১৪ এপ্রি, ২০১৬

বারাণস্যাং অন্নপূর্ণাং



বারাণসী বা কাশী মহাতীর্থে দেবাদিদেব বিশ্বেশ্বর বিরাজ করেন। বিশ্বনাথের মন্দিরের পাশেই অন্নপূর্ণার মন্দির। বারাণসী একান্ন সতীপীঠের অন্যতম কারণ এখানে দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর কুন্ডল পড়েছিল। কথিত আছে বারাণসীর গঙ্গার অন্যতম মণিকুন্ডল ঘাটের নাম এই থেকেই। তাই কাশীর বিশ্বেশ্বর হলেন এখানে মায়ের ভৈরব এবং দেবী অন্নপূর্ণা হলেন তাঁর প্রকৃতি। পীঠ হয়ে ওঠার পেছনে যে স্থান মাহাত্ম্য থাকে অর্থাত উত্তরবাহিনী নদী, সংলগ্ন শ্মশান সবকিছুই বর্তমান এখানে। তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে আছে, 

বারাণস্যাং বিশালাক্ষী দেবতা কালভৈরবঃ 
মণিকর্ণীতি বিখ্যাতা কুন্ডলঞ্চ মম শ্রুতেঃ।।
 যদিও এখানে বলা হয়ৈছে দক্ষযজ্ঞের সময় দেবীর কুন্ডল পড়ার কথা স্কন্দপুরাণের কাশীখন্ডে আছে একদা বিষ্ণু এখানে মহাতপস্যা করেন। তপস্যার পর তিনি তাঁর চক্র দিয়ে একটি পুকুর খনন করেন এবং নিজের স্বেদ দিয়ে তা পূর্ণ করেন। মহেশ্বর তা দেখে খুশি হয়ে মাথা নাড়তে থাকেন ও তাঁর মাথা নাড়ার ফলে কানের কুন্ডল ঐ পুকুরে পতিত হয়। তাই ঐ স্থানের নাম মণিকর্ণিকা। শিবপুরাণে বলা হয় তপস্যার সময় বিষ্ণুর কান থেকে বিবিশ রত্নে ভূষিত কর্ণকুন্ডল পতিত হবার আখ্যান । পীঠনির্ণয় তন্ত্রে দেবীর কর্ণকুন্ডল পতিত হবার জন্য দেবী হলেন মণিকর্ণী বা বিশালাক্ষী আর তাঁর ভৈরব হলেন কালভৈরব।

আদ্যাস্তোত্রে আমরা পাই "বারাণস্যাং অন্নপূর্ণা" । কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গলে পাই এখানে দেবীর বক্ষদেশ পতিত হবার কথা।

রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের ছত্রে ছত্রে দেবী অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য কীর্তণের গল্প পাই। শিব ও পার্বতীর সংসারের ঘোর দারিদ্রের বর্ণনা দিয়ে শুরু এই কাহিনী। মা অন্নপূর্ণা তখনো অন্নপূর্ণা হয়ে ওঠেননি। এহেন দেবী পার্বতী একদিন শিবকে বললেন মনের কথা। দারিদ্র্য তাঁর আর সহ্য হয়না। মাথার চুলে ও সর্বাঙ্গে তেল না পড়ে রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ৈছে তাঁর গাত্র ও কেশরাজি। শিবের জন্য নিত্য সিদ্ধিপাতা বেটে বেটে হাতে পড়েছে কড়া। এক পুত্র গজানন, চারহাতে খায় ও অন্য পুত্র ষড়ানন ময়ূর নিয়ে অহোরাত্র খেলে বেড়ায়। এতজনের সংসারে অন্ন নেই। তাই পার্বতীর হাহুতাশ দেখে মহাদেব ভিক্ষায় বেরুলেন।

আর পার্বতী তাঁর সখী জয়ার কাছে মনের দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলেন..


কি করিব একা ঘরে রয়ে বৃথা

কেন দুঃখ পাই বাপের মন্দিরে যাই

গণপতি কার্তিকেয় লহে।।

যে ঘরে গৃহস্থ হেন সে ঘরে গৃহিণী কেন

নাহি ঘরে সদা খাই খাই

কি করে গৃহিণী পানে ক্ষণক্ষণ ঝন্‌ঝনে

আসে লক্ষ্মী বেড় বান্দে নাই।।

মনস্তাপ করতে করতে দেবী বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন ভাবলেন। জয়া তাঁকে নিরস্ত করে বললেন" দ্যাখো, স্বামী ধনহীন হলে বাপের বাড়িতে মেয়েদের কোনো সম্মান নেই" তার চেয়ে তুমি অন্নপূর্ণা রূপ ধারণ কর। সারা বিশ্বের যত অন্ন আছে তা তোমার সংগ্রহে রাখো। মহাদেব ভিক্ষা করে কোথাও যখন অন্ন পাবেননা তুমিই তাঁকে অন্ন যোগাবে" দেবী অন্নপূর্ণার রূপ ধারণ করলেন। সারা বিশ্বের সমস্ত অন্ন একত্র করে নিজের সংগ্রহে রাখতে শুরু করলেন। এদিকে মহাদেব আর ভিক্ষা পান না। অবশেষে তিনি লক্ষ্মীর কাছে গেলেন অন্নের জন্য। লক্ষ্মী তাঁকে বললেন, " অন্ন তুমি কোথায় পাবে? তোমার ঘরণী সব অন্ন নিজের কাছে রেখেছেন যে! তাই তো বিশ্ব সংসারে অন্ন অপ্রতুল" মহাদেব তখন ঘরে ফিরে দেবীর কাছে ভিক্ষা চাইলেন। পরিতৃপ্তি সহকারে উদরপূর্তি করে বিশ্বকর্মাকে অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য কাশীতে স্বর্ণ দেউল মদির নির্মাণের আদেশ দিলেন। চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতিথিতে দেবীর পূজা চালু হল।





দেবী অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য ও প্রকাশ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গলের পরের পর্বে আরেক লৌকিক কাহিনীর অবতারণা করলেন। দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া দেবীকে বললেন, ধনপতি কুবের নিত্য তোমার পুজো করে। পূজার ফুল সংগ্রহ করেন কুবের অনুচর বসুন্ধর । বসুন্ধরকে শাপগ্রস্ত করো। এবং তবেই বসুন্ধরের মাধ্যমে তোমার পূজার প্রচলন হবে। ধনপতি কুবের পূজার ফুল সংগ্রহ করলেন। কিন্তু দেবীর মায়ায় ফুলের বাগানে তার স্ত্রী বসুন্ধরার সঙ্গে সাক্ষাত হল। বসুন্ধরের স্ত্রী তার স্বামীকে বললে, এই এত ফুলে পুজো করে কি হবে স্বামী? তার চেয়ে আমরা এই ফুল দিয়ে বাসর রচনা করে প্রেমালাপ করি"

এদিকে কুবের ভবনে বসুন্ধরের বিলম্ব দেখে দেবী ক্রুদ্ধ হলেন। এবং বসুন্ধরকে অভিশাপ দিয়ে মর্ত্যে প্রেরণ করলেন। মর্ত্যে বসুন্ধর বাংলাদেশের গঙ্গার তীরে বরগাছি গ্রামে হরি হোড় রূপে জন্ম নিলেন । খুব দুঃখ কষ্টে তার জীবন কাটে। বনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে কাঠ কেটে, ঘুঁটে কুড়িয়ে তার বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য অন্নের জোগাড় করে হরি হোড়। একদিন দেবী অন্নপূর্ণা এক বুড়ির বেশ ধরে তার সামনে উপস্থিত হলেন। হরি হোড় দেখল, সেই বুড়ি তার সংগৃহীত কাঠ-ঘুঁটে সব একত্র করছে।


কোথা হতে আসে বুড়ি, ঘুঁটে পায় ভরে ঝুড়ি সর্বনাশ করিল আমার।

কাড়ি নিলে হবে পাপ, বুড়ি পাছে দেয় শাপ এ দুঃখের নাহি দেখ পার।।

বুড়ি তখন তাকে বললে, বাছ, আমি এত ব‌ইতে পারছিনা, তুমি যদি আমার বোঝাটি বয়ে দাও এর অর্ধেক কাঠ ও ঘুঁটে আমি তোমাকে দান করব"

বৃদ্ধারূপিণী দেবী এত ধীরগতিতে হাঁটতে শুরু করলেন যে হরির বাড়ির কাছে যেতেযেতেই সন্ধ্যে নেমে এল। বুড়ি বলল" এখন তো আর চলতে পারিনে বাবা, তোমার ঘরেই থেকে যাই" হরি বললে" বুড়িমা, আমরা যে হতদরিদ্র, তোমাকে কি খাওয়াব?"

বুড়ি বললে

"বাছা, তোমার মা'কে বল, অন্নপূর্ণার নাম করে ভাতের হাঁড়ি বসাতে"

হরির মা তখন বুড়ির আদেশ মত ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে দেখেন তার মধ্যে নানাবিধ সুখাদ্য রয়েছে। এবার হরি বুঝতে পারলেন বৃদ্ধাবেশী দেবী অন্নপূর্ণার ছলনার কথা। দেবী হরি হোড়কে বরদান করতে উদ্যত হলে হরি বলল, "এই বর দিন, যাতে দেবীর পাদপদ্মে যেন আজীবন ঠাঁই হয়" দেবী তথাস্তু বলে অন্তর্হিত হলেন। এরপর হরির তিনবার বিয়ে হল। ধন সম্পদের অভাব র‌ইলনা। প্রত্যহ তার ঘরে অন্নপূর্ণার পূজা হতে থাকল। কিন্তু এক গৃহে বেশীদিন বাধা পড়ে থাকলে বসুন্ধরের শাপমুক্তি ঘটবে কিভাবে? তাই দেবী আবারো ফন্দী আঁটলেন। এদিকে দেবী হরিকে কথা দিয়েছেন যে তার গৃহ ছেড়ে অন্যত্র যাবেননা। স্বর্গে বসুন্ধরের স্ত্রী বসুন্ধরা ব্যস্ত হলেন তার স্বামীর জন্য। দেবীকে সে কাতর হয়ে প্রার্থনা জানালো। একে পতি বিরহে সে আকুল, অন্যদিকে তিন সতীনের কষ্ট সে আর সহ্য করতে না পেরে দেবীকে বলল" আমাকে রক্ষা করুন, অনেকদিন তো হল আমার স্বামীর মর্ত্যবাস। এদিকে আমি যে আর স‌ইতে পারিনে"

দেবী ভাবলেন বসুন্ধরাকেও যদি মর্ত্যে বদুন্ধর অর্থাত হরি হোড়ের গৃহে পাঠাই তাহলে ওদের ঘরে চরম অশান্তি সৃষ্টি হবে আর সেই অছিলায় তিনি অন্যত্র গমন করবেন।

কিন্তু হরি হোড়ের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে অন্নপূর্ণার ব্রতী হবে কে? তাই নিত্যপূজা চালু রাখার জন্য দেবী গমন করলেন ভবানন্দ মজুমদারের গৃহে। হরি হোড়ের পূজার সময় দেবী তার মেয়ের রূপ ধরে এসে বললেন, " বাবা, আমি তবে যাই?" হরি বললেন, " হ্যাঁ, যাও।" ব্যাস্! সেই অপেক্ষাই করছিলেন দেবী। তিনি ভক্তের সাথে ছলনা করে ভবানন্দের গৃহে পা বাড়ালেন।

হরি হোড়ের বাড়ি থেকে ভবানন্দের বাড়ি যেতে হলে নৌকায় নদী পেরুতে হবে দেবীকে। নদী পার হবার জন্য ঈশ্বরী পাটনীর সাহায্য চাইলেন তিনি। একা মেয়েছেলেকে নৌকা পার হতে দেখে মাঝি ঈশ্বরী তার পরিচয় জানতে চাইলেন। দেবী রহস্যাবৃত করে বলতে লাগলেন সেই বিখ্যাত কবিতা।


গোত্রের প্রধান পিতা মুখ্য বংশজাত।

পরম কুলীন স্বামী বন্দ্যো বংশখ্যাত।।

পিতামহ দিলা মোরে অন্নপূর্ণা নাম।

অনেকের পতি তেই পতি মোর বাম।।

এইভাবে যুগ যুগান্ত ধরে অন্নদামঙ্গলের এই সাধারণ লৌকিক কাহিনীগুলি হরি হোড় থেকে ভবানন্দ মজুমদার, বাংলার একগ্রাম থেকে অন্য গ্রাম দেবী অন্নপূর্ণার দেবী মাহাত্ম্য প্রচার করে আসছে ।

1 টি মন্তব্য:

Jaya Kundu বলেছেন...

বেশ ভাল লাগল। বাব্বা জয়ার এত বুদ্ধি!!! হাহাহহা
একটা কথা শেষে ঐ মেয়েছেলে শব্দটা কি ভাববে? জাস্ট সাজেশান দিচ্ছি, বিচার তোমার।