১৩ জুল, ২০০৮

More ভাবনারে ..... প্রথম পর্ব

প্রথমে ছিল বেহুলার ভেলা, চাঁদ-সদাগরের সপ্তডিঙা, তারপরে দেবী-চৌধুরাণীর বজরা,পর্তুগীজ জলদস্যুদের ছিপ নৌকা, তার আরো পরে ক্লাইভের জাহজ । এ হল জলযানের ফিরিস্তি। তার সাথে ছিল কুলীনদের পালকি করে বৌ আনা , গ্রামের লোকের গো-যান ,জমিদারের অশ্বযান, সাহেব-বিবিদের ফিটন গাড়ি , ঘোড়ায় টানা ট্রাম ,হেনরি ফোর্ডের মডেল-টি , ক্রমে ইলেকট্রিক ট্রাম ,দেহাতিদের টানা রিকশো , বাস, মিনিবাস, মেট্রোরেল, দম আটকানো অটোরিক্সা ... তারপরে পাঁই পাঁই করে কেবল ফিয়াট আর আরাম করে এমবাস্যাডার চলত ... আর এখন? ম্যারাথনে মারুতির সাথে মার্সিডিজ , হৈ হৈ করে হুন্ডাই ,হা হা করে হন্ডা , শোঁ শোঁ করে শেভ্-রোলে আর ফুড়ুত্ করে ফোর্ড , টগ্-বগ্ করে টয়োটা ধূলামাটির শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এভাবে হল স্থলযানের বিবর্তন ।

কত ছোটাছুটি হ'ল ,পায়ে হেঁটে পাণিহাটি থেকে সুতানটি, পালকি চেপে ব্যারাকপুর থেকে গোবিন্দপুর, বজরায় চাঁদপালঘাট থেকে কুটিঘাট , বাসে করে খড়দা থেকে শিয়ালদা, ট্রামে চেপে শ্যামবাজার থেকে বড়বাজার, ট্রেনে করে খড়গপুর থেকে বারুইপুর ,আবার খানিক হেঁটে তালতলা থেকে তারাতলা ...ঠিক এমন করেই পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে কলিকাতার মানুষজন নিয়ে বেঁচে বরতে আজও কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই। "কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে " এ যুক্তির যথার্থতা কলিকাতার সব বাঙলী না বুঝলেও অন্য প্রদেশের বাঙালী,অ-বাঙালী সকলেই বোঝে। ১৬৯০ সালে জোব্-চার্নক কলিকাতা মহানগরীর গোড়াপত্তন করেছিলেন । তখন শিয়ালদহে সত্যি সত্যি শৃগাল প্রতি সন্ধ্যায় সুর-সাধনা করতো, বাগবাজারে বাঘ বেরোতো, হাতীবাগানে হাতী না থাক, হায়ানা হা হা করে হাসতো, আর গোবিন্দপুরের জঙ্গলে নাগরাজ বাসুকির আধিপত্য ছিল। ৩১৮ বছর পূর্বে জোব চার্নক অনুধাবন করেছিলেন এ শহরের মাহাত্ম্য। এ শহরের মৃত্তিকার কনায় কনায় কণক-দানা ,যার প্রমাণস্বরূপ এখানে প্রোমোটার-কাম-ডেভালপার রাজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মহাপুরুষের বাণী কি বিফলে যাবে? শ্রীরামকৃষ্ণ সেই কবে বলেছিলেন "টাকা মাটি, মাটি টাকা"| আহা! ঠাকুর দেখে যেতে পারলেন না।

জোবচার্নক আড়িয়াদহ গঙ্গার ঘাটে পরিক্রমাকালে এক হিন্দুরমণীর প্রেমে পড়েন ও তাকে বিবাহ করেন। সেই মহিলা যদি জানতেন যে উত্তর কলিকাতার বিবেকানন্দ সেতুর পার্শ্বে নিবেদিতা সেতুর কি অপূর্ব মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে ,তা হ'লে সাহেব-সুবোর নিকট তার পিতৃগৃহের কদর আরো বৃদ্ধি পেত। কি কলা-কুশলী! কি দৃষ্টিনন্দন কারিগরী। কলিকাতা এই মূহুর্তে সেতু-নগরী । আগে ছিল হাওড়া ব্রীজ,ভারতবর্ষের প্রথম ফ্লাই-ওভার ব্র্যাবোর্ণ রোড ফ্লাই ওভার , শিয়ালদা'র উড়াল-পুল। পরে হেমন্তসেতু, বিজন সেতু, অরবিন্দ সেতু, আরো পরে শম্বুক-গতিতে তৈরী হল বিদ্যাসাগর সেতু । তার পরে আর চেয়ে দেখতে হয়নি। প্রয়োজনীয়,অপ্রয়োজনীয় সেতুতে সেতুতে ছয়লাপ। বেচারা রামচন্দ্র! কি কষ্ট করে সেতুবেঁধেছিলেন! তিনি বেঁচে থাকলে অবশ্যই রামেশ্বর স্টাইলের আরো দু চারটে সেতু গঙ্গাবক্ষে এত দিনে নির্মাণ হয়ে যেত। তফাত কেবল একটাই। বানরসেনার সেতুবন্ধে কোনো ক্যাপিটাল cost ছিলনা।

যোগাযোগ ব্যাবস্থায় কলিকাতার জন্মলগ্নেই বৃহস্পতি তুঙ্গে। ভৌগালিক সীমারেখা আদি অনন্তকাল থেকেই একে বর্গি,জলদস্যুর হাত থেকে যেমন রেহাই দেয়নি ,ঠিক তেমনি ইউরোপিয় বণিকদের আশ্রয় দিয়ে তাদের ব্যাবসা বাণিজ্যের পথ ও সুগম করে দিয়েছিল। সেই জন্যই সাহেব-সুবো বুঝতে পেরেছিল তাদের এই প্রাণের জায়গাটি অর্থাত 'ক্যালকাটা' সারা ভারতবর্ষের রাজধানী হবার যোগ্য। এর অন্যতম ও প্রধান কারণ হোল এ নগরীর যোগাযোগ ব্যাবস্থা |আর সহজলভ্য শ্রমিক,যারা অন্যের হাতে মার খেয়ে কাজ করতে প্রস্তুত,আর তার সাথে বিদেশি বণিকের মোসায়েবি করতে পিছপা নয় এরূপ উত্কোচলোভী বাঙালি-বাবু |

(ক্রমশঃ)

২টি মন্তব্য:

নামহীন বলেছেন...

ভাল লাগল

Unknown বলেছেন...

Excellent one. Nice font size this time. keep it up sis.