জগন্নাথ বসুর "বেতারের কথকতা এবং" বইটি পড়ে যারপরনাই ঋদ্ধ হলাম । বর্তমানের বাচিক শিল্পী জগন্নাথ বসুর অতীতের কর্মজগত এবং তাঁর অভিজ্ঞতা, সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক আর সর্বোপরি আকাশবাণী ও দূরদর্শনের অনেক না জানা কথা উঠে এসেছে তাঁর লেখায় । বইটি উতসর্গ করেছেন তাঁর সহধর্মিণী শ্রীমতী ঊর্মিমালা বসুকে আর সেখানেও সেই মঞ্চে শ্রুতিনাটকের খুনসুটি অনুভূত হয় " না দেখলে রইতে নারি , দেখলে কাটাকাটি এহেন....." গৌরচন্দ্রিকায় লেখনীর সাবলীলতা মুগ্ধ করে । তারপর সাদাকালোয়, লেখকের সংগ্রহের দুষ্প্রাপ্য সব পুরোণোদিনের ছবিগুলি নিজের সংগ্রহে থেকে গেল এই ভেবে মনে হয় বইটির মূল্য মাত্র ১৫০টাকা কেন? তারপর শুরু হয় বেত্তান্ত । আকাশবাণী কেমন করে আকাশবাণী হয়ে উঠেছিল এবং বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজ কুমার মল্লিক এবং বাণীকুমারের মহিষাসুরমর্দিণি এই প্রোডাকশানটি কেমন ভাবে তৈরী হয়েছিল তা জানার সুপ্ত ইচ্ছে আমাকে এতদিনে তৃপ্তি দিল । কারণ আমি নিজেও এই প্রোডাকশানটির অন্ধ ভক্ত ।এই তিনজন প্রবাদপ্রতিম মানুষের জন্য তিনি উজাড় করে দিয়েছেন তাঁর শ্রদ্ধার ঝুলি আর এনারা যে কতবড় মানুষ হয়েও ভর্তি করতে পারেন নি তাঁদের প্রাপ্ত মর্যাদা বারবার তাঁর লেখার মাধ্যমে উঠে আসে ।জানতে পারি পঙ্কজ মল্লিকের বেতারজগত থেকে অপসারণের কাহিনী আর স্বনামধন্য রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের সেই শূন্যস্থানে স্থলাভিষেক । মহানায়ক উত্তমকুমারের মহালয়া তৈরী এবং সেখানে আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মহিষাসুরমর্দিণির জয়লাভ উঠে এসেছে । বীরেন্দ্রকৃষ্ণের উত্তমকুমারের প্রতি স্নেহ বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ না করে রোমান্টিক নায়কের সংলাপে অজানা কথা "হাফনোটের" ব্যঞ্জনা আমাকে ভাবিয়ে তুলল ।
বেতার-নাটকের নেপথ্যের কুশীলবেরা কেমন করে তৈরী হয়েছিলেন এবং প্রতিনিয়ত তাদের সাথে ওঠাবসার সাথে নিজের স্মৃতির পাতা থেকে অজানা সব তথ্যের অবতারণা পাঠকমনকে আনন্দ দেয় । একজায়গায় উনি লিখেছেন " শ্রুতি এদেশের আদিমতম শিল্প" অর্থাত বেদপাঠ । আর সেই শ্রুতিশিল্পকে ভালবেসে সেই চারাগাছটিকে এতদিন ধরে লালন করে চলেছেন তাঁরা দুজনে তা তো আমরা দেখতে পাই বাচিক শিল্পী জগন্নাথ-ঊর্মিমালার শ্রুতিনাটকে । উঠে এসেছে সত্যজিত রায়ের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে সঙ্গে তাঁর নাটকের প্রোডাকশান নিয়ে ওঠাবসা ও কতকিছু গবেষণার গল্প । মঞ্চ বা বেতারে সহশিল্পীদের অগ্রণী ভূমিকার কথা জানতে পারি আমরা "শব্দের দোকানি" অংশে। এই মানুষগুলিকে নিয়ে কেউ কখনো কিছু লিখেছেন বলে আমি তো জানিনা । আর আছে নেপথ্যের প্রম্পটারদের কথা যারা না হলে নাটক মঞ্চস্থ হয় না অথচ তারা থেকে যান অধরা হয়ে । " দর্শক্ঃ দেবাঃ ন জানন্তি" পড়ে হাসতে হাসতে পেট ফেটে যায় । কারণ আমিও আম দর্শকের আসনে বসি । মঞ্চে গান করে থাকলেও নাটক? নৈব নৈব চ ! জগন্নাথদার দর্শকের শ্রেণীবিভাগ এবং সিটে বসে তাদের আচরণ পড়ে মনে হল তিনি স্টেজে বসে সব কিছু লক্ষ্য করেন এবং অমন মনোজ্ঞ শ্রুতিনাটকও করেন ! "অন্যদেশে, বিদেশে" বিভাগটি পড়ে মনটা ভারি হয়ে যায় । সরকারী ব্যুরোক্রেসির যাঁতাকলে তাঁদের মত মানুষেরাও যে আজীবন পিষ্ট হয়েছেন ভাবলে খারাপ লাগে । বেতার থেকে দূরদর্শনে এসে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা আর নিজের সাথে প্রতিনিয়ত সংঘাতের কাহিনী পাঠকের আসনে বসে পড়ে চলেছি আমরা কিন্তু তিনি স্বয়ং কেমন করে সেই দুস্তর পথ অতিক্রম করেছেন তা বোঝা যায় । সম্পূর্ণ বইটিতে তাঁর আনন্দের মূহুর্ত হয়ত আছে পর্দার নেপথ্যে কিন্তু কর্মক্ষেত্রে খ্যাতনামা মানুষদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েন আছে প্রকটভাবে । সবশেষে একটাই কথা বলতে ইচ্ছে হয় , জগন্নাথ বসু কিন্তু অনেকের সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছেন কিন্তু কোনো বিবাদের সুরে নয় , অপমানের ভাষায় নয় ঘৃণার শব্দে নয় । তাঁর লেখার মধ্যে রয়েছে সুপ্ত অভিযোগ, প্রচ্ছন্ন অভিমান আর আমলাতন্ত্রের ওপর বিতৃষ্ণা ।
যাইহোক গদ্যকার জগন্নাথ বসুকে শুভেচ্ছা এমন একটি বই লেখার জন্য ।আমরা ছোটবেলায় রেডিওতে বাবা মায়েদের নাটক শুনতে দেখেছি কিন্তু আমরা তো টেলিভিশনের যুগের টিনএজারদের দলে ছিলাম । তাই নাটক্, বেতার এবং দূরদর্শন কি এবং কেন সে সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম । ধন্যবাদ আমার বন্ধু মৌসুমী গুপ্তকে যে আমাকে এই বইটির কথা বলেছিল আর একটি টিভি চ্যানেলের লাইভ টকশোতে জগন্নাথদাকে কথা দিয়েছিলাম বইটি পড়ে কেমন লাগে তা অবশ্যই জানাব, তাই এই রিভিউ লেখা । আর এর পরের ভাগ আছে " বেতারের গ্রীণরুম" এ। সেটির অপেক্ষায় আছি । ভাগ্যি নেট ছিল এই খড়গপুরে তাই তো বাড়ি বসে বসে ফ্লিপকার্টে অর্ডার দিয়ে দু দিনে বই এসে গেল হাতে । আবার সাথে কমিশান আর ফ্রি হোম ডেলিভারি । পরের বইটি আউট অফ মার্কেট.. এত বিক্রি হয়েছে বলে । ক'দিন বাদে হাতে পাব বলেছে তারা ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন