঁটার কত গভীর সংযোগ। সূর্যপত্নী সংজ্ঞা সূর্যের সঙ্গে সহবাসকালে তাঁর পতির তেজোদৃপ্ত শরীরের ছটা, উত্তাপ, তেজময় বিকিরণ সহ্য করতে না পারায় চোখ বুঁজে র‌ইলেন। ক্রুদ্ধ সূর্যের সংজ্ঞার এহেন সংযম অপছন্দ হল। গালিগালাজ করলেন পত্নীকে! "কোথায় আমার মত পুরুষের সঙ্গে রতিলিপ্ত হয়ে শীত্কারে, আনন্দে চূড়ান্ত সম্ভোগময়ী হবে তা নয় চোখ বুঁজে রয়েছো! সংযম পালন হচ্ছে? ঠিক আছে, আমার ঔরসে তোমার গর্ভের সন্তান হবে আলোকবিহীন অর্থাত ঘোর আঁধারের মত কালো।' 

সাহিত্যের ধারাপাতে সংযোজিত হল নতুন শব্দ যার নাম সংযম। আর সূর্যের অভিশাপে সংজ্ঞার একজোড়া কালো পুত্রকন্যা জন্ম নিল যাদের নাম হল যম এবং যমী। ।  

সূর্যপত্নী সংজ্ঞা সূর্যের দাপট সহ্য করতে না পেরে পৃথিবীতে ফিরলেন । সেইসঙ্গে তার বিকল্প হিসেবে তার ছায়াকে রেখে এলেন সূর্যের কাছে, দেবলোকে।ব্যাস! সূর্য ছায়ার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হলেন। ছায়ার গর্ভে যখন সূর্যের সন্তান এল তখন সংজ্ঞার পুত্রকন্যা যম-যমীর সঙ্গে ছায়া বৈমাত্রেয় সুলভ ব্যবহার করতে থাকলেন । ছায়ার কুমন্ত্রণায় সূর্য নিজপুত্র যমকে নরকে এবং কন্যা যমীকে মর্ত্যে পাঠিয়ে দিলেন । 

সাহিত্যের অভিধানে একজোড়া সহজাত সন্তানের নাম একত্রে যমজ। সূর্যতনয়া, রবিনন্দিনী, সূর্যজা যমুনার অপর নাম কালিন্দী বা যমুনাও প্রবাহিত হল কালীয় নামক সর্পের বিষোদগারে কালো বর্ণের নদীরূপে । যম হলেন কালদন্ড হাতে নরকে মৃত্যুর দেবতা রূপে।  

বহুদিন অতিবাহিত হলে যম এবং যমী উভয়ে একে অপরের বিচ্ছেদে কাতর হলেন। যম দেখা করতে গেলেন যমীর সঙ্গে । আর সেদিনটি ছিল কালীপুজোর দু-দিন পর কার্তিক অমাবস্যার শুক্লাদ্বিতীয়া তিথি যা আজো ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা যমদ্বিতীয়া নামে খ্যাত। ভাইয়ের জন্য যমী নানাবিধ খাদ্যদ্রব্যের আয়োজন করে, উপহার সাজিয়ে নাকি বসেছিলেন তাই ঐদিনে বোনেরা ভাইদের জন্য এভাবেই পালন করে থাকে। কারণ একটাই। ভাইয়ের মঙ্গলকামনায়, ভাইয়ের পরমায়ু কামনায়।  

ঋগ্বেদ বলে যম আর যমী মায়ের শরীরের বাইরে এসেও নাকি মাতৃজঠরের একত্র অবস্থানকে ভুলতে পারেনা। তাই যমী যমকে কামনা করে বসেন। বলেন, আমাকে তোমার সন্তান দাও।  যম কিন্তু নিরুত্তর। প্রত্যাখ্যান করেন আপন সহোদরা যমীকে। 

অথর্ববেদে বলে যমুনা নাকি যমকে বলেছিলেন মায়ের পেটে তো তাঁরা একত্রে দশমাস পাশে শুয়ে ছিলেন অতএব এখনো তিনি সেভাবেই যমকে শয্যাসঙ্গিনী রূপে কামনা করেন কিন্তু যম বোনের মুখে এমনটি শুনে যেন তড়িতাহত হলেন। বলেন, জন্মসূত্রে এক পরিবারের হলে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করা গর্হিত কর্ম।   

যদিও প্রাকবৈদিক যুগে ভাই-বোন বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছে তাই যমীর এরূপ ধারণা অমূলক নয়।  কিন্তু যম সেই ধারণাকে এক্কেবারে আমল না দিয়ে চলে যান।  আজ আমাদের শরীরবিজ্ঞান বলছে ভাই-বোনে বিবাহ হওয়াটা সত্যি সত্যি যুক্তিযুক্ত নয় । ভারত সহ পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে এই বিবাহ চালু ছিল কিন্তু জিনগত সমস্যা এই বিবাহকে নিরাপদ করেনা অনেকাংশেই। সুস্থ মাতৃত্ব আসেনা। এলেও জিনগত ত্রুটি নিয়ে সন্তান আসে তাদের যা পরবর্তী জীবনে দুর্বিষহ। ভয়ানক সব রোগের স্বীকার হয় ভাইবোনের মিলনের ফলস্বরূপ সন্তানটি। সে যুগে এত বিজ্ঞান ছিলনা। ছিলনা হেমাটোলজির পরীক্ষানিরিক্ষা। মানুষ বুঝতনা জিনতত্ত্ব ও জৈবরহস্য। সেই বিয়ের ফলশ্রুতি মোটেই সুখকর হয়নি তাই বুঝি ধীরে ধীরে বিদায় নিয়েছে সহোদর-সহোদরার বিবাহ।  সেই প্রাচীন যুগে এক পরিবারের, একই পিতামাতার দুই পুত্রকন্যার বিবাহ হলে হয়ত নিজেদের রক্তের শুদ্ধতা বাঁচিয়ে রাখাটা হত একটি‌ই কারণে। পিতার সম্পত্তি যাতে নিজের পরিবারের মধ্যেই সযত্নে রক্ষিত হয়। কারণ বিবাহ নামক সামাজিক বন্ধন হল সম্পত্তি রক্ষার্থে উত্তরসুরীর উৎপাদন। 

কিন্তু রক্তের রসায়ন দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ । এ জটিল তত্ত্ব গবেষণায় উঠে এসেছে। রক্তের শুদ্ধতার পরিবর্তে রক্ত দূষণ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা জানিয়েছে বিজ্ঞান। কিন্তু এ তত্ত্ব জানতেন না যমরাজ। ডার‌উইনের থিয়োরি অফ ইভোলিউশানে  সারভাইভ্যাল অফ দ্যা ফিটেষ্ট বা যে সমর্থ সেই বাঁচবে সেই অনুসারে কালক্রমে ভাই-বোনের এই বিবাহে ভাটা পড়ে গেছে। পরে এসেছে আরো থিয়োরি। রক্তসূত্র ধরে যেমন এসেছে আমাদের বংশগোত্র। এখনো আধুনিক সমাজেও আমরা স্বগোত্রে তাই বিবাহ দিতে কেউ কেউ নারাজ হ‌ই।  আর তাই বুঝি যমীর ভাইকে বিবাহের আবেদন ও বোনকে বিবাহে যমের এই প্রত্যাখানের লোকায়ত কাহিনীটি প্রচার করে ধীরে ধীরে মর্যাদার আসনে বসানো হয়েছে ভাইফোঁটাকে আর সমাদর করা হয়েছে ভাইবোনের মধুর সম্পর্কটিকে।  

যা হয়েছে তা সমাজের ভালোর জন্যেই। যম-যমীর সুস্থতার জন্যেই। আর ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়েছে ভাইবোনের বিয়ে। তাই বুঝি যমী মনকে বুঝিয়ে বলে,  যমের অখন্ড পরমায়ু আশা করে। তাকে পেট পুরে তার মনের মত পদ রেঁধেবেড়ে খাওয়াও, তাকে উপহার দাও..শুধু এই বিয়ে থেকে শতহস্ত দূরে থাকো।  

কালের স্রোতে ধুয়েমুছে সাফ হল ভাইবোনের যৌনতার গন্ধ মাখা সম্পর্ক। আর ঠাঁই পেল স্বর্গীয় সুন্দর এক অমলিন, পবিত্র সম্পর্ক।  যম যমীর ফোঁটা নিয়ে পরম তৃপ্তি পেলেন। আর সমাজ স্বীকৃতি দিল  ভাই-ফোঁটা, ভাই-দুজ, ভাই-বীজ, ভাই-টীকা বা ভাই-তিলকের মত পবিত্র উত্সবকে।  

পুরাণ এই উত্সবের অন্য ব্যাখ্যা দেয়। কার্তিকমাসের শুক্লা দ্বিতীয়ার দিনে শ্রীকৃষ্ণ দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ নরকাসুর বধ করে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর বিজয়-সম্বর্ধনায় ভগিনী সুভদ্রা যে উত্সবের আয়োজন করেন তার নাম‌ই ভাইফোঁটা।  

*তাই আবহমান কাল ধরে বোনেরা ভাইদের মঙ্গল কামনা করে ফোঁটা দেয় ভাইয়ের শত পরমায়ু, উন্নতি কামনা করে।

কিন্তু কখনো কি শুনেছি আমরা এর উল্টোটা? অর্থাৎ ভাই তার বোনকে ফোঁটা দিয়ে বোনের সুস্থতা, সুরক্ষা এবং সার্বিক উন্নতি চাইছে? সকালে ধোপদুরস্ত হয়ে মাঞ্জা দিয়ে, ধুতির কোঁচা দুলিয়ে ভাইরা যুগে যুগে বলে এল, "ভাইফোঁটা নিতে যাচ্ছি"। কিন্তু "বোনফোঁটা দিতে যাচ্ছি" ও তো বলতে পারত তারা।

তাই এস আমরা চালু করি সামগ্রিক "ভাইবোনফোঁটা"। দু-তরফের পক্ষ থেকেই ফোঁটা চালু হোক!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ভাইফোঁটা...

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ভাইফোঁটা' অনুষ্ঠানের উষ্ণতা ও আন্তরিকতা খুবই পছন্দ করতেন। তিনি তাঁর ভগিনীদের কাছ থেকে ভাইফোঁটা নেবার সুযোগ থেকে কখনও বঞ্চিত হতে চাইতেন না। সৌদামিনী, শরৎকুমারী, সুকুমারী, স্বর্ণকুমারীর ও বর্ণকুমারী দেবীরা নানা সময়েই দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, সৌমেন্দ্রনাথ প্রমুখ দাদা-দের ভাইফোঁটার দিন ফোঁটা দিতেন এবং সেই পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন রবীন্দ্রনাথও।

স্বর্ণকুমারী দেবী রবীন্দ্রনাথ-কে খুবই স্নেহ করতেন এবং ভালোবাসতেন ও তাঁর আদরের ভাই-কে ফোঁটা দিয়েছেন। স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'গাথা' তাঁর আদরের ভাই 'রবি'কে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন -

"ছোট ভাই'টি আমার

যতনের গাঁথা হার কাহারে পড়াব আর?

স্নেহের রবিটি, তোরে আয়রে পড়াই,

যেন রে খেলার ভুলে ছিঁড়িয়া ফেল না খুলে,

দুরন্ত ভাইটি তুই, তাইতে ডরাই।"

কবি'র জীবনের শেষ ভাইফোঁটার আবেগঘন অনুষ্ঠানের অসাধারণ বর্ননা আছে রাণী চন্দ'র "গুরুদেব" বইটিতে।

"ভ্রাতৃদ্বিতীয়া এল। গুরুদেবের এক দিদিই জীবিত তখন - বর্ণকুমারী দেবী। তিনি এলেন আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিতে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আজও ভাসে ছবি চোখের সামনে - গৌরবরন একখানি শীর্ণহাতের শীর্ণতর আঙুলে চন্দন নিয়ে গুরুদেবের কপালে কাঁপতে কাঁপতে ফোঁটা কেটে দিলেন। দুজন দুপাশ হতে ধরে রেখেছি বর্ণকুমারী দেবীকে। ফোঁটা কেটে তিনি বসলেন বিছানার পাশে চেয়ারে। ভাইয়ের বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। খুব রাগ হয়েছে দিদির ভাইয়ের উপরে। কালিম্পঙে গিয়েই তো ভাই অসুস্থ হয়ে এলেন, নয়তো হতেন না - এই ভাব দিদির। ভাইকে বকলেন, বললেন, দেখো রবি, তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনো। বুঝলে?

গুরুদেব আমাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, বললেন, না, কক্ষনো আর ছুটে ছুটে যাব না; বসে বসে যাব এবার থেকে।

সকলের খিলখিল হাসিতে ঘর ভরে উঠল।"


মেয়েদের উপলক্ষ্য করে কোনো অনুষ্ঠানই নেই। একটি মাত্র অনুষ্ঠান সাধভক্ষণ তাও সে কোনো গৌরবের নয় সবাই জানি ।বেশ কয়েক বছর আগে তসলিমা নাসরিন তাঁর কোলকাতার বাড়িতে বোনফোঁটার অনুষ্ঠান শুরু করেন।গতবছর দেখলাম এই ফেসবুক পাতায় বেশ কয়েক জোড়া বোনের বোনাফোঁটার ছবি।বেশ লাগলো কিন্তু। মেয়েরা যদি এইভাবেই আরো কাছাকাছি এসে যায় পরস্পরের প্রতি আরো সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে।

যাইহোক আমাদের সিস্টারহুড জারি থাকুক।সব বোনেদের পক্ষ থেকে আমার পরম বন্ধু কবি তৃষ্ণা বসাক এর বোনফোঁটা মন্ত্রটি পড়ছি 

বোনফোঁটার মন্ত্র 

তৃষ্ণা বসাক 


(অমৃত আর গরল মথিয়া 

এসে গেছে আজ ভগিনীদ্বিতীয়া)


নতুন যুগের নতুন সুর।

বোন না যেও দূর।।

বোনের কপালে দিলাম ফোঁটা ।

ভায়েরা প্লিজ দিও না খোঁটা।।

যমুনাকেও দিলাম ফোঁটা ।

যম দেখে ভয়ে কাঁটা! 

তুমি আমার  বোন হয়ো।

বছর বছর ফোঁটা নিও।।

২৪ আগ, ২০২০

রসনাপুরাণ

 

রসনাপুরাণ / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় ( লেখাটি প্রকাশিত গুরুচণ্ডালী ই-ম্যাগাজিনে) 

আমার মায়ের বাবা এবং বাবার মা দুজনেরি জন্ম বাংলাদেশের খুলনা জেলার সাতক্ষীরায় তবে কর্ম কোলকাতায় । তাই এহেন "আমি"র  সেই অর্থে শিরা উপশিরায় বাঙাল ও ঘটি উভয় শোণিত স্রোত বহমান । অন্তত: আমার শ্বশুরালায়ের মন্তব্য তাই ।


উপাদেয় পোস্তর বড়ার স্বাদ পেতে আমাকে ছুটতে হয় বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বন্ধুর বাড়িতে । আর নারকোল-বড়ি দেওয়া মিষ্টি মোচার ঘন্ট খাবার জন্যে আমাকেই ছুটতে হয় রান্নাঘরে । আমাদের ঘটি বাড়ির হেঁশেলের বেশির ভাগ রান্নাবান্নাই শর্করায় পুষ্ট । কুটিঘাটের মেয়ে আমার দিদিমা ছিলেন খাস ঘটিবাড়ির মেয়ে । বিয়ের পরদিন বাঙাল শ্বশুরবাড়ির রান্নায় চিনি ছড়িয়ে খেয়েছিলেন । 


সেইকারণেই  বুঝি আমার ঠাকুরদাদার মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনেছি । সব ক্রিয়াপদে এলুম, গেলুম, খেলুম শুনে বন্ধুরা হেসে বলত এই এল হালুম হুলুম করতে । কি আর করি ! জন্ম-দোষ যে! তাই বুঝি আমি মিসডি কথাও বলতি পারি আবার আট ডেসিবেল ক্রস ক‌ইরা ঝগড়া করতিও পারি । আমাদের সব রান্নায় যেমন মিষ্টি, তেমনি ঝাল। অভিনব এক কেমিস্ট্রি হয়েছে জানেন?  ইলিশ আর চিংড়ি দুইয়ের সঙ্গতে  আমার রসনা পুরাণ জমে গেছে । আমি যেমন রাঁধতি পারি ঝরঝরে ভাত তেমন ভাজতি পারি ফুলকো ফুলকো নুচি। তবে ঘটির ওপর আমি পক্ষপাতদুষ্ট । কারণ ঐ শোণিত স্রোতের সংকরায়ন ।  


ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি খুলনা হল পশ্চিম আর পূর্ববাংলার সীমানার কাছে অতএব আমরা বাঙাল ন‌ই। আরে বাবা তাতে আমারই বা কি আপনারই বা কি! আমি বাঙালী ঘরে জন্মেছি সেটাই আমার কাছে বড় কথা। রবিঠাকুর, নজরুল, মাছের ঝোলভাত, কড়াইয়ের ডাল-আলুপোস্ত আমার শয়নে-স্বপনে-জাগরণে।  আমি বাঙালী বলেইতো বাংলাভাষা আমার সহজাত  আর বাংলার শিল্প-কলা-কৃষ্টি আমার রোমকূপের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সিঁধিয়ে আছে। কি ঠিক বলছি তো না কি? 


আমার একরত্তি একাদশী দিদিমা, ঘটিবাড়ির মেয়ের বাঙাল ঘরে বিয়ে হয়ে আসাটা যেন তার জীবনের ভোল পাল্টে দিয়েছিল রাতারাতি। ঐটুকুনি মেয়ে বিয়ের কি বোঝে! সে আবিষ্কার করতে শুরু করেছিল গ্রাম্য পরিবেশের মাধুর্য্য। গাছের ফলপাকড়, টাটকা শাকসব্জী, নদী-পুকুর থেকে মাছ ধরে আনা সেই বিবাহিতা কিশোরীর কাছে যেন বিস্ময় তখন। শহর বরানগর তখন অনেকটাই আটপৌরে গেঁয়োপনা ছেড়ে সবেমাত্র শহুরে হতে শিখেছে। কাজেই প্রকৃতি, সবুজের মাঝে অবাধ বিচরণ সেই কিশোরীর জীবনে অধরা ছিল । শ্বশুরবাড়িতে সকাল হতেই ঘি অথবা কাঁচা সরষের তেল ছড়িয়ে আতপ চালের ফেনাভাত খাওয়া তার কাছে অপার আনন্দ বয়ে আনত। বরানগরে তিনি শিখেছিলেন সকালের প্রাতরাশ হিসেবে পাঁউরুটি-মাখন খাওয়া অথবা লুচি-পরোটা কিম্বা রুটি তরকারী । বাংলাদেশে এসে সেই ফেনাভাত তার কাছে অবাক করা এক ব্রেকফাস্ট সেই মুহূর্তে। দুপুর হলেই পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা ছিল তার কাছে এক আশ্চর্য্যের বিষয়। 


ননদীনিরা গরম গরম জ্যান্ত ট্যাংরা মাছভাজা আর তেল দিয়ে একথালা ভাত  নতুন বৌকে বসিয়ে আদর করে খেতে দিয়েছিলেন জলখাবারে। দিদার মুখে কতবার শুনেছি এ কথা। নদীর টাটকা মাছ আর অমন যত্ন দিদার মাও বুঝি করেনি তাকে..তিনি বলতেন।


এইভাবে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার সারটুকুনি আর উভয় পরিবারের আত্মীয়তায় গড়ে ওঠে আমাদের পরিবার। আমরা এর মধ্যে দিয়েই বড় হলাম, শিখলাম আর এখনো ভাবতে থাকলাম....পূর্ববাংলায় সেই আমাদের মরাই ভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছের কথা। দুইবাংলার সংস্কৃতি তখন মিলেমিশে একাকার । জমে গেল ঘটি-বাঙালের রসনা, হেঁশেল বেত্তান্ত ।  আর এহেন ক্ষুদ্র আমি মেলবন্ধন ঘটালাম এপার বাংলা ও ওপার বাংলার সেরা রসনার ।  


বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে বন্ধুরা সকলে ভাত খেত আর আমরা খেতাম লুচি-পরোটা বা রুটি কিন্তু দুবেলা ভাত নৈব নৈব চ ! কি আর করে বন্ধুরা! ওদের মা ময়দার কাজে মোটেও পটু নন, ভাতের রকমারিতে পটু তাই ঘটির বৈকালিক জলযোগের ময়দা বুঝি ওদের কাছে অধরা । 


ওদের সেই চিতলামাছের মুইঠ্যা একবগ্গা মাছের এক্সোটিক ডিশ ফর গ্যাস্ট্রোনমিক তৃপ্তি । আর কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা দিয়া সেই বাদলা দিনের কাদলা মাছের পাদলা ঝোল না খেলে হয় না। আমাদের তার চেয়ে কাতলার কালিয়া, ক্রোকে, দৈ-মাছ, কোর্মা, মাছের পোলাও, মাছের কচুরী, চপ আরো কত বলব ! ঘটি হেঁশেলে শুঁটকি ফুটকির নো এন্ট্রি ! একবার বাঙাল-ঘটির কাজিয়ায় আমার ঠাকুর্দা তার এক বাঙাল বন্ধুকে বলেছিলেন "কচুরী আর রাধাবল্লভীতে যে বিস্তর ফারাক সেটাই জানোনা? আর কি করেই বা জানবে "ময়দার" ব্যাপারে  তোমাদের তো হাঁটুতে খঞ্জনী বাজে। চাড্ডি ভাত চাপিয়েই খালাস তোমরা । জমিয়ে মিষ্টি মিষ্টি নাউ-চিংড়ি খাও । দেখবে মনের কাদা সাদা হয়ে গেছে । এট্টু চিনি ছড়িয়ে কড়াইয়ের ডাল আর ঝিঙেপোস্ত খাও । দিল খুশ হয়ে যাবে । মিষ্টি কথা কি এমনি কৈতে পারি? মিষ্টি মিষ্টি ব্যবহার কি এমনি পারি! সবের মূলে ঐ ঘেটো মিষ্টি" 


বাজার গেছি একবার জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে । সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছি তখন । পুলিশে কর্মরত জ্যাঠামশাই তাঁর চাঁচাছোলা ভাষায় গঙ্গার ঘাটে তাঁর এক পুরোণো সহপাঠীকে বলছেন :

"তোমরা হলে গিয়ে, ইশে "অরিজিনাল দেশি" তাই বলে আমরা অ্যাবরিজিনাল দেশি ন‌ই গো দাদা ! এট্টু ঘুসোচিংড়ির বড়া খেয়ে দ্যাখেন মশাই ! অথবা কষে চিনি দিয়ে ছোলারডাল আর ঐ আপনাগো "ময়দা" মানে আমাগো "নুচি" । চিল্লোতে পারিনা আমরা, আট ডেসিবেল কি সাধে ক্রস করিনা? ভেতরটা সত্যিসত্যি মিষ্টি হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে"


এভাবেই আমি এলুম, দেখলুম, ছিলুম বলে । আমের সময় মিষ্টি আঁব খেলুম, হ্যান্ডলুম পরলুম ! নাউচিংড়ি রাঁধলুম নঙ্কা দিয়ে। সাদা ময়দার ফুলকো নুচি ভাজলুম ছোট্ট ছোট্ট। ডালের সঙ্গে নেবু ডললুম। এতে নজ্জার কিছু নেই । ঘটি রান্নার সোশ্যাইটি জুড়ে, হেঁশেলের ঝুলকালিতে শুধু একটাই কথা । রান্নায় মিষ্টি। জলখাবারে ময়দা আর রাতে রুটি। 


আমাদের ঘটিবাড়িতে জন্মেস্তক দেখছি চিংড়ির অবাধ ও অনায়াস গতায়ত। বারোমেসে বাজারের ফর্দে মহার্ঘ গলদা নয় তবে লবস্টারের বাবালোগ অর্থাত ঘুসো/কাদা/ফুল চিংড়ি থেকে কুচো কিম্বা ধানক্ষেতের জ্যান্ত চাবড়া চিংড়ি থাকবেই।  


চিংড়ি আর কাঁকড়া মাছ নয় বলে আর সম্পূর্ণ অন্যজাতের সজীব বলে বুঝি ওদের এত স্বাদ। আঁশটে ব্যাপরটা নেই। আছে এক অন্য রসায়ন। 


বাড়িতে কাউকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো মানেই চিংড়ি মালাইকারি যেন অন্যতম প্রধান পদ ঘটিবাড়িতে। 


আজকাল হোটেলে ডাবচিংড়ি নামে একটি মাগ্যির ডিশ সার্ভ করা হয়। এমনকিছু আহামরি নয়, শুধু দামে গালভারী। দেখনদারির পণ্য। অথচ আজ থেকে একশো বর্ষ আগে আমার মামারবাড়িতে এই রান্না হত ডাব দিয়ে নয়। নারকোলের শাঁসসুদ্ধ দুটি মালার মধ্যে বাগদাচিংড়ি সর্ষে-পোস্ত-কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে মেখে, কাঁচা সর্ষের তেল, হলুদ, লঙ্কা, নুন দিয়ে নারকোলের মালায় রেখে এবার নারকোলটিকে বন্ধ করে সেই ফাটা অংশে ময়দার পুলটিশ লাগিয়ে মরা উনুনের আঁচে ঐ নারকোলটি রেখে দেওয়া হত ছাইয়ের ভেতরে । ঘন্টা দুই পরে তাক লাগানো স্বাদ ও গন্ধে ভরপুর ভাপা চিংড়ি নাকি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসত নারকোলের শাঁসের সঙ্গে। চিংড়ির মালাইকারীও এভাবে রাঁধা হয়েছে বহুবার। সেখানে সর্ষের বদলে পিঁয়াজ, আদা-রসুন গরমমশলা বাটা আর তেলের বদলে ঘি দেওয়া হত। 


চিংড়ি মাছের কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় আমার এক রগুড়ে মামার কথা। ওনাদের সময় কত্ত বড় চিংড়ি খেয়েছিলেন তা বোঝানোর জন্য উনি একবার বলেছিলেন "জানিস? এ আর কি চিংড়ি? আমাদের সময়ে যে চিংড়ি খেয়েছি তার খোলাগুলো ডাস্টবিনে পড়ে থাকলে তার মধ্যে দিয়ে কুকুরের বাচ্ছা ঢুকতো আর বেরুত।"     


পুঁইশাক বাদ দিলে আমাদের মোচা, লাউ, ওলকপি, ওল, ফুলকপি, ডুমুর, প্যাঁজকলি সবের অন্যতম অনুপান হল চিংড়ি। চিংড়ি ছাড়া এসব সবজী রাধুমই  না। আবার পটল-আলু পোস্ত চচ্চড়ি তে আমার ঠাম্মা চিংড়ি দেবেন ই।  দিদিমার সিগনেচার ডিশ ছিল চিংড়ির বাটি চচ্চড়ি। দাদু তো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রায় বলেই ফেলেছিলেন  "এই বাটি চচ্চড়ি পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাব" । না এটা আমি বললাম। উনি বলতেন, "থাক, এটা আর খাব না। মাথার বালিশের পাশে নিয়ে শোব। খেলেই ফুরিয়ে যাবে।" 


তবে চিংড়ির পাশাপাশি ইলিশ‌ও তাই বলে ঘটিবাড়িতে ব্রাত্য এমন নয়। বাবার মুখে শুনেছি আড়িয়াদহের গঙ্গায় নামতেন তেল মেখে। কোমরের গামছায় চার আনা পয়সা বেঁধে। সাঁতরে ওপার থেকে ফেরার পথে মাঝিদের ধরা  ইলিশ কিনে নৌকোয় চড়ে বাড়ি ফিরেই মা'কে ভাত বসাতে বলতেন। তবে ঘটিবাড়িতে ইলিশ মানে বাঙালদের কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা বা বেগুণ দিয়ে পাতলা ঝাল নয় । ভাতের মধ্যে কৌটোবন্দী ভাপা অথবা সর্ষে ইলিশ। কৌটোর মধ্যেই নুন মাখানো ইলিশের গাদা-পেটি সর্ষে, কাঁচালঙ্কা বাটা, কাঁচা সর্ষের তেল আর বেশ কয়েকটি চেরা কাঁচালঙ্কার সাথে জারিয়ে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে মিনিট দুয়েক রেখে দিলেই এই অমূল্য পদ তৈরী।  আমার রন্ধন পটিয়সী দিদিমা তার বিশাল সংসারে বিরাট এক হাঁড়ির মুখে বিশাল এক কচুপাতার মধ্যে মাছগুলিকে ম্যারিনেট করে পাতাটি সুতো দিয়ে বেঁধে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে রাখতেন। মা বলত, সে ভাপা ইলিশের নাকি অন্য স্বাদ। আমি একটু ইম্প্রোভাইজ করে এই কায়দাটি করি লাউপাতায় মুড়ে এবং ননস্টিক প্যানে অর্থাত পাতুড়ির স্টাইলে। যাই করো এ কানুর তুলনা নেই। কাঁচা তেলঝাল, ভেজে ফোড়ন দিয়ে ঝাল, গায়ে মাখামাখা হলুদ সর্ষেবাটার ঝাল, বেগুন দিয়ে বাঙালদেশের পাতলা ঝোল...সব‌ই যেন বর্ষায় দৌড়তে থাকে গরম ভাতের সঙ্গে।


আবার ইলিশের মুড়ো দিয়ে পুঁইশাক, কুমড়ো, মূলো, আলু দিয়ে অমৃতসম ছ্যাঁচড়া। এই ছ্যাঁচড়াতে পাঁচফোড়ন, কাঁচালঙ্কা আর নামানোর সময় সর্ষেবাটা। কড়াইয়ের গায়ে লাগা লাগা হয়ে রান্নাঘরময় পোড়া পোড়া গন্ধ বেরুবে তবেই সার্থক সে ছ্যাঁচড়া। দাদু মায়েদের নিয়ে পিওরসিল্ক কিনতে গিয়ে বলতেন শাড়ির কোল আঁচল থেকে একটি সুতো বের করে দেশলাই কাঠিতে ধরে যদি ছ্যাঁচড়াপোড়া গন্ধ বেরোয় তবেই সেটা আসল রেশম। এখন বুঝি তার অর্থ।  মেছো গন্ধে ভরপুর ছ্যাঁচড়া কাঁটা-অপ্রেমীদের কাছে যত‌ই কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর মত বস্তু হোক মাছের মাথা মিশে তা প্রোটিনে ভরপুর এক রসায়ন। তাই বুঝি পিওরসিল্কে সেই প্রোটিন পোড়া গন্ধটাই প্রকট। 


তবে দুই বাংলার পুণ্য তিথিতে শাক-সুক্তোয় শুরুয়াত হলে মন্দ হয় না মধ্যাহ্নভোজন। শুভদিনে ডালের সঙ্গে পাঁচ ভাজাও আবশ্যিক। দুই বাংলার ফোড়ন বিনে রান্না অচল। দুই বাংলাতেই  মূলো বিনে কিম্বা ঘি ছাড়া শুক্তো নৈব নৈব চ। 


আর দুই বাংলাতেই 


" বৃষ্টি মানেই পিটারপ্যাটার বৃষ্টি মানে টুপটাপ

বৃষ্টি মানেই মায়ের হাতে ভুনি খিচুড়ির উত্তাপ।" 


 


গোবিন্দভোগ চাল আর শুকনোখোলায় ভেজে রাখা সোনামুখ ডাল মেপে ধুয়ে ভিজিয়ে ডুমো ডুমো ফুলকপি, কুচোনো গাজর, বিনস আর ফ্রোজেন মটরশুঁটি দিয়ে আদা, ট্যোম্যাটো কুচি কষিয়ে খিচুড়ির রেসিপি কিন্তু এক মোটামুটি। জিরে আর ধনের গুঁড়োর সঙ্গে সামান্য লাল লঙ্কার গুঁড়ো। সামান্য ঘিয়ে তেজপাতা, জিরে আর গোটা গরমমশলার ফোড়ন। চড়বড়িয়ে উঠলেই আদা-মশলার পেষ্ট। সবশেষে চালডাল দিয়ে নাড়াচাড়া, ওলটপালট। এবার সব্জী দিয়ে মেপে জল। ঢাকা খুলে নেড়েচেড়ে নুন্, মিষ্টি, হলুদ ছেটানো। পরিবেশনের আগে ঘি ছড়িয়ে গরমমশলা গুঁড়ো।তবে বাঙ্গালদের এই খিচুড়িকে জব্দ করেই লাবড়ার তুমুল যোগাড়।আমরাও শিখে গেছি । ঘটিদের পাঁচমেশালি চচ্চড়ির মত। ঘটির ছ্যাঁচড়া আর বাঙালের লাবড়া কে কার অপভ্রংশ তা জানা নেই। খিচুড়ির সঙ্গে লাবড়া অথবা ছ্যাঁচড়া কে কার অলংকার!  


ঘটি বাঙাল উভয় হেঁশেলের গ্রীষ্ম-বর্ষার অগতির গতি ছেঁচকি রান্নার চল খুব। চাইনিজদের স্টার ফ্রাই আমাদের অল্প তেলে ফোড়ন দিয়ে ঢাকাচাপা দিয়ে ঝিরিঝিরি করে কাটা সবজী কে ন্যায়দম খাওয়ানোর নাম ছেঁচকি। আলু, পটল, ফুলকপিই হোক কিম্বা কুঁদরী অথবা ঢেঁড়শ। হাতের কায়দায়, গ্যাসের ঢিমে আঁচে সব সবজীর আস্ফালন নিমেষেই ফুরোয়। তাপের চাপে সব্বাই জব্দ হয়ে কেঁচোর মত গুটিয়ে যায়। আর যত গুটোবে তত স্বাদ হবে সেই ছেঁচকির। বাঙালীর আদি অকৃত্রিম কালোজিরে মেথি, শুকনোলংকা বা কাঁচালঙ্কা অথবা পাঁচফোড়ন, রান্নাঘরের সব্বোঘটে কাঁঠালিকলা। 


ছেঁচকির কথায় মনে পড়ে আমার যশুরে জেঠিমা শাশুড়ির লাউয়ের খোসার ছেঁচকির কথা। আগেকার গিন্নীদের সব রান্নার শেষে উনুনের ঢিমে আঁচে বসানো হত এই ছেঁচকি। আমরা এখন গ্যাস সিম করে বানাই। তবে উনুনের নিবু নিবু মরা আঁচে সেই ছেঁচকি বসিয়ে জ্যেঠিমার নাইতে যাওয়া আর ফিরে এসে বারেবারে নেড়েচেড়ে তাকে ন্যায়দম খাওয়ানো...আর তাতেই বুঝি ছেঁচকির স্বাদ বেড়ে যাওয়া। সরু সরু করে কাটা লাউয়ের খোসা ধুয়ে নিয়ে হালকা ভাপিয়ে রাখতে হবে। প্রেসারে নয় কিন্তু। তারপর কড়ায় সামান্য সর্ষের তেলে কালোজিরে, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে সেই খোসা সেদ্ধ দিয়ে নুন দিয়ে চাপা দিতে হবে। তারপর নাড়া আর চাড়া। যতক্ষণ না লাউয়ের খোসা স্প্রিং এর মত গুটিয়ে যায়। তখন সামান্য চিনি, পোস্তদানা। লঙ্কা গুঁড়ো, অল্প আটা আর বেসন আলগোছে ছড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ স্টারফ্রাই। দরকারে একটু তেল ছড়ানো যেতে পারে। শুকনো ভাতে গরম গরম এই খোসার ছেঁচকির বিকল্প নেই। আমাদের সব শাকভাজাই এমন। জল পড়বেনা মোটেও। তেলের মধ্যে ফোড়ন আর শাক দিয়ে জব্দ করা হবে। নেতিয়ে পড়বে লকলকে টাটকা সবুজ শাক। শুকনো ভাতে অমৃত। একেক রকমের স্বাদ একেক শাকের। 


ছেঁচকি ছাড়া বাঙালীর আরেক অগতির গতি মাগো তুমি পোস্তবাটা। এই কাঁচা পোস্তবাটার যেমন গুণ তেমনি তা দিয়ে একথালা ভাত উড়িয়ে দেওয়া যায়। সঙ্গে যদি থাকে কাঁচা সর্ষের তেল, পিঁয়াজ কুচি আর কাঁচালঙ্কার ছোঁয়া। আর রেঁধে নিয়ে আলুপোস্ত, ঝিঙেপোস্ত কিম্বা পটল পোস্ত, আর পোস্তর বড়া বানিয়ে খেতে পারলে কথাই নেই। গরমের দিনে নরম মেনু। পোস্ত বাটার সঙ্গে লাউশাকের ডগা সেদ্ধ অথবা গোটা পটল সেদ্ধ দিব্য যায়। তবে সঙ্গত হিসেবে কাঁচা সরষের তেল, নুন আর লংকা মাস্ট।


এমনি আরেক গ্রাম্য খাবার হল শীতের রাঙা মূলো, ওল বা কচু ভাতে। এই দুইয়ের সঙ্গে কাঁচা লংকা দিয়ে সরষে বাট, সরষের তেল আর নারকোল কোরার কেমিস্ট্রি অনবদ্য জমে। তবে বাঙাল বাড়ির কচুবাটা দারুণ খেতে। 


আমি ছোটবেলায় খুব রোগা ছিলাম আর আমিষের বড় একটা ভক্ত ছিলাম না মোটেও। তাই বাবা প্রায়ই বলতেন  


মাংসে বাড়ে মাস

ঘৃতে বাড়ে বল,

দুধে শুক্র বাড়ে

শাকে বৃদ্ধি মল। 


আবার বাড়িতে কারোর সর্দিকাশি হলেই বাবা ব্যাগ দুলিয়ে চলতেন মাংসের দোকানে। তখন মাংস বলতে আমরা খাসির মাংস‌ই বুঝতাম। মুরগী ঢুকত না ঠাম্মার জন্য। বলতেন একটু মাংসের ঝোল ভাত খা। সব সর্দ্দি সেরে যাবে। আমার ঠাকুরদা নাকি বাবাদের ছোটবেলায় বলতেন  


"নস্য মাংস উপবাস তিনটিতে করে শ্লেষ্মা নাশ" 


আর পরে যখন মাংস খেতে ইচ্ছে করত, বাবা দোহাই দিতেন রেডমিটের ওপর জারি নিষেধাজ্ঞা, কোলেস্টেরলের কচকচানি এইসব আর মা আমার পক্ষ নিয়ে বলতেন, 


"জমিদারের দাঁত পড়ল, পাঁঠা বলি বন্ধ হল"  


আর জামাইষষ্ঠীতে সেই প্রবাদটি "জামাইয়ের জন্য মারি হাঁস গুষ্টি শুদ্ধ খায় মাস” ?


কোথায় লাগে মশাই হাঁস, মুরগী, কচ্ছপ, কোয়েল ?


খাসি‌ই বলুন আর পাঁঠাই বলুন এ কানুর তুলনা নাই। অবিশ্যি ভাগাড় কাণ্ডের পর সে খাসিও নেই আর নেই সেই পাঁঠাও। রেডমিট হারিয়েছে তার কৌলীন্য। তবুও খুঁজে পেতে বাজারে গিয়ে কাটিয়ে এনে খেলেই বুঝি সার্থক মাংস মঙ্গল।   


জানেন তো ? কালীঘাটের বলিপ্রদত্ত পাঁঠার মাংসে পিঁয়াজ রসুন পড়েনা। জিরেবাটা, হিং, আদা আর গরমমশলা দিয়েই তৈরী হয় সুপক্ক উৎকৃষ্ট মাংস। তবে আমরা বাড়িতে সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একধরণেরই মাংসের ঝোলে অভ্যস্ত। হয় মায়ের হাতের গরগরে লাল মাংস কিম্বা নিজের ব্যস্ততায় সাদামাটা স্ট্যু। আবার রবিবারের রাতের মাংসে সকাল থেকে টক দৈ, পেঁপে কুরোনো আর সব মশলা মাখিয়ে দমে বসানো রেওয়াজি খাসির কষা মাংসের আরেক স্বাদ। আর এখন কেটারারের দেখাদেখি মাটন রেজালা বাঙালী বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।অথবা খুব খাটতে পারলে হরা মাটন মনোহরা। মানে সবুজ মাংস। কষে ধনেপাতা, পালংশাক বাটা দিয়ে মাটন।


তবে মাটন রান্নার মদ্যা কথাটা হল ঠান্ডা জল নৈব নৈব চ। এটা জেনেছিলাম অবিশ্যি আদর্শ হিন্দু হোটেলে। আর আমার মায়ের একটা ভাল টিপ্‌স হল


"মাছ ধুলে মিঠে, মাংস ধুলে রিঠে"


তাই বাজার থেকে কিনে এনে মাত্র একবার ধুলেই যথেষ্ট। মা অবিশ্যি প্রচুর সরষের তেল দেয়। মাঝেমাঝেই সেই তেল ওপর থেকে ডিক্যান্ট করে আমি রেখে দিই পরদিনের ডিমের কারি বা ঘুগনির জন্য। সে ঘুগনি বা এগ কারির  স্বাদ অনবদ্য।

২০ আগ, ২০২০

কি চেয়েছি আর কিপাইনি

 আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। পাইনি। আমি চেয়েছিলাম খোলা চুলে বিয়েবাড়ি যেতে। পারিনি। আমি চেয়েছিলাম বুকের কাছে ফ্রিল ছাড়া ফ্রক পরতে। পরতে দেওয়া হয় নি। এ ছিল টিন-বেলার দুঃখের কিস্‌স্যা । সবে তে বসানো হত টেকশো। মা বলত আমার ভালোর জন্য। বাবা বলত কথা শুনলে লক্ষ্মী মেয়ে বলবে সবাই। 

আমি চেয়েছিলাম জৈব রসায়ন বিজ্ঞানী হতে। আত্মীয়স্বজনের প্ররোচনায় বাড়ির সবচেয়ে "কালো মেয়ের" বিয়ে দিয়ে দিলেন বাবা। বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাঙ্ক করেও আমি বঞ্চিত হয়েছিলাম গবেষণা থেকে। আবারো করের বোঝা। 

বিয়ের পরেও স্বাধীনতা পাইনি। এক রক্ষণশীল পরিবার থেকে আরেক রক্ষণশীল পরিবারে এলাম। ভেবেছিলাম  নদীর ওপারে অনেক সুখ। তেমনি বিশ্বাস ছিল আমার। সেই বিশ্বাসে জল ঢেলে দিল শ্বশুরবাড়ির মাথারা। আগুণকে সাক্ষী করে নেওয়া ব‌উ তার স্বামীর পাশাপাশি বারান্দায় দাঁড়ালে, শোবার ঘরে দরজা আঁটলে নাকি অশালীন। 

তবে আমি যা চাইনি তা সত্যি পেলাম একদিন। তাই হিসেব মিলোতে চাইনা আর। এসব কি চেয়েছি আর কি পাইনির টানাপোড়েনে বিদ্ধ্বস্ত না হয়ে সোজা হাজির হয়েছিলাম সব পেয়েছির দেশে, আমার লেখালেখির জগতে।