১৫ মে, ২০১১

নতুন যুগের ভোরে

ভোটের উত্তেজনার পারদ তখন তুঙ্গে; ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ , ২০১১ সালের মে মাসের গ্রীষ্মও তখন চরমে । পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনের সুনামির পূর্বাভাস পাওয়া গেছে । ভোটপূজো শেষ। শুরু কাউন্টডাউন । আগের দিন কোলাহলমুখর কোলকাতা ছেড়ে রবীন্দ্র সরোবরে সূর্যাস্ত হব হব করছে । দু একটা পাখি নিজের মনে গান গেয়ে কুলায় ফিরছে । লেকের আকাশে লাল ফাগের শেষরেশটুকুনি ধীরে ধীরে নিয়ে চলে গেল সেদিনের সূয্যিটা । শুধু কৃষ্ণচূড়ার কুচোকুচো কমলার ফুলঝুরি আর হলদে বাঁদরলাটির ঝুলনমেলা তখন আকাশে আর লেকের জমা জলের গা ঘেঁষে সবুজ সবুজ কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে দু একটা বেগনিরঙের ফুল যেন অনেক অনেক কাজের ফাঁকে একটু অবকাশ । লেকের ওপারে লম্বালম্বা সাউথসিটির দিক থেকে কুচোকুচো মিছরির মত সাদা আলোর চিকচিকে আভিজাত্য আর লেকের জলে রোয়িংক্লাবের গতিশীল দুএকটা স্কাল । এই ছিল সেই বিকেলে । আমরা হেঁটে চলেছিলাম লেকের জলের ধার দিয়ে , একটু ঠান্ডা হাওয়া মেখে সেই ঘামেভেজা বোশেখের গ্রীষ্মে । লেকের জলে বহুদিনের জমে থাকা শ্যাওলায় জলের বহমানতা কিছুটা হলেও রূদ্ধ ছিল সে বিকেলে । বাঁধানো সিমেন্টের চেয়ারে কত ভালোবাসা-বাসি চলছে তখন.. কলেজ ফিরতি পথে ঊনিশ-কুড়ির বানভাসি সন্ধ্যে নিয়ে, অফিস ফেরত মোনোটোনাস বান্ধবীর প্রতিশ্রুতি রাখায় ।
কেউ খুলে দিয়েছে ল্যাপটপ খোলা আকাশের নীচে । তার গানভাসি সাঁঝ তখন । আইপড কানে দিয়ে একমনে হেঁটে চরকিপাক খাচ্ছে কেউ । বেঞ্চেবসা ছেলেমেয়েগুলির জোড়ায় জোড়ায় একমন একপ্রাণ । গরমে নেই প্রেমের হেলদোল । পরিবর্তনের দোলাচলে প্রেমের বিরাম নেই । নেই সান্ধ্য অভিসারের বিরতি । অন্ধকার যত ঘন হয় প্রেম হয় ঘনিষ্ঠ ।
টিন-প্রেমের পরবে আহুতিপর্ব চলছে । ভালোবাসা ভাসছে লেকের জলে, ভালোবাসা উড়ছে লেকের হাওয়ায় । লেকের মধ্যিখানের একফালি আইল্যান্ডটিকে সেই মূহুর্ত্তে মনে হল সবুজদ্বীপের রাজার রাজধানী । আমি দাঁড়িয়ে আছি সেই সবুজদ্বীপে । সব অন্ধকারের ঘোর কেটে যাচ্ছিল। অন্ধকারের পরতগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে আলো ঠিকরে আসছিল সেই দ্বীপের মধ্যে থেকে । দ্বীপের নাম টিয়ারং ... একটা ছবি হয়েছিল । মনে হচ্ছিল সেই সবুজদ্বীপকে এই নামটি দিলে বেশ হয় । একঝাঁক সবুজ টিয়া উড়ে ঐ আইল্যান্ডের ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে পড়ল ।আমার মনে হল জেগে উঠলাম রবীন্দ্রসরোবরের উপকূলে ।
নতুন বছরে আমাদের মেঘ সোনারতরীতে উঠেছিল " বাতিঘর এক সবুজ" নিয়ে । আমার হাঁটতে হাঁটতে কেবল মনে হতে লাগল ফেসবুকের সেই সবুজ ফুটকির কথা চুঁইয়ে পড়ছে সবুজ আলো সেই ছোট্ট ফুটকি দিয়ে । একে একে হাতবাড়িয়ে সক্কলের বাতিঘর তখন সবুজ আলোর ফোঁটায় দৃশ্যমান হল । মেঘের সাথে রোদ্দুর, বৃষ্টি অভ্র, আবীর, শুভ্র , শুভ সকলেই তখন মাত করছে ফেসবুকের আড্ডাঘর । আমিও সেই জনস্রোতে সামিল হয়েছিলাম । আড্ডাঘরে তখন সবুজ গন্ধ, নতুন গন্ধ । আমার একবার মনে পড়ে গেল পাঞ্জাবের সবুজ বিপ্লবের কথা । ভয় হ'ল একবার । পরেই মনটা বলে উঠল " হৈ হৈ বিপ্লব ? হোক !বাংলার সবুজ, বাংলার পথঘাট ভরুক সবুজ আনন্দের জোয়ারে । হুজুগে নয় । রবিঠাকুরকে মনে পড়ে গেল " আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব " ভোলাব স্বচ্ছতার আবীরে, সবুজে নয় । সন্ত্রাসের শিবিরে নয়, শান্তির আবহে । সুনামি হয়ে শিল্প আসুক! আয়লার ঝোড়ো হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে চলে যাক বন্ধ্যা, নঞর্থক রাজ্যনীতিকে। বাংলা তুমি আবার এসো গো ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায় ।
রবীন্দ্র সরোবরের লাগোয়া নজরুল মঞ্চে তখন কোনো এক বিদ্যামন্দিরের ছেলেমেয়েরা রবিপ্রণাম জানাচ্ছে " বাজে বাজে রম্য বীণা বাজে..." পরদিন অর্থাত ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থের প্রভাতফেরীর রিহার্সাল মনে হল !!!

কোন মন্তব্য নেই: